-সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়
এল টিয়েমব্লো। পরিসরে বিশাল হলেও মাত্র হাজার চারেক মানুষের বাস। স্পেনের ক্যাস্টিল অ্যান্ড লিওন নামে স্বায়ত্ত্বশাসনাধীন অঞ্চলের আভিলা প্রদেশের এই শহরে পাওয়া গেছে আদিম মানুষের দেহাবশেষ। সেটা বছর তিরিশ আগের কথা। তবে এর অনেক আগে থেকেই এল টিয়েম্বলো বিখ্যাত। একে বিখ্যাত করেছে চারটি পাথুরে মূর্তি। স্প্যানিশে যার নাম টরোস দে গুইসান্ডো, বাংলা করলে হয়, গুইসান্ডোর ষণ্ড।
ইতিহাসবিদরা মনে করেন ১৩৬-১৩৩ খ্রিস্টপূর্ব অব্দে যখন এই ভাস্কর্য তৈরি করা হয়, তখনও রোম এই অঞ্চলে সাম্রাজ্য বিস্তার করেনি। সেই সময় সেলটিক বংশোদ্ভূতরা এই মূর্তি তৈরি করেন। এই মূর্তিগুলি ষাঁড় বা বলদ নাকি শূকরের তা নিয়ে ধন্দ রয়েছে। ইবেরিয়ান উপদ্বীপে বসবাসকারী সেলটিক বংশোদ্ভূতরা কেন এই ভাস্কর্য তৈরি করেছিলেন, নির্দিষ্টভাবে সেই উত্তর পাওয়া না গেলেও মনে করা হয়, কারও অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার অংশ হিসেবে এগুলি তৈরি করা হয়েছিল। মনে করার কারণও আছে। এই মূর্তিগুলির গায়ে যা লেখা ছিল সেসব প্রায় মুছে গেলেও একটি লেখা পড়া গেছে। তাতে ল্যাটিনে লেখা রয়েছে LONGINUS PRISCO – CALAET Q PATRI F.C., যার বঙ্গানুবাদ করলে হয়: লঙ্গিনাস তার বাবা প্রিস্কোর জন্য এটি (স্মৃতিস্তম্ভ) তৈরি করেছিলেন। কারও মতে, প্রাণীদের রক্ষা করার বার্তা দিতেও এইধরনের ভাস্কর্য সেই সময় তৈরি করা হত।
স্মৃতিস্তম্ভে ষাঁড় দেখে মনে পড়ে যায় বৃষকাষ্ঠের কথা। বৃষোৎসর্গ শ্রাদ্ধের সময় কারুকাজ করা একটি প্রায় এক-মানুষ সমান উঁচু খুঁটিতে একটি ষাঁড়কে বেঁধে রেখে তাকে উৎসর্গ করা হত ঈশ্বরকে বা প্রকৃতির কাছে। তাতে নাকি মৃত ব্যক্তির স্বর্গলাভ নিশ্চিত হত। তেমন প্রথা কি তাহলে ইউরোপেও চালু ছিল? এখন হলফ করে বলা মুশকিল। যেমন বলা মুশকিল এইসব লোকাচারের উৎস কী। টরোস দে গুইসান্ডো পাথরের বলে রয়ে গেছে কিন্তু বৃষকাষ্ঠের আয়ু সীমিত। তাই এদেশে সেটির খুব প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া সম্ভব নয়।
টরোস দে গুইসান্ডো আরও একটি কারণে বিখ্যাত। পঞ্চদশ শতকে ক্যাস্টিলের গৃহযুদ্ধের অবসানের সাক্ষী এই পাথুরে ভাস্কর্য। ১৪৬৮ খ্রিস্টাব্দের ১৮ সেপ্টেম্বর এখানে ক্যাস্টিলের রাজা চতুর্থ হেনরি ও তাঁর সৎ বোন ইসাবেলার মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল তার নাম ট্রিটি অফ বুলস অফ গুইসান্ডো। চুক্তির ফলে রাজয়কীয় সম্মান ও উপাধি ফিরে পান রাজার ভগিনী।
১৪৬৪ সালে দ্বিতীয় জনের মৃত্যুর পরে রাজা হন চতুর্থ হেনরি। তিনি সিংহাসনে থাকলেও প্রভাবশালীরা তাঁকে অস্বীকার করে তাঁর সৎ ভাই অ্যালফোনসোকে রাজা ঘোষণা করে দেন। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। কিন্তু পরের বছর অর্থাৎ ১৪৬৫ সালে অ্যালফোনসোর মৃত্যু হয়। তখন চতুর্থ হেনরির চেয়ে ২৬ বছরের ছোট সৎ বোন ইসাবেলাকে রানি করে যুদ্ধ চালাতে চান প্রভাবশালীরা। ইসাবেলা অবশ্য দূত পাঠিয়ে, নানা প্রস্তাব দিয়ে শেষ পর্যন্ত হেনরিকে রাজি করান যে হেনরির পরে রানি হবেন তিনিই। তাতে চতুর্থ হেনরি রাজি হন। ট্রিটি অফ বুলস অফ গুইসান্ডো অনুযায়ী চতুর্থ হেনরি তাঁর নিজের মেয়ের বদলে ইসাবেলাকে যুবরানি ঘোষণা করেন। কিন্তু অল্প কদিনের মধ্যে ইসাবেলার বিয়ে হলে রাজা সেই চুক্তি বাতিল করে দেন। ফলে আবার শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। সেকথা অবশ্য এখানে অপ্রাসঙ্গিক।
টরোস দে গুইসান্ডো নামের সেই বিশ্ব ঐতিহ্যের স্মারকের ছবি ছাপা হয়েছে ১৯৯৫ সালে, স্পেনের ২৫ পেসিতা মুদ্রায়।
(লেখক পরিচিতি – প্রাক্তন সাংবাদিক, বর্তমানে ভাষাতত্ত্ববিদ; ইতিহাস চর্চা ও মুদ্রা সংগ্রহ তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান অঙ্গ)
Comment here