শাশ্বত সনাতনস্বভূমি ও সমকাল

বঙ্গদেশের লোকমাতৃকা চণ্ডী

– শ্রী আকাশ বিশ্বাস

 

আদ্যাশক্তি জগজ্জননী যুগে যুগে ভিন্ন ভিন্ন নামে সাধকবর্গের প্রার্থনাগ্রহণ করেছেন ।বিভিন্ন পুরাণে এই সকল ঘটনা ও দেবীর মহিমার বর্ণন পড়লে দুর্গা ও কালী ছাড়াও চণ্ডী, চণ্ডিকা ও সর্ব্বমঙ্গলা এই তিনটি নামের বিশেষ উপস্থিতি দেখা যায়। দেবী ভাগবত, অগ্নিপুরাণ, হরিবংশ এমন কি মহাভারতেও ভগবতী জগন্মাতার এই তিনটি নাম বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় ।

সকল প্রাণীর মঙ্গলের আধার মঙ্গলদায়িনী দেবী সর্ব্বরূপী শিবের ঘরণী তাই মঙ্গলা বা সর্ব্বমঙ্গলা নামে তাঁর পুজো হয় ভূভারতের সর্ব্বত্র। এছাড়া চণ্ডী ও চণ্ডিকা-দেবীর এই দুই নামও বিশেষ প্রসিদ্ধ ।অর্জুন, অনিরুদ্ধ প্রভৃতি অনেকেই এই নামে সম্বোধন করে দেবীর স্তুতি করে তাঁর দর্শন পান এবং তাঁদের মনস্কামনাও পূর্ণ হয় ।গোটা ভারতেই তাই মঙ্গলা , চণ্ডী, মঙ্গলচণ্ডিকা, চণ্ডিকেশ্বরী, মঙ্গলাগৌরী, মঙ্গলচণ্ডী ভিন্ন ভিন্ন নামে ভগবতী শিবানীরই পুজো হয় । বাঙালীও মঙ্গলচণ্ডী নামে তাঁকে বিশেষভাবে আপন করেছেন ।অরণ্যানী দুর্গা উগ্র যোদ্ধারূপিণী রুদ্রাণী মূর্তি, অরণ্যে তাঁর বাস , একই ভাবে শান্তা ললিতকান্তা পার্ব্বতীরূপেও তিনি ভক্তগণের কল্যাণ করে থাকেন, সকল বিপদ ও সঙ্কট নিবারণ করে জননীর মত ভক্তকে আগলে রাখেন ।এই মঙ্গলময়ী মাতারই কল্যাণে গ্রহদোষেরও সমাধান ঘটে । জগন্মাতা নিজলীলায় সমাজের প্রতি শ্রেণীর মানুষকেই চরণে ঠাঁই দিয়েছেন , দিয়েছেন পুজো করার সৌভাগ্য , তাই তিনি প্রকৃত অর্থে একজন সর্ব্বজনীন দেবী ।

সার্বজনীন ভাবে পুজ্যা হওয়ার জন্যই তাকে লোকমাতৃকা বলা হয়েছে (সমগ্র বিশ্বের সকলের আরাধ্যা জগদম্বা)।

অখণ্ড বঙ্গদেশের সর্বোচ্চ সুপ্রসিদ্ধা ও বহুপূজিতা মাতৃকা হলেন ভগবতী চণ্ডী।বিশিষ্ট গবেষক ডঃ শিবেন্দু মান্না ও তার লেখায় স্বীকার করতে বাদ দেননি যে অবিভক্ত বঙ্গের লোকমাতৃকা দেবী চণ্ডিকা। কখনো অকুলের কুল, কখনো ব্রতের দেবী, কোথাও রণমত্তা -রণপ্রিয়া, আবার কোথাও গৃহদেবী, গ্রামে গ্রামে ক্ষেত্রদেবীও। দেবী চণ্ডীর প্রথম প্রকাশ বৈকৃতিক রহস্যতে, দেবী সেখানে আদি মূল চণ্ডী,মহা লক্ষ্মী।দেবী নিজের থেকে প্রকট করলেন মহাকালী ও মহাসরস্বতীকে, তারপর নিজে বিভক্ত হলেন ব্রহ্মা ও রমা রূপে।আবার এই দেবী নিজেকে প্রকাশ করেন বর্তমান কোল্হাপুরে, কোল্হাসুর নাশের কারণে, যার বর্ণনা দেয় ‘প্রাণতোষিণী তন্ত্র’, ‘আগমরহস্য’ এবং ‘করবীরমহাত্ম্য’।পুনরায় দেবী সকল দেবতাদের তেজ থেকে প্রকট হন দ্বাদশভূজা কাত্যায়নী রূপে, শাপভ্রষ্ট চিত্রসমকে মহিষাসুর রূপ থেকে মুক্ত করতে।আবার প্রলম্ব বধে দেবী রুদ্রচণ্ডী প্রকট হন।

দেবী চণ্ডী আবার প্রকট হন পার্বতীর কৃষ্ণকোষ হতে, নিশুম্ভ ও শুম্ভ নামক দুই অসুর ও তাদের সমগ্র সেনা নাশে।আশা করি এই ঘটনাগুলি থেকে স্পষ্ট যে চণ্ডী রণের দেবী, জয়দা, ক্ষত্রিয়দের আরাধ্যা। তবে “চণ্ডী “কথার মূল অর্থ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুসারে “চতুরা” অর্থাৎ চতুরনারী। এই হলো “চণ্ডী” নামের অক্ষরিক অর্থ।

চতুর্বর্গদাত্রী দেবী চণ্ডী। সকল বিশ্ব বিমোহিনী মহামায়াই চণ্ডী, আবার সেই মায়ার উর্দ্ধে গিয়ে সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মলাভ করা যায় যার কৃপায়, তিনিও চণ্ডী, একাধারে সেই সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মই চণ্ডী। মার্কণ্ডেয় পুরাণে দেবী নিজে বলেছেন এ বিশ্ব সংসারে যা কিছুর অস্তিত্ব সবই চণ্ডী, তাই চণ্ডী ছাড়া কিছুই নাই। যা ছিল, যা আছে এবংযা থাকবে, অর্থাৎ ত্রিকাল, ত্রিগুণ, নির্গুণ, আবার যা নেই, ছিল না, এবং থাকবে না, সর্বস্বচণ্ডী।

দেবী চণ্ডী সর্ববর্গ দানেই নিজের চাতুর্য ও পারদর্শীতার নিদর্শন রেখেছেন মুহুর্মুহু।তাইতো অখণ্ড বঙ্গের বিভিন্ন ব্রতের দেবী রূপেও তিনি গৃহিতা হয়েছেন। সাহিত্যচর্চায়েও রয়েছেন চণ্ডী। চণ্ডী সর্বঐশ্বর্য দাত্রী। আবার চণ্ডী আরাধনার প্রচলন আদিকাল থেকে ক্ষত্রিয়দের মধ্যেই, তারপর দেবী গৃহিতা হন বৈশ্য ও ব্রাহ্মণ সমাজে। মূলত দেবী কান্তারবাসিনী, বন্যপশুদেরও দেবী শাসন করেন, তাই বন্য পশুদের থেকে সুরক্ষিত থাকতে আদিকাল থেকে বনবাসী বা বনের নিকট বসবাস করা মানুষ সুরক্ষার জন্য করেছেন চণ্ডী পূজা।যেহেতু ক্ষত্রিয়কুলারাধ্যা তাই কামপূর্তি ও জয়লাভ হেতু দেওয়া হয় দেবীকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন পশু দেওয়া হতো বলি।

কালিকা পুরাণ তার বিস্তারিত বলি পশুর তালিকা ও ফলাফল প্রস্তুত করে চণ্ডীকে বলি প্রিয়া ও রুধীর প্রিয়া বলেছে।আজ ত্রিগুণ অনুসারেই দেবীর পূজা হয়, যার স্বভাবে যে গুণের প্রাধান্য সে সেই প্রকার নৈবেদ্য ও বলি দেবীকে অর্পণ করবে, কিন্তু বলি লাগবেই, তা সে যতই সাত্ত্বিক হোক, কারণ বলি ছাড়া দেবী তুষ্ট হন না, একথা সাত্ত্বিক শাক্ত পরম্পরাও স্বীকার করেছে, তাই তারা দেয় সাত্ত্বিক বলি। আবার চণ্ডী পূজা করেন কৃষকরা, সুফল লাভের আশায় ও যথা সময়ে বৃষ্টির মাধ্যমে অনাবৃষ্টি মোচন হেতু। বিশেষ করে বারুইরা তো করেই দেবীর পূজা, আমরাও বারুই, আমাদের কুলদেবী রয়েছেন উত্তর বরোজে, দেবী বরোজচণ্ডী। তুলাচাষীরা দেবীর পূজা করেন, নাম তুলায়চণ্ডী।

দেবী চণ্ডীকে নিয়ে মধ্যযুগে রচিত হয় নানান কাব্য, বা বলা ভালো মঙ্গল কাব্য। মঙ্গল কাব্য বঙ্গের আঞ্চলিক পুরাণ(স্থল পুরাণ ) যা শুধু ধার্মিক ভাবে দেব-দেবীর পূজা প্রচলনের ভূমিকাই পালন করে না, তুলে ধরে তৎকালীন ঐতিহাসিক সমাজচিত্র।একই ভাবে চণ্ডী পূজা প্রচারে মঙ্গলকাব্য ও পাঁচালিগুলি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে।

সবার আগে যে মঙ্গলকাব্যের উল্লেখ করবো তা হলো কবি রাধাকৃষ্ণদাস বৈরাগী বিরচিত “গোসানীমঙ্গল “।এই মঙ্গল কাব্য উত্তর বঙ্গে চণ্ডী পূজার প্রচলন করতে ভূমিকা পালন করেছে তো বটেই , তা ছাড়া গোসানী মারীর ক্ষেত্র দেবী গোসানী চণ্ডীর মন্দির গড়ে তুলতেও ভূমিকা পালন করেছে। এই গোসানী চণ্ডী হলেন দেবী কামাখ্যা। কালিকাপুরাণ, কামাখ্যাতন্ত্র, যোগিনীতন্ত্রে দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়।এবার আসি কবি দ্বিজমাধব এবং কবি দ্বিজরামজীবন বিরচিত “সুবচনী মঙ্গল “কাব্যের প্রসঙ্গে, শুভচণ্ডী বা সুবচনি হলেন দেবী ব্রাহ্মী, তাঁকে নিয়ে রচিত হয় এই মঙ্গলকাব্য, ফলে ব্রত সমাজে দেবীর প্রভাব বিস্তার হয়, শুরু হয় তার পূজা ও ব্রত, মূলত উত্তর ও পূর্ববঙ্গেই এই মঙ্গলকাব্য বেশি পাঠ করা হয়।ব্রাহ্মী পৌরাণিক এবং একাধারে তান্ত্রিক দেবী। বরাহপুরাণ, কালিকাপুরাণ, মৎসপুরাণ, শিবপুরাণ, মার্কণ্ডেয়পুরাণ, দেবীভাগবত, দেবীপুরাণ, ত্রিপুরা রহস্যাদিশাস্ত্রে দেবীর উল্লেখ মেলে। এবার আসি সবচেয়ে প্রচলিত ও জনপ্রিয় মঙ্গলকাব্যের দেবীর প্রসঙ্গে, অভয়াচণ্ডী বা মঙ্গলচণ্ডীর প্রসঙ্গে। মঙ্গলকাব্যের প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে তার শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা করি।

হরিবংশ পুরাণ, দেবী ভাগবত, বৃহদ্ধর্ম পুরাণ, স্কন্দ পুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণাদি শাস্ত্রেদেবী মঙ্গলা উল্লেখিতা। দেবী ভাগবত ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ থেকেই তার স্তোত্র উদ্ধৃত হয়, সেই স্তোত্রে স্পষ্ট করা সর্বাগ্রে শিব দেবীর উপাসনা করেন ত্রিপুর বধ হেতু, তারপর মঙ্গল গ্রহ দেবীর পূজা করেন, তাই দেবীর নাম মঙ্গলচণ্ডী, মঙ্গলগ্রহের আরাধিতা-অধিশ্বরী তথা মাঙ্গলিক দোষনাশিনী এই মঙ্গলচণ্ডী। তৃতীয়ত দেবীর পূজা করেন নৃপতি মঙ্গল। তারপর সুন্দরীরা দেবীর পূজা করে, অর্থাৎ বিদ্যাধরিরা। তারপরই দ্বাপর যুগে দেবীর পূজা করেন রুক্মিণী, দেবীর বরে রুক্মিণী হন কৃষ্ণজায়া। ত্রেতায় দেবীর পূজা করেছিলেন দেবী সীতা, মঙ্গলার বরে হন রামপত্নী। এবার আসি মঙ্গলকাব্যে। সবার আগে দুটি বিলুপ্তপ্রায় কাব্যের আলোচনা করি, কবি দ্বিজরামদেব বিরচিত “অভয়ামঙ্গল ” এবং দ্বিজমাধব বিরচিত “মঙ্গলচণ্ডীর গীত “, এই দুই কাব্য আজ প্রায় বিলুপ্ত। অভয়া হলো মঙ্গলার অপর নাম, অভয়া অর্থাৎ যিনি নির্ভয়া তথা ভয় নাশ করেন।

এই দুই কাব্যেই একটি মিল পাওয়া যায়, দেবী মঙ্গলার মঙ্গলাসুরবধের কাহিনী, যা বাকি কবিদের কাব্যে মেলে না।এবার আসি কবি মাণিকদত্ত বিরচিত “চণ্ডীমঙ্গল ” কাব্যে, দেবীর স্বপ্নাদেশে এই কাব্য মাণিকদত্ত রচনা করেন ।মাণিকদত্ত সকল চরিত্রের পরিচয়ে বিষদ আলোচনা করেছেন, আবার কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী” চণ্ডীমঙ্গল ” রচনা করেন দেবীর উদ্দেশ্যে, দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে।কবিকঙ্কন দেবীর পূজা প্রচারের কাহিনীতেই জোর দিয়েছেন। কবি রামচরণদত্ত রচনা করেন “মেলাইচণ্ডী কথা “নামক কাব্য গ্রন্থটি, যা মেদিনীপুরের পাঁশকুড়া থেকে উদ্ধার করা হয়, যা থেকে স্পষ্ট মেলাইচণ্ডী হাওড়া জেলার আমতায় স্থাপিত হওয়ার আগে থেকেই বাংলার ব্রতের বিশিষ্ট দেবীছিলেন।এইভাবেই দেবী চণ্ডী বাংলার সাহিত্যে বিশেষ চরিত্ররূপে ভূমিকা পালন করেছেন, আমরা সবাই জানি মঙ্গলকাব্য মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের এক বিশেষ অঙ্গ।আজও এই মঙ্গলকাব্যগুলি বা কিছু ক্ষেত্রে ছোট করে পাঁচালি আকারে পাঠ করা হয়, এইগুলিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে যাত্রা ও পালাগান।

এবার আসা যাক দেবী চণ্ডীকা সংক্রান্ত বিভিন্ন ব্রতানুষ্ঠানে। লুপ্ত ব্রতগুলি দিয়ে শুরু করি।

সবার আগে যে ব্রতের কথা বলবো তা হল মেলাইচণ্ডী ব্রত। দেবী মেলাইচণ্ডীর ব্রতকথা রচনার ব্যাপারে আগেই আলোচনা করেছি।এই ব্রতের নির্দিষ্ট কোনো সময় নাই, সম্মৃদ্ধিলাভের আশায় দেবী মেলাইচণ্ডী পূজিতা হন।এর থেকে বোঝা যায় হাওড়া জেলার আমতার ক্ষেত্রদেবী হওয়ার আগে থেকেই দেবী মেলাইচণ্ডী বাংলার ব্রাত্য সমাজের এক বিশিষ্টা দেবী। দ্বিতীয়ত যেই ব্রতের আলোচনা করবো তা হলো উদ্ধারচণ্ডীব্রত।

প্রসঙ্গত বলে রাখি উদ্ধারচণ্ডীর ব্রত একটি পূর্ববঙ্গীয় ব্রত। অগ্রহায়ণ মাসের যে কোন শনি বা মঙ্গলবার পূজিতা হন গৃহে গৃহে দেবী উদ্ধারচণ্ডী, দেবীর নামকরণ এখানে ভূমিকানুসারে, যিনি ভক্তকে প্রতিকূল পরিস্থিতি হতে উদ্ধার করেন, তিনিই উদ্ধারচণ্ডী। অপরব্রত হচ্ছে কুলাইচণ্ডী ব্রত, এই ব্রতও অনুষ্ঠিত হয় অগ্রহায়ণ মাসে, তো দেখা যাচ্ছে এই মাস চণ্ডী উপাসনায় বিশেষ গুরুত্ব রাখে।

কুলরক্ষায় ও কুলবর্ধনে যিনি সহায় হন তিনিই কুলাইচণ্ডী, আবার কুল চাষীরাও দেবীর পূজা করেন, যে কোনো অগ্রহায়ণ মাসের মঙ্গলবার দেবী পূজ্যা। এরপর আসি নাটাইচণ্ডীব্রতের প্রসঙ্গে, এই ব্রত পালিত হয় অগ্রহায়ণ মাসেই। এই ব্রতের আবার নিয়মভেদ আছে কিছু, কোথাও প্রতি বুধবার এই ব্রত হয়, কোথাও প্রথম রবিবার/কোথাও পুরো মাসের রবিবার আবার কোথাও যে কোন তিনটে রবিবার।

এই ব্রত যদিও বৈশ্যদের মধ্যেই বেশী হয়, বাণিজ্যের বিপদ মুক্তির আশায়। এবার আসি আষাঢ় মাসের ব্রতে। আষাঢ় মাসে (বিশেষত মালদা জেলায়) পালিত হয় রথাইচণ্ডীব্রত ,মূলত শারীরিক সুস্থতাকামনায়, ব্রত হয়ে থাকে রথযাত্রার দিন। এখনও পর্যন্ত যে ব্রতগুলির কথা বললাম ,প্রত্যেকটিরই উদ্ভব পূর্ববঙ্গে।

এবার আসি এদেশীয় চণ্ডীব্রতে; বিপদনাশিনী চণ্ডীব্রত হয় আষাঢ়েই রথযাত্রা থেকে উল্টোরথের মধ্যের মঙ্গলবার। এটাই বিপদনাশিনী দুর্গাব্রতের সাথে এর তফাৎ। মেদিনীপুর অঞ্চলে পালিত হওয়া এক বিশেষ বিশেষ ব্রত হলো মেলাইচণ্ডীব্রত, দারিদ্রমোচনে দেবীর ব্রত হয়, বিশেষ সময় কিছু নাই। বৈশাখ ও মাঘ মাসে পালিত হয় পূর্ণিমা করে ‘ওলাইচণ্ডীর’ ব্রত, যা মহামারী কলেরা রোগের প্রাদুর্ভাবের সময় শুরু হয় ও বেশ জনপ্রিয়তা পায়। বৈশাখের অপর ব্রত ‘সুবচনী’ বা ‘শুভচণ্ডীব্রত’, মতান্তরে কোন বিশেষ সময় নেই। পূর্ববঙ্গীয় ব্রত যে কোনো শুভ অনুষ্ঠানে, বিবাহ উপনয়ন ও সন্তান প্রসবের পর শুভচণ্ডীব্রত বা সুবচনীর পূজা হয়। মূলত শনি-মঙ্গলবারেই এই পূজা হয়।এইরকমই শুভ সময়ে হওয়া অপর পূর্ববঙ্গীয় চণ্ডীব্রত হল ‘সুমতিচণ্ডী’ ব্রত| সুমতিচণ্ডীব্রত বিপদ নাশ করে।

নদীয়া, মুর্শিদাবাদে আর এক ব্রত হয় যার উদয় পূর্ববঙ্গে , তার নাম যশাইচণ্ডী। যশ লাভের জন্য এই ব্রত পালিত হয় , বৈশাখ মাসের যে কোন শনি ,মঙ্গলবার। এবার আসি মঙ্গলচণ্ডীব্রতে। আসলে পূর্ববঙ্গীয় নিয়মানুসারে প্রতি মঙ্গলবারেই এই ব্রত উদযাপনের বিধান, কিন্তু সময়ের অভাবে এখন তা মাসিকব্রতে পরিণত হয়েছে। যে মাসের সংক্রান্তিতে মঙ্গলবার পড়ে, তা ‘মঙ্গলসংক্রান্তি’ নামে খ্যাত, এইদিন দেবীর পূজা হয়।আবার সারা বৈশাখের মঙ্গলবারে হয় ‘হরিষমঙ্গলব্রত’। জৈষ্ঠ্যের মঙ্গলবারগুলিতে হয় ‘জয়মঙ্গলচণ্ডীব্রত’, আবার আষাঢ় ও অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষের মঙ্গলবার হয় ‘সঙ্কটমঙ্গল’ ব্রত। এই হলো বিভিন্ন সময়ে পালিত মঙ্গলাব্রত ,এছাড়াও ত্রিপুরা রাজ্যে প্রতি ভাদ্র মাসের মঙ্গলবারে ‘ভাদ্রমঙ্গল’ ব্রত হয়। আর এক নিয়ম আছে অশ্বিন মাসের প্রতি মঙ্গলবার রাতে দেবীর পূজা হয়, নাম – ‘নিশিমঙ্গলব্রত’। এইভাবেই বিভিন্ন ব্রত,পূজা-পার্বণে গৃহীত হন দেবীচণ্ডী। এই ব্রতকে আবার অবাঙালিগণ বলেন “মঙ্গলাগৌরিব্রত “, বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও কলিঙ্গে এই ব্রত হয়, উচ্চারিত হয় সেই মঙ্গলচণ্ডীস্তোত্রই, তাই বোঝা যায় যে এটি একই ব্রতের নামান্তর।নদীয়া ও মুর্শিদাবাদ এলাকার এক অতি প্রচলিত ব্রত হলো যশাইচণ্ডীব্রত, যার উদয় পূর্ববঙ্গে। যিনি যশ দান ও রক্ষা করেন তিনিই যশাইচণ্ডী। বৈশাখের শনি বা মঙ্গলবার দেবীর ব্রত হয়, আর হয় রাস পূর্ণিমায়। অপর চণ্ডীব্রত পালিত হয় পূর্ববঙ্গীয়দের মাঝে, পৌষমাসের শুক্লাচতুর্দশী তিথিতে, ব্রতের নাম পাটাইচণ্ডীব্রত, যদিওনাম চণ্ডী, ব্রতটি বনদুর্গার উদ্দেশ্যে পালিত হয়ে থাকে। এইভাবেই নানা সময়ে ব্রতের মাধ্যমে পূজিতা হন দেবী চণ্ডী।

পৌষ-পার্বন উপলক্ষে পিঠে -পায়েস আমরা প্রায় সব পূর্ববঙ্গীয়রাই খেয়ে থাকি, তবে পিঠে উৎসব শুরু হয় কিন্তু আমরা দিদাকেই দেখেছি অগ্রহায়ণ থেকে মাঘ, তিন মাস পিঠে বানাতে, কিন্তু কেন? এর সাথেও জড়িয়ে আছেন দেবী চণ্ডী।আমরা সবাই জানি যেই সময় যেই জিনিস সহজলভ্য, তাই সেই সময়ের পূজায় ব্যবহার করা হয়, কারণ সব আর্থিক অবস্থার মানুষের কাছেই তা সুলভ। অগ্রহায়ণে কাটা হয় নতুন ধান, আমনধান। তাই এই সময় চালের গুঁড়ো খুবই সহজলভ্য, ঢেকি দিয়ে ভেঙে গুঁড়ো করা হয়। যে কোনো পিঠের মূল উপকরণ চালের গুঁড়া, তাই এই সময় যেই ব্রতগুলি হয় তাতে নৈবেদ্য রূপে পিঠে ও পায়েস উৎসর্গ করা হয়, আবার শাস্ত্রে সাত্ত্বিকবলির মধ্যে মুখ্য পিঠে বলি।অগ্রহায়ণ মাসে দেবীচণ্ডীকে উদ্দেশ্য করে একাধিক ব্রত পালিত হয়, আগেই বলেছি।ব্রতচারিণীগণ পূজার দিন প্রাতঃকালে প্রত্যেক ব্রতচারিণীর জন্য এক সের এক মুঠা করে আমন ধান মেপে নেন; এতদ্ব্যতীত যত বাড়ির মহিলা একসঙ্গে মিলিত হয়ে ব্রত করবেন, তত সের তত মুঠা ধান মাপতে হয়।এই শেষোক্ত ধান গৃহদেবতার জন্য। ধান মেপে নেওয়ার পর সেগুলি ভেঙে চাল করতে হয়।তারপর এই চালের গুড়া প্রস্তুত করে তদ্দারাচিতই পিঠা তৈরি করা হয়ে থাকে।

চালের গুঁড়া করে ঝাড়বার সময় চালের যে কণা বাহির হইয়াথাকে, তা দ্বারা ব্রতচারিণিগণ পরমান্ন প্রস্তুতকরেন।উদ্ধারচণ্ডী ব্রতোদ্দেশ্যে কোটা চালের কুড়াও ফেলবার নয়। তাহা দ্বারা চাপটা প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। গুড়া প্রস্তুত করিবার পূর্বে চাল ভিজিয়ে রাখা আবশ্যক। ব্রতচারিণীগণ এই চাল ভিজানি জলও ফেলে দেন না। পূজান্তে ব্রত কথা শুনবার পর এই জল পান করা হয়। ফলতঃ তাঁরা চাল ভিজানি জল, চিতই পিঠা, পরমান্ন ও চাপটি দ্বারাই এদিন ক্ষুন্নিবৃত্তি করেন।

ওই সকল আহার সামগ্রী প্রস্তুত হলে তিন ভাগ করে একভাগ গৃহদেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করে গৃহস্থ বালক বালিকা দাস দাসীকে দেওয়া হয়।বাকী দুই ভাগ দ্বারা ব্রতচারিণিগণ ক্ষুন্নিবৃত্তি করেন। তাহলে বোঝা যায় সঞ্চয় করার বিশেষ প্রশিক্ষণও মেলে দেবীচণ্ডীর ব্রত থেকে।আবার এই মাসেই হয় সংকটমঙ্গলাব্রত, সেই ব্রতের দেবী মঙ্গলচণ্ডীকে অর্পণ করা হয় বিবিধ পিঠে। কুলাইচণ্ডী পূজায়ও দেবীকে অর্পিত হয় পিঠে, কিন্তু তাছাড়া নিবেদিত হয় এক বিশেষ নৈবেদ্য, নতুন পাটালি গুড়, বঙ্গগৌড় দেশ, যার অর্থ গুড় উৎপাদনের দেশ, এই পাটালি এই সময় নতুন উৎপাদিত হয়, তাই অর্পণ করা হয় দেবীচণ্ডীকে। এবার আসি নাটাইচণ্ডী পূজায়, দেবীর পূজায় ১৪টি পিঠে তৈরী করতে হয়, চিতই পিঠে মূলত, সাতটি লবণযুক্ত ও বাকিগুলি লবণহীন। এই পিঠে নৈবেদ্য হিসেবে অর্পিত হয় দেবীকে, কচুপাতার উপর, অর্থাৎ কচুর পাতা এখানে থালার ভূমিকা পালন করে।

এবার আমরা সকলে জানি শাক খাওয়া উপকারী, পৌষ মাসের পাটাই পূজায় দেবীকে অর্পিত হয় আড়াই ব্যঞ্জন যার অন্যতম হলো মটরশাকের পিঠাল, সাথে অর্পিত হয় মাছও, তবে আঁশযুক্ত। যাঁরা সাত্ত্বিক পূজা করেন তাঁরা মাছ দেন না, এছাড়াও থাকে বিবিধ পিঠে, চিতই-পাটিজোড়া -পুলি-পায়েস। এর থেকে স্পষ্ট পিঠে খাওয়ার অভ্যাসের পিছনে দেবীচণ্ডীর ব্রতই ভূমিকা রেখেছে, এই পিঠে উৎসবের মূলেও সেই চণ্ডীব্রত।বৈশাখ মাস ও জ্যৈষ্ঠমাসের ব্রতদুটিতে, এবং আষাঢ় মাসের বিপদতারিনী চণ্ডীব্রতের সময় কাঁঠাল সহজলভ্য, এই সময় তাই মঙ্গলচণ্ডী ও বিপদনাশিনী চণ্ডীদের অর্পণ করা হয় আম ও কাঁঠাল। এই সময় এই পূজায় অধিক ব্যবহৃত হয় বলেই এই দুই ফল বেশি হয়, আগে তো ঘরে ঘরে এই ব্রতগুলি পালিত হতো, আমি আমরা দিদার সময় থেকে দেখছি, তখন সমাজ এতো প্রগতিশীল ছিল না। অর্থাৎ ফল, পিঠে, মাছ, সকল খাদ্যাভ্যাসের পিছনেও রয়েছেন দেবী চণ্ডী, সত্যিই বাংলার সব আচার আচরণে জড়িয়ে আছেন বঙ্গমাতা চণ্ডী।

এবার ক্ষেত্রদেবী চণ্ডীর প্রসঙ্গে কিছু কথা না বললেই নয়, ক্ষেত্রের নামানুসারে তার ক্ষেত্র চণ্ডীর নাম সাধিত হয়, এইরকম ঘটনা খুবই সাধারণ।কিছু উদাহরণ দিচ্ছি এই প্রসঙ্গে। জলপাইগুড়ির ধাপগঞ্জের নামানুসারে তার ক্ষেত্র চণ্ডীর নামকরণ হয় ধাপচণ্ডী। হুগলী জেলার গ্রাম পাতুল, তার ক্ষেত্র চণ্ডীর নাম পাতুলচণ্ডী। মালদার মাধাইপুরের নামানুসারে নাম হয়েছে ক্ষেত্রচণ্ডীর, মাধাইচণ্ডী, তেমনভাবে গৌহিলার নামানুসারে গৌহিলচণ্ডী। হাওড়া জেলার বেতাইতলার নামানুসারে ক্ষেত্র চণ্ডীকে বলা হয় বেতাইচণ্ডী। হাওড়া জেলার মাকড়দহ অঞ্চলের নাম হয় মাকড়চণ্ডী। মেদিনীপুর জেলার খাড়গ্রামের নামানুসারে হয় নামকরণ খাড়চণ্ডী।মেদিনীপুর এলাকার দাঁতন অঞ্চলের সাউরী গ্রামের নামানুসারে দেবীর নাম সাউরীচণ্ডী, সগড়ার নামানুসারে নাম সগড়াচণ্ডী, সাবড়ার নামানুসারে নাম সাবড়াচণ্ডী, বনাই গ্রামের নামানুসারে বনাইচণ্ডী, ললাটেরক্ষেত্র দেবী ললাটচণ্ডী, একারুখীর নামানুসারে একাইচণ্ডী, ভাণ্ডারডিহি ও ভাণ্ডারবেড়িয়ার দেবী ভাণ্ডারচণ্ডী।

এরকম ভাবে বর্ধমান জেলার গ্রাম সাবড়া, তার ক্ষেত্র দেবী সাবড়াচণ্ডী, দম্ভানির নামানুসারে নাম দম্ভানিচণ্ডী, একাইহাটের নামানুসারে একাইচণ্ডী, কুলনগরের ক্ষেত্র দেবী কুলাইচণ্ডী। নদিয়া জেলার উলাগ্রামের নামানুসারে নাম হয় ক্ষেত্রদেবীর উলাইচণ্ডী।বাঁকুড়া জেলার পুণিয়া জোলের নামানুসারে দেবীর নাম পুণেচণ্ডী, শিদাড়ার নামানুসারে শিদাড়াচণ্ডী।এরকমভাবে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগরের নামানুসারে দেবীর নাম জয়চণ্ডী। কিছু ক্ষেত্রে আবার দেবীর গুরুত্ব ক্ষেত্রের নামের চেয়ে বেশি দেখা যায়, সেখানে আবার দেবীর নামানুসারে ক্ষেত্রের নাম হয়, যেমন হুগলী জেলার চণ্ডীতলার নাম হয় ক্ষেত্রদেবী মঙ্গলচণ্ডীর নামানুসারে। মেদিনীপুর জেলার চকচণ্ডীর নাম হয় দেবী চকচণ্ডীর নামানুসারে।বাঁকুড়া জেলার আটবাইচণ্ডী গ্রামের নাম হয় দেবী আটবাইচণ্ডীর নামানুসারে।মালদা জেলার বুলবুলচণ্ডীর নাম হয় ক্ষেত্রদেবী বুলবুলচণ্ডীর নামানুসারে, চেঁচাইচণ্ডী গ্রামের নাম ক্ষেত্রদেবী চেঁচাইচণ্ডীর নামানুসারে।এরকমভাবেই কখনো ক্ষেত্রের নাম ক্ষেত্রচণ্ডীর নামানুসারে হয় আবার কখনো উল্টোটা।

এবার আসি ক্ষেত্র দেবীরূপে দেবীচণ্ডীর বন্দনায়, যদিও সব জেলায় কম বেশী চণ্ডীক্ষেত্র দেবী, কিন্তু সব জেলা নিয়ে আলোচনা করলে তা অনেক বড় হয়ে যাবে, তাই আমি শুধু অখণ্ড মেদিনীপুর নিয়ে আলোচনা করব।

সবার আগে আসি পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যার সীমান্তে অবস্থিত ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাঁতন অঞ্চলে।দাঁতন অঞ্চলের কালীচণ্ডী মন্দির যেমন জাগ্রত তেমন জনপ্রিয়। রোজ বহু ভক্তেরই সমাগম হয় দেবীর দর্শন করতে, জানালেন মন্দিরের পুরোহিত শ্রী শুভেন্দু মিশ্র মহাশয়।দাঁতনে রয়েছেন অপর এক চণ্ডী মন্দির ,যারও পুরোহিত শ্রীশুভেন্দুবাবু। মন্দিরটির নাম ‘রণচণ্ডী’ মন্দির, যিনি আদতে ক্ষত্রিয়দের দ্বারা বন্দিত হতেন। দাঁতনের সাউরিতে আছেন ক্ষেত্রদেবী সাউরি চণ্ডী,নামকরণ ক্ষেত্রানুসারেই হয়েছে।দাঁতনের সগড়া গ্রামের নামানুসারে নাম হয় সগড়ার গ্রামদেবী ‘সগড়াচণ্ডী’র, দাঁতনের জনকাপুরে আছেন আর এক ক্ষেত্রদেবী, খড়খাইচন্ডী। দাঁতনের হাসিমপুরে আছেন দেবী চিকনাচণ্ডী।জনকার অপর গ্রামদেবী হলেন আসুরাচণ্ডী, পশ্চিম মেদিনীপুরের বনাইতে বনের ক্ষেত্রদেবী রূপে আরাধিতা হন দেবী বনাইচন্ডী।আবার পশ্চিম মেদিনীপুরের যমুনাবালি,পূর্ব মেদিনীপুরের এগরার অন্তর্গত জেড়থান গ্রাম ও কামারডিহায়ও রয়েছেন গ্রামচণ্ডী, যিনি ক্ষেত্রদেবী রূপেই পূজিতা।আবার মেদিনীপুরের গ্রাম একারুখীর ক্ষেত্রদেবী একাইচণ্ডী। বোঝাই যাচ্ছে যে যে স্থানের নামানুসারেই ক্ষেত্রদেবীর নামকরণ করা হয়েছে।

পিংলাতে রয়েছে জাম্নাগ্রাম, যার ক্ষেত্রদেবী হলেন জামনাচণ্ডী যারও নামকরণ হয়েছে গ্রামের নামানুসার। পিংলাশে রয়েছেন, দেবী বাজারচণ্ডী।মেদিনীপুর অঞ্চলে পালিত হয় মেলাই, কুলাই ও বিপদনাশিনীব্রত। বিপদনাশিনী চণ্ডীর মন্দিরও পাওয়া গেছে মেদিনীপুরের তাজপুরে।আবার শুভচণ্ডীর মন্দির আছে নারায়ণগড়ে।

রামপুরায় আছে অপর রণচণ্ডী মন্দির। মেদিনীপুরে খাড়গ্রামের নামানুসারে নাম হয়েছে ক্ষেত্রদেবী খাড়চণ্ডীর। মোদনীপুরের চণ্ডীপুরের নাম হয় তার ক্ষেত্রদেবী চকচণ্ডীর নামানুসারে তবে বঙ্গে যাঁরা চণ্ডী নন, তাঁদের নামের সাথে ও যুক্ত হয় ‘চণ্ডী’ পদবি। এতোই জনপ্রিয় দেবী চণ্ডী। তার উদাহরণ আছে মেদিনীপুরের সিনুয়ায়, যেখানে গঙ্গা নামের সাথে চণ্ডী যুক্ত হয়ে হয়েছে ‘গঙ্গাচণ্ডী’।

পশ্চিম মেদিনীপুরের মোহনপুরের সিঙ্গারুইতে রয়েছে ‘লালীয়াচণ্ডী’। চণ্ডীযোগের অপর উদাহরণ আছে মেদিনীপুরের মুরাদপুরে, যেখানে গ্রামদেবী বারাহীর নামের সাথে চণ্ডী যোগ করে করা হয়েছে ‘বারাহীচণ্ডী’, মেদিনীপুরের হলদিয়া ও সিরসাদুই অঞ্চলের গ্রামদেবী হলেন বকুলচণ্ডী। মেদিনীপুরের উত্তর বরোজে রয়েছেন দেবী বরোজচণ্ডী, বারুইদের বরোজ রক্ষা করেন, তাই ভূমিকানুসারে নাম বরোজচণ্ডী।ভূমিকা নিয়েই যখন কথা হচ্ছে তখন ওলাইচণ্ডীর নামতো আসবেই , যিনি ওলারোগ নাশ করে ওলাইচণ্ডী নামে খ্যাতা, তার মন্দির মেদিনীপুরের বাকচায়, এগরা মহকুমার জেড়থান গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত উলুয়ায় ও পশ্চিম পাড়ায় দেখা যায়।

এবার ফিরি ক্ষেত্রদেবীর কথায়, মুলদা গ্রামের ক্ষেত্রদেবী মুলদাচণ্ডী, মানিক দিঘীর মানিকচণ্ডী, খাড়ুইয়ের খাড়ুইচণ্ডী।মেদিনীপুরের চন্দপুর হাটে বিরাজিতা দেবী রুদ্রচণ্ডী, নারায়ণগড়ে আছেন দেবী টাকলাচণ্ডী। সওয়াই গ্রামে দুইজন পায়রাচণ্ডী। মির্জা বাজারে রয়েছে দেবী প্রচণ্ডচণ্ডীর মন্দির। কাঁউরচণ্ডী গ্রামের নাম হয় ক্ষেত্রদেবী কাঁউরচণ্ডীর নামানুসারেই। মেদিনীপুরের দেবী রাউতমনি, যার ক্ষেত্রদেবী হলেন রাওতানচণ্ডী।ময়নায় রয়েছেন দেবী গোজিনাচণ্ডী। ময়না, ভাণ্ডারবেড়িয়া ও ভাণ্ডরিয়া ,তিন স্থানের ক্ষেত্রদেবী হলেন ভাণ্ডারচণ্ডী।]

শিমুলিয়ার ক্ষেত্রদেবী হলেন ভীমাচণ্ডী। বসানচকের ক্ষেত্রদেবী হলেন রাখালচণ্ডী ,খুকুড়দহের খুকুড়চণ্ডী। সাঁকরাইল, খেজুরি, ওসুজানগর, মেদিনীপুরের এই তিন গ্রাম ছাড়াও মাড় গ্রামের পাথরাতেও ক্ষেত্রদেবী হলেন দেবী জয়চণ্ডী। তবে মেদিনীপুরের সর্বোচ্চ জনপ্রিয় দেবী হলেন বড়ামচণ্ডী। সাতহাতিয়া, জোড়াপুকুর, বারকাসিমপুর, মেদিনীপুরশহর, ফুলপাহাড়ি, রাড়বেলিয়, পাইনাবাজার, রাণীসরাই, মোহনপুর, হাঁদলা, ললাট, কেথিয়ড়ি, মাড়তলা, কোয়ালিটিবাজার, কুলবাড়ি, বাহারুন, হবিবপুর, নারায়ণগড়, কেঁওসা,বইতলাক ,গড়গ্রামের দোলগ্রাম ও জঙ্গলকুচি,মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা,বলাইপাড়া,নারায়ণগড় ইত্যাদি অঞ্চলে দেবীর মন্দির পাওয়া যায়।

মেদিনীপুরের পর আসি বর্ধমান ও তার বিভিন্ন ক্ষেত্রচণ্ডীদের বর্ণনায়। সর্বাগ্রে যার কথা না বললেই নয় তিনি মঙ্গলচণ্ডী, উজানীনগরে তার মন্দির, এই অঞ্চলের ক্ষেত্রদেবী মঙ্গলচণ্ডী সেই মধ্যযুগ থেকে, এই সেই বণিক খণ্ডের ঘটনাস্থল। এই মন্দির নির্মাণ করেন ধনপতি।এছাড়াও ফুলবেড়িয়া, মহিষিলা, পুরাতন হাট ও বালিডাঙ্গার ক্ষেত্রদেবী হলেন মঙ্গলচণ্ডী। গুপ্তিপাড়া ও অমরপুর, এই দুই ক্ষেত্রের দেবী হলেন জয়চণ্ডী।কেউগুড়ির ক্ষেত্রদেবী অতিবিচিত্রা, আতাইচণ্ডী। মুচিপাড়া ও ডিসেরগড়ের ক্ষেত্রদেবী প্রচণ্ডচণ্ডী। জয়রামপুরের ক্ষেত্রদেবী বারাহীচণ্ডী।পালসান, কাটোয়া, বনগ্রাম, বড়বেলুন ও শ্রীপল্লীর ক্ষেত্রদেবী ওলাইচণ্ডী। আসানসোল এলাকার ক্ষেত্রদেবী ঘাঘরচণ্ডী।রায়ান ও বোঁয়াই অঞ্চলের ক্ষেত্রদেবী হলেন বসন্তচণ্ডী। দেহুরার ক্ষেত্রদেবী শিবাচণ্ডী। আমূলের ক্ষেত্রদেবী আমূলচণ্ডী বা দেবাসীনচণ্ডী। গৌড়ডাঙ্গার ক্ষেত্রদেবী গৌড়চণ্ডী।রানীগঞ্জের ক্ষেত্রদেবী মথুরাচণ্ডী। কুসুমগ্রাম ও বড়বেলুনের ক্ষেত্রদেবী দক্ষিণাচণ্ডী। মাধবডিহির ক্ষেত্রদেবী আহারচণ্ডী।লোহারের ক্ষেত্রদেবী দ্রাসিনচণ্ডী। কল্যাণপুরের ক্ষেত্রদেবী বিলেচণ্ডী। খেঁয়াইবান্দার ক্ষেত্র দেভু খেঁয়াইচণ্ডী।

সগড়ার গ্রাম দেবী সগড়াচণ্ডী।দোম্ভানির ক্ষেত্রদেবী দোম্ভানিচণ্ডী। কুলনগর ও ঊষার ক্ষেত্রদেবী হলেন কুলাইচণ্ডী। কালাপাহাড়ির ক্ষেত্রদেবী শুভচণ্ডী। শোনপুরের ক্ষেত্রদেবী রণচণ্ডী।মৌগ্রামের ক্ষেত্রদেবী হলেন আংরাইচণ্ডী। ফুলবেড়িয়ার ক্ষেত্রদেবী মুক্তাইচণ্ডী। বেনালি গ্রামের ক্ষেত্রদেবী হলেন বিকলাইচণ্ডী।জোতরামপুরের ক্ষেত্রদেবী মড়কচণ্ডী। আন্দুরের ক্ষেত্রদেবী গান্তারচণ্ডী। সর্বশেষে উল্লেখ করি, ফড়িংগাছির ক্ষেত্রদেবী হলেন ন্যাকড়াইচণ্ডী।বর্ধমানের গাঙুঠিয়া গ্রামের ক্ষেত্রদেবী হলেন দেবীডাকাইচণ্ডী। বর্ধমান এলাকায়, গোটা জেলা জুড়ে, বিশেষ করে পশ্চিমে চলতো বড়ামচণ্ডী পূজা, যেহেতু পশ্চিম ছিল গভীর জঙ্গলাকীর্ণ, এবং বনবাসীদের দ্বারা দেবী বন্দিতা হতেন আত্মরক্ষার মানসে।

হুগলী জেলার অবদান চণ্ডী উপাসনায় অনস্বীকার্য। সবার আগেই যেই ক্ষেত্রচণ্ডীর কথা বলবো তিনি চণ্ডীতলার দেবী মঙ্গলচণ্ডী, যার সাথে জড়িয়ে আছে সেই মঙ্গলকাব্যের ঘটনা। কাঁকড়াখুলি গ্রামের ক্ষেত্রদেবী হলেন ঘোলাইচণ্ডী। পাতুল গ্রামের ক্ষেত্রদেবী পাতুলচণ্ডী।চন্দ্রহাটির ক্ষেত্রদেবী হলেন ইটেলচণ্ডী। বিঘাটির ক্ষেত্রদেবী চৰ্চিকাচণ্ডী। আরাণ্ডী গ্রামের ক্ষেত্রদেবী হলেন খননচণ্ডী।আলিশাগড় ও জিয়াড়া অঞ্চলের ক্ষেত্রদেবী ওলাইচণ্ডী। জিয়াড়া গ্রামের অপর ক্ষেত্রদেবী হলেন বসন্তচণ্ডী, যিনি আবার আমনান গ্রামেরও ক্ষেত্রদেবী।

এবার আলোচনার পালা হাওড়া জেলা ও তার চণ্ডী উপাসনার। শিবপুরের ক্ষেত্রদেবী হলেন ওলাইচণ্ডী।খালনা ও ঝিখিরা অঞ্চলের ক্ষেত্রদেবী হলেন জয়চণ্ডী। ঝিখিরা অঞ্চলের অপর ক্ষেত্রদেবী হলেন গড়চণ্ডী এবং এই গড়চণ্ডী আবার রসপুরেরও ক্ষেত্রদেবী।বেতাইতলার ক্ষেত্রদেবী হলেন বেতাইচণ্ডী। আমতার ক্ষেত্রদেবী হলেন মেলাইচণ্ডী। মাকড়দহ অঞ্চলের ক্ষেত্রদেবী হলেন মাকড়চণ্ডী।রামরাজতলা অঞ্চলের ক্ষেত্রদেবী হলেন সৌম্যচণ্ডী। উদয়নারায়ণপুরের ক্ষেত্রদেবী হলেন গজাইচণ্ডী। পোলগুস্তিয়ার ক্ষেত্রদেবী হলেন মগরাচণ্ডী।পাঁচরার ক্ষেত্রদেবী হলেন যুগলচণ্ডী।

মুর্শিদাবাদ জেলার কথা প্রসঙ্গত উল্লেখ না করলেই নয়। মুর্শিদাবাদের হলদি অঞ্চলের ক্ষেত্রদেবী হলেন হলদিচণ্ডী।জাখিনা গ্রামের ক্ষেত্রদেবী জাখিনচণ্ডী। জলসুতি গ্রামের ক্ষেত্রদেবী জলেশ্বরীচণ্ডী। শিমুলিয়া গ্রামের ক্ষেত্রদেবী হলেন চর্চিকাচণ্ডী।মাতাই গ্রামের ক্ষেত্র রক্ষা করেন দেবী মাতাইচণ্ডী। সর্বশেষে যার কথা বলব তিনি হলেন সোনারুন্দি গ্রামের ক্ষেত্রদেবী, স্বর্ণচণ্ডী।

পিছিয়ে নেই নদীয়া জেলাও চণ্ডী আরাধনায়; আর যেহেতু নদীয়া আমার নিজের জেলা তাই তার চণ্ডীপূজার বিবরণ না দিলেই নয়।নদীয়া জেলার নবদ্বীপ অঞ্চলের বিশিষ্ট ক্ষেত্রদেবী হলেন বিপদনাশিনীচণ্ডী। নদীয়ার রানাঘাটের ক্ষেত্রদেবী হলেন জহুরাচণ্ডী।নগরউখড়া ও বীরনগরের ক্ষেত্রদেবী ওলাইচণ্ডী। রাধানগর ও তেহট্ট অঞ্চলের ক্ষেত্রদেবী হলেন দেবী যশাইচণ্ডী। কৃষ্ণনগর সংলগ্ন যাত্রাপুরের ক্ষেত্রদেবী হলেন ঢেলাইচণ্ডী। দেবগ্রাম ও মুহুড়ি অঞ্চলের ক্ষেত্রদেবী হলেন কুলাইচণ্ডী। চাকদা ও হাঁসখালির ক্ষেত্রদেবী হলেন রক্ষাচণ্ডী।পাগলাচণ্ডীর ক্ষেত্রদেবী হলেন দেবী পাগলাচণ্ডী। এইভাবেই বঙ্গের চণ্ডী উপাসনায় সক্রিয় ভূমিকা বজায় রেখেছে নদীয়া জেলা।

মালদা জেলার চণ্ডীপূজা কিন্তু বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কেন তা বলছি। মালদার পূর্বের নাম ছিল লক্ষ্মণাবতী কারণ তা শাসন করতেন বল্লালসেনের পুত্র লক্ষ্মণসেন। তিনি ছিলেন দেবী চণ্ডীর উপাসক। আগেই বলেছি ক্ষত্রিয়গণ দেবীর আরাধনা করতেন রাজ্যরক্ষা ও জয়লাভের কারণে।রাজা লক্ষ্মণ রাজ্যের চারদিকে স্থাপন করেন চারটি চণ্ডী মন্দির। পূর্বে স্থাপিত হয় জহুরাচণ্ডী মন্দির, যার অবস্থান ইংরেজবাজারে। পশ্চিমে কাজি গ্রামে স্থাপন করা হয় দেবী দ্বারবাসিনী চণ্ডীকে। মাধাইপুর, অর্থাৎ দক্ষিণে স্থাপিতা হন দেবী মাধাইচণ্ডী ও উত্তরে স্থাপিতা হন পাতালচণ্ডী, অর্থাৎ ব্যাসপুরে। এছাড়া বুড়াবুড়িতলার ক্ষেত্রদেবী হলেন দেবী বুড়াবুড়িচণ্ডী। চেঁচাইচণ্ডী গ্রামের ক্ষেত্রদেবী হলেন দেবী চেঁচাইচণ্ডী।বুলবুলচণ্ডী গ্রামের ক্ষেত্রদেবী বুলবুলচণ্ডী, চরকাদিপুরের ক্ষেত্রদেবী হলেন দেবী গোওয়ালাচণ্ডী। গোহিলা গ্রামের ক্ষেত্রদেবী হলেন দেবী গৌহিলচণ্ডী।

সবার শেষে আসি বাঁকুড়া জেলার চণ্ডী আরাধনায়। বাঁকুড়া জেলায় অজস্র চণ্ডী মন্দির রয়েছে।সবার আগে উল্লেখ করা দরকার ছাতনা গ্রামের ক্ষেত্রদেবী বাঘরায়চণ্ডীর কথা। তারপর আসেন সতীঘাট ও বিষ্ণুপুরের ক্ষেত্রদেবী প্রচণ্ডচণ্ডী, তবে আরও এক ক্ষেত্রদেবী রয়েছেন বিষ্ণুপুরে, মঙ্গলচণ্ডী। বিসিন্দা অঞ্চলের ক্ষেত্রদেবী হলেন নাচনচণ্ডী। পুণিয়াজোল অঞ্চলের ক্ষেত্রদেবী হলেন পুণেচণ্ডী।আটবাইচণ্ডী গ্রামের ক্ষেত্রদেবী আটবাইচণ্ডী। হদলনারায়ণপুরের ক্ষেত্রদেবী হলেন শুভচণ্ডী। বৈতালের দুই ক্ষেত্রদেবী, বসন্তচণ্ডী ও ঝগড়াইচণ্ডী।মালিয়াড়ার ক্ষেত্রদেবী পুণেচণ্ডী।তবে বসন্তচণ্ডী শুকগেড়ে, ধরমপুর, বড়জুড়ি, উলিয়াড়া, পত্রসায়ের, কলাইবেড়িয়া ও নবকিশোরেরও ক্ষেত্রদেবী।পরাডিয়ার ক্ষেত্রদেবী হলেন সোনাইচণ্ডী। শিদাড়ার ক্ষেত্রদেবী হলেন শিদাড়াচণ্ডী।

এইভাবেই বঙ্গের ঐতিহ্য, ব্রত ও পার্বণের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছেন আমাদের লোকমাতৃকা দেবী চণ্ডী, তাঁর উপাসনা ও পূজা।ভক্তদের সমস্যার সমাধানে আশার আলো, আরোগ্য -বিজয় -বিদ্যা -সম্পদদাত্রী দেবী চণ্ডী হয়ে উঠেছেন বিশ্বাস ও আস্থার কেন্দ্রবিন্দু।এর ফলেই বাংলা ও কলিঙ্গের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে চণ্ডী উপাসনা ও গড়ে ওঠে অজস্র মন্দির, চলতে থাকে চণ্ডীর আরাধনা।এইভাবেই বাংলার সব আচার অনুষ্ঠানের সাথে জড়িয়ে আছেন ভগবতী চণ্ডী।

(লেখক পরিচিতি – স্নাতক, প্রাবন্ধিক, গবেষক)

Comment here