সংস্কৃতি

কাব্যে উপেক্ষিতা – অন্নপূর্ণা দেবী

(প্রথম পর্ব

( কন্ঠ থেকে বৈখরি , হৃদয়ে মধ্যমা , স্বাধিষ্ঠানে পশ্যন্তি , তারও পরে গভীরে চলে গেলে নাদ আর মনুষ্য কর্ণে ব্যক্ত থাকে না , তা পরা –বাক , পরা নাদ হয়ে যায় । সুর লোকের পথে চলতে চলতে কোন অন্যমনস্ক দেবগন্ধর্ব যদি এই মর্ত্যভূমিতে এসে পড়ে , তার কষ্টের শেষ থাকে না । সে যা দেবার দিয়ে যায় , দিতে চায় , কিন্তু আমরা মানুষ এমনকি মনুষ্য গন্ধর্বরাও তার কতটুকুই বা বুঝতে পারি । সে ঐশীবস্তু ধরে রাখি এমন সাধ্যই বা আমাদের কই —- গান্ধর্বী , বাণীবসু )

লেখার শুরুতেই অন্নপূর্ণার জীবননাট্যের যাঁরা কুশীলব তাঁদে রএকটা সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দিয়ে দিই । তা না হলে এই লেখার স্বল্পপরিসরে এতগুলি চরিত্র ,পাঠকের গুলিয়ে যেতে পারে । দ্বিতীয়ত,এই পাত্রপাত্রীদের অধিকাংশই মৃত, তাই সাধারণ পাঠকের পক্ষে তাঁদের নাম শুনেই চিনতে পারা মুশকিল ।

১) বাবা আলাউদ্দিন খাঁ – অন্নপূর্ণার পিতা । মাইহার – সেনিয়া ঘরানার জনক । জন্ম — ১৮৬২ , অধুনা বাংলাদেশে অবস্থিত ত্রিপুরা রাজ্যের শিবপুর । শিষ্যত্ব করেছেন উস্তাদ আহমদ আলি খাঁর এবং উস্তাদ ওয়াজির আলি খাঁর । ১৯১৮ সাল থেকে বুন্দেলখণ্ডের মাইহার রাজ্যে বসবাস । বিখ্যাত ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন পুত্র আলি আকবর , কন্যা অন্নপূর্ণা , জামাতা রবিশংকর , নিখিল ব্যনার্জী , বাহাদুর খাঁ , পান্নালাল ঘোষ । মৃত্যু ৬ই সেপ্টেম্বর , ১৯৭২।

২) মদিনা বেগম – আলাউদ্দিনের স্ত্রী ,অন্নপূর্ণার মা ।

৩) জাহানারা বেগম — আলাউদ্দিনের জ্যেষ্ঠা কন্যা । সংগীতচর্চার জন্য শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িতা । বাপের বাড়িতে অকালমৃত্যু ।

৪) আলি আকবর খাঁ — প্রখ্যাত সরোদবাদক । জন্ম ১৪ই এপ্রিল, ১৯২২ । অন্নপূর্ণার ভাই । আলি আকবর কলেজ অফ মিউজিকের প্রতিষ্ঠাতা।

৫) অ্যালিস বোনার — ভাস্কর্য শিল্পী । উদয়শংকরের পৃষ্ঠপোষক ।

৬) আশিস খাঁ – সরোদিয়া । আলি আকবরের পুত্র।

৭) বিমান ঘোষ – রবিশংকরের বন্ধু । কর্মস্থল – অল ইন্ডিয়া রেডিও, পরে এইচএমভি ।

৮) ব্রিজনাথ সিং – মাইহারের মহারাজা । আলাউদ্দিনের পৃষ্ঠপোষক ।

৯) ধ্যানেশ খাঁ – আলি আকবরের দ্বিতীয় পুত্র । সরোদিয়া । রবীন্দ্রভারতীর প্রাক্তন শিক্ষক । অকালমৃত ।

১০) হেমাঙ্গিনী দেবী — উদয়শংকর ,দেবেন্দ্রশংকর , রাজেন্দ্রশংকর , রবিশংকরের মা ।

১১) রবিশংকর — অন্নপূর্ণার স্বামী । বিখ্যাত সেতারবাদক ।

১২) রুশী কুমার পাণ্ড্য — সেতারবাদক । মনোবিদ । অন্নপূর্ণার দ্বিতীয় স্বামী ।

১৩) সরস্বতী বা কমলাশংকর — জন্ম ২৩ শেনভেম্বর , ১৯২৩ । লক্ষ্মীশংকরের বোন , রাজেন্দ্রশংকরের শ্যালিকা । রবিশংকরের প্রেমিকা । স্বামীর নাম অমিয় চক্রবর্তী , প্রখ্যাত প্রযোজক । স্বামীর মৃত্যুর পর বিশ বছর রবিশংকরের সঙ্গিনী ছিলেন । ১৯৮১ তে রবিশংকরের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাকি জীবন কাটান চেন্নাইতে, একা ।

১৪) শ্যামশংকর চৌধুরী —- রবিশংকরের বাবা । বাল্যশৈশব কাটে ঝালওয়ার এস্টেটে । সংস্কৃতজ্ঞ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে জেনিভা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট ,বার – অ্যাট – ল শ্যামশংকর নিউইয়র্কে ভারতীয় দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন । ১৯৩৫ সালে ইংল্যান্ডে অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীর হাতে খুন হন ।

১৫) শুভেন্দ্রশংকর বা শুভ — রবিশংকর, অন্নপূর্ণার একমাত্র সন্তান । এই কাহিনীর সবচেয়ে ভাগ্যহত চরিত্র । জন্ম ৩০ শেমার্চ, ১৯৪১ । শিক্ষা মুম্বইয়ের জেজে স্কুল অফ আর্টে । ১৯৭০ এ মার্কিন যুক্ত্ররাষ্ট্রে পাড়ি। রবিশংকরের সঙ্গে বাজাতে । স্ত্রী লিন্ডা , মার্কিনি । দুই সন্তানের জনক সোমশংকর এবং কাবেরী ।

১৬ ) সুকন্যাশংকর – রবিশংকরের দ্বিতীয় স্ত্রী । রবির সঙ্গে বিবাহ ২৩ শে জানুয়ারি, ১৯৮৯ ।

১৭ ) অনুষ্কাশংকর – রবিশংকর ও সুকন্যার কন্যা । সেতারবাদক ।

১৮) উদয়শংকর — বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী । কোরিওগ্রাফার । জন্ম ১৯২০ সালে ,উদয়পুর শহরে । আনা পাভলোভার সঙ্গে নাচের পরিবেশন করে খ্যাতিলাভ । ঘুরেছেন দেশ বিদেশ । ১৯৪০ সালে আলমোড়ায় উদয়শংকর কালচারাল সেন্টারের প্রবর্তন করেন যা টাকার অভাবে ১৯৪৪ সালে বন্ধ হয়ে যায় । ১৯৭৭ সালে কলকাতায় মৃত্যু।

১৯ )অমলা নন্দী,পরে শংকর — উদয়শংকরের স্ত্রী । প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী ।

২০ )জুবেইদা বেগম —- আলিআকবরের প্রথম স্ত্রী । আশিস ও ধ্যানেশের মা ।

অন্নপূর্ণার বিখ্যাত ছাত্ররা —

১) নিখিল ব্যানার্জি( সেতার )

২) হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া( বাঁশি )

৩) নিত্যানন্দ হলদিপুর( বাঁশি )

৪) অতুল মার্চেন্ট( সরোদ )

৫) ড্যানিয়েল ব্র্যাডলে ( সরোদ )

৬) অমিত ভট্টাচার্য( বাপ্পা ) ( সরোদ )

৭) বসন্ত কাবরা( সরোদ )

৮) দক্ষিণামোহন ঠাকুর ( সেতার , তারসানাই , বীণা )

অন্নপূর্ণার জীবনের ঘটনাগুলিকে কালানুক্রমিকভাবে সাজিয়ে লিখলাম । এতে পাঠকের পরে ঘটনাগুলি বুঝতে সুবিধা হবে —

১৮৬২ —- আলাউদ্দিন খাঁয়ের জন্ম ।

১৯০০ – উদয়শংকরের জন্ম ।

১৯১৭ — বাবা আলাউদ্দিন খাঁয়ের মাইহারের রাজা ব্রিজনাথ সিংহের দরবারে সভাশিল্পী হিসাবে চাকরি লাভ ।

১৯১৮ — জাহানারার জন্ম ।

এপ্রিল , ১৯২০ —- রবিশংকরের জন্ম বেনারসে ।

১৪ ই এপ্রিল ১৯২২ —- আলি আকবরের জন্ম ।

অক্টোবর ১৯২২ — মদিনা বেগম ছয় মাসের আলি আকবরকে নিয়ে মাইহারে স্বামীর সঙ্গে স্থিতু হলেন ।

১৯২৩ — ইংলন্ডে উদয়শংকরের সঙ্গে আনা পাভলোভার পরিচয় ।

১৯২৭ — অন্নপূর্ণার জন্ম ।

১৯২৯ — উদয়শংকরের সঙ্গে সিমকি ও অ্যালিস বোনারের পরিচয় ।

১৯৩০ — উদয়শংকর ভারতে এলেন । সেই বছরই তিমিরবরণ যোগ দিলেন উদয়শংকরের সঙ্গে ।

জুলাই, ১৯৩০ — বেনারসের পাট পাকাপাকি চুকিয়ে শংকর পরিবারের বিদেশ যাত্রা ।

১৯৩৩ — উদয়শংকরের দেশে প্রত্যাবর্তন ।

১৯৩৪ — তিমিরবরণ উদয়শংকরের দল ছাড়লেন ।

ডিসেম্বর , ১৯৩৪ — উদয়শংকরের সঙ্গে বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সে বাবা আলাউদ্দিনের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ।

জানুয়ারি ,১৯৩৫ — বাবা আলাউদ্দিন খাঁয়ের উদয়শংকরের সঙ্গে বিদেশযাত্রায় সম্মতি ।

আগস্ট ১৯৩৬ — আলাউদ্দিন খাঁয়ের ইউরোপ থেকে মাঝপথে প্রত্যাবর্তন ।

১৯৩৮ — দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাককালে উদয়শংকরের দেশে প্রত্যাবর্তন ।

জুলাই , ১৯৩৮ — রবিশংকরের মাইহারে আগমন ।

১৯৪০ — আলমোড়ায় উদয়শংকর স্কুল অফ কালচারাল সেন্টারের স্থাপনা ।

মার্চ ১৯৪০ — রবিশংকর কমলার মন দেওয়া-নেওয়া শুরু । জোহরা সেহগালের দিদি উজরা সেহগালের সাথে রবির সম্পর্ক তৈরি হল ।

এপ্রিল , ১৯৪১ — রবিশংকর — অন্নপূর্ণার বিয়ের খবর পেয়ে আলমোড়া ছাড়লেন উজরা ।

১৫ ই মে ,১৯৪১ — রবিশংকর-অন্নপূর্ণার বিবাহ ।

৩০শে মার্চ , ১৯৪২ — শুভেন্দ্র ওরফে শুভশংকরের জন্ম ।

জুন , ১৯৪৪ — রবিশংকর — অন্নপূর্ণা শিশু শুভকে নিয়ে মাইহারে ফিরলেন ।

অক্টোবর , ১৯৪৪ —- রবিশংকর মুম্বইয়ের মালাডে স্থিতু হলেন রাজেন্দ্রশংকরের বাড়িতে । কমলার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হল । এই মাসেই উদয়শংকর কালচারাল সেন্টার পাকাপাকিভাবে বন্ধ হল ।

ডিসেম্বর , ১৯৪৪ — রবিশংকর অন্নপূর্ণাকে কমলার প্রতি তাঁর আসক্তির কথা জানালেন ।মতান্তরে আলি আকবরের স্ত্রী জুবেইদার কাছ থেকে অন্নপূর্ণা রবিশংকরের ব্যভিচারের কথা জানতে পারেন ।

জানুয়ারি , ১৯৪৫ — অন্নপূর্ণা শুভকে নিয়ে রবির সংসার ছেড়ে মাইহারে চলে এলেন ।

৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫ — কমলার সঙ্গে অমিয় চক্রবর্তীর বিবাহ ।

জানুয়ারি , ১৯৪৫ — রবিশংকর আইপিটি এ যোগদান করলেন ।

১৯৪৬ — রবিশংকর আইপিটিএ ছাড়লেন ।

১৯৪৭ —- রবিশংকর রেনেসাঁ আর্টিস্ট গ্রুপ তৈরি করলেন । ঐ বছরই অন্নপূর্ণা রবির সংসারে ফিরে এলেন ।

১৯৪৮ — রবিশংকরের আত্মহত্যার চেষ্টা । তৎ বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ ।

১৯৪৯ — রবিশংকরের অল ইন্ডিয়া রেডিওতে ডিরেক্টর এক্সটার্নাল সার্ভিসেস ডিভিশন ,হিসাবে দিল্লিতে যোগদান ।

১৯৫০ —- অন্নপূর্ণা দিল্লি এলেন ।

৩০ শে, মার্চ , ১৯৫৫ — রবিশংকর — অন্নপূর্ণার শেষ কনসার্ট দিল্লির কনস্টিউশন হলে ।

ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৬ — অন্নপূর্ণা রবিশংকরের ঘর ছাড়লেন ।

১৪ ই এপ্রিল, ১৯৫৬ — কলকাতায় আলি আকবর কলেজ অফ মিউজিকের সূচনা । ওই মাসেই অন্নপূর্ণা ভাইস-প্রিন্সিপাল হিসাবে যোগ দেন ।

নভেম্বর, ১৯৫৮ — অন্নপূর্ণার রবির সংসারে প্রত্যাবর্তন ।

২০ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৭ — রবি অন্নপূর্ণার চূড়ান্ত বিচ্ছেদ । রবি কমলাকে নিয়ে লস এঞ্জেলসে চলে যান ।

১৯৬৮ — অন্নপূর্ণা মুম্বইয়ের আকাশগঙ্গা অ্যাপার্টমেন্টে বাস করতে শুরু করলেন ।

১৯৭০ –শুভশংকরের আমেরিকা যাত্রা ।

৬ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭২ —বাবা আলাউদ্দিন খাঁয়ের মৃত্যু ।

ডিসেম্বর, ১৯৭২ — শুভ – লিন্ডার বিবাহ ।

১৯৭৬ — শুভ’র ছেলে সোমের জন্ম ।

১৯৮১ — রবি — কমলার বিচ্ছেদ । শুভ’র মেয়ে কাবেরীর জন্ম ।

১৯৮২ — রবি — অন্নপূর্ণার আইনিবিচ্ছেদ ।

ডিসেম্বর ১৯৮২ —- অন্নপূর্ণার সাথে রুশি কুমার পাণ্ড্য’র বিবাহ ।

২৩ শেজানুয়ারি , ১৯৮৯ — রবিশংকরের সাথে সুকন্যার বিবাহ ।

১৫ই সেপ্টেম্বর , ১৯৯২ — শুভ’র মৃত্যু ।

২৯শে এপ্রিল, ২০১৩ —রুশি কুমার পাণ্ড্যর মৃত্যু ।

১৩ই অক্টোবর , ২০১৮ — অন্নপূর্ণার মৃত্যু ।

বাল্যকাল –

মধ্য ভারতের বুন্দেলখণ্ড অঞ্চলের একটি জনপদ মাইহার । আয়তন ৪০৭ বর্গমাইল , লোকসংখ্যা বর্তমানে লক্ষাধিক । ১৯১২ সালের ৫ই জানুয়ারি রাজা ব্রিজনাথ সিং মাইহারের সিংহাসনে বসেন । ব্রিজনাথের ভূমিকা অন্নপূর্ণার জীবনে অপরিসীম । ব্রিজনাথই ছিলেন আলাউদ্দিনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক । সে যুগে আলাউদ্দিন মাইহারের মাসারদা এস্টেট থেকে বার্ষিক দেড়শটাকা ভাতা পেতেন ।

অন্নপূর্ণার জন্ম সন বা জন্মদিন একদম সঠিক ভাবে নিরূপণ করা অসম্ভব তবে এমন কথা অনুমান করা অসংগত নয় যে বাংলা ১৩৩৪ সনের ( ইংরাজী ১৯২৭ ) সনের চৈত্র সংক্রান্তির দিন অন্নপূর্ণার জন্ম হয় । ঐ দিনের ধর্মীয় অনুষঙ্গটি স্মরণ করেই রাজা ব্রিজনাথ আলাউদ্দিনের কন্যার নাম রাখেন অন্নপূর্ণা । যদিও তাঁর আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীদের চাপে তাঁর একটি মুসলমান নামও রাখা হয় — রোশনারা । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য অন্নপূর্ণার বড়বোনের নাম ছিল জাহানারা । গান গাওয়ার অপরাধে বিশেষত ভজন গাওয়ার অপরাধে শ্বশুরবাড়িতে অশেষ লাঞ্ছনাভোগ করে জাহানারা পিতৃগৃহে ফিরে আসেন , এবং অকালে মারা যান । এই কারণেই আলাউদ্দিন এবং মদিনা বেগম অন্নপূর্ণাকে গান বাজনার সংস্রব থেকে দূরেই সরিয়ে রাখতেন । কিন্তু অন্নপূর্ণার জন্য ভাগ্যবিধাতা অন্য কিছুই ভেবে রেখেছিলেন ।

উদয়শংকর তাঁর নাচের দল নিয়ে সারা ইউরোপ আমেরিকা মাতিয়ে দিয়ে ১৯৩৩ সালে ভারতবর্ষে পৌঁছন । সেই সময় ইনি উ থিয়েটার্সের ব্যানারে চলচ্চিত্রের সুরারোপের কাজ গ্রহণ করার জন্য তিমিরবরণ উদয়শংকরের দল ছাড়েন । ১৯৩৪ সালের ডিসেম্বর মাসে অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সে বাবার বাজনা শুনে বাবাকে তাঁর দলে যোগ দিতে অনুরোধ করেন । বাবা প্রথমে এই ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন , কিন্তু রাজা ব্রিজনাথ তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর পরিবারের দায়িত্ব নিতে অঙ্গীকারবদ্ধ হলে আলাউদ্দিন উদয়শংকরের দলে যোগদান করতে সম্মত হন । বিদেশে যাওয়ার সময় রবিশংকরের মা হেমাঙ্গিনী দেবী রবির দায়িত্ব বাবা’র হাতে তুলে দেন । অল্প বয়সে পিতৃহারা রবি ছিলেন চঞ্চলমতি । কী বাজনা বাজাবেন তা তখনও মনস্থ করে উঠতে পারেননি । কিছুদিন নেচেওছেন । ব্যক্তিগত জীবনে নারীসঙ্গের প্রতি তখন থেকেই উন্মুখ । এই একান্ত বহির্মুখী রবি কিন্তু বাবা আলাউদ্দিনকে প্রথম থেকেই শ্রদ্ধা করেছেন, দুজনের দৃষ্টিভঙ্গীর যোজনব্যাপী দূরত্ব সত্ত্বেও । কিন্তু আলাউদ্দিনের প্রবাসজীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি । কারণ ১৯৩৬ সালে মাইহার রাজার দেওয়ান নগেন্দ্রনাথ মজুমদার চিঠিতে আলাউদ্দিনকে জানান যে বাবার অনুপস্থিতিতে আলি আকবরের তালিম ব্যাহত হচ্ছে । উদ্বিগ্ন আলাউদ্দিন বিদেশ সফর কাটছাঁট করে দেশে ফিরে এলেন ছেলে কে ঠিকঠাক তালিম দেওয়ার জন্য । সেটা ১৯৩৬ সাল , আলি আকবরের বয়স তখন চৌদ্দ , অন্নপূর্ণার দশ । বাবা আলি আকবরকে কঠোর অনুশাসনে বাঁধলেন , রেওয়াজে সামান্য গাফিলতি হলেই বালক আলাউদ্দিনের কপালে জুটত তিরস্কারএবংমার । ঐ বয়সের আলি আকবরের পক্ষে আলাউদ্দিনের জটিল শৈলীকে আয়ত্ব করার কাজটি সহজ ছিল না । তাছাড়া বয়সোচিত চপলতাও ছিল আলি আকবরের মনঃসংযোগের পথে বড় অন্তরায় । কিন্তু বালিকা অন্নপূর্ণা একলব্যের মতো নিজেকে তৈরি করে নিচ্ছিলেন । একদিন আলি আকবর রাগ ভৈরোঁ কিছুতেই তুলতে পারছেন না , ক্ষিপ্ত আলাউদ্দিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন । মাথা ঠাণ্ডা হলে ফিরে এসে দেখেন আলি আকবরকে সুর তুলে দিচ্ছেন বালিকা অন্নপূর্ণা । নিজের কন্যার এই ঐশ্বরিক প্রতিভার পরিচয় পেয়ে সেদিনই অন্নপূর্ণাকে শিষ্যত্ব দিলেন আলাউদ্দিন , নিজের স্ত্রীর যাবতীয় আপত্তি কে উপেক্ষা করে ।

ছোটবেলা থেকেই আলি আকবর — অন্নপূর্ণার সম্পর্কের সমীকরণ ঠিক স্বাভাবিক ছিল না । আলি আকবর বেধড়ক মারতেন নিজের বোনকে ,কারণ সঙ্গীতের কঠিনতম এলাকায় অন্নপূর্ণার ছিল অনায়াস যাতায়াত । রেওয়াজের সময় আলি আকবর সুর ভুলে গেলে অন্নপূর্ণার কাছ থেকে কিউ নিয়ে বাজাতে শুরু করতেন । দাদার মার খেয়ে বিরক্ত অন্নপূর্ণা তাই এমন সময়ে কাশতে শুরু করতেন । আলি আকবর কিউ না পেয়ে বাজনা বন্ধ করলেই বাবার কাছ থেকে জুটত তীব্র তিরস্কার । জীবনের উপান্তে এসে বাল্যের দূর্ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন আলি আকবর ।

এইভাবে দুই ভাইবোনের জীবন যখন কঠোর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে ,তখনই মাইহারে উপস্থিত হলেন রবিশংকর । মুণ্ডিত মস্তক রবিকে দেখে কয়েক বছর আগের উচ্ছ্বল রবিকে চেনাই শক্ত । রবি বাবা’র পাশের বাড়িতে থাকেন আলি আকবরের সঙ্গে । জীবনে মাইহারের বাইরে পা – না – রাখা আলি আকবরকে ততদিনে দুই মহাদেশ চষে খাওয়া রবি শোনান বাইরের দুনিয়ার গল্প । এই বাইরের দুনিয়ার আকর্ষণেই সদ্যবিবাহিত আলি আকবর পুলিশ অফিসারের কন্যা , নিজের স্ত্রী জুবেইদাকে ছেড়ে তখনকার বম্বেতে পাড়ি দেবেন ।

এর মধ্যে উদয়শংকর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাককালে দেশে ফিরে এসে আলমোড়ায় স্থাপন করলেন উদয়শংকর স্কুল অফ কালচার । সারা ভারত থেকে সেরা শিল্পীরা এলেন আলমোড়ায় । ভারতের তিন ধরণের নৃত্যশৈলী ভারতনাট্যম , কথাকলি এবং মনিপুরীর তিন দিকপাল কানদাপ্পন পিল্লাই , শঙ্করন নাম্বুদ্রি এবংআমোবি সিং এলেন । এলেন বিষ্ণুদাস সিরোলি এবং বাবা আলাউদ্দিন খাঁ । কলকাতার প্রখ্যাত গয়না ব্যবসায়ী অক্ষয় নন্দীর কন্যা অমলাকে প্যারিসে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন উদয়শংকর । কলকাতা থেকে বিএ পাশ করে অমলা এলেন । এই অমলাই পরে অমলাশংকর হয়ে বিখ্যাত হবেন । মাদ্রাজের বৈদ্যনাথ শাস্ত্রীর দুই কন্যা কমলা আর লক্ষীএলেন । বৈদ্যনাথ শাস্ত্রী ছিলেন গান্ধীজীর হরিজন পত্রিকার সম্পাদক। মার্কিন মুলুকে থাকাকালীনই জোহরা সেহগালের দিদি উজরার সঙ্গে রবির একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল । জোহরা এবং উজরাও এলেন । এই সময়েই উদয়শংকর রবির সঙ্গে অন্নপূর্ণার বিয়ের প্রস্তাব রাখলেন । ইতিমধ্যেই রবির দাদা রাজেন্দ্র’র সঙ্গে লক্ষ্মীর বিবাহ হয়েছে । এই লক্ষ্মীই প্রখ্যাত ধ্রুপদী সংগীতশিল্পী লক্ষ্মীশংকর । আলমোড়াতে রবি – অন্নপূর্ণার বিবাহহল । বিবাহের সময় অন্নপূর্ণা আভাসমাত্র পাননি যে রাজেন্দ্র’র শ্যালিকা কমলার সঙ্গে রবির একটা সম্পর্ক রয়েছে ।

অন্নপূর্ণার বিবাহ পরবর্তী জীবনে প্রবেশ করার আগে একটা কথা স্পষ্ট বলে নেওয়া প্রয়োজন । দুজন শিল্পীর সহাবস্থান কখনই সহজ নয় । দ্বিতীয়ত,রবির জীবনের লাগামছাড়া যৌনতা ,তাঁর একাধিক নারীতে আসক্তি আমাদের মূল্যবোধ দিয়ে বোঝা শক্ত । অপরদিকে অন্নপূর্ণা ছিলেন জেদী , প্রচারবিমুখ , নিউরোটিক —- কখনও কখনও তাঁর আচরণ যুক্তিগ্রাহ্যতার সীমা ছাড়িয়েছে ।

(ক্রমশঃ)

Comment here