-যাজ্ঞসেনী যশস্বিনী
সত্যজিৎ রায় থাকলে হয়তো বলতেন, যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে নয়, বরং কর্নাটকে। স্কুল, কলেজে হিজাব পরার রাইট নিয়ে সিলিকন ভ্যালিতে তুলকালাম এখনও অব্যাহত। হিজাব পরতে না পেরে মেয়েরা স্লোগান তুলেছে, পহলে হিজাব, ফির কিতাব। অর্থাৎ লেখাপড়া চুলোর দোরে গেলে ক্ষতি নেই, হিজাব পরতে দিতেই হবে, দিতেই হবে। ওটা রাইট। কীসের রাইট, কেন রাইট, কারা সেই রাইট দিল সে সব চুলচেরা জটিল হিসেব নিকেশ, তাতে তেমন কেউ যাচ্ছে না। কিন্তু এটা পরিষ্কার, মাথা ঢাকার অধিকার না পেলে লেখাপড়ায় জলাঞ্জলি দিতে তেমন আপত্তি নেই তাদের।
ছেলেরা অবশ্য হিজাব পরার দাবি তোলেনি। সে দাবি তারা কখনওই তোলে না। তারা আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, এমনিতেই পূত পবিত্র, তাদের আবার লোকচক্ষু থেকে লুকিয়ে রাখা কীসের! তাদের দাবিও অত্যন্ত নারীবাদী, মেয়েদের হিজাব পরতে দিতে হবে। যে সব ঘাড় ত্যাড়া ছেলেমেয়েরা হিজাব বিরোধী আন্দোলন করছে, সময় সুযোগ মত তাদের ওপর ইটপাটকেল ছুঁড়ছে তারা। কেউ কেউ ব্যতিক্রম হলেও বেশিরভাগ মিডিয়াই চোখ বুজে থাকছে, হিজাব পরার মত অত্যন্ত ন্যায্য একটা দাবির প্রতিষ্ঠায় যদি কয়েকজনের মাথা ফাটে, তাতে কীই বা এল গেল।
আর বয়স্করা? তাঁরা পড়েছেন মহা ফাঁপরে। হিজাব, বোরখা তাঁদেরও বেজায় পছন্দ, তা নিয়ে সমস্যা নেই। তাঁদের মহিলারা অসূর্যম্পশ্যা, পাঁচ থেকে পঁচানব্বই, তাঁরা কালো বস্তা না চাপিয়ে রাস্তায় বার হন না, সূর্যের আলো, পুরুষের কুদৃষ্টি কিছুই যেন গায়ে না পড়ে। কিন্তু মুশকিল করেছে এই ইস্কুল কলেজগুলো। এই যে পরীক্ষার বাজারে মাথা ঢাকা মেয়েদের ক্লাসে ঢুকতে দিচ্ছে না তারা, এখন মেয়েগুলো কী করবে। পরীক্ষা না দিয়ে বছর নষ্ট করবে? তাতে অসুবিধে নেই কিন্তু আদালত পছন্দমত রায় না দিলে তো নাক কান মলে সেই স্কুলে গিয়েই ঢুকতে হবে, লেখাপড়া তো আর সত্যি সত্যি এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেওয়া যায় না! অথচ এই যে পরিসর দখলের এত বড় একটা আন্দোলন যাতে সমবেত জাগ্রত মুসলিম উম্মাহ ঝাঁপিয়ে পড়েছে, পাকিস্তান বাইট ফাইট দিচ্ছে, আফগানিস্তান থেকে তালিবানও পিছিয়ে নেই, ওদিকে আবার নোবেলজয়ী মালালা দিদিও টুইট করে ফেলেছেন, সেখান থেকে এইভাবে এত সহজে ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন হলে চলে? ভুললে চলবে না, কানমে বিড়ি, মু মে পান নিয়ে তাঁদের নানা পরনানারাই পাকিস্তানের জন্য ফাইট করেছেন, পবিত্র ভূমি কায়েম করে ছেড়েছেন। হ্যাঁ, তাঁরা সবাই সেখানে যাননি, সে তো এই নাপাক কাফেরগুলোকে ‘পাকজনাবেষু’ করে তোলার কর্তব্যবোধ থেকে। তারপর থেকে সিমি, ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন, পিএফআই, আইএসএফ কত কিছু তৈরি করে, বোমা মেরে, কোতল করে শান্তির ধর্ম বোঝানোর প্রাণপণ চেষ্টা চলছে কিন্তু বেশিরভাগ কাফেরই নেহাত মাথামোটা, শান্তির দাওয়াত গ্রহণ করতে কিছুতেই রাজি নয়। আর এখন তাঁদের পবিত্র খুকিগুলোকে পবিত্রতর করে তোলার প্রচেষ্টায় এই যে হিজাব-জিহাদ, তাতেও তারা সাধ্যমত বাধা দিচ্ছে। কোথাও কিছু না, কথা নেই, বার্তা নেই, গলায় গেরুয়া স্কার্ফ জড়িয়ে স্কুল-কলেজে চলে আসছে, হিজাবি মেয়ে আল্লাহু আকবর স্লোগান দিলে তারাও পাল্টা স্লোগান দিচ্ছে। এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতি, কারবালা যখন এভাবে একেবারে সামনাসামনি, তখন আদালতের ভয়ে হাসান-হুসেন ডাক ছাড়তে ছাড়তে পালিয়ে এলে চলে?
তবে হ্যাঁ, একটা সুবিধে, মেনস্ট্রিম মিডিয়া শেখানো বুলিই বলছে। তারা দিস্তা দিস্তা লিখে টিখে, টিভির পর্দায় কেঁদেকেটে আকাশ ফাটিয়ে বলে চলেছে, হিজাব অতি অবশ্যই ব্যক্তিস্বাধীনতা, গোবেচারা সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অধিকার, যা এই দেশের অসহিষ্ণু মোদী সরকার, অসহিষ্ণুতর যোগী সরকার ও সর্বোপরি অসহিষ্ণু শিরোমণি সংখ্যাগুরু জনতা কেড়ে নিতে চলেছে। সঙ্গে বেরোচ্ছে সাক্ষাৎকার, হিজাব পরিহিতারা কাগজের পাতায় হাসি মুখে বলছেন, এই তো হিজাব পরেই আমি কী সুন্দর বাইক চালাই, আপনারাও মাথা ঢাকা দিন না, যেমন চমৎকার দেখাবে, তেমন চুলে খুশকিও হবে না। বুদ্ধিজীবীর দল এক বাক্যে জানিয়ে দিয়েছেন, হিজাব হল ‘চয়েস’, কর্নাটকের ওই ছাত্রীরা পাঁচ বছর বয়স থেকেই হিজাব পরছে, তাদের পোশাক নির্বাচনের সাংবিধানিক অধিকার খণ্ডন করছে গেরুয়া ভারত। কোনও কোনও অলপ্পেয়ে অবশ্য প্রশ্ন করেছে, যে মেয়ে পাঁচ বছর থেকে হিজাব পরে, তারও হিজাব ‘চয়েস’? কিন্তু সব প্রশ্নেরই উত্তর দিতে হবে, এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে?
আরও একটা সুবিধে আছে। সেটা হল, নরেন্দ্র মোদী সরকার যতটা গর্জেছিল, ততটা বর্ষায়নি এখনও পর্যন্ত। ইন্দিরা গান্ধী থাকলে এই সব হিজাবান্দোলন কী চোখে দেখতেন কে জানে, তবে বিজেপি সরকার কড়া হাতে ঝামেলা ঝঞ্ঝাট দমন করার চেয়ে আদালতের মুখাপেক্ষী হতে বেশি আগ্রহী। রাম মন্দিরই হোক বা সবরীমালা- তারা সব কিছুতেই আদালতের দিকে চেয়ে থাকে। কর্নাটক, যেটা কিনা একশভাগ আইনশৃঙ্খলা জনিত সমস্যা, সেখানেও পুলিশের ডান্ডার বদলে আদালতের কালো কুর্তা তাদের বেশি পছন্দ। আদালত বলেছে, হিজাব আপাতত স্থগিত। যদি উল্টো কথা বলত, তবে হিজাবধারীদের কলেজ-স্কুলে ক্লাস করাতে সম্ভবত কোনও আপত্তিই করত না রাজ্য সরকার। আদালতের কোনও নির্দেশ না থাকা সত্ত্বেও এক কলেজ কর্তৃপক্ষ অতি উৎসাহে তিলকধারী ছাত্রছাত্রীদের কলেজে ঢোকা বন্ধ করে দিয়েছে, মডার্ন হিন্দু রাজ্যে দেখা যাচ্ছে, ফোঁটা কাটাও নিষিদ্ধ।
এমতাবস্থায় হিজাব আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কী? হিজাব পরে, ক্লাস আলো করে লেখাপড়া চালাতে পারবে হিজাবপন্থী ছাত্রীরা? নাকি নাকে খত দিয়ে স্কুল ড্রেস পরার মত গুনাহ করেই ক্লাসে ঢুকতে হবে? সেকুলার দেশের আদালত অবশ্য সংখ্যালঘুদের দাবিদাওয়া সংক্রান্ত রায় দেওয়ার জন্য সংবিধানের থেকে কোরানেই বেশি ভরসা করে, কোরান খুঁটিয়ে দেখা হচ্ছে, হিজাব না পরলে পাপের ফিরিস্তি ঠিক কতটা দেওয়া হয়েছে। তারপর ঠিক হবে, হিজাব ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী না চয়েস। আর তালেগোলে ভুলে যাওয়া হয়েছে ইরানের সেই সূর্যতপাদের কথা, যাঁরা খোলা আকাশের স্পর্শ পেতে হাজার চোখের সামনে হিজাব উড়িয়ে দেওয়ার স্পর্ধা দেখিয়েছেন, শরিয়তের চাবুক, জেলের ভয় কোনও কিছুই যাঁদের মুখ ঢাকতে বাধ্য করতে পারেনি। ভুলে যাওয়া হয়েছে আফগান মেয়েদের কথা, মাথার ঢাকনা একটু সরে গেলে যাঁদের প্রকাশ্যে কোতল করা হয়। এই পরিস্থিতিতে এ দেশের যে মেয়েরা হিজাবে মুক্তি খুঁজছে, হিজাবের প্রয়োজন মিটে গেলে শরিয়তি শাসনের স্বাদ চাখতেও তারা আপত্তি করবে না নিশ্চয়।
Comment here