আঙিনা

স্বাধীনতা কি ? একটি গভীর পর্যবেক্ষণ

– শ্রী সম্বুদ্ধ সেনগুপ্ত

 

আমাদের জীবনযাত্রাতে কয়েকটি শব্দের আমরা বিকৃত মানে করে থাকি। তার মধ্যে একটি শব্দ হলো স্বাধীনতা। স্বাধীনতা মানেই হলো আমাদের কাছে- যা খুশি করার লাইসেন্স, মনে যা আসছে স্থান কাল পাত্র না বুঝে তা বলে দেওয়া, ইত্যাদি। বর্তমানে কিছু ব্যক্তি আছেন। না জানি কি তাদের শিক্ষাদীক্ষা ও কি করে তারা রোজকার করেন! এই অদ্ভুত প্রজাতিকে বলা হয় বুদ্ধিজীবী! স্বাধীনতা শব্দের বদহজমের মধ্যে এরাই দায়ী।

যেহেতু আমার বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলা উচিত তাই ব্যাপারটা জীবনবিজ্ঞান দিয়েই দেখা দরকার। জীবনবিজ্ঞান অনুযায়ী যে কোনো তত্ত্বের মানুষের ওপর প্রয়োগ করতে গেলে প্রথমে সেটা অন্য কোনো প্রাণীর মডেলে পরীক্ষা করতে হয়। আচ্ছা মানুষ বাদ দিয়ে জীবজগতের কি যথেচ্ছাচার করার অধিকার আছে ? এর উত্তর নিয়ে বিশদে আলোচনা করা দরকার।

ধরা যাক একটি জঙ্গল আছে। জঙ্গলে গাছ, ঘাস ও অন্যান্য উদ্ভিদ হলো producer বা খাদ্য উৎপাদক। কারণ তারা সূর্যের আলোকে রাসায়নিক শক্তিতে পরিণত করে। গাছ ছাড়া তাই জীবজগৎ একেবারেই অবিচল। এরপর আসে শাকাহারী জীব বা herbivore।যেমন হরিণ, গরু, খরগোশ, মোষ, ইত্যাদি। এদেরকে primary consumer বলা হয়। মূলত গাছের ফল ও পাতাই এদের খাদ্য। এরপর আসে secondary consumer । উদাহরণ: বাঘ, সিংহ, নেকড়ে, ইত্যাদি। এদের খাদ্য হল primary consumerরা। এই পুরো ব্যবস্থাটিকে বলে food chain । বাঘ বা সিংহ খুব হিংস্র প্রাণী। আপনি যদি অহিংসাবাদী হন তাহলে আপনি কি বলবেন? এই বাঘ বা সিংহকে প্রকৃতি থেকে সরিয়ে দেয়া হোক। আপনার মনে হতেই পারে যে এতে তো প্রাণীরা নিরাপদ থাকবে। কিন্তু না ! বরঞ্চ ভয়ঙ্কর বিপদ নেমে আসবে যা কাটিয়ে উঠতে হয়তো কয়েক শতাব্দী লেগে যাবে। আচ্ছা বাঘকে তর্কের খাতিরে নাহয় সরিয়ে দিলাম। যা হবে তা হল primary consumerদের বা শাকাহারীদের সংখ্যা ভয়ানকভাবে বাড়তে থাকবে। ফলে তাদের মধ্যে ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতা আরম্ভ হবে। খুব বেশি শাকাহারীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় গাছপালার ও অন্যান্য উদ্ভিদের সংখ্যায় কমতি দেখা দেবে বেশি সংখ্যক শাকাহারীদের ভোজন কুলাতে না পেরে। কয়েক প্রজন্ম পরে শাকাহারীদের সংখ্যা কমতে শুরু করবে উদ্ভিদের পরিমাণ কমে যাবে খাদ্যের পরিমাণের অভাবের কারণে। এর পরিণতি হল গাছপালার ও শাকাহারী: দুজনের সংখ্যা হ্রাস পাওয়া। আর গাছপালা কমে গেলে সেই জায়গা মরুভূমি পরিণত হতে কতক্ষণ ?
এবার প্রশ্ন আসতেই পারে গাছপালা বাড়লে ক্ষতি কি ? তারা তো যত বেশি সংখ্যায় থাকবে তত বেশি মঙ্গল। একেবারেই না। গাছপালা প্রয়োজনের অতিরিক্ত হলে পরিপোষক পদার্থকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতা দেখা দেবে। একসময় পরিপোষকের অভাব হবে। ফলে গাছেরাও মরতে আরম্ভ করবে। আর উদ্ভিদ মরতে আরম্ভ করলে শাকাহারী বা মাংসাহারীরা কেউই বাঁচবে না।

এখানে মাত্র একটি food chain এর উদাহরণ দেয়া হল।

এইরকম প্রচুর food chain মিলিয়ে তৈরী হয় food web। এই food webই প্রকৃতিতে দেখা যায়। উপরের ছবি হল food web এর। ছবিতে tadpole অর্থাৎ ব্যাঙের ছানাকে খাদ্য হিসেবে তিন রকমের মাছ, বক ও মানুষ গ্রহণ করে। যদি এই tadpoleএর সংখ্যাই বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেওয়া হয় নির্দিষ্ট সংখ্যার থেকে তাহলে পুরো ভারসাম্যই নষ্ট হয়ে যাবে।

তাই প্রকৃতিতে মোটেও যথেচ্ছাচার নেই। যারা একথা বলে তাদের চেয়ে বড় ভন্ড আর কেউ নেই। মানুষও সেই প্রকৃতির অঙ্গ। আর মানুষের যথেচ্ছাচারের ফলে প্রকৃতির কি ভয়ঙ্কর অবস্থা হয়েছে তা নিয়ে লিখে প্রবন্ধকে লম্বা করার আমার কোনো ইচ্ছাও নেই।

স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ হল নিজের কর্তব্য পালন। যা আমাদের হিন্দুশাস্ত্রে বারবার বলা আছে। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা তো এই নিয়েই রচিত হয়েছে। আরেকটি প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে আসে।এর চেয়ে কি বিদেশির অধীনে পরাধীনতা ভালো ? যখন এটাই দেখা যাচ্ছে যে প্রকৃতিতে তথাকথিত স্বাধীনতার অভাব। একেবারেই না। বিদেশির গোলাম হওয়া মানে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ তাদের হাতে তুলে দেয়া। ফলে দেশের বনজঙ্গল সাফ ও প্রাণীদের বিপুল ক্ষতি। মানুষ হবে গোলাম। ব্রাহ্মণের কাজ হবে শাস্ত্রচর্চা ও অধ্যয়ন ছেড়ে বিদেশির প্রশস্তি গাওয়া সাহিত্য রচনা করা। ক্ষত্রিয়ের কাজ হবে বিদেশির ভাড়াটে সৈনিক হওয়া। বৈশ্যের কাজ হবে ব্যবসা ছেড়ে বিদেশির দালালি করা। আর শূদ্রের কাজ হবে বিদেশির পদলেহন ও শেষে তার চাবুক খাওয়া যৎসামান্য মাইনের কেরানি হওয়া। আগে সে ঘরবাড়ি বানাত। মন্দিরে সুন্দর কারুকার্য করত। বিদেশির কাছে তার দাম নেই যে। হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা সমাজের ভারসাম্য নিমেষে নষ্ট হল।

তাই তথাকথিত ‘’বুদ্ধিজীবীদের স্বাধীনতা’’ ছেড়ে স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থে ফিরে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে মানুষের কাছে কর্তব্য আগে ও অধিকার পরে। কর্তব্যের মধ্যেই লুকিয়ে আছে স্বাধীনতা। কর্মই সাধনা, কর্মই মুক্তি।

 

(লেখক পরিচিতি – সদ্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জৈব-রসায়নে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রাপ্ত)

Comment here