সাদাকালো রঙমাখা

‘চপল আলোতে ছায়াতে’

আরতি দাসের সঙ্গে প্রথম যেদিন দেখা কথা করতে যাই,সেদিন ম’নে বাড়তি কোনো আবেগ উত্তেজনা সত্যিই ছিল না।

হেমন্ত গবেষক জয়দীপ চক্রবর্তীর সঙ্গে ওঁর পরিচিতির সূত্রেই আমায় নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ‘সন্ধ্যারাতের শেফালী’ বইটি বেরিয়ে গিয়েছে তখন (যদিও আমি জানলাম সেদিন ওঁর বাড়ী গিয়েই) এবং নব্য বা একটাও ছবি না করা কয়েকজন বার্গম্যান(!!),বুনুয়েল(!!) গোত্রীয় পরিচালককে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘এই তো, এবার ত আমি মিস শেফালীর বায়োপিকে হাত দিচ্ছি’। এই অবস্থায় আমার ওঁর বাড়ী যাওয়া এক দারুণ গ্রীষ্মের বিকেলে। যাবার মূল উদ্দেশ্য ছিল,আকাশবাণীর এফ এম গোল্ডের তৎকালীন ‘সিনেমন’ অনুষ্ঠানে ওঁকে গেস্ট ক’রে আনা। দমদম এলাকার এক বিল্ডিংয়ে অপরিসর কিন্তু দারুণ গোছানো ফ্ল্যাট। শেফালী দি ব’সে রয়েছেন, এবং তাঁকে ঘিরে বেশ কয়েকজন অল্পবয়সী চটকদার ছেলেমেয়ে ‘ওঁর মত ডান্সার’ হবে ব’লে শিখতে এসেছে। এফ এম এর অনুষ্ঠানে যাঁদেরই অতিথি ক’রে নিয়ে এসেছি, তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গেই আগে মিট করতে যাবার একটাই উদ্দেশ্য ছিল যে, তাঁদের কথাগুলো শুনে,সেইমত questionnaire ঠিক ক’রে সেটাকে এমন একটা অর্ডারে সাজিয়ে ফেলা যাতে ওই নির্দিষ্ট সময়টুকুতে ম্যাক্সিমাম কথা তিনি বলতে পারেন;কিন্তু এক্ষেত্রে ‘আলো স’রে যাওয়া’ সেলিব্রিটিদের একটা খুব বড় সমস্যা হল, সে সময় অব্দি তাঁদেরকে দিয়ে ইন্টারভিউয়ে যে কথাগুলি বলানো হয়েছে,সেই বৃত্ত থেকে বেরোনো তাঁদের খুব মুশকিল হয়ে পড়ে। আর শেফালী দি’র ক্ষেত্রে তা আরোই, কারণ ভুলে যাওয়া শেফালীকে এ প্রজন্মের কাছে আবার ফিরিয়ে এনেছে ‘সন্ধ্যারাতের শেফালী’ বইটিই। আর, তা প’ড়ে অনেকেই তাঁর কাছে সেই সব রোমাঞ্চকর অধ্যায়ের গল্প শুনতে চেয়েছেন বারবার ; ফলে সেই কথাগুলোই বলতে বলতে শেফালী দি (এবং অন্যদের ক্ষেত্রেও দেখেছি) কেমন যেন ঐ বইটাই মুখস্থ বলছিলেন ম’নে হয়েছে পরবর্তীকালে,বইটি পড়ার পর।

‘সন্ধ্যারাতের শেফালী’তে লেখা ঘটনাক্রমেই এগোতে লাগল শেফালী দি’র বক্তব্য। কোথাও ভুলে গেলে ধরিয়ে দিচ্ছে আশপাশের নাচ শিখতে আসা ছেলেমেয়েরা। আমার অস্বস্তি লাগছে। আমি ত এই ছ’কে ফেলা জীবন বৃত্তান্ত শুনতে আসি নি…
বুঝলাম,প্রথম দিনেই হবে না। ধীরে ধীরে ওপরের জরি,কাগজ,গ্লিটার এর বাঁধন সরবে।অতএব শুনে যাই।শুনছি আর দেখে চলেছি সেই কিন্নরীকে অপলক। শিথিল মুখশ্রী মেদ ভারে আর তেমন সুন্দর নয় তখন,কিন্তু সত্তর পেরিয়েও ত্বক যেন কথা বলছে। একটা ওয়াইন রঙের শাড়ী প’রে ব’সেছিলেন সেদিন।তবে কথা বলতে বলতে প্রতিমূহুর্তেই হারিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। এত বছরের শ্রমে,ক্লান্তিতে,জীবনকে বুঝতে গিয়ে মূঢ় প্রতিপন্ন হবার বিস্ময়ে,আঘাতে একটানা একটা বাক্যও ব’লে উঠতে পারছিলেন না।শব্দ,খেই – হারিয়ে যাচ্ছিল বারবার। নিজের নানারকম অসুস্থতার কথাও আসছিল। কথায় কিথায় এও জানালেন যে সমসময়ের এক প্রথম সারির নায়িকা মেডিকায় তাঁর ফ্রি চিকিৎসার ব্যাবস্থা ক’রে দিয়েছেন ব’লে তিনি কিঞ্চিৎ নিশ্চিন্ত। থেমে থেমে, আবার অনেকটা আগে থেকে শুরু ক’রে, ভুলে যাওয়া জিনিষ ম’নে ক’রে ক’রে তাঁর কথা এগোচ্ছিল।ঘিরে থাকা শিক্ষার্থী ডান্সাররা ততক্ষণে অন্য ঘরে গিয়ে চটুলতায় মেতেছে। আরতী দি, কয়েকবার তাঁর সাহায্যকারিণীকে ‘ওদের চুপ করতে’ ব’লতে ব’লে ১৯৫০-‘৫১,’৫২ এ ফেরার চেষ্টা করছিলেন।

একটা উদ্বাস্তু পরিবারের প্রায় নিরন্ন বালিকা মায়ের সঙ্গে বাসন মেজে বেড়াত আর উত্তর কলকাতার গঙ্গার ধারের ঝুপড়িতে ফিরে আসত মাঝে মধ্যে কাজের বাড়ি থেকে পাওয়া তরকারি দিয়ে সকালে মায়ের ফুটিয়ে রাখা একগাল ভাত মেখে খাবে ব’লে।আমি ন’ড়েচ’ড়ে সজাগ হ’য়ে ব’সি। এই মেয়েটাকে খুঁজতেই ত’ আমার এই গলদঘর্ম দিনে এই এত্তটা পথ পেরিয়ে আসা,নাহলে নিয়মমাফিক কাজ ত’ ফোনেই সারা হয়ে যেত।

বাড়ন্ত গড়নের পরিচারিকা বাড়ীর সেই মেয়ে প্রথম ছন্দ খুঁজে পায় কি ভাবে?…

আনমনা হয়ে যান আরতী দি আবারও। হঠাৎ ক’রে কিছু একটা খুঁজে পাওয়ার শিশু আনন্দে ঝিকমিক ক’রে ব’লে ওঠেন, ‘কবে জানো? কবে জানো?? আরে আমি ত, ওই ফুটপাথ হয় না,ফুটপাত?

কাজের বাড়ীতে মায়ের হাতে হাতে কাজ করার জন্য যখন এ বাড়ী থেকে ও বাড়ী করতাম, তখন তিড়িংতিড়িং ক’রে একবার ফুটপাতে উঠতাম, একবার রাস্তায় নামতাম, আর আমার এটা করতে খুব ভাল লাগত, জানো..এত পথ হাঁটার কোনো কষ্টই আমার গায়ে লাগত না। আমার ম’নে হয় আসলে তখন নাচটাই আমার পায়ে আসত।তাই হাঁটাটা আর হাঁটা নয়, নাচ হ’য়ে যেত। আর নাচে ত আমার কোনোদিনই এক মূহুর্তের জন্যও ক্লান্তি নেই। “

এর পরের পর্ব আবার ‘সন্ধ্যারাতের শেফালী’ পাতা ধ’রেই এগোয়।অ্যাংলো পরিবারে কাজ করতে কর‍তে নাচ দেখা,শেখা ইত্যাদি। আসে তাঁর প্রথম পাব্লিক পারফরম্যান্স এর কথা।তৎকালীন অর্থাৎ ষাটের দশকের কলকাতায় হোটেল,পাব মাতিয়ে রাখা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান নাচিয়েদের ভীড়ে প্রথম ভারতীয় নর্তকীর নাচ।শুধু নাচই বা বলি কেন,তার সঙ্গে অমন দেহসৌষ্ঠবের অনাস্বাদিতপূর্ব মোহনীয়তায় দর্শককূলকে আবিষ্ট ক’রে রাখার সাফল্যে সারাদিনের উৎকণ্ঠা আর দেহের ক্লান্তি অনুভব করার ফুরসত মেলেনি সেদিন গভীর রাত অব্দি।

নিজের ঘরে এলেন যখন,সে আর এক ভয়ের ব্যাপার হল। কোথায় বসবেন,কোথায় শোবেন! – বিলাসশীর্ষ কক্ষের চোখধাঁধানো ঐশ্বর্য্যে এতদিনের বস্তিবাসের অভ্যাস বড় সমস্যায় ফেলল। যাই হোক, সে পর্বের সমাধা হতেই পেট তরকারি মাখা ভাতের গ্রাসের প্রয়োজন জানান দিতে থাকল উচ্চকিতভাবেই।

এমন সময়ে ঘরের বাইরে নক।দরজা খুলতেই একটা ছোট ‘গাড়ী মতন জিনিষে কত কি সব নিয়ে দুজন ঢুকল’।হ্যাঁ,খাবার ভর্তি ডিনারের ট্রলি ঠেলে ঢোকা বেয়ারাদের দেখে এটাই ছিল তাঁর সেদিনের ভাবনা।

বিরক্তিতে ভরে গেল ভেতরটা। কোথায় কাঁচা সর্ষের তেল,পেঁয়াজ দিয়ে তরকারি মেখে কাঁচালঙ্কা কামড়ে ভাত খাবার জন্য প্রাণটা প’ড়ে রয়েছে, সেখানে এই হু হু ক্ষিদের সময়ে এত যন্ত্রপাতি, এত হ্যাঙ্গাম!!..

” ছুরিকাঁচি ধরা ছেড়েই দাও, আদ্দেক পাত্র কিভাবে কোনদিক দিয়ে খুলব, ধরব -তাইই ভেবে পাই না”। অবশেষে হাতড়াতে হাতড়াতে এক জায়গায় পেয়ে গেলেন ম্যাশড পটাটো। এক মন হাসি নিয়ে আরতী দি আবার ডাকলেন বেয়ারাদের। “গ্রিণ চিলি হ্যায়,গ্রিণ চিলি?? ও চাইয়ে মুঝে”। বেয়ারারা কাঁচালঙ্কা এনে দিয়ে যেতেই,সোজা দরজা লক ক’রে দিলেন ভেতর থেকে।” তারপর জানো, খাটের ওপরের নরম সব তুলেটুলে দিয়ে পা মুড়ে বাবু হ’য়ে ব’সে ঐ ট্রলিটা টেনে নিলাম।তিনরকম রাইসের মধ্যে সাদা ভাতও ছিল দেখেছিলাম। ব্যাস, ওই আলু দিয়ে ভাত মেখে সালাড থেকে পেঁয়াজগুলো তুলে নিয়ে, আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে আহ,কি ভাল যে খেলাম,তোমায় কি বলব!!”।

তারপর বেয়ারাদের আবার ডেকে সব নিয়ে যেতে বললাম যখন, ওরা ত অবাক!দেখছে আর ভাবছে আমি কিছুই খাই নি কেন”…

গ’ড়ে দেওয়া শেফালী ছাঁচের বাইরের আরতীকে সবে দেখতে পেতে শুরু করছি ম’নে হল।

যার সবটার শেষে বড় দুঃখ হ’তে লাগল।বড় বিষণ্ণতায় কেবলই ম’নে হ’তে লাগল যৌবন,লাস্য,বৈভব, প্রাচুর্য্যের খোলসের ভিতরের প্রাণটার খোঁজ রাখে নি কেউউ কোনোদিইন।

সেই আরতীর কথা লিখব পরের পর্ব।

সঙ্গে থাকুন কাঞ্জিকের………………..

Comment here