আমার ইতিহাসসংস্কৃতি

রাঢ় শব্দের উৎপত্তি সন্ধানে লাল মাটির দেশে –

– শ্রী জ্যোতিষ্মান সরকার

 

 

রাঢ় শব্দের অর্থ কী? এর উৎসই বা কি?

আমরা সাধারণত রাঢ় শব্দটির পশ্চাতে বাংলা বা বঙ্গ জুড়ে রাঢ়বঙ্গ বা রাঢ় বাঙলা বলতে অভ্যস্ত । কিন্তু সত্যিই কি তাই?

মহাভারতের বিবরণ অনুযায়ী, রাজা কর্ণ বঙ্গ, কলিঙ্গ সহ পাশ্ববর্তী রাজ্যগুলি জয় করেন। ঐতিহাসিকগণ ধারণা করেন তিনি রাঢ়দেশকেও তার অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। রাঢ়ের উল্লেখ রামায়ণ মহাভারতে না পেলেও, সুম্ভ দেশের উল্লেখ রয়েছে।

মহাবংশের লাল দেশ:

সিংহল থেকে প্রাপ্ত বৌদ্ধ পুঁথি মহাবংশ অনুসারে ৫৪৩-৫০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শ্রীলংকার প্রথম রাজা বিজয় সিংহ ‘লাল’ দেশ থেকে আগত।

এই ‘লাল’ দেশের অবস্থান নির্ণয়ে চন্দ্র সেন দুটি মতের কথা উল্লেখ করেছেন।
১) গুজরাটের লোহিত দেশ
২) পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চল

১ম সম্ভাবনাটি ভুল হওয়ার প্রবণতাই বেশি কারণ ইতিমধ্যে ২০০৩ সালে Dr Toomas Kivisild র করা একটি গবেষণা অনুযায়ী Y-chromosome DNA haplogroups র মধ্যে R2 Haplogroup বেশি মাত্রায় পাওয়া গেছে ।যা ভারতীয় বাঙালিদের মধ্যেই বেশি পাওয়া যায়।

রাঢ় অঞ্চলের কোন স্থান থেকে বিজয় সিংহ শ্রীলঙ্কায় গমণ করেন জানা যায় না। তবে এ বিষয়ে দুটি theory দুইজন ঐতিহাসিক দিয়েছেন।

১) সিঙ্গুর : শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন মনে করেন যে বিজয় সিংহের পিতা সিংহবাহুর রাজধানী যেহেতু সিংহপুর ছিল, তাই এই অঞ্চলটি সম্ভবত নামের সাযুজ্য অনুসারে সিংহপুর হতে পারে।

২) সিংহারণ: বর্ধমান ইতিহাস ও সংস্কৃতি গ্রন্থের প্রণেতা শ্রী যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী এর সমালোচনা করেছেন।

উনি মজুমদার ও অন্যান্য ঐতিহাসিকদের ডক্টর হান্টার-এর বিবরণের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হওয়াকে সমালোচনা করেছেন। তাঁর মতে, সিংহ বাহুর মাতা সুসামা বঙ্গ অঞ্চল থেকে মগধ যাওয়ার পথে পর্বতসঙ্কুল ‘লাল দেশের’ জঙ্গলের মধ্যে ভ্রমণকারী বণিকদের দল থেকে একটি অরণ্যের মধ্যে পৃথক হয়ে পড়েন।

উনার মতে সিংহারণ অরণ্যৈ সেই অঞ্চল। সিংহারণ দুর্গাপুর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বরাকরের একটি উপনদী। এক সময় এই নদী খুবই জলপ্রবাহে পুষ্ট ছিল ও এই উপত্যকার নাম সিংহারণ হয়েছে সিংহ অরণ্য থেকে। অতীতে এই অঞ্চলে সিংহ পাওয়া যেত। মহাবংশের বিবরণে সিংহের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।

উনার অনুমান ভিত্তিহীন না ১৯৬৬ খ্রি শুশুনিয়া পাহাড়ে পশ্চিমবঙ্গ প্রত্ন আধিকারিকরা সিংহের অস্থিকঙ্কাল পেয়েছেন।

এই অঞ্চলের সিংহের অস্তিত্বের উল্লেখ ১৭ শতকেও পাওয়া যায়। Journal of the Royal Asiatic Society of Great Britain and Ireland, Volume 1 (1833-34) র ৩২৬ পৃ তে একটা উঃ পাওয়া যায় । সেখানে “জাহাঙ্গীরনামা” গ্রন্থের উল্লেখ করে বলেছেন যে আলিকুলী বর্ধমানের গভর্নর ছিলেন। এই অঞ্চলে একটি সিংহ হত্যা করে শের আফগান নামে পরিচিত হন ।

এই অঞ্চলে শেরগড় নামের একটি দুর্গেরও উল্লেখ পাওয়া যায় মুঘলদের রেকর্ডে । সম্ভবত এই অঞ্চলের সিংহের আধিক্য ছিল তাই একে শেরগড় বলা হয়েছে। পরবর্তীতে এই অঞ্চল পরিচিত হয়ে শেরগড় পরগনা নামে।

রাজমহল পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সিংহের উল্লেখও পাওয়া যায় ইংরেজ শাসনকালে, ১৮৫০ নাগাদ। অতিরিক্ত শিকারের কারণে পালামৌ অঞ্চলের সিংহদের অবলুপ্তি ঘটে।এমনকি ১৮২৯ খ্রি: এডোয়ার্ড টার্নার বে্ন্নেট একটি প্রবন্ধে পূর্ব ভারতের সিংহদের জন্য Felis Leo Bengalensis নামটা প্রস্তাব করেন।

তবে লাল শব্দটিই আদি শব্দ ধরে নেয়া যেতে পারে।

লাল> লাল্ঢ> লাঢ় > রাঢ়

রোমান ও আর্থিক সোর্স থেকে পাওয়া গঙ্গারাঢ়ী সভ্যতা: ভার্জিল ডিওডেরাস প্লেটো প্রমুখ লেখকদের বর্ণনায় Gangaridai শব্দটা বারবার ব্যবহার হয়েছে। অনুমান করা যায় গঙ্গা পার্শ্ববর্তী রাঢ় অঞ্চলকে বোঝাতেই এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

গাঙ্গেয় রাঢ় > গঙ্গারাঢ়ী> গঙ্গারিডাই > গেন্ডারিডাই – এই সময়কালে তাম্রলিপ্ত অঞ্চলে গভীর সমুদ্র বন্দর ছিল যা গাঙ্গে বন্দর নামে পরিচিত। গঙ্গা বংশের প্রতিষ্ঠাতা অন্ততবর্মন তাম্রলিপ্ত রাজপরিবারের রাজকুমার ছিলেন এবং তাঁর বংশের নাম গঙ্গা বংশ এই কারণেই হয়। এরকম মতই মেদিনীপুরের ইতিহাসে শ্রী যোগেশচন্দ্র বসু দিয়েছেন।

গঙ্গা বন্দরের সাথে মিশর ক্রীট প্রভৃতি অঞ্চলের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল ।এই অঞ্চলের নির্মীত অস্ত্রের বেশ প্রসিদ্ধি ছিল।

টলেমি এইরকম বলেছেন গঙ্গা বন্দর সম্পর্কে:

There is a river near it called the Ganges, and it rises and falls in the same way as the Nile. On its bank is a market-town which has the same name as the river, Ganges. Through this place are brought malabathrum and Gangetic spikenard and pearls, and muslin of the finest sorts, which are called Gangetic. It is said that there are gold-mines near these places, and there is a gold coin which is called caltis.

Anonymous, Periplus of the Erythraean Sea. Translated by Wilfred Harvey Schoff

Bibliotheca history এর বই 2-এ, Diodorus বলেছেন যে “Gandaridae” (অর্থাৎ গঙ্গারাঢ়ী ) অঞ্চলটি গঙ্গা নদীর পূর্বে অবস্থিত ছিল, যা 30 টি স্টেড প্রশস্ত ছিল। তিনি উল্লেখ করেছেন যে কোন বিদেশী শত্রু কখনও Gandaridae জয় করতে পারেনি, কারণ এটি তার শক্তিশালী হস্তী বাহিনীর কারণে।

তিনি আরও বলেন যে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট অন্যান্য ভারতীয়দের পরাজিত করার পরে গঙ্গা অববাহিকার পশ্চিম পর্যন্ত অগ্রসর হন, কিন্তু তিনি যখন শুনেছিলেন যে Gandaridae এ ৪,০০০টি হাতি রয়েছে তখন তিনি পিছু হটার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

This river [Ganges], which is thirty stades in width, flows from north to south and empties into the ocean, forming the boundary towards the east of the tribe of the Gandaridae, which possesses the greatest number of elephants and the largest in size. Consequently no foreign king has ever subdued this country, all alien nations being fearful of both the multitude and the strength of the beasts. In fact even Alexander of Macedon, although he had subdued all Asia, refrained from making war upon the Gandaridae alone of all peoples; for when he had arrived at the Ganges river with his entire army, after his conquest of the rest of the Indians, upon learning that the Gandaridae had four thousand elephants equipped for war he gave up his campaign against them.

Diodorus Siculus, Bibliotheca historica 2.37.2-3. Translated by Charles Henry Oldfather.

Bibliotheca historica র 17তম বইতে, ডিওডোরাস আবারও “Gandaridae” বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন যে আলেকজান্ডারকে পিছু হটতে হয়েছিল যখন তার সৈন্যরা Gandaridae বিরুদ্ধে অভিযান করতে অস্বীকার করেছিল।

…the first one along the Caucasus is India, a great and populous kingdom, inhabited by many Indian nations, of which the greatest is that of the Gandaridae, against whom Alexander did not make a campaign because of the multitude of their elephants. The river Ganges, which is the deepest of the region and has a width of thirty stades, separates this land from the neighbouring part of India. Adjacent to this is the rest of India, which Alexander conquered, irrigated by water from the rivers and most conspicuous for its prosperity. Here were the dominions of Porus and Taxiles, together with many other kingdoms, and through it flows the Indus River, from which the country received its name.

Diodorus Siculus, Bibliotheca historica 18.6.1-2. Translated by Russel M. Geer.

Datis (দ্বৈতস), নামে একজন সেনাপতির উঃ পাওয়া যায়। তিনি গঙ্গারিডাইয়ের একজন কমান্ডার ছিলেন এবং ভাগ্যানুসন্ধানে Perses III র সেনাবাহিনীতে ছিলেন, কুচিয়ান গৃহযুদ্ধের সময় Αἰήτης(Aeëtes) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন।

কোলচিস কৃষ্ণ সাগরের পূর্বে আধুনিক জর্জিয়ায় অবস্থিত ছিল। Aeetes ছিলেন Colchia এর বিখ্যাত রাজা যার বিরুদ্ধে Jason এবং Argonauts “গোল্ডেন ফ্লিস” এর সন্ধানে অভিযান পরিচালনা করেছিল।পার্সেস তৃতীয় ছিলেন আইটিসের ভাই এবং টাউরিয়ান গোত্রের রাজা।

গ্রীক লোককথায় সুবর্ণরেখা নদীর উল্লেখ:

Dionysius Periegetes (CE 2nd-3rd শতাব্দী) “Gargaridae” এর কথা উল্লেখ করেছেন যা “সোনা বহনকারী হাইপানিস” নদীর কাছে অবস্থিত।

তাম্রলিপ্ত বন্দরকে যদি গঙ্গা বন্দর অর্থাৎ গঙ্গারাঢ়ী সভ্যতার কেন্দ্র ধরি তবে তার অতি নিকটে সুবর্ণরেখা নদী বর্তমান। অতীতকালে এই নদী দিয়ে বিপুল পরিমাণ সুবর্ণরেনু এই নদীর পলি থেকে উদ্ধার হত।

পূর্ব ভারতে সম্ভবত এটাই একমাত্র নদী যেখানে এখনো কিছু মাত্রায় বালিতে সোনা পাওয়া যায়। রাঁচির নিকটবর্তী এলাকায় পিসকা গ্রাম এই নদীর উৎপত্তি যেখান থেকে সেখানে সম্ভবত সোনার খনি ছিল কোনকালে ।বর্ষার পর সুবর্ণরেখায় জল কমে গেলে তীরে নাকি সোনার টুকরো পড়ে থাকে। সুবর্ণরেখার উপনদী হল খারকাই। জামশেদপুরের আদিত্যপুরের উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে এই নদী। এই নদীর দৈর্ঘ্য মাত্র ৩৭ কিলোমিটার।এই নদীতেও নাকি সোনা পাওয়া যায়। সুবর্ণরেখা নদীর সঙ্গে যোগসূত্রের কারণে এই খারকাইয়েও সোনা ভেসে আসে। এখানেও স্থানীয় মানুষদের সোনার সন্ধান করতে দেখা যায়।

হাইপানিস নদীকে আমরা সুবর্ণরেখা ধরতেই পারি। যদিও একদল ঐতিহাসিক এটিকে হিমাচল প্রদেশের বিয়াস নদী বলেছেন।যাই হোক একথা অনুমান করা যেতে পারে সোনার বেনে সম্প্রদায় সোনা ব্যবসায় অগ্রগতি লাভ করেছিলেন সুবর্ণরেখা নদীর কারণেই। গ্রীকদের সাথেও তাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল।

Ἀπολλώνιος Ῥόδιος( Apollṓnios Rhódios) র লেখা Argonautica (3rd century BCE) কাব্যে ভার্জিল এইভাবে গঙ্গারাঢ়ী সভ্যতার বর্ণন করেছেন, On the doors will I represent in gold and ivory the battle of the Gangaridae and the arms of our victorious Quirinius. Virgil, “Georgics”(III, 27)

কুইন্টাস কার্টিয়াস রুফাস (সম্ভবত খ্রিস্টীয় ১ম শতাব্দী) দুটি জাতি Gangaridae এবং Prasii উল্লেখ করেছেন:Next came the Ganges, the largest river in all India, the farther bank of which was inhabited by two nations, the Gangaridae and the Prasii, whose king Agrammes kept in field for guarding the approaches to his country 20,000 cavalry and 200,000 infantry, besides 2,000 four-horsed chariots, and, what was the most formidable of all, a troop of elephants which he said ran up to the number of 3,000.

Quintus Curtius Rufus

প্লিনি দ্য এল্ডার (23-79 CE) বলেছেন,

… the last race situated on its [Ganges’] banks being that of the Gangarid Calingae: the city where their king lives is called Pertalis. This monarch has 60,000 infantry, 1000 cavalry and 700 elephants always equipped ready for active service. […] But almost the whole of the peoples of India and not only those in this district are surpassed in power and glory by the Prasi, with their very large and wealthy city of Palibothra [Patna], from which some people give the name of Palibothri to the race itself, and indeed to the whole tract of country from the Ganges.

Pliny the Elder, Natural History 6.65-66. Translated by H. Rackham.

জৈন গ্রন্থে উল্লেখিত মহাজনপদ লাঢ়:

বৌদ্ধ গ্রন্থগুলিতে ১৬ মহাজন পদের তালিকায় বঙ্গ ও রাঢ়ের উল্লেখ না পাওয়া গেলেও জৈন ভগবতী সূত্র ও আচারঙ্গ সূত্রে এই অঞ্চলের বিবরণ পাওয়া যায়।

ভগবতী সূত্রে ১৬ টি জনপদের মধ্যে ২টি জনপদ উল্লেখ্য ভঙ্গা( বঙ্গ ) ও লাঢ়।

খুব সম্ভবত বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার সেই সময় এই অঞ্চলে হয়নি কিন্তু জৈন ধর্মের বিস্তার কিছুটা হলেও হয়েছিল। আমরা শ্রী তরুণদেব ভট্টাচার্যের গ্রন্থ থেকে জানতে পারি, ২ য় ও ৩য় শতকে কিভাবে পুরুলিয়ার তেলকুপী একটি সমৃদ্ধ জৈন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। পুরুলিয়ায় এখনো বেশ কিছু প্রাচীন ১০০ বছর পুরোনো সিদ্ধেশ্বর মন্দির বর্তমান।

তবু রাঢ় অঞ্চলে জৈন ধর্মের বিস্তার এত সহজে হয়নি –

যে সময় মহাবীর জৈন বজ্রভূমিতে  ধর্মপ্রচার করতে আসেন তাঁকে এই অঞ্চলের লোকেরা কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিলেন।
[ উঃ রাঢ়কে বজ্রভূমি ও দক্ষিণ রাঢ়কে সুম্ভভূমি হিসেবে বিভিন্ন স্থানে চিহ্নিত করা হয়েছে। সুম্ভ শব্দের প্রথম ব্যবহার রঘুবংশমতে কালিদাস তাঁর “রঘুবংশম” -এ দেখিয়েছেন রঘু দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে সুম্ভ ও বঙ্গ জয় করে উড়িষ্যার দিকে যাত্রা করেন]

সর্বশেষ (২৪শ) তীর্থঙ্কর মহাবীর ভ্রমণ করতে করতে এই অঞ্চলে উপস্থিত হয়েছিলেন। উক্ত গ্রন্থে এই অঞ্চলটিকে “লাঢ়ার পথহীন দেশ”।

পরবর্তীতে এই অঞ্চলে জৈন ধর্ম ভালো রকম বিস্তার লাভ করে। তার প্রমাণ বর্ধমান শহরের নামকরণেই পাওয়া যায় [ বর্ধমান মহাবীর]

একসময় এই অঞ্চলে জৈন ধর্ম ভাল রকম বিস্তার লাভ করলেও বর্তমানে কেবল ১৩৫জন শরক সম্প্রদায়ের জৈন ধর্মের মানুষ বসবাস করেন, ২০০৯ সালের তথ্য অনুযায়ী।

বাঙলায় জৈন ধর্মের অবলুপ্তি কিভাবে হল?

“At that time, an incident occurred which greatly enraged the king. A follower of the Nirgrantha (Mahavira) painted a picture, showing Buddha prostrating himself at the feet of the Nirgrantha. Ashoka ordered all the Ajivikas of Pundravardhana (North Bengal) to be killed. In one day, eighteen thousand Ajivikas lost their lives. A similar kind of incident took place in the town of Pataliputra. A man who painted such a picture was burnt alive with his family. It was announced that whoever would bring the king the head of a Nirgrantha would be rewarded with a dinara (a gold coin). As a result of this, thousands of Nirgranthas lost their lives.”

(Sujitkumar Mukhopadhyaya: “The Ashokavadana”, p.134).

সম্ভবত সম্রাট অশোকের ক্রোধ কলিঙ্গ বিজয়ের পর তেলকুপির জৈনদের ওপরেও পড়ে। সম্ভবত সেই কারণেই এই অঞ্চলে জৈন ধর্ম স্তিমিত হয়ে পড়ে ও বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার হয়। যদিও তার পরেও জৈন ধর্ম এই অঞ্চলে টিকে ছিল। পাকাবিড়া দেউলঘাটা তেলকুপির মন্দিরগুলো তার প্রমাণ।

সম্রাট অশোকের অত্যাচার থেকে বাঁচতে বহু জৈন শৈব মত গ্রহণ করে। তাদের ক্ষেত্রে শৈব মত বৌদ্ধদের থেকে মন্দের ভালো মনে হয়েছিল । জৈন সিদ্ধাচার্য থেকে নাথপন্থী সিদ্ধাচার্যদের জন্ম হয় এভাবেই।

রাঢ় শব্দটির ব্যবহার ২০০- ৯০০ খ্রী র মধ্যবর্তী সময়ে পাওয়া না গেলেও এই অঞ্চলের বিবরণ ভালোই পাওয়া যায়। শ্রী সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতে কজঙ্গলের রাজা নরসিংহ বা নরসিংহার্জুনের কথা আছে। অন্যদিকে ষষ্ঠ শতকের মধ্যভাগে লেখা বরাহমিহিরের “বৃহৎসংহিতা” তে ছয়টি বৃহৎ জনপদ গৌড়, পৌণ্ড্র, সমতট, তাম্রলিপ্তের সাথে রাঢ়দেশীয় বর্ধমানেরও উল্লেখ আছে।

তামিল শিলালিপিতে লাঢ়াম :

একাদশ শতকের প্রথমদিকেই আবার রাঢ়দেশের বিবরণ পাওয়া যায় প্রথম রাজেন্দ্র চোলের তিরুমালাই অভিলেখে। এর একটি প্রধান কারণ হল, চোলদের প্রথম শক্তিশালী রাজা হিসাবে প্রথম রাজেন্দ্র চোল তৎকালীন কলিঙ্গরাজ মধুকুমার্নবকে হারিয়ে কলিঙ্গ পার হয়ে রাঢ়-অংশের গঙ্গা তীরবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত জয়লাভ করেন। নিজেকে গঙ্গাইকোন্ডচোল বলে ঘোষণা করেন ।

পরবর্তীতে যদিও মহিপাল চোলদের পিছু ধাওয়া করে মলয় পর্বত অবধি অভিযান করেছিলেন বলে জানা যায়। শ্রী
রজনীকান্ত চক্রবর্তীর গৌড়ের ইতিহাস বইতে মহিপালের একটি শিলালিপির কথা উল্লেখ করেছেন। সেখানে একটি শ্লোকে মলয় পর্বত অভিযানের উল্লেখ করা হয়েছে।মূল শ্লোক এই :–

“দেশে প্রাচি প্রচুরপসি স্বচ্ছমাপীয় তোয়ং

স্বৈর ভাস্তা তদনু মলয়োপত্যকাচন্দনেষু

কৃত্বা সান্দ্রৈস্তরুষু জড়তাং শ্রীকরৈরভ্রতুল্যাঃ

‘প্রালেয়াদ্রে: কটকম্ ভজন যস্য সেনা-গজেন্দ্ৰাঃ ॥”

এটিকে অনেকে উড়িষ্যার মলয়গিরি বলে দাবি করলেও এখানে যে চন্দন বনভূমির উল্লেখ পাওয়া যায় তা কেবলমাত্র দঃ ভারত ও পশ্চিমঘাট পর্বতমালা অঞ্চলেই পাওয়া যায়।

মধ্যবর্তী কয়েক শত বছর রাঢ়ের কথা তেমন পাওয়া যায় না। অনুমান, তৎকালীন শক্তিশালী রাজ্য গৌড়ের সঙ্গে রাঢ়দেশ অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। তিরুমালাই অভিলেখ অনুযায়ী রাঢ় দুটি অংশের নাম উত্তর লাড়াম ও তক্কণ লাড়ম অর্থাৎ উত্তর ও দক্ষিণ রাঢ়। উত্তর অংশের রাজা প্রথম মহীপাল এবং দক্ষিণ অংশের রাজা রণশূর বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই অর্থে রাঢ়দেশে দুটি স্বতন্ত্র রাজ্য।

রাঢ় শব্দের ব্যবহার: শব্দটির বহুল ব্যবহার সেন যুগেই চোখে পড়ে যদিও ১০/১১ম শতকে প্রখ্যাত গণিতজ্ঞ শ্রীধর আচার্য নিজের জন্মভূমির বর্ণনা দিতে “নায়িকন্দলি” গ্রন্থে দক্ষিণ রাঢ় শব্দটির উল্লেখ করেছেন।

আসীদক্ষিণরাঢ়ায়াং দিজানাং ভূরিকর্মাণাম।
ভূরিসৃষ্টিরিতি গ্রামো ভূরিশ্রেষ্ঠিজনাশ্রয়ঃ।।

রাঢ়:

শ্রী দীনেশচন্দ্র সরকারের লেখা বই ‘পাল-পূর্ব সেন যুগের বংশানুচরিত’ থেকে আমরা পাই ৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের উৎকীর্ণ পরমা মুঞ্জের গাঁওরি শাসনে দক্ষিণ রাঢ়ের কথা এবং ত্রয়োদশ শতকের মলকাপুর শিলালেখে গৌড়ের অন্তর্গত দক্ষিণ রাঢ়দেশের কথা। এই সময়ের সাহিত্যের উপাদান হিসাবে পাওয়া যায় একাদশ-দ্বাদশ শতকে রচিত কৃষ্ণমিশ্রের “প্রবোধ চন্দ্রোদয়” নাটকে রাঢ়দেশীয় অঞ্চলের কথা এবং তার প্রধান নগর রাঢ়াপুরীর কথা। তবে শুধু দক্ষিণ রাঢ় নয়, উত্তর রাঢ়ের কথাও পাই আমরা নবম শতকের গঙ্গারাজ দেবেন্দ্র বর্মনের একটি লিপির মধ্যে। পরে রাজা ভোজবর্মার বেলাব লিপিতেও সন্ধান মেলে উত্তর রাঢ়ের বিস্তৃত অঞ্চলের। পরে যোড়শ শতকে রচিত দিগ্বিজয় প্রকাশ গ্রন্থে দামোদর নদ ও সেই অঞ্চলের কথা আছে। সেনযুগে বল্লালসেনের নৈহাটি তাম্রশাসন এবং লক্ষ্মণসেনের শক্তিপুর তাম্রশাসনেও রাঢ়দেশের কথা আছে, তবে সেই সব অঞ্চল বেশিরভাগই মুর্শিদাবাদ জেলায় অবস্থিত। বর্তমান বাংলা তখন চারটি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল বরেন্দ্র, রাঢ়, বাগড়ি ও বঙ্গ।এখন রাঢ়দেশের তৎকালীন সীমানা নির্ণয় করলে দাঁড়াবে উত্তরে রাজমহল পাহাড়িয়া অংশের কজঙ্গল, দক্ষিণপূর্বে বঙ্গ। যার শুরু কাটোয়া মহকুমার ও তার উত্তরাংশ থেকে দামোদর উৎস ধরে বীরভূমের পার্বত্য অঞ্চল পর্যন্ত। এই অঞ্চলকে দ্বাদশ ভূম নামে ডাকা হত ১২টি প্রশাসনিক বিভাগ ছিল বলে। 

১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দে জাও দ্য ব্যারোসের মানচিত্রে রাঢ়ের অবস্থান সুন্দরভাবে অঙ্কিত আছে। চৈতন্যচরিতামৃতেও রাঢ় দেশকে একটি পৃথক-দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

দুর্গাপুরের নিকটবর্তী এলাকায় একটি রাঢ়েশ্বরের দেউল বর্তমান । অনেকে মনে করেন এটি বল্লাল সেনের দ্বারা স্থাপিত। সম্ভবত এটি একসময় নাথপন্থী সিদ্ধাচার্যদের একটি তীর্থক্ষেত্র ছিল।

ঠিক এইভাবে সময়ের কালচক্রে লাল দেশ থেকে রাঢ় শব্দের উৎপত্তি হয়।

১৯৬২-৬৩ সালে পূর্ব বর্ধমানে নতুনহাটের পাণ্ডুরাজার ঢিপিতে খননকার্য চালিয়ে দেখা যায়, দু-তিন হাজার বছর আগেও রাঢ়দেশে উন্নত জাতির বাস ছিল। এরা আলপাইন জাতির শ্রেণিভুক্ত বলে ধরা হয়। ভাগীরথী ও তার উপনদীগুলির ক্রমে-ক্রমে দিক ও গতি পরিবর্তনের জন্য রাঢ়দেশীয় মানুষের ভাগ্য বারবার পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে এবং একইভাবে আজও তা বয়ে চলেছে।

ছবি:

১) বঙ্গের সিংহ।
২) সিংহারণ নদী।
৩) টলেমির মানচিত্র
৪) সুবর্ণরেখা নদী থেকে সোনার সংগ্রহ।
৫) পাকাবিড়া আদিনাথ মূর্তি

মূল ছবি: শ্রী শ্রী রাঢ়েশ্বর শিব মন্দির

 

(লেখক পরিচিতি: শ্রী জ্যোতিষ্মান সরকার B.Tech Ceramic Technology তে পাঠরত।)

Comment here