ফাল্গুন-চৈত্রমাস আমাদের মন কেমন করার মাস। বাতাসে মিশে থাকে সেই মন কেমন করার তরঙ্গ। মনের সাথে সাথে মনের আধারটিতেও জানান দেয় বটেই। নানানরূপে ঘটে আত্মপ্রকাশ। বসন্ত আসে কখনো পলাশের আগুন রাঙ্গা ছোঁয়া হয়ে তো কখনো মড়কের বুকফাটা হাহাকার হয়ে। হিন্দু বাঙ্গালী সমাজে লৌকিক দেবদেবীদের আবির্ভাব অধিকাংশেই প্রকৃতির রূপ পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে। অনেকক্ষেত্রেই আবার এই দেবদেবীদের পৌরাণিক দেবদেবীদের সাথে কোন না কোন যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। এই পর্বের গল্প উত্তরবঙ্গের এমনই একজন লৌকিক দেবতাকে নিয়ে।
মাসান ঠাকুর অথবা মাসান বাবা মূলত রাজবংশী মানুষদের আরাধ্য হলেও কালক্রমে উত্তরবঙ্গের অন্যান্য জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে মাসান ঠাকুরের পূজার প্রচলন হয়েছে। অন্যান্য অনেক লৌকিক দেবদেবীদের মতই ইনি দেবতা এবং অপদেবতা দুই রূপেই পূজিত হন।স্থান বিশেষে ও মতভেদবিশেষে এনার প্রায় আঠেরো প্রকার রূপ আছে এবং ভিন্ন ভিন্ন রূপের ভিন্ন ভিন্ন বাহন। তবে প্রায় প্রতিটি রূপেই এনার ভীষণ-দর্শন ভক্তের মনে শ্রদ্ধা ও ভয় দুটোরই সঞ্চার করে।
অনেক মানুষের মতে কোন দেবতা বা অপদেবতা কিছু বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অর্জন করলে তবেই মাসানে পরিণত হয় এবং এইরূপ মাসানেরও অনেক প্রকারভেদ থাকে। এই মতবাদটি তন্ত্রমতে বিশ্বাসী মানুষদের মধ্যে বেশী প্রচলিত। তাই বলাই বাহুল্য, মাসানের এই রূপটিকে শ্মশান মশানের বাতাসে বিচরণ করা অপদেবতাদের সাথেই জুড়ে থাকেন তাঁরা। এই মাসান মানুষের উপর ভর করে তার ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে। যাকে মাসানে ধরে, সে মানসিক ভারসাম্য হারায় এবং আস্তে আস্তে শুকিয়ে যেতে যেতে অবশেষে শ্মশানযাত্রা করে। এই রকম মাসানের কবল থেকে আক্রান্ত মানুষকে উদ্ধার করার জন্য যেমন আচার অনুষ্ঠান আছে তেমন আছে লোকমুখে প্রচলিত নানান মন্ত্র ও ছড়া। মাসানের প্রকারভেদের উপর নির্ভর করে লোকের মুখে মুখে তৈরি হয়েছে একেকটি ছড়া। প্রচলিত মত অনুযায়ী মাসানের জন্ম বা উৎপত্তি কালীর(মত বিশেষে ধর্মরাজের সাথে মিলনের ফলে) থেকে।
মাসান ঠাকুরের দেখা শহুরে মানুষ কমই পায়। কারণ বলাই বাহুল্য যে গ্রাম ও মফঃস্বলের দিকেই লৌকিক দেবতা বা অপদেবতাদের মূলত বসবাস। অতএব আমার মাসান ঠাকুরের সাথে প্রথম পরিচয় তুফানগঞ্জে গিয়ে। রায়ডাক নদীর পাড়ে বাঁধের ধারে আমার রায়বাঘিনীর নিবাস। সেথায় বেড়াতে গিয়ে প্রথম শুনেছিলাম এই আশ্চর্য ঠাকুরের কাহিনী। কয়েক দশক আগেও যখন উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ অঞ্চলেই রাত্রিবেলা মানুষ ও পশুপাখির সাথে সাথে বিদ্যুৎ ও আরামে নিদ্রা যেত, তেমনি এক নিশুতি রাতে পাড়ার কোন এক নববিবাহিতা গৃহবধূ গরমের ঠেলায় জানালা খুলতে গিয়ে দেখা পেয়েছিল তাঁর। এই রূপটি আবার ছিল মুণ্ডহীন। বাঁধের রাস্তার উপর দিয়ে তিনিও বুঝি বায়ুসেবনেই বেরিয়েছিলেন।
বধূটির সেরাত্রে কোনোরকমে দাঁত কপাটি ছাড়ানো গেলেও অবশেষে গুণিনের কাছে গিয়েই ভর ছাড়ানো গেছিল। আমি জিগ্যেস করেছিলাম, “এমন ক্ষতি করে তাকে ঠাকুর কেন বলে?” ননদিনী উত্তর করেছিল, “পাগলী, ওনাদেরই তো বেশী করে সম্মান দিতে হয়!”
পরবর্তীকালে অনেক জায়গাতেই দেখা পেয়েছি মাসান ঠাকুরের, নানান রূপে। অবশ্যই মাটির প্রতিমা অথবা প্রস্তর শিলা রূপেই। আমি এই অল্পেই সন্তুষ্ট। অনেকটা মাসান ঠাকুরের একটি দেবতা রূপের মতোই। যদি ধরে থাকেন তো ঠিকই ধরেছেন। হ্যাঁ, শিবের একটি লৌকিক রূপ হিসেবেও পূজিত হন মাসান বাবা। তাই মাসান বাবার প্রতিমার সাথে বাংলার লৌকিক শিবের সামঞ্জস্যও আছে বৈকি। বাহন নিয়ে যদিও অনেক রকম মতভেদ। হাতে ত্রিশূলের বদলে থাকে গদা। চোখদুটো ভাঁটার মত। তবে মাসান বাবার এই রূপ রক্ষকের। চৈত্রমাসের দিকে জায়গায় জায়গায় মাসান বাবার পূজা আয়োজিত হয়। পূজা উপলক্ষে বসে মেলা। দিনহাটার গোসানীমারি মাসান পাটের মেলায় একবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। পরের দিন দোল। কত দূরদূরান্ত থেকে ভক্তদের সমাগম। মেলার ধারেই বসেছে প্রসাদ ভাণ্ডার। প্রসাদ ভাণ্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম, বাবার পূজার ভোগের আয়োজন – টক দৈ, চিঁড়া, বাতাসা আর বিচা কলা। পূজা নিবেদন ও মনস্কামনা পূরণ হেতু যেই ভক্তদের আগমন, তাঁরা উপোষ করে ভোগ নিবেদনের পর প্রথমে এই দৈ-চিঁড়ে-কলা প্রসাদ মেখে খেয়েই উপবাস ভাঙ্গেন।
শিবরাত্রি অতিক্রান্ত হয়েছে ইতিমধ্যে। কিন্তু বাঙ্গালীর ও অবাঙ্গালীর শিবের মধ্যে প্রকারভেদ নিয়ে বয়ে চলে নানান কচকচি। এই আসরে জানিয়ে গেলাম উত্তরবঙ্গের বাইরে স্বল্প পরিচিত, উত্তরের জনজীবনের সাথে জড়িত আরেক লোকায়ত শিবের কথা। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর…
পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। উত্তরবঙ্গ জন্মভূমি এবং বর্তমানে কলকাতা কর্মভূমি। ভ্রমণপিপাসু এবং জ্ঞানপিপাসু।”
Comment here