বিশ্বেশ্বর তখন লাল কাপড় পরিয়া, জামা গায়ে দিয়া, টিপ পরিয়া, চুল আঁচড়াইয়া দাদুর কোলে চড়িয়া কথা শুনিতে গেল। কথকঠাকুর রাজা ভরতের উপাখ্যান কহিতেছিলেন। করুণকণ্ঠে গাহিতেছিলেন, কেমন করিয়া সেই বনবাসী মহাপুরুষের ক্রোড়ের নিকট হরিণ-শিশু ভাসিয়া আসিয়াছিল, কেমন করিয়া সেই সদ্যঃপ্রসূত মৃগ-শাবক কাতরনয়নে আশ্রয় ভিক্ষা চাহিয়াছিল। আহা, রাজা ভরত নিরাশ্রয়কে আশ্রয় দিয়াছিলেন। এই সময় বিশু একটু সরিয়া বসিয়াছিল, কৈলাসচন্দ্র তাহাকে কোলের উপর টানিয়া লইলেন।
তাহার পর কথক গাহিলেন, সেই মৃগ-শিশু কেমন করিয়া পলে পলে, দণ্ডে দণ্ডে, দিনে দিনে তাঁহার ছিন্ন স্নেহডোর আবার গাঁথিয়া তুলিতে লাগিল, কেমন করিয়া সেই শতভগ্ন মায়াশৃঙ্খল তাঁহার চতুষ্পার্শ্বে জড়াইয়া দিতে লাগিল, কেমন করিয়া সেই মৃগ-শিশু নিত্যকর্ম পূজাপাঠ, এমন কি, ঈশ্বর-চিন্তার মাঝে আসিয়াও অংশ লইয়া যাইত। ধ্যান করিবার সময়ে মনশ্চক্ষে দেখিতে পাইতেন, সেই নিরাশ্রয় পশু-শাবকের সজলকরুণ-দৃষ্টি তাঁহার পানে চাহিয়া আছে; তাহার পর সে বড় হইতে লাগিল। ক্রমে কুটীর ছাড়িয়া প্রাঙ্গণে, প্রাঙ্গণ ছাড়িয়া পুষ্পকাননে, তাহার পর অরণ্যে, ক্রমে সুদূর অরণ্যপথে স্বেচ্ছামত বিচরণ করিয়া বেড়াইত। ফিরিয়া আসিবার নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হইলে রাজা ভরত উৎকণ্ঠিত হইতেন। সঘনে ডাকিতেন, আয়, আয়, আয়! তাহার পর কবি নিজে কাঁদিলেন, সকলকে কাঁদাইয়া উচ্ছ্বসিতকণ্ঠে গাহিলেন, কেমন করিয়া একদিন সে আজন্ম মায়াবন্ধন নিমেষে ছিন্ন করিয়া গেল,—বনের পশু বনে চলিয়া গেল, মানুষের ব্যথা বুঝিল না। বৃদ্ধ ভরত উচ্চৈঃস্বরে ডাকিলেন, আয়, আয়, আয়! কেহ আসিল না, কেহ সে আকুল আহ্বানের উত্তর দিল না। তখন সমস্ত অরণ্য অন্বেষণ করিলেন, প্রতি কন্দরে কন্দরে, প্রতি বৃক্ষতলে, প্রতি লতাবিতানে কাঁদিয়া ডাকিলেন, আয়, আয়, আয়! কেহ আসিল না। প্রথমে তাঁহার আহার-নিদ্রা বন্ধ হইল, পূজাপাঠ উঠিয়া গেল—তাঁহার ধ্যান, চিন্তা—সব সেই নিরুদ্দেশ স্নেহাস্পদের পিছে পিছে অনুদ্দেশ বনপথে ছুটিয়া ফিরিতে লাগিল।
কবি গাহিলেন, মৃত্যুর কালোছায়া ভূলুণ্ঠিত ভরতের অঙ্গ অধিকার করিয়াছে, কণ্ঠ রূদ্ধ হইয়াছে, তথাপি তৃষিত ওষ্ঠ ধীরে ধীরে কাঁপিয়া উঠিতেছে। যেন এখনও ডাকিতেছেন, ফিরে আয়, ফিরে আয়, ফিরে আয়!
কৈলাসচন্দ্র বিশ্বেশ্বরকে সবলে বক্ষে চাপিয়া হাহা-রবে কাঁদিয়া উঠিলেন। অন্তরের অন্তর কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিল, আয়, আয়, আয়!
সভায় কেহই বৃদ্ধের এ ক্রন্দন অস্বাভাবিক মনে করিল না। কারণ, বয়সের সহিত সকলেরই কেহ না কেহ হারাইয়া গিয়াছে। সকলেরই হৃদয় কাঁদিয়া ডাকিতেছে—ফিরে আয়, ফিরে আয়, ফিরে আয়!
কৈলাসচন্দ্র চক্ষু মুছিয়া বিশ্বেশ্বরকে ক্রোড়ে তুলিয়া বলিলেন, চল দাদা, বাড়ি যাই—রাত্তির হয়েচে।
বিশু কোলে উঠিয়া বাড়ি চলিল। অনেকক্ষণ একস্থানে বসিয়া থাকিয়া ঘুম পাইয়াছিল, পথিমধ্যে ঘুমাইয়া পড়িল।
বাড়ি গিয়া কৈলাসচন্দ্র সরয়ূর নিকট তাহাকে নামাইয়া দিয়া বলিলেন, নে মা, তোর জিনিস তোর কাছে থাক।
সরযূ দেখিল, বুড়োর চক্ষু-দুটি আজ বড় ভারী হইয়াছে।
[চন্দ্রনাথ – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ]
* * * * * * * * * * * * * *
আকাশ পৃথিবী শোনে,শোনে বনলতা
নরলোকে শোনে রাজা ভরতের কথা
একদিন নিশাকাল অবসান হলে
মৃগশিশু এল এক ভরতের কোলে
সকরুণ আঁখি মেলি মাঙিল আশ্রয়
রাজা ভাবে পথ ভুলে এল সুনিশ্চয়
কোথা হতে এল এই স্রোতে ভাসা ফুল
অসহায় মৃগ যেন মায়ার পুতুল
অবোধ অবলা প্রাণী কোমল কাতর
করুণায় ভরে গেল রজত অন্তর
[বনবাসী রাজা বনের পশুকে আশ্রয় দিলেন আপন কুটীরে]
হরিণ শিশুরে রাজা করেন পালন
কোথা গেল পুজাপাঠ ভজন সাধন
কুটীর ছাড়িয়ে যদি চ’লে যায় ব’নে
হরিণ শিশুর মুখ ভেসে ওঠে ম’নে
জপতপ ফেলি রাজা ডাকে আয় আয়
রাজারে বাঁধিল একি নতুন মায়ায়
বিচার করে না স্নেহ কে আপন পর
খেলাঘর ভেঙে রাজা বাঁধে খেলাঘর
[একদিন বনের পশু চলে গেল বনে; দিন গেল,সন্ধ্যা হল,আর ফিরল না।তখন…]
আকাশ কাঁদে বাতাস কাঁদে কাঁদে বনের লতা
বনের পশু বুঝল না হায় রাজার মনের ব্যাথা
ব’নে ব’নে গিরিগুহায় ডেকে ডেকে হায়
ভরত রাজার দুই নয়ানে সাগর ব’য়ে যায়
বরুণ ছায়া নেমেছে আজ রাজার দেহ ঘিরে
অবুঝ মায়া তবুও কাঁদে আয় রে বুকে ফিরে
শূন্য বুকের সেই সে কাঁদন আজও শোনা যায়
তোমার আমার বুকের মাঝে আয় রে ফিরে আয়
আয় রে ফিরে আয়..
[গান রচনা-প্রণব রায়,সুর -রবীন চট্টোপাধ্যায় কণ্ঠ-হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ছবি ‘চন্দ্রনাথ’, পরিচালনা -কার্ত্তিক চট্টোপাধ্যায় -১৯৫৭]
* * * *
উপরোক্ত প্রথম অংশটি শরৎচন্দ্রের ‘চন্দ্রনাথ’ উপন্যাস থেকে গৃহীত এবং দ্বিতীয় অংশটি কার্ত্তিক চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘চন্দ্রনাথ’ ছবিতে ব্যাবহৃত একটি গান
দুটো টেক্সটকে পাশাপাশি রেখে কয়েকটা বিষয় একটু খেয়াল করতে চেষ্টা করি বরং।
উপন্যাস খণ্ডাংশে স্পষ্টতই বলা হয়েছে যে কথক ঠাকুরের গান হচ্ছে,এবং অনেক শ্রোতার আগমনে সেটি সভার ( উল্লিখিত অংশের ৫ম প্যারা) আকার ধারণ করেছে।
গানের দ্বিতীয় লাইনেই ‘নরলোকে শোনে’ শব্দদুটির ব্যাবহারে সেই পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা হয়ে গেছে।
এর পরের অংশে,মৃগশিশুর অসহায়তা ও ভরতের সঙ্গে তার সম্বন্ধ যে ডিটেলিং এ লিপিবদ্ধ করেছেন শরৎবাবু,স্বল্প পরিসরে ‘স্রোতে ভাসা ফুল’ বা পরের লাইনে ‘মায়ার পুতুল’ শব্দবন্ধের দ্বারা শরৎচন্দ্রের সেই বিস্তৃত মায়ালিখনকেই গানে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন গীতিকার এক আশ্চর্য্য ইকোনমি অফ এক্সপ্রেশন এর মধ্যে দিয়ে…
৪২ বছরের ব্যাবধানে জন্মানো বাঙালীর চেতনাজয়ী দুই কাব্যপথিকের সৃষ্টির তুল্যমূল্য বিচারক্ষেত্র এ নয়,তাই দ্রুত এ প্রসঙ্গের আরও গুরুত্বপূর্ণ বিন্দুটি ছুঁয়ে আমরা চ’লে যাব শতবর্ষ পেরোনো গীতিকারের উজ্জ্বল তম জীবনখণ্ডে।
“কৈলাসচন্দ্র বিশ্বেশ্বরকে সবলে বক্ষে চাপিয়া হাহা-রবে কাঁদিয়া উঠিলেন। অন্তরের অন্তর কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিল, আয়, আয়, আয়!
সভায় কেহই বৃদ্ধের এ ক্রন্দন অস্বাভাবিক মনে করিল না। কারণ, বয়সের সহিত সকলেরই কেহ না কেহ হারাইয়া গিয়াছে। সকলেরই হৃদয় কাঁদিয়া ডাকিতেছে—ফিরে আয়, ফিরে আয়, ফিরে আয়!”
এই সমগ্র অংশ গানে রূপান্তরিত হল এবং আবেগের বিন্দুমাত্র হানি না ক’রে, ‘তোমার আমার’,মাত্র দুটি শব্দের সহজতম প্রয়োগে গীতিকার চমৎকারভাবে বুঝিয়ে দিলেন আবেগের এই সর্বজনীনতা
“শূন্যবুকের সেই সে কাঁদন আজও শোনা যায়/তোমার আমার বুকের মাঝে আয় রে ফিরে আয়”।
ইনিই হচ্ছেন প্রণব রায়। আপাত ও বিদিত পরিচয়ে গীতিকার প্রণব রায়, (বিস্তৃত পরিচয়ে,স্বদেশী আন্দোলনের শরিক, গল্পকার,কবি,চিত্রনাট্যকার,প্রযোজক এবং চলচ্চিত্র পরিচালক)পরিসংখ্যানে না গিয়ে বলি,ইনিই সেই মানুষ,গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার যাঁর সম্পর্কে বলছেন, বাংলা ছবিতে সিচুয়েশান অনুযায়ী গান লেখার ক্ষেত্রে প্রণব রায় আমার ভগীরথ।তা এ হেন ভগীরথ ১৯৩৬ সালে প্রথম ‘পণ্ডিতমশাই’ ছবিতে গান লেখার বেশ কয়েকবছর আগে, ১৯২৯ এ কল্লোলের পাতায় লিখলেন।প্রসঙ্গত ব’লে রাখতেই হয়,’কল্লোল’ উঠে যাওয়ার পর এই প্রণব রায়ের সান্নিধ্যে বসত আড্ডা,এবং এ আড্ডায় প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত সহ আরও তারকাদের প্রত্যেকেই কেমন ক’রে যেন ভুলে যেতেন ‘কল্লোল’ উঠে যাওয়ার যন্ত্রণা। ‘প্রণবের অফিসটি’ই যে এই ভুলিয়ে দেবার ক্ষেত্রে এক বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল,সে কথা আত্মকথা ‘স্মৃতির ঝাঁপি’তে লিখে গেছেন পরিমল গোস্বামী।প্রসঙ্গত এও উল্লেখযোগ্য, ‘কল্লোল’ উঠে যাবার আগে প্রবল উদযোগে প্রেমেন্দ্র মিত্র শেষ দুটি সংখ্যায় প্রণব রায়কে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলেন। ১৩৩৬ এর ৭ম বর্ষের অঘ্রান সংখ্যায় বেরিয়েছিল তাঁর গল্প ‘গন্ধ’ আর পৌষ সংখ্যায় কবিতা ‘তোমাকে’।
কবিতাটি ছিল এরকমঃ
জীবন পথে জনতা মাঝে চলিতেছিনু একা;/
সহসা করে ঊষর পথে ফুটিল নবতৃণ/
মাধবী-দূতী বনানী শাখে বাজালো কুহু-বীণও/
ক্ষণেক তরে নীরবে হল তোমারি সনে দেখা..
ক্ষণিক দেখা-নমিত তব নয়ন দুটি তুলি’/
চাহিলে তুমি,পথিকসখী,আমারি মুখ’পরে,/
মুদিত মনোমুকুল মম নয়নারুণকরে/
মেলিল ধীরে পরাগরেণুসুরভি দলগুলি
আজিকে তুমি হারায়ে গেছ জনতা-কোলাহলে,
মরুভূ বুকে মিলায়ে গেছে শ্যামল মরিচীকা/
জ্বলিছে খর তপনতাপে দারুণ দাহশিখা/
স্মিরিতি তব অস্তগত অতীত তমোতলে/
ভুলিয়া গেছি-তবুও ডাকি ধরিয়া শতনাম,
তোমারে খুঁজি সবার মাঝে সর্বকালে দেশে/
বিকচ মম হৃদয়টিরে তোমারি উদ্দেশে/
পান্থ যত সবারি হাতে আজিকে সঁপিলাম।।
শব্দচয়নে সময়চিহ্ন এ কবিতায় বহমান ঠিকই,তার পরেও বক্তব্যের সঙ্গে প্রকাশভঙ্গীর দার্ঢ্য এবং ভাবনার অভিনবত্ব মিলেমিশে, সময়ানুগ চেনা অবয়বে এ কবিতা এক অন্যতর আস্বাদ যুগিয়েছে। দারুণরকম লক্ষ্যণীয় ‘পথিকসখী’ শব্দটি। কপালকুণ্ডলার ‘পথিক,তুমি কি পথ হারাইয়াছ’ থেকে রবিগানের ‘আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি’ (এবং অতি অবশ্যই এ গানের পরিবেশনে করুণ করবী আর আমের মঞ্জরীর নারী কণ্ঠের পাশাপাশি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় দ্বারা পরিবেশিত পথিক অংশটি)।
বা সুকুমার রায়ের ‘অবাক জলপান’এর পথিক চরিত্রটির বর্ণনায় এপরি পথিক বলতে পুরুষ অবয়বই অবভিয়াস হয়ে ওঠায়,কোন অলিখিত নিয়মে ‘পথিক’ শব্দটির একটি নির্দিষ্ট জেন্ডারপ্রাপ্তি ঘটেছিল। সেই ১৯২৯ এ প্রণব রায় একটা শব্দের ব্যাবহারে এই তিন আইকনিক সাহিত্যিকের নির্মাণকৃত ‘পথিকসত্ত্বা’র এক বিপরীত ছবি এঁকে দিলেন।
‘পথিকসখী’ কয়নেজে যে কেবল ‘পথিক’ শব্দের জেণ্ডার বিনির্মাণ হচ্ছে তাইই নয়, রচিত হচ্ছে এক চিত্রকল্পও।
নারী চরিত্রটি এখানে পথিক;সলজ্জা বধু নয়।ঘরের কোণে নয়,বিজন বাতায়নে নয়,নিভৃত কাননে নয়,নিরালা প্রান্তরে নয় -রাজপথে তার সঙ্গে কবির দেখা।চলার পথে পথসখীর সঙ্গে তাঁর দৃষ্টিবিনিময় এবং হৃদয় উন্মীলন।
এই একটা শব্দ ব্যাবহারে,প্রেমিকা বা প্রেয়সী ইমেজে একটা যুগান্তকারী বদল এনে দিলেন। লজ্জাবনতা,অবগুণ্ঠিতা, ঢাকাই শাড়ী আর টিপ এ অপেক্ষারতা বা লিপিদুরত্বের প্রিয়তমা নন। রাস্তায় সমানতালে পা ফেলে এগিয়ে যাওয়া এক নারী,জনস্রোতে মিশে থাকা এক পথিক পুরুষের চোখ আটকে যায় যাতে।
এর পরেই স্তবকান্তর। আবারও লক্ষ্যণীয় যে প্রথম দেখার পরবর্তী অবশ্যম্ভাবী প্রেমপর্ব সম্পূর্ণ অনুপস্থিত এ কবিতায়।
কবি ফিরছেন অনেকটা সময় পেরিয়ে আবার,যখন নারীটি বিচ্ছিন্না হয়েছেন তাঁর জীবন থেকে,এবং সেই হারানোর ক্ষেত্রটিও আবারও ‘জনতা কোলাহল’।চলার সাথীর স্মৃতিও মুখ ডুবিয়েছে অতীতগহনে, তবু খুঁজে চলা তাঁকে নিরন্তর।
‘তোমারে খুঁজি সবার মাঝে সর্বকালে দেশে/বিকচ মম হৃদয়টিরে তোমারি উদ্দেশে /পান্থ যত সবারি হাতে আজিকে সঁপিলাম ‘
তাঁকে ফিরে পাওয়ার প্রয়াস যেমন দেশ কাল এবং আবহমান মানবসমাজকে ঘিরে,তেমনি তাঁর উদ্দেশে সঁপে দেওয়া হৃদয়টিও কবি বিলিয়ে দেন চরৈবেতি মন্ত্রানুগামীদের তরে।
১৯৭৭ সালে সলিল চৌধুরী নিজের লেখা গান গাওয়ালেন লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে, ‘আজ নয় গুনগুন গুঞ্জন প্রেমের’, বা তারও আগে মোহিনী চৌধুরির ১৯৪৫ এর গান ‘পৃথিবী আমারে চায়’ এর বক্তব্যের যে ধারা আমরা পেয়েছি,(নরনারীর প্রেমকে বৃহত্তর মানবিক আঙিনায় মেলে দেওয়া)তার সুচনা কি এই কবিতাতেই হ’য়ে যায় নি??
প্রণব রায়,এ কবিতায় শুধু সেটুকুই করছেন না, বরং তাঁর মনের সবটুকু প্রেমনির্যাস তিনি আবহমান পথিকের চলার রসদ ক’রে দিয়ে যান।
খেয়াল রাখতেই হবে এ হেন চূড়ান্ত পরিণত মানসিকতার কবিতা যাঁর লেখনী থেকে আসছে, সেই কবির বয়স তখন মাত্রই ১৮।
সূচনার কথাই এল যখন উঠে আসে আরও কিছু প্রসঙ্গও। অভিনেত্রী সুপ্রিয়া দেবীর অভিনয়ের সূচনা হয়েছিল যে ছবি দিয়ে,সেই ‘নাগপাশ’ ছবির কাহনী,সংলাপ এবং গান রচয়িতা ছিলেন প্রণব রায়।যদিও কোন কারণে মুক্তির আলো দেখে নি এ ছবিটি।আবার ‘দেয়া নেয়া’ বা ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ খ্যাত পরিচালক সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায়ের চলচ্চিত্র জীবন শুরুই হত না,যদি না এই মানুষটি থাকতেন। ১৯৪২ থেকে নীরেন লাহিড়ী আর প্রণব রায়ের যৌথ যাত্রা শুরু ‘গরমিল’ ছবি দিয়ে।তারপর ‘দম্পতি’, ‘সহধর্মিনী’ থেকে শুরু ক’রে ‘দেবীমালিনী’ ‘তানসেন’ পর্যন্ত নীরেন লাহিড়ীর বহু ছবির গীতিকার বা কাহিনীকার থেকেছেন প্রণব বাবু।১৯৪২ থেকে ১৯৫৯ পর্যন্ত এই সুদীর্ঘ সময়কালের কোন একদিন ইউনিটে কর্মরত অবস্থায়,একটি ছেলে এসে কাজ চাইলেন নীরেন বাবুর কাছে। উনি দুরের দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘ওই ঘরে গিয়ে দেখ,পাজামা পাঞ্জাবি পরা একটি ঢ্যাঙামতন লোক ব’সে লিখছেন।ওঁকে গিয়ে বল।যদি দরকার হয়,উনিই বুঝবেন।ছেলেটি সেই ঘরেই গেল।খানিক বাদে প্রবল উৎসাহে বেরিয়ে এলেন প্রণব রায়। “বেণুবাবু, (ইন্ডাস্ট্রিতে এ নামেই পরিচিত ছিলেন নীরেন লাহিড়ী) এ ছেলেকে নিতেই হবে আমাদের।ছেলেটি ইংরেজিতে সদ্য এম এ পাশ করেছে।ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এ সব শিক্ষিত ছেলেদেরই ত আসা একান্ত প্রয়োজন”।সেই থেকেই সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে গেলেন নীরেন লাহিড়ীর সহকারী এবং মিউজিক্যাল ছবি তৈরির ক্ষেত্রে ‘যদুভট্ট’বা ‘তানসেন’ এর নির্দেশকের সার্থক উত্তরসূরির স্বাক্ষর রাখলেন তাঁর নিজের ছবিতেই।
প্রথম আধুনিক গান হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল তাঁর ‘সাঁঝের তারকা আমি’ গানের রেকর্ডটি।উল্টোদিকে যার ছিল, ‘আমি ভোরের যুথিকা’।প্রথম ‘ব্যালাড সং’ ‘চিঠি’ বা ‘সাতটি বছর আগে/পরে’ই শুধু নয়,বা সায়গলকে দিয়ে প্রথম আধুনিক গান গাওয়ানোর পাশাপাশি,মনে রাখতেই হয় যে,প্রথম পরিচালন গোষ্ঠী ‘অগ্রগামী’র শুরুতেই যে ম্যাগনাম ওপাস ১৯৫৮ সালের ‘শিল্পী’, তার চিত্রনাট্য লিখে দিয়েছিলেন প্রণব রায়।
কিন্তু সরোজ দে’র অনুরোধে প্রণব রায় সরিয়ে নেন নিজের নাম। ‘চিত্রনাট্যকার’ হিসেবে টাইটেল কার্ডে যায় ‘অগ্রগামী’র নামই।ঠিক এই একই ঘটনা ঘটেছিল ১৯৬৯ সালে ‘পরিণীতা’ ছবির ক্ষেত্রে। পার্থপ্রতিম রায়চৌধুরিকৃত গোটা চিত্রনাট্যই প্রণব রায়কে দিয়ে রিরাইট করিয়েছিলেন অজয় কর,কিন্তু নতুন ছেলের ভবিষ্যৎ নির্মাণের কথা মাথায় রেখে প্রণব রায় পার্থপ্রতিমের নামটিই রেখেছিলেন ‘পরিণীতা’ ছবির চিত্রনাট্যকার হিসেবে।
তাঁর নাম গিয়েছিল ‘গীত রচয়িতা’ হিসেবেই।
১৯৬২ তে তাঁর কাহিনী নিয়ে নির্মিত ছবি ‘বাত এক রাত কি’ র পর দেবানন্দ তাঁর চেতলার বাড়ীতে এসে দীর্ঘসময় গল্প ক’রে গেছেন।কথা বলেছেন পরবর্তী ছবি নিয়ে।অনুরোধ করেছেন, প্রণববাবু বম্বেতে এলেই তিনি বাকি ভাবনা এগোবেন।কিন্তু বিপত্তি ত ঐ খানেই। বম্বের আর্টিস্ট দিয়ে তাঁর গান রেকর্ড করানো হবে শুনলে যেমন কুঁচকে যেত তাঁর ভুরু।স্পষ্টই বলতেন, ‘কেন বাবা,আমাদের এখানে কি শিল্পী কেউ নেই??’তেমনি নিজেরও বম্বে গিয়ে কাজের ব্যাপারে ছিল নিতান্তই অনীহা।
আসলে বাংলা ছবিকে সার্ভ করতে, বাংলায় জড়িয়ে থাকতে চেয়েছেন আজীবন বড় প্রাণ দিয়ে।সেজন্যই ৫০ এর দশকের পূর্ববর্তী গীতিকাররা যেখানে অপসৃত হচ্ছেন ইণ্ডাষ্ট্রির চাহিদায়,সেখানে ‘৪১ সালে ‘পরিচয়’ ছবির জন্য রবীন্দ্রনাথ মনোনীত গীতিকার প্রণব রায় “যখন রব না আমি দিন হলে অবসান/আমারে ভুলিয়া যেও, ম’নে রেখ মোর গান” লিখছেন যেমন,তেমনই ‘৭০ এর গোড়ায় লিখছেন ‘আজ দুজনে মন্দ হলে মন্দ কি’ (ফরিয়াদ ১৯৭১) বা ‘এক যে আছে কন্যা’ (নায়িকার ভূমিকায় ১৯৭২)র মত গান যা আজকের অনুপম রায় গোত্রীয়দের অনায়াসে বাউন্ডারি লাইনের বাইরে ক’রে দিতে পারে।
এ আখ্যান শেষ হবার নয়।
অমিতাভ বচ্চনের প্রথম বাংলা ছবি (‘অগ্রদূত’ পরিচালিত এ ছবিটি করতে অমিতাভ রাজী হয়েছিলেন এবং পরিচালক বিভূতি লাহার সঙ্গে তাঁর বাবার বন্ধু প্রণব রায়কে চিত্রনাট্যকার হিসেবে পেয়ে তাঁর সদিচ্ছা আরও বেড়ে গিয়েছিল)বা নিজের অভিনয় ও প্রযোজনায় সুচিত্রা সেন এর বায়োপিক এর যাবতীয় অগ্রগতি নিজের জীবনরেখায় জড়িয়ে নিয়ে তিনি আচমকাই ১৯৭৫ এ চ’লে গেলেন।
রবীন্দ্রনাথ যাঁর সম্বন্ধে ব’লেছিলেন, -প্রণবের কবিতা আমি যখনই পড়ি,আমার ম’ন তার কবিত্বশক্তিকে স্বীকার ক’রে নেয়-;
আর
সুচিত্রা বললেন,
-আমার জীবনের পাতাগুলো হাট ক’রে খুলে দিতে পারতাম যে মানুষটির কাছে,তিনিই যখন চ’লে গেলেন,এ জীবনকে জানানোর প্রয়াসও এখানেই ইতি পাক-।
প্রণব রায়ের মত মানুষেরা আসলে সেই সময়ের ফসল ছিলেন, ‘পুরুষকার’ শব্দটা যখন বাঙালীর অস্তিত্বে খুব সহজেই খুঁজে আওয়া যেত।সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের উত্তরাধিকার থেকে নিজেকে মুক্ত রাখবেন ব’লে পদবী কেবলমাত্র ‘রায়’ লিখতেন,এবং এই স্বতন্ত্র্য পরিচয়ের নামের সঙ্গেই সমার্থক ক’রে যেতে পেরেছিলেন বাংলা সংস্কৃতি জগতের এক অধ্যায়কে। সেখানেই তিনি উজ্জ্বল,সেখানেই তিনি ইতিহাস, সেখানেই তিনি প্রাসঙ্গিক -বারবার।
শ্রীমতী দোলন ঘোষ বিগত ১০ বছর যাবৎ আকাশবাণী এফ এম এ উপস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত আছেন। তৎসহ দীর্ঘদিন ধরে তিনি চলচ্চিত্র গবেষণায় নিবিষ্ট ও নিজস্ব স্বাধীন ব্যবসার সাথেও যুক্ত।এবং বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের এক সক্রিয় কর্মী।
Comment here