১৯৯২ সাল।আমি তখন উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র।বাগবাজারে গিরিশ মঞ্চে একক রবীন্দ্রসঙ্গীতের আসরে শিল্পী শ্রীমতী সুচিত্রা মিত্র।আমাদের বাড়িতে আমরা প্রত্যেকে সুচিত্রা মিত্রর ভক্ত।তাই এই অনুষ্ঠান দেখতেই হবে।যাঁরা উদ্যোক্তা তাঁদের মধ্যে একজন আমার বিশেষ পরিচিত।অতএব মঞ্চের পাশে খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখবার সুযোগ রয়েছে।সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ সুচিত্রা মিত্র এলেন।চেহারা ছোটোখাটো কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি হাঁটছেন।সিঁড়ি দিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে উপরে উঠলেন।আমি সামনে গিয়ে প্রণাম করলাম।সঙ্গে সঙ্গে বললেন, – একি! পা তো জুতোতে ঢাকা।ধুলো নেই তো পায়ে।
এরপর অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য খাতা বাড়ালাম। – আমি লেখাপড়া জানিনা।টিপছাপ দিই।এই বলে আমার খাতায় যখন স্বাক্ষর দিচ্ছেন মনে হলো হাতে কোহিনুর পেলাম।
এরপর মঞ্চে শুরু হলো অনুষ্ঠান। শুরুতেই ‘ ছিন্নপাতার সাজাই তরণী’ এরপর ‘ জানি জানি গো দিন যাবে’,’ ‘ঐ সাগরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে,’ ‘ অন্ধজনে দেহ আলো’,’ আমারে তুমি অশেষ করেছ’, ইত্যাদি।শেষ গান গাইলেন’যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’৷ দর্শকদেরও বললেন তাঁর সঙ্গে গাইতে। পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে গমগম করছে সুচিত্রা মিত্রর কন্ঠ।সঙ্গে দর্শকরা।সে এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা।
আরও একবার ১৯৯৭ সাল।রবীন্দ্রসদনে বসেছে রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানের আসর।অন্যতম শিল্পী সুচিত্রা মিত্র।সেই আসরেই ইন্দ্রাণী সেন ও ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের যুগ্ম উপস্থাপনায় ‘কৃষ্ণকলি’- যেটির ক্যাসেট এলবাম হিসেবে প্রকাশিত হওয়ার সময় কিছু বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিলো ।মঞ্চের পর্দা উঠতেই দেখা গেলো সুচিত্রা মিত্র বসে রয়েছেন হারমোনিয়ামের সামনে।শুরু করলেন’ ওগো আমার শ্রাবণ মেঘের খেয়াতরীর মাঝি’ দিয়ে।এরপর ‘ আমার নিশীথরাতের বাদলধারা’,’ ঝর ঝর বরিষে বারিধারা’,’ যায় দিন শ্রাবণ দিন যায়’, ইত্যাদি গান।কিন্তু শ্রোতারা কৃষ্ণকলি না শুনে ছাড়বেন কেন? আসলে সুচিত্রা মিত্র আর কৃষ্ণকলি সমার্থক।সেই ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে রেকর্ড করেছিলেন এই গান তারপর থেকে খুব কম আসরই হয়েছে যেখানে তিনি এই গান করেন নি।দর্শকদের বারংবার অনুরোধে বললেন তিনি, – আজ এরপরেই ইন্দ্রাণী গাইবে এই গান।ব্রততী আবৃত্তি করবে এই কবিতা।আমার গলায় তো এতদিন শুনলেন। এবার ওদের গলায় শুনুন।ভালো লাগবে।
কিন্তু দর্শকরা বারংবার অনুরোধ করতে লাগলেন।তখন সুচিত্রা মিত্র গাইলেন কৃষ্ণকলি।এতবার তাঁর গলায় শুনেছি সেই গান।সেদিন আরও একবার ভালো লাগলো।যতবার কালো শব্দটি উচ্চারণ করলেন আলাদা আলাদা রকমের অনুভূতি হলো।
রবীন্দ্রসঙ্গীত আর সুচিত্রা মিত্র – একে অপরের পরিপূরক। ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি ‘ উৎসব’। সেখানে শ্রাবণী সেনের কন্ঠে সুরকার দেবজ্যোতি মিশ্র ব্যবহার করেছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘ অমলধবল পালে লেগেছে মন্দমধুর হাওয়া’। গানটিতে সুরকার সামান্য ইম্প্রোভাইজেশান ঘটালেন।আপত্তি উঠলো বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের কাছ থেকে।এগিয়ে এলেন সুচিত্রা মিত্র।তিনি দেবজ্যোতি মিশ্রকে বললেন, – আমার সময়ে যখন গলা সায় দিত, সাধ আর সাধ্যের মধ্যে কোনও দূরত্ব ছিলো না।তখন তোমার পরিচালনায় যদি আমি এমন গাইতে পারতাম খুব খুশি হতাম।শ্রাবণী যেমন গেয়েছে তেমন রেন্ডিশন বড়ো একটা শুনি না।এই গানটা শুনে রবীন্দ্রনাথের গানই মনে হয়।এটাই কি অনুমোদনের জন্য যথেষ্ট নয়।
সুচিত্রা মিত্র ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ় চরিত্রের মহিলা।সব থেকে বড়ো কথা তাঁর কাছে কোনোরকম বাধাই বাধা ছিলো না। ১৯৭৮ সালে ভয়াবহ বন্যা। তখন সুচিত্রা মিত্র সুইনহো স্ট্রিটে থাকেন।চারদিকে জল থৈথৈ।সেই জলের মধ্যে রবীন্দ্রসদনে অনুষ্ঠান।সকালবেলায় গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের হলো।গাড়িতে ফুটবোর্ড অবধি জল।সেই জলে ভাসতে ভাসতে গাড়ি কর্নফিল্ড রোড অবধি গেলো।সুচিত্রা মিত্র রিকশায় উঠলেন।কর্নফিল্ড রোডে জল নেই। নামলেন সেখানে রিকশা থেকে।সেখানে গাড়ি থেকে জল বার করা হলো।এবার তিনি অনুষ্ঠানে গেলেন।
সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন যে সুচিত্রা মিত্রর গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত যেন খেলা করতো।উচ্চারণ,গায়নভঙ্গীমা, স্বরক্ষেপণ এবং সর্বোপরি প্রকাশভঙ্গী তাঁর গাওয়া প্রত্যেকটি রবীন্দ্রসঙ্গীতকে উচ্চপর্যায়ে নিয়ে যেতো। ‘ আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’,’ আজি গোধূলিলগনে’,’এ পথ গেছে কোনখানে’,’ হৃদয়ের একুল ওকুল’,’ ছি ছি চোখের জলে ‘,’ গানগুলি মোর শৈবালেরই দল’ ‘ মেঘের পরে মেঘ জমেছে’,’আমারে করো জীবন দান’,’ নহ মাতা নহ কন্যা’, ইত্যাদি গানগুলি যেন সুচিত্রা মিত্রর গান হয়েই রয়ে গিয়েছে।
স্বরলিপি থেকে বিচ্যুত না হয়ে,সামান্য যন্ত্রাণুষঙ্গ নিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে কিভাবে প্রাণবন্তভাবে উপস্থাপনা করা যায় তা সুচিত্রা মিত্রর কাছে শিক্ষণীয়। রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে শ্রী সন্তোষ সেনগুপ্তর তত্ত্বাবধানে গ্রামাফোন কোম্পানী থেকে প্রকাশিত চন্ডালিকা,চিত্রাঙ্গদা,শাপমোচন,বাল্মীকি প্রতিভা গীতিনাট্যে সুচিত্রা মিত্রর কন্ঠদান আজও জনপ্রিয়।
চলন্ত ট্রেনে তাঁর জন্ম তাই সারাজীবন ছিলেন গতিশীল।সুসাহিত্যিক সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের এই কন্যা যে নিজেও ভালো লিখবেন তা তো বলাই বাহুল্য।কবিতা,ছড়া,ছোটোগল্প,সবেতেই ছিলো তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ। সারাজীবন আক্ষেপ করেছেন যে রবীন্দ্রনাথের চলে যাওয়ার মাত্র কয়েকদিন পর শান্তিনিকেতন গিয়েছেন ফলে গুরুদেবের প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে আসতে পারেননি।শান্তিনিকেতনে গান শিখেছেন শান্তিদেব ঘোষ,ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী,শৈলজারঞ্জন মজুমদারদের কাছে।বন্ধু হিসেবে পেয়েছেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়,অরুন্ধতী দেবী,মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায় বা নীলিমা সেনকে।
কলকাতায় চলে এসে শ্রী দ্বিজেন চৌধুরীর সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষাকেন্দ্র।রবিতীর্থ। পূর্বা দাম,সুমিত্রা রায়,সুমিত্রা চট্টোপাধ্যায়,রমা মন্ডল, সুদেষ্ণা চট্টোপাধ্যায়,অগ্নিভ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ছাত্রছাত্রীদের তৈরী করেছিলেন সুচিত্রা।দেশের বিভিন্ন জায়গার পাশাপাশি বিদেশে বহুবার রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেছেন সুচিত্রা মিত্র।পদ্মশ্রী,আলাউদ্দিন পুরস্কার,দেশিকোত্তম,ইত্যাদি পুরস্কারে সম্মানিতা হয়েছেন তিনি। হয়েছিলেন কলকাতার শেরিফ। ১৯৭১সালেরবাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধর পটভূমিকায় নির্মিত ‘জয়বাংলা ‘ ও ঋতুপর্ণ ঘোষের পরিচালনায় ‘ দহন’ ছবিতে অভিনয় করেন সুচিত্রা মিত্র। চিত্র পরিচালক রাজা সেন ১৯৯৩ সালে তাঁকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন।
১৯২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্ম।২০১১ র ৩ জানুয়ারি চিরতরে রবীন্দ্রলোকে চিরতরে পাড়ি দেন। সুচিত্রা।আজও শ্রোতাদের হৃদয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতের রাজেন্দ্রনন্দিনী হয়ে বিরাজ করছেন সুচিত্রা মিত্র।
– পেশাগতভাবে সরকারী কর্মী, সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়েই বাঁচেন, লেখলেখির মাধ্যমে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাথে যুক্ত।
Comment here