-শ্রী সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়
কয়েন দেখতে দেখতে মনে পড়ে গেল বাসবদত্তার কথা। সেই বাসবদত্তা, রূপের অহমে যিনি মত্ত। একদিন বাসবদত্তার প্রেমকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সন্ন্যাসী উপগুপ্ত। ঠিক ফিরিয়ে দেননি, তাঁর দূতকে বলেছিলেন, সময় হলেই তিনি বাসবদত্তার কাছে যাবেন। কথা রেখেছিলেন উপগুপ্ত। কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত পরিত্যক্তা বাসবদত্তার সেবা করেছিলেন তিনিই। মৌর্য সম্রাট অশোকের ধর্মীয় গুরু ছিলেন উপগুপ্ত।
একটা সময় ছিল যখন কুষ্ঠ মানে লোকে মনে করতেন অভিশাপের ফল। এজন্মে পাপ না করে থাকলে গতজন্মের পাপের ফলে কুষ্ঠ হয়েছে। কিন্তু মুদ্রার সঙ্গে এর কী সম্পর্ক সে কথায় আসছি। আসলে শুধু হারানো সভ্যতার কথা নয়, হারানো অসভ্যতা, ভ্যান্ডালিজমও উঠে আসে মুদ্রা নিয়ে আলোচনা করার সময়।
বাসবদত্তাকে শহরের বাইরে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিল, কারণ তখন ধারণা হয়েছিল ঈশ্বরের অভিশাপেই এমন হয়েছে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (জন্ম ১৪৪৬ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দ) দেখা করেছিলেন বাসুদেব বিপ্রর সঙ্গে, বাসুদেব বিপ্রও কুষ্ঠরোগী ছিলেন। মধ্যযুগে কুষ্ঠরোগীদের একঘরে করে রাখতে কলোনি তৈরি করা হয়েছিল যাতে সেই রোগ ছড়িয়ে পড়তে না পারে। ভারত তো বটেই, ইউরোপেও এমন অনেক কলোনি ছিল বলে জানা যায়।
কুষ্ঠ যে অভিশাপ ছিল সে কথা অনস্বীকার্য। এই রোগ ছিল সামাজিক অভিশাপ। অশোকের সময় মানে তো খ্রিস্টপূর্ব সময়ের। কিন্তু হাল আমলেও কলোনি তৈরি করে সেখানে আলাদা মুদ্রা তৈরি করেছে এমন উদাহরণও আছে। লোকের ধারণা ছিল, টাকা-পয়সা থেকেও কুষ্ঠ ছড়ায়। করোনার সময়েও এমন রটনা হয়েছিল। তাই বাড়িতে বাড়িতে খবরের কাগজ নেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কেন এমন হয়েছিল তা অবশ্য বলা মুশকিল।
কুষ্ঠ যে অভিশাপ নয়, ব্যাকটেরিয়া ঘটিত একটি রোগ তা ১৮৭৩ সালে আবিষ্কার করেছিলেন নরওয়ের বিজ্ঞানী গের্হার্ড হেনরিক আর্মুয়ের হ্যানসেন। তাঁর নামে এই রোগের নাম হয় হ্যানসেনস ডিসিজ। তিনি বলেছিলেন, শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে এই ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করলে তা থেকে কুষ্ঠ হতে পারে। তিনি এই রোগের জীবাণুর নাম দিয়েছিলেন মাইক্রোব্যাকটেরিয়াম লেপ্রি। প্রাচীন গ্রিসে লেপ্রা বলতে এমন এক রোগের কথা বোঝাত যে রোগের ফলে ত্বক হয়ে যেত আঁশের মতো। আধুনিক গবেষণার ফল অনুযায়ী ৯৫ শতাংশ মানুষের শরীরেই এই রোগ প্রতিরোধের স্বাভাবিক ক্ষমতা রয়েছে।
১৮৯৭ সালে জার্মানির বার্লিনে প্রথম লেপ্রসি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। ১৯০১ সালে কলম্বিয়ায় লেপ্রোসারিয়াম বা লেপার কলোনিতে ব্যবহার করার জন্য তৈরি হয় আলাদা মুদ্রা। লেজার হাউসে সেই মুদ্রা চালু করা হয়। এই মুদ্রা ব্যাঙ্কেও বিনিময়যোগ্য ছিল। মানে রোগীর মৃত্যু হলে তাঁর কাছে থেকে যাওয়া মুদ্রা বদল করে সাধারণ মুদ্রা নেওয়া যেত। বিশ্বের ঠিক কোথায় কোথায় এই ধরনের মুদ্রা ছিল তার সহজ লেখাজোখা কিছু নেই। এমন মুদ্রা চালু ছিল ফিলিপিন্সেও। তবে যতদূর জেনেছি বিভিন্ন সময়ে ব্রাজিল, চিন, কোস্টারিকা, কোরিয়া ও নাইজেরিয়াতেও এণন মুদ্রা চালু করা হয়েছিল। পানামা চ্যানেলে এমন মুদ্রা চালু করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। ১৯০১ থেকে ১৯৫৫ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময় এগুলি চালু ছিল।
১৯৩৮ সালে গর্ডন আলেকজান্ডার রাইরি নামে এক বিজ্ঞানী মালয়েশিয়ায় গবেষণা করে প্রমাণ করেন, টাকাপয়সার মাধ্যমে মাইক্রোব্যাকটেরিয়াম লেপ্রি (কুষ্ঠ বা লেপ্রসির জন্য এটিই দায়ী) ছড়ায় না। তাই শোনা যায়, লজ্জা ঢাকতে মালয়েশিয়া সরকার কুষ্ঠ কলোনি বা লেপার কলোনির জন্য ছাপানো ও সেখানে ব্যবহার করা সব কাগুজে মুদ্রা পুড়়িয়ে ফেলেছিল।
এখানে আমার সংগ্রহে থাকা কলম্বিয়ার দুটি মুদ্রার ছবি দেওয়া হল। এমন মুদ্রা সংগ্রহ করা বেশ কঠিন। আসলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলি এইসব মুদ্রা যথাসম্ভব নষ্ট করে ফেলেছে। তবে তারা সেই ইতিহাস মুছে ফেলতে পারেনি।
(লেখক পরিচিতি – প্রাক্তন সাংবাদিক, বর্তমানে ভাষাতত্ত্ববিদ; ইতিহাস চর্চা ও মুদ্রা সংগ্রহ তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান অঙ্গ)
Comment here