আমার ইতিহাসসংস্কৃতি

শতবর্ষে মহেঞ্জোদাড়ো আবিষ্কার, অবহেলায় ধ্বংস হচ্ছে স্থাপত্য নিদর্শন

-শ্রী সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়

 

অ্যানাগ্লিফস; অ্যান্ড ওয়ান্ডারফুল আর্কিওলজিক্যাল ডিসকভারিজ।

১৯২৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর দ্য ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজের মাস্ট হেডের উপরে এই কথাটি লেখা ছিল। চারপাতার প্রতিবেদনে লেখার চেয়ে ছবিই ছিল বেশি, যাকে ক্যাপশন স্টোরি বললে একেবারেই অত্যুক্তি হবে না। প্রতিবেদনের প্রথম পৃষ্ঠায় ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের তৎকালীন মহানির্দেশক স্যার জন মার্শালের সঙ্গে আরও একটা নাম ছিল। শ্রী রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। বাঙালি পুরাতত্ত্ববিদ, যিনি প্রথম প্রস্তাব করেছিলেন মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পায় উৎখনন করা হোক। প্রবল বিরোধিতার মুখেও দমে যাননি। উৎখনন শুরু হয় তাঁরই তত্ত্বাবধানে। আজ থেকে শতবর্ষ আগে, ১৯২২ সালে মাটি খুঁড়ে তিনি বের করে এনেছিলেন বৌদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ের ইতিহাস। যদিও প্রথম দিকে আবিষ্কৃত অবশেষকে বৌদ্ধস্তূপ বলেই মনে করা হয়েছিল।

সিন্ধু সভ্যতার অনেক অংশ এখন ভারতে, যদিও আবিষ্কার যেখান থেকে শুরু সেই মহেঞ্জোদাড়ো এবং হরপ্পা দেশভাগের পরে পাকিস্তানে। রাখিগড়ি, ঢোলাবীরার মতো প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ভারতে হলে কী হবে, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও এইসব জায়গার নাম শুনলে অনেককেই হোঁচট খেতে হয়। ভ্রমণপিপাসুদের কাছে অজানা থেকে যায় কালিবঙ্গানের নাম। এই সভ্যতাকে সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা বলতেও অনেকে সঙ্কোচ করেন আজও।

টাকা-পয়সা দিয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তের যে ইতিহাস, কথা, কাহিনি তুলে আনার প্রয়াস শুরু হল তার প্রথম পর্বেই বিশ্বের প্রাচীনতম এই সভ্যতা আর তা নিয়ে টাকা-পয়সার কথা।

১৯২২ সালে এই সভ্যতার কথা প্রথম মাটি খুঁড়ে বের করে আনেন শ্রী রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পা বলতে প্রথমেই যে দুটো ছবি মনে পড়ে, সেই নর্তকী (ডান্সিং গার্ল) ও রাজ-পুরোহিতের (প্রিস্ট-কিং) নিদর্শনের ছবি ছাপা হয়নি ১৯২৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বরের ‘দ্য ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজে’। মহেঞ্জোদাড়ো থেকে ৪৫০০ বছরের পুরনো নর্তকী মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৯২৬ সালে। এটি এখন রয়েছে দিল্লির ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। আর অন্য নিদর্শনটি আবিষ্কৃত হয় পরের বছর। এটি এখন রয়েছে পাকিস্তানের করাচির ন্যাশনাল মিউজিয়ামে।

মহেঞ্জোদাড়োর অবশেষের ছবি প্রথম মুদ্রায় ছাপা হয় ১৯৭৬ সালে, পাকিস্তানের ১০ টাকায়। রঙ বদল করে মোট ৩ রকম ১০ টাকা পাকিস্তান ছেপেছে নিজের দেশের জন্য। সেদেশের হজযাত্রীদের জন্য ১৯৮২ সালের ১০ টাকাতেও একই ছবি ছিল। ২০০৬ সাল পর্যন্ত এই নোট ছাপা হয়েছে। এই জায়গাটি ১৯৮০ সালে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় যুক্ত হয়।

২০০৫ থেকে ২০০৭ এবং ২০০৭ থেকে এখনও পর্যন্ত মোট দু-রকম রঙে পাকিস্তানের ২০ টাকার নোটে মহেঞ্জোদাড়োর একই ছবি ছাপা হয়েছে তবে ১০ টাকার নোটে যে ছবি ছাপা হয়েছে এটি সেই দিক থেকে তোলা ছবি নয়।

এক্ষেত্রে আরেকটা কথা বলা দরকার। ভারতে বর্তমানে যেসব নোট নতুন করে চালু হয়েছে (নোটবন্দি পরবর্তী সময়ে) সেইসব নোটে পুরাতাত্ত্বিক বিচারে গুরুত্বপূর্ণ স্থানের ছবি রয়েছে, তবে সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত কোনও স্থানের ছবি তাতে নেই।

দেশভাগের পরে পাকিস্তান পেয়েছে বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতার উত্তরাধিকার, বদলে সেই সভ্যতাকে সে কী দিয়েছে তাও বিচার করার সময় এসেছে। টাকার অভাবে ১৯৯৬ সালে বন্ধ হয়ে যায় রক্ষণাবেক্ষণের কাজ। আন্তর্জাতিক আর্থিক সহায়তায় আবার সেই কাজ শুরু হয় পরের বছর। আর্থিক সাহায্যকারী দেশের তালিকায় ভারতও ছিল, প্রায় ৫০ হাজার মার্কিন ডলার অর্থ সাহায্য করেছিল। ২০১৪ সালে আবার সমস্যা শুরু। সিন্ধ উৎসবের জন্য সরকার বন্ধ করে দেয়। তারপরে অনুষ্ঠানের নামে ঐতিহ্যের উপরে তাণ্ডব করে পিপিপি।

শুষ্ক আবহাওয়া, ৫৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাওয়া তাপমাত্রা আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাব দ্রুত ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে শুরু করে বিশ্বের এক প্রাচীনতম স্থাপত্যে স্মারককে। আর এই বছরের বন্যা ভেঙে দেয় সাড়ে চার হাজার বছরের পুরনো প্রাচীর। তালিবানরা বামিয়ান ধ্বংস করেছিল গোলা-বারুদ দিয়ে আর পাকিস্তান ধ্বংস করছে অবহেলায়। এভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে অনেকটাই হারিয়ে যাবে প্রাচীনতম সভ্যতার নিদর্শন।

ছোট একটা প্রশ্নের উত্তর যাচাই করা যাক। সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে প্রায়ই একটা মত পাওয়া যায়, তা হল এখানে ঘোড়া ছিল না। তাই মহাভারতে যে ঘোড়ার উল্লেখ পাওয়া যায় সেই ঘোড়া নাকি এসেছিল অন্য কোনও ভূখণ্ড থেকে। এখানে একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে, একশৃঙ্গ যে প্রাণীর মোহর (সিলমোহর) এখানে পাওয়া গেছে, যার সঙ্গে ইউনিকর্নের মিল পাওয়া যায়, সেই প্রাণী কি তাহলে এখানে ছিল? পশুপতি নামে চিহ্নিত মোহরে যে যোগীকে দেখা যায়, যোগাভ্যাসের প্রাচীনতম নিদর্শন সেটিই। প্রাপ্ত মোহরগুলি আসলে কী, সেই প্রশ্নের এখনও কোনও সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এখনও সম্ভব হয়নি সেই ভাষা পাঠোদ্ধার করা। নিদর্শনগুলি মুদ্রা হলে, মুদ্রার ইতিহাস যে নতুন করে লিখতে হবে সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।

 

 

(লেখক পরিচিতি – প্রাক্তন সাংবাদিক, বর্তমানে ভাষাতত্ত্ববিদ; ইতিহাস চর্চা ও মুদ্রা সংগ্রহ তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান অঙ্গ)

Comments (1)

  1. […] প্রথম প্রকাশিত হয় কাঞ্জিক […]

Comment here