ব্রহ্মানন্দং পরমসুখদং কেবলং জ্ঞানমূর্তিং
দ্বন্দ্বাতীতং গগনসদৃশং তত্ত্বমস্যাদিলক্ষ্যম্।
একং নিত্যং বিমলমচলং সর্বধীসাক্ষীভূতং।
ভাবাতীতং ত্রিগুণরহিতং সদগুরুং তং নমামি।।
স্বামীজীত্তোর বঙ্গদেশ তথা সমগ্র ভারতবর্ষব্যাপী হিন্দু জাতির স্বার্থরক্ষায় এবং তাদের মধ্যে একতা ও মহামিলনের বাণী নিয়ে এসেছিলেন যুগাবতার স্বামী প্রণবানন্দজী, আমাদের পরম পূজনীয় গুরুমহারাজ। ইংরেজ শাসকের শোষণের বিরুদ্ধে যখন সমগ্র বাঙ্গালী হিন্দু এককাট্টা, সেইসময়ই শাসক ইংরেজ তাঁদের কূটনৈতিক চালে হিন্দু-মুসলিম সমাজের মধ্যেকার ফারাক ও ভিন্নতাকে বিভাজন ও বিরোধিতায় পর্যবসিত করে। মুসলিম সংখ্যাধিক্য বঙ্গদেশের গ্রামাঞ্চলগুলিতে শাসকের প্রশ্রয়ে হিন্দুদের ওপর লাঞ্ছনা ও অত্যাচার ক্রমশই অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে কংগ্রেস-সহ অন্যান্য রাজনৈতিকদলগুলির নেতৃবৃন্দও একই ভাবে শাসক ইংরেজের বিভাজন ও তোষণনীতির পদাঙ্ক অনুসরণ করায় বাঙ্গালী হিন্দুদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা তলানিতে পৌছেছিল। আর বাংলার হিন্দুসমাজের মধ্যে বর্ণবাদজনিত অনৈক্যই ক্রমশ শাসক ইংরেজের প্রশ্রয়ে তৎকালীন বাংলার সংগঠিত মুসলিম সমাজের একচ্ছত্র রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের আকাঙ্খাকে অতুলনীয় সাফল্যে পরিণত করে; যার ফলশ্রুতি আজকের বিভক্ত বাংলা এবং কার্যত হিন্দুশূন্য বাংলাদেশ। ১৯০৫ সাল থেকে বাঙ্গালী হিন্দুর অন্তর্জলিযাত্রার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তা আজও অব্যাহত। একদা ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বভাগ যে জনজাতির সমাজ-সংস্কৃতি আবাসভূমি ছিল তা এখন সম্পূর্ণভাবে বিজাতীয় বৈদেশিক সংস্কৃতি দ্বারা অধিকৃত।
বাঙ্গালী হিন্দুর নিরন্তর পরাজয় ও চরম দূর্যোগের সময়ে সমগ্র হিন্দুসমাজকে ক্ষাত্রশক্তিতে দীক্ষিত করার নবমন্ত্র নিয়ে সন ১৩০২-এর ১৬ই মাঘ বুধবার মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে (ইংরাজি ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে ফেব্রুয়ারি) আবির্ভূত হয়েছিলেন জগৎগুরু যুগাচার্য্য শ্রীশ্রীস্বামী প্রণবানন্দজী। আশ্রয়হীন, অভিভাবহীন দুর্বল বাঙ্গালী হিন্দুসমাজকে কোন সংকীর্ণ অর্থে নয়, তিনি হিন্দুজাতিকে তার মর্ম্মমূলে পৌঁছতে, মানুষকে সকল অর্থেই প্রকৃত ‘মানুষ করে’ তুলতে চেয়েছিলেন। হিন্দুসমাজকে তার ভিতরের অনাচার-অবিচার-ছুতমার্গ-বিলাস ব্যসন এবং রিপুআদি থেকে মুক্ত করে, ইন্দ্রিয়সংযম, লোকসেবা ও শক্তিঅর্জনের মাধ্যমে প্রকৃত ধর্মসাধন ও ধর্মপালনের বাণী নিয়ে এলেন। হিন্দুসমাজ একমাত্র তার ভিতরের দুর্বলতা, ভীরুতা, কাপুরুষতার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে, রজোগুণের অর্চনার মধ্যে দিয়েই স্বীয় সমাজের অস্তিত্ব ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। স্বামী বিবেকান্দ চেয়েছিলেন হিন্দুসমাজের মধ্যে রজোগুণের প্রবল উদ্দোপনা; আর এইখানেই যেন আমরা গুরুমহারাজের ভাবনার সাথে স্বামীজীর ভাবনার আশ্চর্য মিল অনুভব করি। গুরুমহারাজ বিংশ শতাব্দীতে বাঙ্গালী হিন্দুজাতিকে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানিয়েছিলেন যাতে আমরা পরস্পর পরস্পরের প্রতি সেবাদর্শের মনোভাব এবং ভেদবুদ্ধিরোহিত দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে পারি; হিন্দুজাতির ক্ষাত্রশক্তি জাগরণ তখনই সম্ভব হবে যখন আমরা সমস্ত আত্মসুখ ও শুচিতা ত্যাগ করে পরস্পরের দুঃখ নিরসনে একত্রিত হব। হিন্দুসমাজের দোষ-ত্রুটি-দুর্বলতাগুলি সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় এত গভীরে নিমজ্জিত যে হিন্দুতীর্থস্থান গুলিই এক একটি হয়ে উঠেছিল ব্যাভিচার-দুর্নীতির কেন্দ্রভূমি; যার প্রভাবে আজ হিন্দুসমাজ নিজস্ব আত্মমর্যাদা ধর্ম-সংস্কৃতি-সম্পত্তি রুক্ষার সংগ্রামেও পলায়নমুখর আত্মসমর্পনকারী।
আচার্যদেব আমাদের শুধুমাত্র পরলোকসর্বস্ব ধর্মের বাণীতে নয়; অনুভব করাতে চেয়েছিলেন সেই শাশ্বত বাণী – আদর্শ গার্হস্থ্যজীবন কখনই ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, সমাজকেন্দ্রিক। লোকহিতার্থেই হিন্দুসমাজের যুবসম্প্রদায়কে দেশের জাতির শক্তিবৃদ্ধিতে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বারংবার আমাদের স্মরণ করিয়েছেন ভারতবর্ষের আত্মা সনাতন ধর্ম সংস্কৃতির মধ্যেই গ্রথিত। আমরা আমাদের পূর্বপুরুষের অর্জিত জ্ঞান-শক্তি সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছি নিজের নিজের আত্মসুখ ও চারিত্রিক দুর্বলতার কারণে। তাই তিনি ত্যাগী, সংযমী, নির্ভীক সন্ন্যাসীদল গঠন করে হিন্দুসমাজকে শক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন দুর্যোগের দিনে সহায়-সম্বলহীন নিপীড়িত-লাঞ্ছিত-বিপন্ন হিন্দুসমাজকে যেমন সেবাধর্মের দ্বারা পরিত্রাণ করতে হবে, তেমনি হিন্দুসমাজ যেন অত্যাচার-অপমান-লাঞ্ছনা-নিপীড়নের বিরুদ্ধে ক্ষাত্রধর্ম পালনে সক্ষম হয়। এই জন্যই তিনি তার ভক্তদের মধ্যে লাঠিখেলা, ব্যায়ামচর্চা, সশস্ত্র নৃত্য-গীতের প্রচলন করেছিলেন; যার অর্থ ছিল শক্তি আরোধনা। দুর্গা দশ-প্রহরণ-ধারিণী, তিনিই রিপুদলবারিণী এই বাণীমন্ত্র বাঙ্গালী হিন্দুর দুর্গাপূজার মধ্যে সশস্ত্র অর্চনার প্রচলনের মাধ্যমে শক্তিচর্চার আদর্শকে নূতনমাত্রা প্রদান করেছিল। যদিও আজ আমরা শক্তিচর্চার সেই আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে দুর্গাপূজাকে উৎসবে রূপান্তরিত করেছি!
শ্রীশ্রীস্বামী প্রণবানন্দজীর সাধন জীবন, কঠোর যোগসাধনা এবং মানব হিতৈষণায় জনসেবাদর্শের ব্রতর মাধ্যমেই হিন্দুসমাজের তীর্থস্থানগুলির সংস্কার সাধন সম্ভব হয়েছিল। অল্পসংখ্যক সন্ন্যাসীদের নিয়েই গুরুমহারাজ কলিকাতা, মাদারীপুর, বাজিতপুর,সাতক্ষীরা, আশাশুনী, খুলনাসহ বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে সেবাশ্রম সংঘ স্থাপনের মাধ্যমে বাঙ্গালী হিন্দুসমাজের মধ্যে এক অভূতপূর্ব আত্মশক্তির জাগরণ ঘটেছিল। এই জাগরণ শুধু বাংলাপ্রদেশেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা ক্রমশ সমগ্র ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পরেছিল। হিন্দুসমাজের মধ্যেকার বিভেদ-মতপার্থক্য ছুতমার্গ বিসর্জন দিয়ে সার্বিক মিলন এবং সংঘশক্তি মাধ্যমে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত করুক, এই ছিল আচার্যদেবের অভীষ্ট এবং একমাত্র লক্ষ্য। বাংলার সর্বত্র হিন্দুরা যেন তাদের মধ্যেকার দলাদলি ভুলে, ছুতঃমার্গ ভুলে হিন্দু মিলন মন্দিরে যেন সকলে একত্রিত হয় তার জন্যই তাঁর মহাপ্রস্থানের শেষ বছরগুলিতে সর্বক্ষণ তিনি নিয়োজিত ছিলেন হিন্দুসমাজের স্বাধীনতা,আত্মমর্যাদা রক্ষায়, এই জন্যই তাঁর উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল হিন্দুরক্ষী বাহিনী। বর্তমান ভারতবর্ষ তথা খন্ডিত ভারতে আরেকবার আজ এই মাঘী পূর্ণিমার তাঁর পূণ্য আবির্ভাব তিথিতে বাঙ্গালী হিন্দু সমাজের একজোট হওয়ার প্রয়োজন। দলাদলি আর সাময়িক রাজনৈতিক ক্ষমতার আকাঙ্খায় হিন্দুবিদ্বেষীরা আজ ঐক্যবদ্ধ, বাঙ্গালী হিন্দুর সর্বশেষ আবাসভূমি এই পশ্চিমবঙ্গকে আরব-পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদীদের দখলমুক্ত করতে আজ আমরা সকলে একজোঁট হই, শক্তিসঞ্চয় করে বিজাতীয়দের হাত থেকে পবিত্র মাতৃভূমিকে রক্ষায় সক্ষম হই। এই প্রতিজ্ঞা এই সংকল্প নিয়ে আমরা আজ শ্রীশ্রীগুরুমহারাজের আবির্ভাব দিবসে তাঁর উপসনায় রত হই; সমস্ত শক্তিদিয়ে আমরা হরিনাম নাম-সংকীর্তন সহযোগে আসন্ন বাঙ্গালী হিন্দুর মুক্তিসাধনায় লিপ্ত হই।
“যত পূজা তুমি করেছ হিন্দু পরে নাই, মোর পায়ে,
হীনবীর্য্যের ক্লীবতার পূজা স্বীকার করিনা তায়।
অত্যাচারের প্রতিরোধে যবে
ভীম প্রতিজ্ঞা লও যদি সবে
সেই দিনে তব প্রার্থনা-ধ্বনি পশিবে আমার কাণে।
শুধু ফুলে পূজা নেবো না এবার কাতর কাকুতি গানে।”
প্রত্নতত্ত্ববিদ, গবেষক ও সমাজকর্মী। । এবং বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের সক্রিয় কর্মী।
Comment here