(চতুর্থ পর্বের পর)
এরপরে যে আড্ডার কথা বলবো সেটি হল কলেজ স্ট্রীটের আরও এক ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান’ মিত্র ও ঘোষ ‘-এর আড্ডা। সুসাহিত্যিক গজেন্দ্রকুমার মিত্র ও সুমথনাথ ঘোষ ছিলেন অভিন্নহৃদয়ের বন্ধু। এই দুই সাহিত্যিক বন্ধুর প্রচেষ্টায় মিত্র ঘোষ প্রকাশনা সংস্থার গোড়াপত্তন হয় ১৯৩৪ সালের ৯ মার্চ। ১০ নং শ্যামাচরণ দে স্ট্রীটের এই প্রকাশনা সংস্থায় আনাগোনা ছিল বাংলা সাহিত্যের বরেণ্য সব রূপকারদের।প্রমথ নাথ বিশী এই আড্ডাকেই বলতেন হাউস অফ কমনস। বিভূতিভূষণ বলতেন’গজেনবাবুর আড্ডায় তেঁতুলপাতায় নয়জন তো নয় তেরোজন।’ কারা কারা আসতেন এখানে?
যখন প্রথম মিত্র ও ঘোষ প্রতিষ্ঠা হয় তখন কবিশেখর কালিদাস রায়, ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, কবি কৃষ্ণদয়াল বসু, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধকুমার সান্যাল আসতেন। এঁরা ছিলেন আড্ডার প্রথম যুগের মানুষ। মাঝে মাঝে বাগবাজার থেকে আসতেন তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়- তখন তারাশংকর বাগবাজারেই থাকতেন। পরবর্তীকালে আড্ডার পরিসর আরও বাড়লো। ধীরে ধীরে আসরে নিয়মিত সদস্য হয়ে পড়লেন নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়, প্রমথনাথ বিশী, সজনীকান্ত দাস প্রমুখ। এইরকম একদিন আড্ডার আসরে ঢুকে পড়লেন জাদুসম্রাটপ্রতুল চন্দ্র সরকার।তাঁর ‘মেসিমেরিজম’ নামে একটি বই মিত্র ও ঘোষ থেকে প্রকাশ পেয়েছিল।
সেদিন আড্ডায় রয়েছেন আশুতোষ কলেজের বাংলার অধ্যাপক বিজনবিহারী ভট্টাচার্য। পি.সি. সরকারের সঙ্গে বিজনবাবুর পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো বাংলার অধ্যাপক হিসেবে -আমি কিন্তু শুনেছি আপনি অর্থনীতির অধ্যাপক। বলে উঠলেন পি.সি. সরকার।
– আমি অর্থের ধারকাছ দিয়েও হাঁটিনি। বললেন বিজন বিহারী।
কে বলেছে? এই তো আপনার চাদরে টাকা।এই কথা পি.সি সরকার ডান হাত বুলিয়ে দেখালেন একটা টাকা।আবার বাঁ হাত বোলাতেও গা থেকে টাকা উঠে এলো।
বিজনবিহারী চমৎকৃত হয়ে গেলেন। রসিকতা করে ব্যাগটা দুহাতে জড়িয়ে ধরে বললেন,
– দাঁড়ান মশাই।আজকে মাইনে পেয়েছি। এখান থেকে বেরিয়ে গেলে মুশকিল।
একবার হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় এলেন। সুদর্শন হরিনারায়ণ ছিলেন ক্যালকাটা ইন্স্যুরেন্সের আধিকারিক। সেদিন আড্ডায় রয়েছেন আরও একজন সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। পরস্পরের আলাপ পর্ব মিটে যাওয়ার পর অচিন্ত্যকুমার বললেন,
– আপনাকে সভক্তি নমস্কার ডবল হরিবাবু।
প্রত্যেকে অত্যন্ত অবাক। অচিন্ত্যকুমার বিষয়টি পরিষ্কার করে দিলেন,
-প্রথমে হরি তারপর নারায়ণ, ডবল হরি না?
আড্ডার আসরে মাঝে মাঝে আসতেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। চকচকে সোনালী প্রেমের রোদ চশমা। মাথার চুল সামান্য বড়ো। উজ্জ্বল কান্তি, গায়ে গরদের পাঞ্জাবি, জরিপাড় ধুতি মাটিতে লুটোচ্ছে। শৈলজানন্দ এসে ঢুকলেই পরিবেশটাই কেমন পাল্টে যেতো। আরেকবারের ঘটনাও উল্লেখ করার মতো। তবে এই ঘটনাটিতে কিছুটা দুঃখের ছোঁয়া রয়েছে।
কেমন সে ঘটনা? সে গল্প পরেরবার।
(ক্রমশ)
– পেশাগতভাবে সরকারী কর্মী, সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়েই বাঁচেন, লেখলেখির মাধ্যমে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাথে যুক্ত।
[…] পর্বের […]