– প্রজ্ঞাপারমিতা
তাঁর সঙ্গে যাঁরা প্রাণ দিয়েছিলেন তাঁরা দেশপ্রেমী হিসেবে ভারতজুড়ে সমাদৃত। তিনি শুধু ব্যতিক্রম। দেশ তো দূরের কথা, যে রাজ্য, যে জাতি থেকে তিনি উঠে এসেছিলেন তারাই তাঁর নাম জানে না। শুধু উত্তরপ্রদেশের এক অখ্যাত স্টেশন কাকোরীর সঙ্গে অনন্তকালের মতো জুড়ে গিয়েছেন রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ী। কাকোরী ট্রেন ডাকাতি মামলা পণ্ডিত রামপ্রসাদ বিসমিল, আসফাকুল্লা খান, ঠাকুর রোশন সিংকে অমরত্ব দিয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিয়ে যত সিনেমা হয়েছে তার সিংহভাগের নায়ক ভগৎ সিং। ছবির প্রয়োজনে দেখা গিয়েছে চন্দ্রশেখর আজাদ, বিসমিল, আসফাকুল্লার মত প্রাতঃস্মরণীয় বিপ্লবীদের। শুধু নেই রাজেন্দ্র লাহিড়ী। তাঁদেরই সঙ্গে, বরং তাঁদের ক’দিন আগে যাঁর ফাঁসি হয়েছিল। পাবনার সেই ছেলেটি শুধু মিশে গিয়েছেন অপরিচয়ের অন্ধকারে।
অবশ্য সর্বত্র এমনটাই ছবি এ দাবি করলে অন্যায় হবে। এ রাজ্য ভুলে গেলেও রাজেন্দ্র লাহিড়ীকে সগৌরবে বরণ করে নিয়েছে উত্তরপ্রদেশের গোন্ডা। সেই জেলা যেখানকার জেলে রাজেন্দ্রর ফাঁসি হয়েছিল। প্রতি বছর ১৭ ডিসেম্বর গোন্ডা জেলা প্রশাসন সসম্মানে পালন করে লাহিড়ী দিবস। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় নানা অনুষ্ঠান হয়, জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকে। ঐতিহাসিক সেই ফাঁসির মঞ্চ ফুল দিয়ে সাজানো হয়, বৈদিক রীতি মেনে হয় যজ্ঞ। আসেন অসংখ্য মানুষ, কাকোরী বিপ্লবের প্রথম শহিদকে শ্রদ্ধা জানাতে।
রাজেন্দ্র লাহিড়ী। বর্ণ প্রথার বিরোধী ছিলেন, পৈতে পরতেন না। খাবারদাবারে বাছবিচার ছিল না, আপত্তি ছিল না গরু, শুয়োর কোনও কিছুতেই। ছিল না ঈশ্বর বিশ্বাসও। অথচ এই রাজেন্দ্র লাহিড়ীই ফাঁসির দিন ভোরে অন্যান্য দিনের মত ব্যায়াম করছিলেন। যূপকাষ্ঠে নিয়ে যেতে আসা জেলের সুপার অবাক হয়ে কারণ জিজ্ঞেস করেন। রাজেন্দ্র বলেছিলেন, আমি হিন্দু, পুনর্জন্মে আস্থা রাখি। এ জন্মে যে কাজটা অসম্পূর্ণ রেখে যাচ্ছি তা আগামী জন্মে সম্পূর্ণ করার জন্য স্বাস্থ্যবান শরীর চাই। প্রবাসী হয়েও বাংলা সাহিত্যে অত্যন্ত আগ্রহী এই যুবক বেনারস থেকে বার করতেন ‘অগ্রদূত’ নামে হাতে লেখা একটি পত্রিকা। মায়ের নামে বেনারসে খুলেছিলেন বাংলা বইয়ের লাইব্রেরি। কিন্তু পাবনার ক্ষিতীশমোহন লাহিড়ীর ছেলে কীভাবে এসে পড়লেন বেনারসে? ইতিহাস বলছে, রাজেন্দ্রর জন্ম ১৯০১-এ, পাবনার ভারেঙ্গা গ্রামে। বাবা অনুশীলন সমিতির সদস্য ছিলেন, পুলিশের দৃষ্টি এড়াতে ৯ বছরের ছেলেকে পাঠিয়ে দেন বেনারসে মামার বাড়িতে। তখন থেকে বেনারসই হয়ে ওঠে তাঁর ঘরবাড়ি, যুক্ত হন অনুশীলন সমিতির স্থানীয় শাখার সঙ্গে। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে এম এ পড়ছিলেন, প্রবন্ধ লিখতেন অনুশীলনের স্থানীয় মুখপত্র বঙ্গবাণীতে। তখন বিপ্লবী শচীন্দ্রনাথ সান্যালের সংস্পর্শে আসা। শচীন সান্যাল তাঁর হাতে বেনারস অনুশীলন সমিতির দায়িত্ব তুলে দেন, তাঁর মাধ্যমেই রাজেন্দ্রর পরিচয় হয় রামপ্রসাদ বিসমিলের সঙ্গে। বিসমিলের হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন আর অনুশীলনের মুখ্য সমন্বয়কারী হয়ে ওঠেন রাজেন্দ্র লাহিড়ী। অনুশীলনের বেনারস শাখার দায়িত্ব সামলানোর পাশাপাশি তিনি ছিলেন অ্যাসোসিয়েশনের প্রাদেশিক কাউন্সিলের বেনারস বিভাগের প্রতিনিধিও।
হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের গোপন বৈঠকে নিয়মিত যেতেন রাজেন্দ্র। অ্যাসোসিয়েশন তখন অর্থকষ্টে ভুগছে, সমস্যা হচ্ছে অস্ত্রশস্ত্র জোগাড়ে। সে সময় বিসমিল একদিন শাহজাহানপুর থেকে ট্রেনে করে লখনউ যাওয়ার সময় খেয়াল করেন, ট্রেনে করে সরকারি রাজস্বের টাকা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তখনই তৈরি হয় ঐতিহাসিক কাকোরী ট্রেন ডাকাতির ভিত।
১৯২৫-এর ৯ অগাস্ট ঘটে কাকোরী ট্রেন ডাকাতি। ঠিক তার আগের রাতে শাহজাহানপুরের ঘাঁটিতে এ নিয়ে চূড়ান্ত পরিকল্পনা করেন হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন ও অনুশীলন সমিতির সদস্যরা। বৈঠকে বেনারস থেকে যোগ দিতে যান রাজেন্দ্র লাহিড়ী ও ১৭ বছরের কিশোর মন্মথনাথ গুপ্ত। কলকাতা থেকে শচীন্দ্রনাথ বক্সী, কেশব চক্রবর্তী, উন্নাও থেকে চন্দ্রশেখর আজাদ, শাহজাহানপুর থেকে আসফাকুল্লা খান। ছিলেন আরও কয়েকজন বিপ্লবী এবং স্বয়ং বিসমিল। ঠিক হয়, পরদিনই ৮ নম্বর ডাউন প্যাসেঞ্জার ট্রেনের গার্ডের কামরায় রাখা সরকারি অর্থ লুঠ করা হবে।
তার পরের ঘটনা ইতিহাস। ৯ তারিখ রাত আটটার পর কাকোরী ছেড়ে বেশ খানিকটা এগিয়েছে ৮ নম্বর প্যাসেঞ্জার ট্রেন। সে সময় চেন টেনে ট্রেন থামিয়ে দেন রাজেন্দ্র লাহিড়ী। বিভিন্ন বগি থেকে রিভলভার হাতে নেমে আসেন কয়েকজন যুবক। চন্দ্রশেখর ও আসফাকুল্লা গার্ডের কামরা থেকে বার করে আনেন তালা দেওয়া বিরাট লোহার সিন্দুক। ছেনি, হাতুড়ি দিয়ে বাক্স ভাঙা যাচ্ছে না দেখে এগিয়ে আসেন আসফাকুল্লা। হাতুড়ির বাড়িতে তিনি বেশ কিছুটা ভেঙে ফেলেন সিন্দুকের ওপরটা। বার করে আনা হয় টাকার থলিগুলো। সব মিলিয়ে লুঠ হয়ে যায় আট হাজার তিনশোর কিছু বেশি টাকা।
পরিমাণ হিসেবে এখন এমন কিছু টাকা নয়। কিন্তু সে সময় এই অর্থ বেশ ভাল অঙ্কের ছিল। তারপর লুঠ হয়েছে খোদ ব্রিটিশ রাজের নাকের ওপর। ফলে তদন্তের দায়িত্ব পায় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া একটা চাদরের সূত্র ধরে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দারা বিসমিলের নাম জানতে পারেন। শুরু হয় ধরপাকড়। ২৬ সেপ্টেম্বর ধরা পড়েন রামপ্রসাদ বিসমিল ও রোশন সিং। আর ১০ নভেম্বর দক্ষিণেশ্বরের বাচস্পতিপাড়া থেকে গ্রেফতার হন রাজেন্দ্র লাহিড়ী।
তবে কাকোরী মামলায় নয়, রাজেন্দ্র ধরা পড়েছিলেন দক্ষিণেশ্বর বোমা মামলায়। বিসমিলের কথায়, বোমা তৈরির কৌশল শিখতে রাজেন্দ্র বাচস্পতিপাড়ায় আসেন। আচমকা বোমা ফেটে ধরা পড়েন সবসুদ্ধ ৯ জন, সঙ্গে বোমা তৈরির মালমশলা। মামলায় তাঁর ১০ বছরের জেল হয়। কাকোরী মামলা শুরু হওয়ার পর আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় লখনউ। মামলার পাবলিক প্রসিকিউটর ছিলেন জগৎনারায়ণ মুল্লা, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর শ্যালক। মামলায় রাজেন্দ্র লাহিড়ীর প্রথমে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়, আপিলে সেটা কমে দাঁড়ায় ৫ বছরে। কিন্তু ব্রিটিশ সম্রাটের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ ঘোষণার দায়ে নতুন করে আটঘাট বেঁধে মামলা সাজায় পুলিশ। তিনি যে চেন টেনে ট্রেন থামিয়েছিলেন তার বেশ কয়েকজন সাক্ষী ছিল। তারা আদালতে এসে তাঁকে সনাক্ত করে। ফলে রাজদ্রোহিতার অভিযোগে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ফার্স্ট সেশন কোর্টে ফাঁসির সাজা পান বিসমিল, রাজেন্দ্র লাহিড়ী ও রোশন সিং। সাপ্লিমেন্টারি সেশন কোর্টে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় আসফাকুল্লা খানকে।
প্রথমে সবাইকে রাখা হয় লখনউ সেন্ট্রাল জেলে। কিন্তু বিসমিল নাকি কয়েকজনকে নিয়ে জেল থেকে পালানোর পরিকল্পনা শুরু করেন। তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন স্বয়ং সূর্য সেন। কোনওভাবে তা জেনে ফেলে পুলিশ। মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত চার আসামীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভিন্ন ভিন্ন জেলে। তখন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত রাজেন্দ্রর ঠিকানা ছিল গোন্ডা জেল।
এর মধ্যে বিসমিল উপলব্ধি করেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে আরও বেশি আঘাত হানতে হলে মৃত্যু নয়, অনেক বেশি জরুরি তাঁদের বেঁচে থাকা। আসফাকের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর তাঁরা ঠিক করেন, মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা রোধে আপিল করবেন। চিফ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে মার্সি পিটিশন দাখিল করেন বিসমিল, রোশন সিং ও আসফাকুল্লা। চেয়েছিলেন, মৃত্যুদণ্ড রদ হয়ে যাতে দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড হয়, যাতে জেল থেকে খালাস পেয়ে আবার ঝাঁপাতে পারেন মুক্তি সংগ্রামে। আসফাকুল্লার মা ভাইসরয়ের কাছেও ছেলের মৃত্যুদণ্ড রদের আর্জি জানান। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন রাজেন্দ্র লাহিড়ী। প্রাণভিক্ষা চাওয়া তো দূরের কথা, আদালত তাঁকে কী শাস্তি দিল তা জানার জন্যও তিনি আগ্রহ দেখাননি। দিনের পর দিন আদালতে গিয়েছেন, কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন কিন্তু বিচারের গতিবিধি নিয়ে তাঁর ভ্রূক্ষেপ ছিল না।
কোনও পিটিশনেরই জবাব ব্রিটিশ সরকার দেয়নি। ১৯২৭-এর ১৯ ডিসেম্বর তাঁদের ফাঁসির দিন ধার্য হয়। কিন্তু রাজেন্দ্রর ক্ষেত্রে আচমকা তারিখ দু’দিন এগিয়ে আনা হয়। জানা যায়, বাংলার অনুশীলন সমিতির কয়েকজন ঠিক করেছিলেন, গোন্ডা জেল ভেঙে তাঁকে ছাড়িয়ে আনবেন। সেটা কোনওভাবে জেনে যায় পুলিশ। তা রুখতেই এগিয়ে আসে ফাঁসির দিন।
১৭ ডিসেম্বর ভোর ছটায় গোন্ডা জেলে রাজেন্দ্র লাহিড়ীর ফাঁসি হয়ে যায়। বিচার চলাকালীন তিনি নির্বিকার ছিলেন। একইরকম নির্বিকার ছিলেন মৃত্যুতেও। অন্যদিনের মত সেদিনও ব্যায়াম সারেন, এ জন্মের অসমাপ্ত কাজটা পরজন্মে শেষ করতে হবে তো। ফাঁসির আগে জেল সুপারকে যা বলেছিলেন তা এখনও লেখা আছে গোন্ডা জেলের ফলকে। I am not going to die but I am going to be born to free India.
সহবিপ্লবী মন্মথনাথ গুপ্ত জানিয়েছেন, রাজেন্দ্রর মুখে সব সময় হাসি লেগে থাকত। ছেলেমানুষি হাসি। ফাঁসির রায় শুনেও একইভাবে হেসেছিলেন। জেলের খাবারদাবার, জেল কর্তৃপক্ষের আচরণের প্রতিবাদে বিপ্লবীরা একবার অনশনের ডাক দিয়েছিলেন। ব্যতিক্রম রাজেন্দ্র। বলেছিলেন, তিনি গুলি করতে পারেন, গুলি খেতেও পারেন কিন্তু উপোস করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। আবার সঙ্গীরা যখন মৃত্যুদণ্ড রোধে আপিল করার পথে হাঁটেন, তাতেও পাওয়া যায়নি তাঁকে। রক্তের মধ্যে হয়তো ক্রিয়া করেছিল বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অনুশীলন সমিতির শিক্ষা। আর নিস্পৃহতা। তা জীবন নিয়েই হোক বা মৃত্যু।
Comment here