– সৌগত বসু
খাদ্য আর আশ্রয়। এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্যে মনুষ্যেতর যে কোন প্রাণীর Basic Need অর্থাৎ মৌলিক প্রয়োজন মূলতঃ এই দুটোই। অন্ততঃ এই বিষয়ে মানুষের সাথে মনুষ্যেতর কোন প্রাণীর আদতে এতটুকুও পার্থক্য নেই। যদিও অর্থনীতির একেবারে প্রাথমিক পাঠে বলা হয়েছে খাদ্য আর আশ্রয়ের সাথেই বেঁচে থাকার জন্যে প্রাণী শ্রেষ্ঠ মানুষের আরো একটা মৌলিক প্রয়োজন আছে – বস্ত্র। যদিও সে প্রয়োজন পশুর নেই। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই শুধু খাদ্য, বস্ত্র আর আশ্রয়টুকুর সংস্থানেই মানুষের চাহিদার শেষ হয় নি। আর তাই অর্থনীতি বলে মৌলিক প্রয়োজনটুকু জোগাড় হলেই মানুষের চাহিদা তৈরী হয় Comfort অর্থাৎ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যে। আর সেটা পূরণ হলেই মানুষ যা চায় তা হলো Luxury অৰ্থাৎ বিলাসিতা। যদিও স্থান, কাল, পরিস্থিতির সাথে সাথে মৌলিক প্রয়োজনের উপাদানের বদল না হলেও বদলে যায় সাচ্ছন্দ্য আর বিলাসিতার মাপকাঠি।
এ তো গেল অর্থনীতির একেবারে গোড়ার কথা। মানবসভ্যতা যে এতটা পথ অতিক্রম করলো তা কি শুধুই মানুষের মৌলিক প্রয়োজন, সাচ্ছন্দ্য আর বিলাসিতার উপকরণ জোগাড় করার তাগিদে? শুধু পরনের কাপড়টুকুই কি মানুষ আর পশুর একমাত্র পার্থক্য? নিশ্চয় নয়। মনুষ্যেতর কোন প্রাণীর সে যোগ্যতা না থাকলেও – মৌলিক প্রয়োজন, সাচ্ছন্দ্য আর বিলাসিতার নানা উপকরণের সন্ধানে সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষ যে তার সভ্যতাকে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে এগিয়ে নিয়ে চলেছে সে কথা সত্যি। কিন্তু সেটাই সবটা নয়। এর পাশাপাশি পৃথিবীর সব প্রান্তে মানব সভ্যতা যা অবলম্বন করে এতটা পথ পাড়ি দিয়েছে তার নাম ‘সংস্কৃতি’। আর সেই সংস্কৃতির অজস্র উপাদানের অন্যতম হলো ‘ভাষা’।
কোন এক নির্দিষ্ট অঞ্চলে জন্ম নিয়ে কালের হাত ধরে যেমন বিবর্তন হয়েছে। তেমনই একের পর এক ভৌগোলিক সীমানাও অতিক্রম করেছে এই পৃথিবীর অজস্র ভাষা। কখনও অন্য অঞ্চলের স্থানীয় ভাষার সাথে মিলে মিশে গিয়ে জন্ম হয়েছে নতুন কোন এক ভাষার। তার মধ্যেই নানা কারণে কোন কোন ভাষা আবার হারিয়েও গেছে কালের অতলে। এ ভাবেই নানা রকম সংস্কৃতি আর কালের হাত ধরে এগিয়ে চলেছে মানব সভ্যতা। আর সেই সব সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান তার ভাষা। এ কথা অস্বীকার করা প্রায় অসম্ভব যে নিজের ভাষা নিয়ে এই পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই কম বেশী স্পর্শকাতর। আর বাংলাভাষী মানুষের একটা বড় অংশের সে কারণে একটা আত্মশ্লাঘাও তৈরী হয়েছে। কারণ প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারী ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করার জন্যে বাংলাদেশের আনা প্রস্তাবে ১৯৯৯-এর ১৭ই নভেম্বর স্বীকৃতি দিয়েছে রাষ্ট্র সংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান আর সংস্কৃতি বিষয়ক শাখা সংস্থা (UNESCO) ইউনেস্কো-র ৩০তম সাধারণ সভা। আর সেকারণেই তার পরের বছর ২০০০ সন থেকেই শুরু হয়েছে গোটা পৃথিবী জুড়ে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃ ভাষা দিবস হিসেবে উদযাপন। এমনকি ২০০২-এর ৯ই এপ্রিল তাদের ৫৬তম সাধারণ অধিবেশনে ৫৬/২৬২ ক্রমিক নম্বরের রেসল্যুশনের মাধ্যমে যার উপর সিলমোহর দিয়েছেন রাষ্ট্র সংঘের সাধারণ সভা স্বয়ং।
তাহলে একবার ফিরে দেখা যাক ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করাকে ঘিরে – বাংলা ভাষার জন্যে সে দেশে যে আন্দোলন হয়েছিল তা নিয়ে – বাংলাদেশের অসামান্য আন্তরিকতা আর রাষ্ট্র সংঘের মতন সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক মঞ্চে এতো উদ্যোগ গ্রহণের প্রেক্ষাপটের দিকে। যে আন্তরিকতা আর উদ্যোগের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছেন ভারতের বিশেষ করে পশ্চিমবাংলার বাংলাভাষী জনতার একটা বেশ বড় অংশের মানুষ। যাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ আবার – মোটের উপর আমরা যাদের শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনস্ক বলতে যা বুঝি তাই।
আসলে ভারত ভাগ করে ধর্মের নামে পাকিস্তান আদায় করে নেওয়ার দু’তিন মাসের মধ্যেই, মহম্মদ আলী জিন্নাহ বেঁচে থাকতেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী অর্থাৎ মুসলিম লীগেরই পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক শক্তির সাথে পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগেরই সেই অংশের বিরোধ শুরু হয়। যারা ভারত ভেঙে পাকিস্তান তো আদায় করে নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত্য সেই সাধের পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতার ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেন নি। এমনকি পাকিস্তানের পূর্ব ভাগের একমাত্র প্রদেশ ইস্টবেঙ্গলের প্রাদেশিক শাসন ক্ষমতার অলিন্দেরও বাইরেই থেকে গিয়েছিলেন। যদিও মাত্র কয়েক মাস আগে পর্যন্ত্য ইসলামের নামে আলাদা পাকিস্তানের দাবীতে এরা সকলেই জিন্নাহের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের ছাতার তলায় বাকিদের সাথেই সহাবস্থান করছিলেন। তখন পূর্ব পাকিস্তানে ছিল সে দেশের মোট জনসংখ্যার ৬৪% মানুষের বাস। যারা মূলতঃ বাংলায় কথা বলেন। ও দিকে পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের ভাষা আবার আলাদা।
যদিও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন ১৯৪৭-এর নভেম্বরেই পাকিস্তানের সরকারী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল উর্দু আর ইংরেজী। পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র প্রদেশ ইস্টবেঙ্গলের প্রধান ভাষা বাংলার মতনই পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশ সিন্ধ, পঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (অধুনা খাইবার পাখতুনখাওয়া ) আর বালুচিস্থানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্থানীয় ভাষাগুলিও অর্থাৎ সিন্ধ্রি, পঞ্জাবী, পশতু বালুচ ইত্যাদির মতন ভাষাগুলিও কিন্তু সে দেশে কোন সরকারী স্বীকৃতি পায় নি। পূর্ব আর পশ্চিম দুই পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মধ্যে এই এক ভাষা ছাড়াছাড়া সে অর্থে আর তেমন কোন মূলগত পার্থক্য ছিল না। যার জন্যে কোন একটা গোটা জনগোষ্ঠী লড়াইয়ের ময়দানে নেমে যেতে পারে। সংগ্রামের পথ বেছে নিতে পারে। শেষ পর্যন্ত্য সেই ভাষার জন্যেই ১৯৪৭-এর ডিসেম্বরের গোড়া থেকে ইস্টবেঙ্গলে শুরু হয় আন্দোলন। যা ধীরে ধীরে গোটা ইস্টবেঙ্গল জুড়ে ব্যাপক আকার নেয়। মুসলিম লীগের সেই অংশের ছোট বড় সব নেতা মূলতঃ তাতে সামিল হন যারা থেকে গিয়েছিলেন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় অথবা ইস্টবেঙ্গলের প্রাদেশিক শাসন ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে।
১৯৪৯-এর ২৩শে জুন মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রতিষ্ঠা করেন এক পৃথক রাজনৈতিক দল, ‘অল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। সামসুল হক সচিব। একে একে সেখানে যোগ দেন ফজলুল হক, হুসেইন শহীদ সুরহাবর্দী, শেখ মুজিবর রহমান, ইয়ার মহম্মদ খান, খোন্দকার মুস্তাক আহমেদ, আতাউর রহমানের মতন ইস্টবেঙ্গলের মুসলিম লীগের তাবড় তাবড় সব নেতারা। গোটা ইস্টবেঙ্গল জুড়ে শুরু হয় এক ব্যাপক আন্দোলন। যে আন্দোলন তার চরম সীমাতে পৌঁছায় ১৯৫২-এর ২১শে ফেব্রুয়ারী। সেদিন ঢাকা শহরে আন্দোলনরত জনতার উপর গুলি চালায় পাকিস্তানের ইস্টবেঙ্গল প্রদেশের নুরুল আমিনের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ সরকারেরই পুলিশ। আর প্রাণ হারান সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতের মতন কয়েকজন। এর পরে ১৯৫৪-এর ৭ই মে পাকিস্তানের কনষ্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলী মেনে নিয়েছিল বাংলা ভাষাকে সে দেশের সরকারী ভাষার মর্যাদা দেওয়ার প্রস্তাব। কনষ্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলীতে মুসলিম লীগের সদস্যরাও যার সমর্থন করেছিলেন। আবার ১৯৫৬-র ২৯শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন হলে সে দেশের সংবিধানের ২১৪(১) ধারায় উর্দু আর ইংরেজির পাশাপাশি একমাত্র বাংলা ভাষাকেই পাকাপাকি ভাবে সে দেশের সরকারী ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়। ১৯৫৪-র পরে পূর্ব পাকিস্তানে আর বাংলা ভাষার জন্যে কোন আন্দোলন করার প্রয়োজন বা অবস্থা কোনটাই অবশিষ্ট ছিল না। যদিও এই ঘটনার ১৬ বছর পরে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে ১৯৭১-এ জন্ম হয় নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। তবু আজও ভারতে তথা পশ্চিমবঙ্গে অনেকের ধারণা বাংলাদেশের জন্মের অন্যতম কারণ সে দেশে বাংলা ভাষার পক্ষে আন্দোলন।
পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী মানুষ কি কোনদিন একবারের জন্যে হলেও ভেবে দেখেছেন – ১৯৪১-র ১২ই ডিসেম্বর থেকে ১৯৪২-র ২০শে নভেম্বর। মাঝের এই এক বছরেরও কম সময়টুকু বাদ দিলে ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৬/৪৭ পর্যন্ত্য টানা ১০ বছর অবিভক্ত বাংলায় ক্ষমতাসীন ছিল মুসলিম লীগ। সেই মুসলিম লীগের ফজলুল হক, সুরহাবর্দীর মতন নেতারাই ছিলেন এই দশ বছর অবিভক্ত বাংলার প্রিমিয়ার অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী। তাদেরই ঘোষিত নীতি ছিল মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম থেকে সংস্কৃতের প্রভাবে হিন্দু-গন্ধী বাংলার গুরুত্ব খর্ব করে উর্দুর মতন কোনও ইসলামী ভাষার প্রভাব বৃদ্ধি করতে গেলে শিক্ষাক্রমের পরিবর্তন করা আবশ্যিক। ১৯৩৭-এ সরকার গড়ার পরে অবিভক্ত বাংলার সরকারে প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হকের হাতেই ছিল শিক্ষা দপ্তর। তাই ১৯৪০-এর ২১শে অগাস্ট তিনিই অবিভক্ত বাংলার অ্যাসেম্বলীতে পেশ করেছিলেন ‘বেঙ্গল সেকেন্ডারী এডুকেশন বিল’। কিন্তু সে সময়ে সরকারের একার পক্ষে তেমনটা করা আদৌ সম্ভব ছিল না। কারণ তখন অবিভক্ত বাংলা ছাড়াও আসাম সাথে বিহার আর উড়িষ্যার একটা অংশে সেকেন্ডারী এডুকেশন ছিল সেই সময়ে উচ্চ শিক্ষার জন্যে পৃথিবীর অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠান, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আর সরাসরি পরিচালনায়। তাই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী কেবল তারাই। সরকার কখনই নয়। অবিভক্ত বাংলায় ক্ষমতাসীন হলেও ১৯০৪-এর ‘ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট’-এর বাধ্যবাধকতার কারণে
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর কর্তৃত্ব কায়েম করে নিজেদের নীতি, সিদ্ধান্ত কোনটাই চাপিয়ে দিতে সক্ষম ছিল না প্রদেশের সরকার। তাই মাধ্যমিক শিক্ষাকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বদলে সরাসরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে উঠে পরে লেগেছিল তারা। স্কুল শিক্ষার সার্বিক ইসলামীকরণের লক্ষ্যে অবিভক্ত বাংলায় সমস্ত স্কুলে উর্দু ভাষা বাধ্যতামূলক করতে যেন আদা জল খেয়ে লেগেছিল। স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে বের করে সরাসরি সরকারের অধীনে এনে বাংলায় উর্দু ভাষাকে আবশ্যিক করে দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার এমন আমূল বদল কোনও ভাবেই মেনে নেয় নি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এমনকি ‘সরকারের কাছের মানুষদের’নিয়ে তৈরী ‘কামাল ইয়ার জং এডুকেশন কমিটি’-র রিপোর্টে তাঁদের কাজের মধ্যে দিয়ে মুসলমান সংস্কৃতিকে অবহেলা, উপেক্ষা করে শুধুই হিন্দু সংস্কৃতির প্রচার আর প্রসার করার অভিযোগে মুসলমান নেতৃত্বের পাশাপাশি শিক্ষিত মুসলমান সমাজের প্রবল সমালোচনা আর তীক্ষ্ণ আক্রমণের মুখে পড়েছিলেন বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম থেকে রবীন্দ্রনাথ, শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতন বাংলা সাহিত্যের দিকপালরা। সেই আক্রমন থেকে বাদ যায় নি কবিগুরুর শান্তিনিকেতন আশ্রমও।
অন্য দিকে বেঙ্গল সেকেন্ডারী এডুকেশন বিলের সমর্থনে অ্যাসেম্বলীর বিতর্কে অংশ নিয়েছিলেন যারা তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আবু হোসেন সরকার, আব্দুল ওয়াহাব খান, খোন্দকার আব্দুর রশিদ, জালালুদ্দিন আহমেদ, আবুল হাশিমের মতন অবিভক্ত বাংলার মুসলমান নেতৃত্ব। অ্যাসেম্বলীর মধ্যে তো বটেই সেই সময়ে অ্যাসেম্বলীর বাইরেও বাংলার মুসলিম লীগ বা কৃষক প্রজা পার্টীর ঘোষিত নীতির সমর্থনে দুই দলের ছোট বড় সব নেতাই ছিলেন ‘বেঙ্গল সেকেন্ডরী এডুকেশন বিল’-এর পক্ষে। বাংলা ভাষার গুরুত্ব হ্রাস করে – ইসলামের নামে উর্দু ভাষার পক্ষে। এদের মধ্যে পরবর্তীতে পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন আবু হোসেন সরকার। তিনি তো আবার নিজের সময়কালে ২১শে ফেব্রুয়ারী-কে শহীদ দিবস আর সেই সাথে ছুটির দিন ঘোষণা করেছিলেন। শুধু তাই নয় শুরু করিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ। ১৯৪৮-এর পরে নিজের আগের অবস্থান থেকে সম্পূর্ণ উল্টো দিকে ঘুরে গিয়ে তখন আবার বাংলা ভাষার পক্ষে দাঁড়িয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃত্ব আর পূর্ব বঙ্গে নুরুল আমিনের সরকারের সমালোচনা করেছিলেন খোন্দকার আব্দুর রশিদ। এমন উদাহরণ মিলবে অজস্র।
যারা ফজলুল হক বা সুহবর্দীর সরকারের সময়কালে তাদের নেতৃত্বে আর পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৪৫-৪৬ পর্যন্ত্য টানা চেষ্টা করে গিয়েছেন বাংলা ভাষার গুরুত্ব খর্ব করে উর্দু ভাষাকে বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থায় পাকাপাকি ভাবে উচ্চ আসনে বসাতে। সেই তারাই আবার কোন জাদুমন্ত্রে মাত্র তিন চার বছরের মধ্যে উর্দু ভাষার বিরুদ্ধাচারণ করে বাংলা ভাষাকে এতটাই ভালোবেসে ফেললেন যে শুরু করে দিলেন সাড়া জাগানো এক আন্দোলন। এ প্রশ্ন কিন্তু এই ভারতের, বিশেষ করে এই পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী মানুষের মনে কখনো ওঠে নি। তাই পাকিস্তানের ইস্টবেঙ্গলে বাংলা ভাষার জন্যে যে আন্দোলন তার ব্যাপকতায় আর স্বতঃস্ফূর্ততায় আজও মুগ্দ্ধ এপারের অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী মানুষ।
যদিও বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আরো একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম হয়েছিল। সেই সংগ্রামেও চলেছিল পুলিশের গুলি। ঝরেছিল রক্ত। যে বন্দুকের গুলিতে সেদিন বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় লড়াই করা মানুষগুলির শরীর ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিল সে বন্দুক কোন ভিন দেশী বা কোন প্রতিবেশী দেশের পুলিশের ছিল না। সে রক্তপিপাসু বন্দুক ছিল এই ভারতেরই পুলিশের। সেদিন ঘটনাস্থলেই ঝরে গিয়েছিল কোন ভিনদেশী তারার নয় ১১জন ভারতীয় বাঙালীর প্রাণ। সেদিন পুলিশের গুলিতে ভয়ংকর ভাবে আহত হয়ে পরে প্রাণ হারিয়েছিলেন আরো বেশ কয়েকজন। যদিও ১৯৫২-র ২১শে ফেব্রুয়ারী প্রতিবেশী রাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া ঘটনার মতন তাকে কেউ মনে রাখে নি। দিনটা ছিল ১৯শে মে। সন ১৯৬১। আসামে তখন কংগ্রেসের সরকার। মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেসের নেতা বিমলা প্রসাদ চালিহা। কেন্দ্রেও তখন কংগ্রেসেরই সরকার। ভারতের দোর্দণ্ডপ্রতাপ এবং প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু তখনও দেশের প্রধানমন্ত্রী।
১৯৪৭-এ ভারত ভাগ করে পাকিস্তান সৃষ্টি করার সময়ে হিন্দু প্রধান হওয়ার কারণে গোটা আসামের ভারতভুক্তি নিশ্চিত হলেও প্রদেশেরই বাংলাভাষী অধ্যুষিত শ্ৰীহট্ট অর্থাৎ সিলেট জেলার ভারতভুক্তিতে মোটেই রাজী ছিলেন না আসামের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, সেই সময়ে আসাম প্রদেশ কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতা, গোপীনাথ বরদলৈ। ১৯৪৬-এই ব্রিটিশ ক্যাবিনেট মিশনকে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি মোটেই সিলেট জেলাকে ভবিষ্যতে আসামের অংশ হিসেবে আর দেখতে চান না। তাই তিনি চান সিলেট জেলাকে পূর্ববঙ্গের হাতে তুলে দিতে। তখন সিলেট জেলায় বাংলাভাষী মুসলমানরা বিশাল সংখ্যায় থাকলেও বাংলাভাষী হিন্দুর সংখ্যাও সেখানে নেহাত কম ছিল না।
হিন্দু প্রধান আসামের অংশ হিসেবে সিলেটের ভারতভুক্তি চেয়ে বাংলাভাষী হিন্দুদের দাবী শেষ পর্যন্ত্য ব্রিটিশ সরকারকে বাধ্য করেছিল উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মতন গণভোটের মাধ্যমেই সিলেটেরও ভাগ্য নির্ধারণ করতে। মুসলিম লীগের আবেদনে সিলেটের মুসলমান সমাজ খুব স্বাভাবিক ভাবেই সেই গণভোটে দাঁড়িয়েছিলেন তাদের জেলার পাকিস্তানভুক্তির পক্ষে। সাথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল সিলেটের মুসলমানদের মধ্যে মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আর তাঁর অনুগামীদের জেলার পাকিস্তানভুক্তির পক্ষে প্রচার আর অতি সক্রিয়তা। আবার কায়েদ-এ-আজম মহম্মদ আলী জিন্নাহর প্রতি আনুগত্য আর সখ্যতার ফলশ্রুতিতে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের মতন হিন্দু দলিত সমাজের নেতাও তাঁর অনুগামীদের আহ্বান জানিয়েছিলেন সিলেটের পাকিস্তানভুক্তির পক্ষেই ভোট দেওয়ার জন্য। অন্যদিকে কংগ্রেসও চায় না সিলেটের ভারতভুক্তি। ফলে অথৈ জলে পড়েছিলেন সিলেটের হিন্দুরা। এতো কিছুর পরেও ১৯৪৭এর ৬ আর ৭ই জুলাই-এর গণভোটে সিলেট জেলার পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে ভোট পড়েছিল ২,৩৯,৬১৯টা আর ভারতে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে ১,৮৪,০৪১টা। অর্থাৎ সিলেটের পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে ৫৫,৫৭৮টা ভোট বেশী পড়েছিল।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, হয় খালি আর না হয় অন্যান্য ত্রুটির কারণে বাতিল ব্যালটের সংখ্যা ছিল ১,২৩,১৫৫। অবিভক্ত ভারতের আসাম প্রদেশের সিলেট জেলার ভাগ্য নির্ধারণও হয়েছিল সেখানকার গণভোটেই। গণভোটের ফলাফলের মাধ্যমে সিলেটের পাকিস্তানভুক্তি নিশ্চিত হলেও কোন এক অদ্ভুত কারণে ১৯৪৭-এর ১৭-ই অগাস্ট সরকারী ভাবে র্যাডক্লিফ লাইনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হতে জানা গেল জেলার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ করিমগঞ্জ সাব ডিভিশন পাকিস্তানের পক্ষে ঢেলে ভোট দেওয়া সত্ত্বেও ভারতের অন্তৰ্ভুক্ত হয়েছে। যদিও আগে থেকেই আসামের বরাক উপত্যকারই হাইলাকান্দি আর কাছাড় জেলাতেও বাংলাভাষী মানুষের যথেষ্ট সংখ্যাধিক্য ছিল। ১৯৫০-এ পাকিস্তানের সিলেটে হিন্দুদের উপর মারাত্মক নির্যাতন শুরু হলে প্রাণ আর নারীর সম্মান বাঁচাতে তারা দলে দলে সেখান থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেন আসামের হাইলাকান্দি আর কাছাড়ে।
মোটের উপর এমন একটা পরিস্থিতিতে কয়েক বছর কাটতে না কাটতেই গোপীনাথ বরদলৈয়ের দেখানো পথেই – অসমীয়াই হবে আসামের এক এবং একমাত্র সরকারী ভাষা। পঠনপাঠনের মাধ্যম। ১৯৬০-এর এপ্রিলে আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিতে এই মর্মে একটি প্রস্তাব পাশ হয়। আর সে বছরেরই ১০ই অক্টোবর আসামের বিধানসভায় হুবহু সেই প্রস্তাব পেশ করেন আসামের তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা। বিধানসভায় সরকার পক্ষের সেই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন কাছাড় উত্তর বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়ক রণেন্দ্র মোহন দাস। তার যুক্তি ছিল আসামের কংগ্রেস সরকার জোর করে প্রদেশের এক তৃতীয়াংশের ভাষা চাপিয়ে দিতে চাইছেন বাকি দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের উপরে। সেই সময়ে আজকের মনিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল প্রদেশ, মেঘালয় ছিল আসামেরই অংশ। ফলে বরাক উপত্যকার তিনটি জেলা হাইলাকান্দি, কাছাড় আর করিমগঞ্জের বিপুল সংখ্যার বাংলা ভাষী মানুষের পাশাপাশি সেই সব অঞ্চলের মূলনিবাসীদের কারো ভাষাই অসমীয়া ছিল না। যদিও ২৪শে অক্টোবর আসাম বিধানসভায় পাশ হয়ে যায় কংগ্রেস সরকারের প্রস্তাব। এর প্রতিবাদে বাংলা ভাষী অধ্যুষিত বরাক উপত্যকায় শুরু হয় শান্তিপূর্ণ আন্দোলন।
যদিও এই সময়ের মধ্যেই ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় কংগ্রেস শাসিত আসামে মূলতঃ বাংলা ভাষী হিন্দুদের উপর শুরু হয় ব্যাপক অত্যাচার। ১৯৬০ এর ১৪ই জুলাই শিবসাগরে শুরু হয় বেছে বেছে নির্দিষ্ট দোকান আর বসত বাড়িগুলির লুঠতরাজ৷ নিম্ন আসামের কামরূপ সাব ডিভিশনের নওগাঁ জেলা ও পরে গোয়ালপাড়া অঞ্চলে গণহত্যা শুরু হয়৷ অধুনা বক্সা আর তৎকালীন কামরূপ জেলার গোরেশ্বরের ২৫ টি গ্রামে এই লুন্ঠন ও হত্যালীলা চালানো হয় সব থেকে বেশি৷ আইনজ্ঞ গোপালজি মেহরোত্রার নেতৃত্বে আসাম সরকার একটি তদন্ত কমিশ গঠন করতে বাধ্য হন। মেহরোত্রা কমিশনের সরকারী নথি অনুযায়ী সমগ্র অঞ্চলে চিরুনি তল্লাশি করে বেছে বেছে ৪,০১৯ টি কুটির, ৫৮ টি বসত বাড়ী সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়৷ স্থানীয় পুলিশ কমিশনারের মতে অন্ততঃ ৯ জনের মৃত্যু হয় ও বহু মানুষ আহত হন৷ মোটামুটি ১,০০০ জন বাঙালি রাতারাতি ঐ অঞ্চল ত্যাগ করেন৷ সব থেকে ঘৃণ্য হিংস্রতা শুরু হয় জুলাই ও সেপ্টেম্বর মাসে। এই সময় আশ্রয়ের খোঁজে প্রায় ৫০,০০০ বাঙালি আসাম-বাংলা সীমানা অতিক্রম করেন৷
পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুকে চিঠি লিখে এই অরাজকতার দ্রুত নিষ্পত্তি চান৷ সেই চিঠিতেই ডাঃ রায় লিখেছিলেন ৫ থেকে ১১ই জুলাইয়ের মধ্যে অন্ততঃ ৪,০০০ বাঙালি হিন্দু ভূমিচ্যুত হয়ে পশ্চিমবঙ্গে আসেন৷ ৩১শে জুলাইয়ের পর থেকে এর পরিমান বাড়তে থাকে ও তা আগস্টের শেষে ৪৫,০০০-৫০,০০০ এ পৌঁছে যায়। তার কিছুদিন আগে ১৯শে জুন বাংলাভাষী অধুষ্যিত হাইলাকান্দিতে আশ্চর্যজনক ভাবে সেখানকার কয়েক হাজার বাংলাভাষী মুসলমান পথে পথে মিছিল করে স্লোগান দিতে থাকে, “আল্লাহু আকবর – চালিহা সরকার জিন্দাবাদ – অসমীয়া ভাষা শিখতে হবে”। যদিও সেই স্লোগান তারা অসমীয়াতে নয় – দিয়েছিল বাংলা ভাষাতেই। কিছুক্ষনের মধ্যেই সেই মিছিল হিংস্র চেহারা ধারণ করে। বেছে বেছে প্রায় ২০০টার মতন বাড়ী লুঠ করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। হিংসা নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশ গুলি চালালে মারা যান প্রায় ১০ জন। যাদের মধ্যে ছিলেন রবীন্দ্র কুমার ঘোষ নামের ১৩ বছরের এক কিশোর। হাইলাকান্দির ঘটনার প্রধান ষড়যন্ত্রকারী আর উদ্যোক্তা হিসেবে উঠে আসে আসামের তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের কৃষি মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীর নাম। যে মইনুল হক চৌধুরী ছিলেন কায়েদ-এ-আজম মহম্মদ আলী জিন্নাহের ব্যক্তিগত সচিব। যিনি তার আগে বৃটিশ ভারতে কোন এক সময়ে জিন্নাহকে কথা দিয়েছিলেন ‘রুপোর থালায় সাজিয়ে তিনি আসামকে তুলে দেবেন জিন্নাহের হাতে’। যদিও দেশ ভাগের পরে তিনি আসামে কংগ্রেস সরকারে মন্ত্রী হয়েছিলেন।
ও দিকে বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা আর সাথে মনিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল প্রদেশ, মেঘালয়ের মতন অঞ্চলগুলির মূলনিবাসীদের ভাষার মর্যাদা আর গুরুত্ব রক্ষার তাগিদে ১৯৬১ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি জন্ম হয় ‘কাছাড় গণ সংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটি সংগঠনের। এই সংগঠনের উদ্যোগেই আসামের কংগ্রেস সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে ১৪ই এপ্রিল শিলচর, করিমগঞ্জ আর হাইলাকান্দির মানুষ পালন করেন ‘সংকল্প দিবস’। বিপুল সংখ্যায় স্বতঃস্ফূর্ত যোগ দান করেন মনিপুরের মূলনিবাসীরাও। বরাকের জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে ২৪শে এপ্রিল একপক্ষকাল ব্যাপী এক পদযাত্রা সংগঠিত করে ‘কাছাড় গণ সংগ্রাম পরিষদ’। ২রা মে শেষ হওয়া এই পদযাত্রাটিতে অংশ নেওয়া বাঙালি সত্যাগ্রহীরা প্রায় ২০০ মাইল উপত্যকাটির গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচার চালিয়েছিলেন। পদযাত্রার শেষে পরিষদের মুখ্যাধিকারী রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করেন – যদি ১৩ই এপ্রিলের মধ্যে বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা না হয়, ১৯শে মে সকাল থেকে সন্ধ্যে তারা হরতাল করবেন। ১২ই মে আসাম আর কেন্দ্রের দুই কংগ্রেস সরকারের উদ্যোগে অসম রাইফেল, মাদ্রাজ রেজিমেন্ট ও কেন্দ্রীয় সংরক্ষিত পুলিশ বাহিনী ফ্ল্যাগ মার্চ করেছিল শিলচরে। ১৮ মে আসাম পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন আন্দোলনের তিনজন প্রধান নেতা নলিনীকান্ত দাস, রথীন্দ্রনাথ সেন আর সাপ্তাহিক যুগশক্তির সম্পাদক, বিধুভূষণ চৌধুরী।
১৯শে মে সকাল থেকেই শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে শান্তিপূর্ণ হরতাল আর পিকেটিং আরম্ভ হয়। করিমগঞ্জে আন্দোলনকারীরা সরকারী কার্যালয়, রেলওয়ে স্টেশন, কোর্ট ইত্যাদিতে শান্তিপূর্ণ পিকেটিং করেন। শিলচরে তারা রেলওয়ে স্টেশনে সত্যাগ্রহ করেছিলেন। বিকেল ৪টের সময় নির্ধারিত যে ট্রেনটি তার সময় পার হওয়ার পর হরতাল শেষ করার কথা ছিল। সেদিন ভোর ৫:৪০ এর ট্রেনটি থেকে শুরু করে আর কোন ট্রেনের একটিও টিকিট বিক্রি হয় নি। সকালে হরতাল শান্তিপূর্ণ ভাবে অতিবাহিত হয়েছিল। কিন্তু দুপুর গড়াতেই হঠাৎ স্টেশনে উপস্থিত হয় আসাম রাইফেলস। বেলা প্রায় ২:৩০র সময় ন’জন সত্যাগ্রহীকে কাটিগোরা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের একটি ট্রাক তারাপুর স্টেশনের (অধুনা শিলচর রেলওয়ে স্টেশন) পাশ দিয়েই পার হয়ে যাচ্ছিল। সেখানে উপস্থিত আন্দোলনকারীরা তাদের সতীর্থদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে দেখে চিৎকার করে স্লোগান দিয়ে তীব্র প্রতিবাদ করেন। ভয় পেয়ে ট্রাকচালক সহ পুলিশরা বন্দীদের নিয়ে পালিয়ে যায়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই স্টেশনের সুরক্ষায় থাকা প্যারামিলিটারী বাহিনী বন্দুকের বাঁট আর লাঠি দিয়ে আন্দোলনকারীদের বেধড়ক মারতে শুরু করে। এরপর মাত্র সাত মিনিটের মধ্যে তারা নির্বিচারে অন্ততঃ ১৭ রাউণ্ড গুলি চালায় স্বাধীন ভারতের মাটিতে বাংলা ভাষার মর্যাদা আর গুরুত্ব রক্ষা করতে মাটি কামড়ে পরে থাকা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের উপর।
১৯শে মে ১৯৬১ বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে আসামের তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের পুলিশ আর কেন্দ্রের তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের আসাম রাইফেলসের গুলিতে বরাক উপত্যকায় শিলচর রেলস্টেশনে যারা প্রাণ হারিয়েছিলেন তারা হলেন: কানাইলাল নিয়োগী, চন্ডীচরন সূত্রধর, হিতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্র দেব, কুমুদ রঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুকমল পুরকায়স্হ এবং কমলা ভট্টাচার্য্য । প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ১৬ বছরের কমলা ভট্টাচার্য্যই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম নারী যিনি নিজের মাতৃ ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে আত্মবলিদান দিয়েছিলেন।
কমলা ভট্টাচার্য্যের জন্ম ১৯৪৫ সালে শ্রীহট্টে অর্থাৎ সিলেটে। ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে তাদের পরিবার শরণার্থী হিসেবে আসামে চলে আসতে বাধ্য হন। আশ্রয় নেন সিলেট লাগোয়া অসমের কাছাড় জেলার শিলচরে। এপারে এসে কমলা ভর্তি হয়েছিল শিলচরের ছোটেলাল শেঠ ইনস্টিটিউটে। ১৯৬১তেই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিল। খুব ইচ্ছা ছিল পারিবারিক আর্থিক অনটন সত্ত্বেও অন্তত বি.এ. পরীক্ষা টুকু পাশ করবে সে। সংসার চলতো ওপরের দুই শিক্ষিকা ও নার্স দিদির টাকায়। পিকেটিংয়ে যাওয়ার জন্যে ১৯শে মে সকালে স্নানটান সেরে কমলা পরে নিয়েছিল স্কুল শিক্ষিকা মেজদিদির একটি শাড়ি। প্রায় জোর করেই সেদিন কমলার সঙ্গী হয়ে সাথে বেড়িয়ে পড়ে ছোট ভাই বোন বকুল আর মঙ্গলাও। নাছোড়বান্দা বড়দির ছেলে বাপ্পাও তাদের সঙ্গী হয়। দুপুরবেলা কমলার মা দুশ্চিন্তা করতে করতে নিজেই গিয়ে একবার হাজির হয়েছিলেন রেল স্টেশনে। বকুল ও বাপ্পাকে একবার পুলিশ ধরেছিল পরে আবার ছেড়েও দিয়েছে। মাকে দেখতে পেয়েই ছুটে এসেছিল কমলা। শেষ পর্যন্ত্য বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল বাড়ীতে। অবস্থানের সময়সূচি ছিল সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা। যেহেতু শেষ ট্রেনটি ছিল বিকেল চারটে নাগাদ। স্বভাবতই অবস্থান বিক্ষোভ দুপুরের পর থেকে এমনিতই শিথিল হয়ে যাওয়ার কথা। আচমকা অসম রাইফেলসের জওয়ানরা শিলচর স্টেশন চত্বর ঘিরে ফেলতে শুরু করে। বেলা আড়াইটা নাগাদ বিনা প্ররোচনায় তারা অবস্থানকারী ছাত্রছাত্রীদের নির্মমভাবে লাঠি ও বন্দুকের কুঁদো দিয়ে যখন পেটাতে থাকে। এলোপাথাড়ি লাঠিচার্জে অবস্থানকারী জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় ও দিকবিদিকজ্ঞানশুন্য হয়ে যে যেদিকে পারে পালাতে থাকে। কমলার ছোটবোন মঙ্গলা পুলিশের লাঠির ঘায়ে মাটিতে পড়ে যায়। সাহায্যের জন্য কমলার উদ্দেশ্যে চিৎকার করতে থাকে। ইতিমধ্যে আসাম রাইফেলসের জওয়ানরা তখন জনতার উপর গুলি চালাতে শুরু করেছে। মঙ্গলাকে বাঁচাতে কমলা ছুটে গেলে একটাগুলি তার চোখ ভেদ করে নিমেষের মধ্যে মাথাটা একেবারে চুরমার করে দেয়। অন্যান্য আহত ও গুলিবিদ্ধ অবস্থানকারীদের সাথে কমলাকেও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। সেদিনের ঘটনায় নিহত হন মোট এগারো জন ছাত্র ছাত্রী, সকলেই বঙ্গসন্তান। মঙ্গলাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এক মাস বাদে জ্ঞান ফিরলেও বাকি জীবনটা তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু হয়েই কাটিয়ে দেন।
ঐদিন মারাত্মক আহত হয়ে তার কিছুদিনের মধ্যেই প্রান হারান প্রদীপ কুমার দত্ত, কৃষ্ণকান্ত বিশ্বাস, মানিক লস্কর, নিশীথেন্দ্র নারায়ন ঠাকুর, সন্তোষ চন্দ্র কির্তনীয়া, ভূপেন্দ্র কুমার পাল, সীতা দে, অঞ্জলী রানী দেব মনোরঞ্জন সরকারের মতন আরো অনেকে। শেষ পর্যন্ত্য এই ছেলেমেয়ে গুলোর আত্মদানের ফলশ্রুতিতে আসামের প্রাদেশিক সরকার বাংলা ভাষার মর্যাদাকে মেনে নিতে বাধ্য হয়। বাংলা ভাষাকে সেখানে দেওয়া হয় দ্বিতীয় অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি !
পাকিস্তানে বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের শহীদদের নিয়ে গান আছে, আমার ভায়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে…..! যদিও একষট্টিতে ভারতের বরাক উপত্যকার ঘটনা নিয়ে তেমন কিছুই নেই। ভুল হতো না যদি কেউ গাইতেন “আমার বোনের রক্তে রাঙানো ১৯শে মে”! কিন্তু তা আর হয় নি। কমলার জন্যে তার সতীর্থদের জন্য এক ফোঁটা চোখের জলও ফেলে নি এই পশ্চিমবঙ্গে বাংলা আর বাঙালির নামে সদা সর্বদা আকাশ বাতাস মুখরিত করে রাখা তথাকথিত সংস্কৃতি মনস্ক পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা।
(লেখক পরিচিতি: ইতিহাস চর্চায় ব্যাপ্ত নিবন্ধকার)
Comment here