শাশ্বত সনাতন

কিন্নৌর কৈলাশ॥ এক অধুরী কাহানী – ভ্রমণ কাহিনী – ৬

(পূর্বের অংশের পর)

– শ্রী সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

০৭/০৭/২০১৫

ঘুম ভাঙল ছেলেগুলোর কথায় “এই উঠ্‌ উঠ্‌..পৌনে ৬ বাজ গয়া..রেডী হো যা” চোখ খুলে দেখি প্রায় সবাই রেডী শুধু ১২জনের মধ্যে ২জন যায়নি, ঐ দুজনের মধ্যে একজন জোশীজি, যে গতকাল থাংলিং থেকে আসার পথে জল না পেয়ে ডিহাইড্রেশনে প্রায় মরো মরো অবস্থা হয়েছিল কোনোক্রমে ওপর থেকে জল নিয়ে গিয়ে খাওয়ানোর পর সে একটু সুস্থ হয় আর তারা ওপরে এসে পৌঁছায় রাত ১০টায়। ওই দুজন ছাড়া সবাই বেরোনোর পর জোশীজি এক কিমি হেঁটে গেল ছবিলালের সাথে কাছের ঝর্নায় স্নান করতে। ইতিমধ্যে আমি ফ্রেশ হয়ে নিলাম যেটুকু জল ছিল তা দিয়ে। এর মধ্যে ৫জনের দলের দুজন আর ১০জনের দলের তিনজন ফিরে এসেছে গ্লেসিয়ারের কাছ থেকে। সকালে আবহাওয়াও ভাল ছিলনা মেঘে ঢাকা ছিল আকাশ, বৃষ্টিও হচ্ছিল টিপ টিপ করে আর ছিল ঠাণ্ডা হাওয়া। ছবিলাল ইতিমধ্যে ফিরে এসে সবার জন্য খিচুড়ি বসিয়ে দিয়েছে। হরিয়ানা গ্রুপের জোশীজি বললো ওরা চা চিনি এনেছে যদি একটু চা বানানো যায়। শুনেই আমার খুব আনন্দ হল কারন আমি খুব চা খেতে ভালবাসি, কিন্তু গত দুদিন একফোঁটা চায়ের নাম শুনিনি কারণ আমরা চায়ের কোনো সরঞ্জাম নিয়ে যাইনি। আমি আর সিধু কোনো ব্যাগ নিইনি। সিধু ওর ক্যামেরারব্যাগ আর আমি খুঁটিনাটি জিনিষ নিয়ে একটা পিঠব্যাগ বাকি আমাদের জামাকাপড়,দুটো ম্যাট,টেন্ট, স্লিপিংব্যাগ, চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, মশলা্পাতি, ম্যাগি ইত্যাদি নিজের জামাকাপড়ের ব্যাগ, ৫লিটার জল, কেরোসিন নিয়ে প্রায় ২৫-৩০ কেজি ওজনের স্যাক নিয়ে গেছিল ছবিলাল। আমরা খালি হাতে গিয়েও আমাদের আশিকিধারে পৌঁছতে সময় লেগেছিল ৯ঘন্টা। যাইহোক, চায়ের সরঞ্জাম না নেওয়ায় আমরা গত দুদিন কেউ চা খাইনি ফলে চায়ের কথা শুনে আমরা যারপরনাই খুশী হ’লাম আর ছবিলালও খুব আনন্দের সাথে চা বানিয়ে খাওয়ালো। চা খাওয়ার পরে আমাদের খিচুড়িও খেতে হ’ল। তখন প্রায় ১০টা বাজে, আধঘন্টার মধ্যে মোটামুটি সবাই থাংলিং যাওয়ার জন্য তৈরী হ’লাম।

০৮/০৭/২০১৫

আমরা তিনজন আলাদা রাস্তা ধরলাম অর্থাৎ বেশ ঢালু উৎরাই আর বাকিরা সাধারণ রাস্তা ধরলো। আমি পাঁচ পা এগোতেই হাঁটুর ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলাম, যদিও বেরোনোর আগে নীক্যাপ আর ক্রেপ ব্যাণ্ডেজ লাগিয়েই এসেছি। রাস্তায় একটা প্যারাসিটামল খেলাম। এরপর খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলছি তো চলছি। ১” করে নামছি আর গুরুদেবকে স্মরণ করছি যাতে আলো থাকতে থাকতে নিচের ঝোড়ো নদী আর ল্যান্ডস্লাইডগুলো পার করে কঙ্গরন পর্যন্ত যেতে পারি। কঙ্গরনে পুরন সিংএর হোটেল আছে যেখানে থাকবার খাবার ভাল ব্যবস্থা, আর আমরা ওপরে ওঠার সময়ে খাবার থালা নিতে ভুলে গেছিলাম তাই ওখান থেকেই দুট বাটি নিয়ে গেছিলাম যাতে সুবিধা হয়েছিল, কারণ ওটা তো শাল-পিয়ালের জঙ্গল নয় যে পাতা কেটে থালা বানাবো! ওখানে পুরোটাই চীর, পাইন, ফার, দেবদারু গাছে ভর্তি। যাইহোক আমি দাঁতে দাঁত চেপে নামছি আর সিধু ওরা এগিয়ে গিয়ে অপেক্ষা করছে আর আমাকে দেখতে পেলেই আবার এগোচ্ছে। আর আমি অসহ্য যন্ত্রনা নিতে রাসটক্স, আর্নিকা খেতে খেতে নামছি আর ভাবছি অধঃপতন হতে এত সময় লাগে? আমরা জানি দাঁড়াতেই সময় লাগে বেশি আর নামতে খুব সোজা কিন্তু এক্ষেত্রে এত কষ্ট করে নামতে হচ্ছে যে…. যাইহোক মাঝখানে বড় পাথরের কিছু আগে ছবিলাল এগিয়ে গেল ম্যাগিস্যুপ বানাতে, ওর বানানো হ’লো আর আমি এসে পৌঁছলাম প্রায় ২০-২৫ মিনিট পরে। খেয়ে আবার নামতে লাগলাম।

এক একটা জায়গা এমন আছে যে আমাকে বসে বসে নামতে হয়েছে। প্রায় ৫.৩০ নাগাদ নিচে নদীটার ধারে এসে ছবিলালকে ডাকলাম। ওরা তখন ওপরে বসে ফোটোশুট করছে। নিজের ওপর নিজের বিরক্তি চেপে ডাকলাম ছবিলালকে..ও আসল, এসে বললো জুতো খুলে ঠাণ্ডা জল পায়ে লাগাতে। বরফ গলা ঠাণ্ডা জল পায়ে হাঁটুতে লাগালাম। অল্প রিলিফ হলেও নদীর ওপর গাছের গুঁড়ি ফেলে রাখা সেতু পার হওয়ার কনফিডেন্স পেলামনা যেটা অতি সহজে আসার সময়ে পেরিয়ে এসেছিলাম।অতঃপর ছবিলাল আমায় পিঠে নিয়ে নদী পার করলো। এক হাতে আমার খোলা জুতো অন্য হাতে স্টিক আর পিঠে আমি, এখনো বাকি..নদী লেভেলে এসেছি এখন আবার ওপরে উঠতে হবে, প্রায় ১.৫কিমি রাস্তা চড়াই। ৩টে স্থানে ডেঞ্জারাস ল্যাণ্ডস্লাইড, পুরোটাই ছোট গুঁড়ো পাথর মেশানো বালি মাত্র ৬” ফুট স্টেপ রাখার জায়গা।কোনোভাবে পা ফসকালে নিচে খাদে। ৭টা বেজে গেছে অন্ধকারও হয়ে এসেছে আমার ক্ষমতা নেই এক হাতে টর্চ নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঐ রাস্তা পার হব তাই ঈশ্বরকে ডাকতে ডাকতে এগিয়ে চলেছি। মাঝখানে ছবিলাল আর একবার আমাকে পিঠে করে নামিয়েছে।

 

(ক্রমশঃ)

(লেখক পরিচিতি – বিশিষ্ট জ্যোতিষী; একাগ্র পান্থ)

Comment here