শক্তিচর্চাশাশ্বত সনাতন

বাঙ্গালীর শক্তিচর্চার অগ্রদূত – রাজেন্দ্র নারায়ণ গুহঠাকুরতা

শ্রী রাজেন্দ্র নারায়ণ গুহঠাকুরতার নামটি বাঙ্গালী সমাজ হতে আজ শুধু বিস্মৃত নয়, অন্তর্হিত হয়ে গেছে প্রত্যেক ক্ষেত্রে। কিন্তু এটি প্রত্যাশিত ছিল না কোনভাবেই, অথচ এটিই এক নির্মম সত্য। রাজেনবাবুর প্রকৃত পরিচয় কি? তিনি বাংলার সর্বকালের অন্যতম শ্ৰেষ্ঠ ব্যায়ামবীর – সেই যুগে যখন বাঙ্গালীর সমাজে ব্যায়ামের স্থান ছিল অতি উচ্চ – প্রত্যেক পাড়াতেই ছিল আখড়া ও তাতে ডাম্বেল, বারবেলের শব্দে মুখরিত হতো প্রাঙ্গণ। পেশাগতভাবে এহেন অগ্রদূত ছিলেন কলিকাতার সিটি কলেজ ও ক্যালকাটা ইউনিভারসিটির কলেজ হোস্টেলের ব্যায়াম-শিক্ষক।

একথা সত্য, বাঙ্গালীদের মধ্যে যে দুজন ব্যক্তি সরাসরি বুকে হাতি তুলেছেন, তাঁদের মধ্যে একজন হলেন রাজেন বাবু ও অন্যজন ছিলেন ভীমভবানী। ভীমভবানী মস্ত বড়ো পালোয়াল হলেও বেশীদিন ধরাধামে ছিলেন না। মাত্র ৩৪ বছর বয়সেই মারা যান। স্যান্ডোর হাত ধরে জার্মার্নি থেকে বডিবিল্ডিং শিক্ষা ছড়াতে আরম্ভ করলে রাজেনবাবু প্রথম ভারতীয় যিনি বডিবিল্ডিং কালচার ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেন। তাঁর উত্তরসুরীদের মাধ্যমে বডিবিল্ডিং ভারতে আরো উন্নত হয়।প্রসিদ্ধ শক্তিসাধকদের মধ্যে শ্রী নীরদ সরকার, শ্রী কেশবচন্দ্র সেনগুপ্ত, শ্রী সুকুমার বসু, শ্রী বিষ্ণুচরণ ঘোষ,প্রমুখেরা তার ছাত্র ছিলেন।

রাজেনবাবুর জন্ম হয় ১৮৮৪ সালে বরিশালে; শৈশব থেকেই হইতেই ঘোড়-দৌড়ে অভ্যস্থ হয়েছিল তিনি। ব্যাঘ্রবিজয়ী ৺শ্যামাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের যোগ্য শিষ্য রূপে খ্যাত ছিলেন শ্রী সূর্যকান্ত গুহ ঠাকুরতা। সূর্যবাবু রাজেনকে বড় ভালবাসিতেন । তখন তার বয়স চৌদ্দ বছর। সূর্য্যবাবু রাজেনকে একপ্রকার  জোর করেই ব্যায়ামে প্রবৃত্ত করান। কিন্তু সার্কাসের কসরত শেখার জন্য রাজেন তাঁকে ধরে বসেন। প্রভুত অধ্যবসায়, পরিশ্রমেরে মাধ্যমে সূর্যবাবু তাকে জিমনাষ্টিকের সব রকম কৌশল (figure ) শিখিয়ে দেন।  শৈশব হতেই রাজেনের শারীরিক গঠন স্বভাবতঃই বেশ ভাল ছিল। তাই নিয়মিত শ্রমসাধ্য ব্যায়ামচর্চ্চার ফলে তাঁর শরীরটি দিন দিন বড়ই সুন্দর হইয়া ওঠে।ডন বৈঠকের পাশাপাশি ডাম্বেল ও বারবেল নিয়ে ব্যায়াম করতে করতে শরীরটা দেখবার মতো গড়ে তোলেন। কিন্তু এতেই থেমে যাওয়ার মতো ব্যক্তি তিনি নন।

নিয়মিতভাবেই বুকে রোলার নেওয়া অভ্যেস করতে থাকেন রাজেন্দ্রনাথ। শরীরটা বেশ জুতসই যখন তখন তিনি মৈমনসিংহ মুক্তাগাছার রাজা জগৎকিশোর আচার্য্য বাহাদুরের বাড়ীতে মোটর থামান এবং রোলার বুকে নেন। এই সময়ে তিনি নারায়ণগঞ্জে সাড়ে তিন টন ওজনের একটি রোলার বুকে নিয়েছিলেন। ১৯১৭ সালে তিনি কলিকাতা যান এবং সেখানে কার্লেকার সার্কাসে তিনি চারি টন (১১০ মণ ) ওজনের রোলার বুকে নেন। পরের বছর তিনি অলডার্স সার্কাসে হাতী নেওয়া অভ্যাস করেন। ১৯১৯ সালে চট্টগ্রাম জেলায়  রায় বাহাদুর গোলোকচন্দ্রের বাড়ীতে একটা হাতীকে এক দিনের ভিতর শিক্ষিত করে সেটাকে বুকে নেন।

এর পূর্বে, ১৯১১ সালে বরিশালের বিশাল দরবার হলের আসরে তিনি একটা রোলার বুকে নিলেন যার ওজন ২৮ মন। তাতে চড়ানো হল পাঁচমন ওজনের পাথর। রোলারের ওপর চালকসহ আরও চারজন লোক। রামমুর্তি কলকাতায় এসে হাতি তুলে দেখালেন।তার সার্কাস দেখতে গেলেন রাজেনবাবু।ভাবলেন রামমূর্তি বুকের ওপর হাতি নিয়ে খেলা দেখাচ্ছে, আর আমি রাজেন্দ্রনারায়ণ যে এই খেলাটা প্রথম দেখিয়েছি। লোকে কি ভুলে গেল? কে একটা ভিনদেশি বুকে হাতি তুলেছে বলে এত বাহবা পাচ্ছে!?

পরের দিন সকাল হতে না হতেই  করে ঢুকে পড়লেন। রামমূর্তির সার্কাসের অন্তরে সরাসরি  বললেন একটা কথা বলতে এসেছি। গত রাতে তোমার খেলা দেখলাম কিন্তু তুমি যা যা দেখালে, আমি সে সবই জানি। রামমূর্তি বললেন–তুমি যদি সব খেলা ঠিকমত দেখাও আমার সব সরঞ্জাম  তোমাকে দিয়ে দেব। সব খেলাই  তিনি দেখিয়েছিলেন কিন্তু কথা রাখেনি রামমূর্তি। রামমূর্তিকে।তিনি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।বাংলা থেকে ১০০ রামমুর্তি আমি গড়ে দেখাবো।দেখিয়েও ছিলেন।কিভাবে সেটাই বলব এবার।

বুকে চোট পেয়ে কলকাতায় এলে একদিন কলিকাতায় সিটি কলেজের অধ্যাপক সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট শ্রীযুক্ত সতীশচন্দ্র চাটার্জ্জির সাথে তাঁর দেখা হয়। সতীশবাবু পূর্ব্বে বরিশাল কলেজে প্রফেসর ছিলেন এবং তখন হতেই রাজেনের সাথে তাঁর পরিচয়। কথাপ্রসঙ্গে সতীশবাবু রাজেনকে বলেন, “রাজেন, তোমাকে সিটি কলেজের ব্যায়াম-শিক্ষক ( Physical Instructor) হতে হবে। লেগে পড়ো।” যদিও চাকরি করার অভিপ্রায় ছিল না তাঁর কোনকালেই, সতীশবাবুর কথা অমান্য করা যায়না। সতীশবাবু বললেন,— “রাজেন, শুধু নিজের শরীর বড় করলেই চলবে না, সঙ্গে সঙ্গে আরো দশজনের শরীরও ভাল করে গড়ে তুলতে হবে। বাঙ্গালী শরীর হিসাবে বড় দুর্বল। বাঙ্গালীকে  সবল করার ভার তোমাদেরই নিতে হবে।” তখন রাজেন্দ্রনারায়ণের মনে পড়ল রামমূর্ত্তির কাছে তাঁর প্রতিজ্ঞার কথা। ভাবলেন, এই তো সুযোগ। স্কুল কলেজের ভিতর দিয়েই তো বাঙ্গালীকে  সবল করার মন্ত্র প্রচার করতে হবে। ঢাকা, বরিশাল সহ নানা অঞ্চলে তিনি প্রদর্শনী করতেন,তার টানে আকৃষ্ট হয়ে শয়ে শয়ে ছেলে ট্রেনিং নিতে আসতো। শ্রী নীরদ সরকারের পুর্বপ্রকাশিত জীবনীতেই বলা হয়েছে তিনি কিভাবে তার সংস্পর্শে আসেন।

১৯২০ সালে সিটি কলেজের অনেক ছাত্রকে তিনি তৈরী করেন এবং তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কেশবচন্দ্র সেন ও বিষ্টু ঘোষ। তার প্রথম ও প্রধান শিষ্য ছিলেন গোপাল নারায়ণ চৌধুরী যিনি একসাথে তিনখানা গাড়ি হাত দিয়ে টেনে থামাতে পারতেন। রাজেনবাবুর অপর ছাত্র শৈলেন্দ্রনাথ চৌধুরী এক হাতে রাজেন বাবুকে তুলতেন।  নীরদ সরকার চোখ ও গলা দিয়ে বর্শা বাঁকিয়ে ফেলতেন। ভুপেশ কর্মকার লোহার শিকল ছিড়তেন।…আজ এইসব স্বপ্ন বলে মনে হয়।

রাজেনবাবুও একবার সেলার্স সার্কাসে ও ১৯২০ সালে একবার আলিপুরের চিড়িয়াখানায় হাতী বুকে নেন, যা দর্শকমহলে এক বিস্ময়ের সৃষ্টি করে।

১৯২৬ সালে রাজেনবাবু একবার নোয়াখালিতে দেওপাড়ায় ঠাকুরদের বাড়ী বড় হাতী বুকে নিয়েছিলেন। যদিও সবচেয়ে অসমসাহসিকতার পরিচয় তিনি দেন চট্টগ্রামে। ১৯২৭ সালে সেখানে মহাজনহাট নামক স্থানে রায়বাহাদুরদের বাড়ীতে খেলা দেখাবার ব্যবস্থা হয়। রায়বাহাদুরদের একটা অতি প্রকাণ্ড হাতী ছিল। এত বড় হাতী সচরাচর দেখা যায় না – বুকে নেওয়া ত দূরের কথা। রাজেনবাবু অন্যান্য খেলা দেখাবার পর বলেন, সেই প্রকাণ্ড হাতী তিনি বুকে নেবেন। হাতীটা দশ ফিটের চেয়ে উঁচু ; তার ওজন ১১৫ মণ। আর যে তক্তার উপর তাহাকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হবে তার ওজন ৮ মণ।

রাজেন্দ্রনারায়ণ গুহঠাকুরতার খেলায় কোনপ্রকার চাতুরী ছিলনা। একথা এজন্যই বলছি কারন শেষদিকে তাঁর ডান চোখ নষ্ট হয়ে যায়। বুকে হাতি নিলে  শরীরের রক্তচাপ বহুগুন বেড়ে যায়,যার প্রভাব চোখেও পড়ে। চোখ নষ্ট হওয়ার পর তিনি তার ছাত্রদের অনুরোধে এই খেলা থেকে  অবসর নেন। এরপরে ভীমভবানীও দুটি হাতি একসাথে বুকে নিয়েছিলেন।

রাজেনবাবুর  দেহসৌষ্ঠব চিরকালই অত্যন্ত সুগঠিত ও আকর্ষণীয়। তাঁর বুকের গঠন এত সুন্দর ও বুকের Pectorals Muscles এর  Volume এত ছিল যে তিনি সোজা দাঁড়ানো অবস্থায় একটি ফুলদানি বুকের ওপর অনায়াসে রাখতে পারতেন। মাসল কন্ট্রোলেও তিনি দক্ষ ছিলেন। বাঙ্গালীকে শক্তিমান রূপে গড়ে তোলার জন্য জন্য তিনি “All Bengal Physical culture Association” নামে একটি সমিতি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এটিই বর্তমান IFBB র পূর্বতন রুপ।দেশের গণ্যমান্য অনেকেই এই প্রখ্যাত সংগঠনের সহিত যুক্ত এবং যাঁরা শরীরচর্চ্চায় বঙ্গভূমিতে অগ্রণী ছিলেন তখনকার দিনে – গোবর গুহ, কাপ্তেন ফণীন্দ্রকৃষ্ণ গুপ্ত, পুলিনবিহারী দাশ প্রভৃতি এই সংগঠনের সভ্য শ্রেণীভুক্ত ছিলেন। এছাড়াও তিনি University, of Physical Culture নামে আর একটি প্রতিষ্ঠান করেন। ব্যায়াম শিক্ষক/ Gym Trainer  তৈরী করা এই প্রতিষ্ঠানটির উদ্দেশ্য ছিল।  গ্রাজুয়েট ছাড়া অপর কাউকে এই ইউনিভার্সিটির সদস্য করা হত  না।

এখানকার নিয়ম ছিল–one year course for physical instructor আর six months course for drill master. অর্থাৎ যিনি ব্যায়াম-শিক্ষক হবেন তাঁকে এখানে এক বৎসর ও যিনি ড্রিল মাষ্টার হবেন তাঁকে ছয় মাস শিক্ষালাভ করতে হবে। ১৯২৫ সাল থেকে তিনি কলিকাতার “ল” কলেজের ছাত্রাবাস হার্ডিঞ্জ হোষ্টেলের ব্যায়াম-শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং আতঁৰ উদ্যোগে সেখানে একটি চমৎকার ব্যায়ামাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তিনি খাওয়ার দাওয়ার দিকে ছিলেন নিরামিষাশী। মাছ মাংস তিনি বিশেষ পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন নিরামিষ আহারেই শরীর ভাল থাকে, অসুখ-বিসুখও কম হয়। খাওয়ার বিষয়ে তিনি বিশেষ সংযমী খুব অল্প আহার করেন। তিনি বলেন, সাধারণ বাঙ্গালীর যা খাদ্য তাহাতেই শরীর বেশ ভাল হইতে পারে। পেস্তা বাদাম মাংস পোলাওর কোন দরকার পড়ে না।

অভিভাবকরা ছেলেদের পড়াশুনার এবং নৈতিক উন্নতির জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেন, কিন্তু ব্যায়াম সম্বন্ধে তেমন কিছুই করেন না। ব্যায়ামের দ্বারা ছেলেদের দেহ যাহাতে সবল, দৃঢ়, মাংসল হয়, তার ব্যবস্থা প্রত্যেক অভিভাবকের করা উচিত। শরীর সুস্থ ও কর্ম্মক্ষম না হলে জগতের কোন ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারা যায় না। স্বাস্থ্য ভাল না থাকলে মন সুস্থ থাকে না; মন সংযত না হলে নৈতিক চরিত্র পবিত্র থাকে না। ব্যায়াম করতে গেলে সংযমী হওয়া দরকার; সংযমী হতে গেলেও গায়ে জোর থাকা চাই; সেইজন্য ব্যায়াম করা দরকার। সাধু-সন্ন্যাসীরাও সংযমী থাকবার জন্য নিয়মিত ভাবে ব্যায়াম করেন। কেবল ব্রহ্মচারীরা ও যোগরা অন্য প্রক্রিয়ায় ব্যায়ামের উদ্দেশ্য সাধন .করেন।

ব্যায়াম নিয়ে তাঁর উপদেশ ছিল  যে “কোন ব্যায়াম নিয়মিত ভাবে করিতে পারিলেই শরীর ভাল হয়। সংযম-শিক্ষা ও ব্যায়াম চর্চ্চা পরস্পর একটি আর একটির উপর নির্ভর করে। শরীর-চর্চ্চাটা হঠযোগেরই একটা অংশ। ইহাও সাধনার মত করিয়াই করিতে হয়। প্রকৃতি অনুযায়ী শ্বাস-প্রশ্বাস—যাহা নিজে করিতে কষ্ট না হয় – এরূপ ব্যায়াম করা বিধেয়। খাদ্য সম্বন্ধে নিয়ম এই—যাহা সহজে জীর্ণ হয় তাহাই গ্রহণীয়—তাহাতেই শরীরের পুষ্টি হয়।”

ব্যক্তিগত স্তরে, রাজেন্দ্রনারায়ণ গুহঠাকুরতা অত্যন্ত চরিত্রবান, সংযমী ও বিবাহিত পুরুষ ছিলেন। ১৯৪৫ সালের ২১ শে জুলাই, কলেরার দ্বারা আক্রান্ত হয়ে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। রেখে যান শক্তিচর্চার এক অসামান্য গাথা ও বাঙ্গালীর পরাক্রমী হয়ে ওঠার এক অপূর্ণ স্বপ্ন।

(ব্যায়ামাচার্য ও যোগাসম্রাট শ্রী নীরদ সরকারের একটি অপ্রকাশিত রচনা থেকে এই জীবনীর অনেক অংশ নেওয়া হয়েছে।তাঁর  গুরু প্রোফেসর রাজেন্দ্র নারায়ণ গুহঠাকুরতার জীবনী তিনি লিখতে শুরু করেন।১৯৮৪  সালে নীরদ বাবুর প্রয়াণ ঘটায় লেখাটি আর প্রকাশিত হয়নি।)

Comment here