হিন্দু বাঙ্গালীর মনন বিগত ‘৬০র দশক থেকে এমন মানুষরা নিয়ন্ত্রণ করেন যাঁদের মূল উদ্যেশ্য ছিল প্রতিযোগিতামূলকভাবে সোভিয়েত সাধারণতন্ত্রকে সাহায্য করা l শাস্ত্রীজির মৃত্যুর পর আমাদের দেশের রাজনীতি এবং অর্থব্যবস্থাতে একটা বড় পরিবর্তন আনেন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী l যদিও ইন্দিরা গান্ধীর সব কুকর্মের দায় নিতে হয় নেহেরুকে l ইতিহাস ১৯৯১ পূর্ববর্তী সময়ের আর্থিক বিপর্যয়ের জন্য যদিও নেহরুভিয়ান মিশ্র অর্থনীতিকে দায়ী করা হয়, কিন্তু এই ব্যবস্থার মৃত্যু হয় সেই দিনই, যেদিন সোভিয়েত ইউনিয়নে শাস্ত্রীজির অস্বাভাবিক মৃত্যু হবার পর ইন্দিরা গান্ধী গদিতে বসেন l এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতার সম্মুখীন হয় হিন্দু বাঙ্গালীl ইন্দিরা গান্ধী, জ্যোতি বসু, সুবোধ ব্যানার্জী এবং চারু মজুমদারদের নেতৃত্বে চার ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় বাঙ্গালী, কিন্তু এরা সবাই পশ্চিমবঙ্গকে ব্যাবহার করে দাস ক্যাপিটালের সত্য প্রমানের পরীক্ষাগারে, যেখানে হিন্দু বাঙ্গালী হয়ে ওঠে গিনিপিগ l হ্যা আমি হিন্দু বাঙ্গালী বলছি, পশ্চিমবঙ্গ নয় l কিভাবে? প্রথমে রাজনৈতিক ব্যাপারটা আলোচনা হোক l
প্রথমে আসি রাজনৈতিক পরিবর্তনে –
সেই সময় দিল্লির সবচেয়ে ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন কংগ্রেস সভাপতি শ্রী কামরাজ l কিন্তু কামরাজের শক্তি ছিলেন বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী ও কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক শ্রী অতুল্য ঘোষ l অতুল্য বাবু এক অর্থে ছিলেন kingmaker l নেহেরুজির মৃত্যুর পর মোরারজির জায়গায় শাস্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রী করেন এই বঙ্গসন্তানই l দেশের সবকটা অহিন্দিভাষী মুখ্যমন্ত্রীদের একটা সিন্ডিকেট ছিল, যার নেতৃত্ব দিতেন এই হুগলী জেলার বঙ্গসন্তানটি l নেহেরু ও শাস্ত্রী তাঁর কথা শুনে চলার চেষ্টা করতেন l শাস্ত্রীজির মৃত্যুর পর আবার প্রধানমন্ত্রী পদের দৌড়ে মোরারজি এলে, ইন্দিরা গান্ধী ফোন করেন মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী দ্বারকা প্রসাদ মিশ্রকে ( ব্রজেশ মিশ্রর পিতা ) l মিশ্র দিল্লিতে এসে বাবু জগজীবন রাম ও ইন্দিরার সঙ্গে মিটিং করেন l তাঁরা বোঝেন ইন্দিরাকে প্রধানমন্ত্রী করতে পারেন একমাত্র কংগ্রেস সভাপতি কামরাজ l আর কামরাজের বুদ্ধি ও শক্তি হলেন ‘দাদা’ অর্থাৎ অতুল্য বাবু l অতুল্য বাবুকে তাঁরা আবার মোরারজির ভয় দেখালেন l বললেন নেহেরুর মেয়েকে প্রধানমন্ত্রী করে রিমোটে সরকার চালাতে l আর এখানেই ভারতীয় রাজনীতির চাণক্য ভুল করে বসলেন l তিনি জানতেন না যে পুরো খেলার পিছনে রয়েছে সোভিয়েত সাধারণতন্ত্রের গুপ্তচর সংস্থা কেজিবি আর ইন্দিরা তাঁদেরই প্রতিনিধি l
ইন্দিরাকে প্রধানমন্ত্রী করা হল l আকবর বৈরাম খাঁর সঙ্গে যা করেছিলেন, ইন্দিরা সেটাই শুরু করলেন কামরাজ ও অতুল্য ঘোষকে সরাতে l তবে গণতান্ত্রিক ভাবে l পশ্চিমবঙ্গে প্রফুল্ল সেনকে হারাতে বাংলা কংগ্রেস তৈরি হল অজয় মুখার্জীর নেতৃত্বে l যোগ দিলেন ইন্দিরার অত্যন্ত প্ৰিয় প্রণব, সিদ্ধার্থ, গনি খান l নির্বাচনের আগে হাত মেলালেন রাশিয়াপন্থী সিপিআই এর সঙ্গে l শুরু হল চূড়ান্ত কুৎসার পালা l দেশের অন্যতম সৎ মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনকে চোর বদনাম দিয়ে পরাজিত করা হল l কিন্তু একক গরিষ্ঠতা পেল না তারা l সিপিএম এর হাত ধরে গড়া হল যুক্তফ্রন্ট সরকার l তামিলনাড়ুতে হারলো কংগ্রেস l অতুল্য ঘোষ দুর্বল হয়ে পড়লেন l ভেঙে দেয়া হল সিন্ডিকেট l রাজনীতি থেকে বিদায় নিলেন দিল্লির রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা শেষ বাঙ্গালীl পরবর্তীকালে সিদ্ধার্থ রায় বা প্রণব মুখার্জীও দ্বিতীয় স্থানে গিয়েছিলেন l কিন্তু রাজার মত নন l অমাত্যের মত l বাংলার রাজনীতিতে একটা বড় অবনমন এলো l উঠে এলেন চারু মজুমদার, সুবোধ ব্যানার্জী, চিত্তব্রত মজুমদার এবং সবচেয়ে ধংসাত্মক কিন্তু শক্তিশালী জ্যোতি বসু l দিল্লির রাজনীতি থেকে বাংলার প্রতিনিধিত্ব প্রায় শেষ l( সিদ্ধার্থ বাবুর অধ্যায় বাদ দিলে )
কিন্তু বড় ক্ষতি হল বাংলার অর্থনীতিতে l যাকে বলে বিপর্যয় নেমে এলো l প্রথমতঃ ইন্দিরা আসার পরই মার্ক্সিয় অর্থনীতি চালু করা শুরু করলেন এদেশে l নেহেরুর মুক্ত অর্থনীতিকে শেষ করার দায় নরসিমা রাওয়ের উপর চাপলেও, বাস্তবে এই কবর দেন তার কন্যাই l একে একে বিদেশী শিল্পপতিরা জলের দরে তাঁদের ব্যবসা বিক্রি করে কিনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা বা নবগঠিত সিঙ্গাপুরে পাড়ি দিলেন l নতুন মালিকরা বাজার হারালেন এবং শিল্প চালাতে ব্যর্থ হলেন l কাজের পরিবেশ দিতে ব্যর্থ হলেন এবং দোষ চাপালেন শ্রমিক সংগঠনগুলির উপর l যদিও শ্রমিক সংগঠনও কিছু কম ছিল না l সঙ্গে শুরু হল মেধা পাচার l তাঁরা সেরা মেধাদেরও নিয়ে যাওয়া শুরু করলেন l( ‘চৌরঙ্গী’ ছায়াছবির উৎপল দত্ত ও উত্তম কুমারের কথা আশাকরি মনে আছে l একজন কেনিয়া গিয়ে অপরজনকে নিয়ে গেলেন ) l
দ্বিতীয় বড় ধাক্কা ব্যাংক ও ইন্সুরেন্স/বীমার জাতীয়করণ l এক সময় ব্যাংক ও বীমা ব্যাবসায় বাঙ্গালীরা যে রাজত্ব করতো, আজকের বাঙ্গালী জানেনা l উত্তম কুমারের বাংলা সিনেমা ‘শঙ্করনারায়ণ ব্যাংক’ বা ‘জীবন মৃত্যু’ তে দেখা যায় বাঙ্গালী ব্যাংকের মালিক l আমি নিশ্চিত, এই সিনেমাগুলি দেখলে আজকের যুগের যাদবপুর বা প্রেসিডেন্সির ‘ শের আফগান’ নাটক দেখা প্রজন্ম ভাববে যে এগুলি নাটক মাত্র l ১৯৬৯ এ রাতারাতি সব ব্যাংক ও ইন্সুরেন্স কোম্পানি জাতীয়করণে রাতারাতি রাস্তায় বসে যায় বহু বাঙ্গালী ব্যবসায়ী l কিন্তু বাঙ্গালীর মনন তখন মাৰ্ক্সে l “বুর্জোয়াদের সব টাকা রেশন দোকানে বেটে দিলেই সব সমস্যার সমাধান ” এটাই বিশ্বাস করতো বাঙ্গালী l
তৃতীয় সমস্যা হল, ছোট বাঙ্গালী ব্যবসায়ীদের যারা ব্রিটিশ বড় শিল্পে জোগানদার ছিল l একে শিল্পের অবস্থা খারাপ l নতুন সমস্যা হল স্বদেশী শিল্পপতি তথা মালিকদের পেমেন্ট না দেয়ার স্বভাব l যারা ব্রিটিশ কোম্পানিতে মালপত্র দিয়ে ঠিক ২০/৩০ দিনে পয়সা পেত, তাঁদের পেমেন্ট পাওয়া অশিকাংশ ক্ষেত্রে বন্ধ হয়ে গেল l ব্যবসায়ীরা তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মকে চাকরিতে পাঠাতে শুরু করলেন l নতুন যারা সৎভাবে ব্যবসায় এলো, তারা অধিকাংশই বসল পথে l যারা আজ সিন্ডিকেটকে দোষ দেয়, তাঁদের জানা উচিৎ, সিন্ডিকেট ব্যাবস্থার মূলে এই না পেমেন্ট পাওয়ার সংস্কৃতিই দ্বায়ী l
সমস্যা আরও বাড়লো যখন Chamber of Commerce থেকে বাঙ্গালী সদস্য কমতে থাকলো এবং বাড়তে থাকল ট্রেড ইউনিয়ন অফিসে l ১৯৭৭ এর পর থেকে যারা সরকারের আসে, তারা কাজের কিছুই বুঝতো না l শিল্পবিষয়ে তাঁদের পরামর্শদাতা ছিল এক কিছু Chamber of Commerce, দুই, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা l অধিকাংশ ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার ও অন্যান্য মেধাবীরা রাজ্য ছেড়ে চলে গেল l সরকারি ইঞ্জিনিয়াররা পর্যন্ত ডেপুটেশনে রাইটস, WAPCOS, EIL এ এবং ডাক্তাররা গেলেন কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরীতে l গ্ৰুপ D কর্মীদের অত্যাচারে IAS অফিসাররাও কলকাতা ছেড়ে দিল্লি পাড়ি দিয়েছে l তাহলে কে বানাবে হিন্দু বাঙ্গালীর পরিত্রাণের রাস্তা? কিছু ভুল পলিসির ব্যাপারে এখানে বলি, যা গত 44 বছরের বিভিন্ন সরকার নিয়েছে, রাজ্যের বিভিন্ন Chamber of Commerce-এর বুদ্ধিতে l যদিও পুরোটাই অলিখিত l
১) কম্পিউটার শিল্প না ঢুকতে দেয়া, যাতে বহুজাতিক কোম্পানি এসে এখানে কর্মীদের বেতন না বাড়াতে পারে।
২) জমিনীতির ব্যাপারে অসচ্ছতা রাখা, যাতে নতুন কেউ এই রাজ্যে বিনিয়োগ না করে ?
৩) জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানির কার্টেল বানিয়ে লুট চালানো l.
৪) পরিকাঠামোতে কোন বিনিয়োগে উৎসাহিত না করা l বিশেষ করে প্রফুল্ল সেন চলে যাবার পর একটা বন্দর তৈরি হল না এই রাজ্যে l
৫) বড় দেশী শিল্পপতিদের ভিলেন বানিয়ে, বাঙ্গালীদের কাছে তাঁদের ভিলেন বানিয়ে রাখা, যাতে quality বা গুণের মানদণ্ড গড়েই না ওঠে। একসময় বাঙ্গালী টাটাকে ঘৃণা করতl আদিত্য বিড়লাকে রাস্তায় জামা খুলে হাঁটিয়েছেl গত দশ বছর রাজ্য সরকারের ভুল নীতির জন্য ইনফোসিস উইপ্রোর মত বেশি বেতন দেয়া কোম্পানি আসছে না l বিনা কারণে আম্বানি ও আদানীর প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে রাখা হচ্ছে l
৬) এই রাজ্যের বহু শ্রমিক হস্তশিল্পে পটু l দূর্গা পুজোর প্যান্ডেল থেকে হস্তশিল্প মেলা তার প্রমান l কিন্তু মেলাতে ক্রেতাদের দরদামে চোখের তারা অন্ধকার দেখে l চাষীদেরও এক অবস্থা l তাঁদের চাই আন্তর্জাতিক বাজার l দরকার রফতানীর পরিকাঠামো এবং বহুজাতিক রিটেল কোম্পানির অবাধ প্রবেশ l ওয়ালমার্ট, ট্রেসকো কিংবা আমাজানের সঙ্গে এদের যোগসূত্র স্থাপন l অথচ এরই বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে 2013 তে মনমোহন সরকার থেকে বেরিয়ে আসেন মমতা ব্যানার্জী l কার লাভ হল? আমরা কি গুটিকতক স্বদেশী মাধ্যস্বত্তভোগীর জন্য দেশের কোটি কোটি মানুষের স্বার্থ বিসর্জন দেব !!? আর দেবার দায় কি একা হিন্দু বাঙ্গালীর?
তাহলে পরিত্রাণের উপায় কি? আমি আগেও বলেছি, আবার বলছি l সংস্কার l ১৯৯১-এর মত l আমূল সংস্কার প্রয়োজন প্রশাসনিক, আর্থিক এবং বিচারবিভাগীয় ক্ষেত্রে l সংস্কার না হলে পরিকাঠামো আসবে না, পরিকাঠামো না এলে শিল্প আসবে না, আর শিল্প না এলে অর্থ আসবে না l আমাদের ভুলে যেতে হবে, ‘অর্থ অনর্থম’ তত্ব l ১৯৬৬ সালে কলকাতার পতনের পর সেই শুন্যস্থান পূর্ণ করে সিঙ্গাপুর, হংকং, সাংহাই l চাঁদ সওদাগর, জব চার্নক বোকা ছিলেন না l দিল্লির সরকার এমনি এমনি প্রথম IIT, IIM, ISI, মেট্রোরেল কলকাতাকে দেয় নি l কলকাতার গত পঞ্চাশ বছরের ব্যর্থতা আশাকরি বাঙ্গালীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে দাস ক্যাপিটালের তত্ব ভুল l এবার আমরা নরসিমা রাও, অটল বিহারি বাজপেয়ীর রাস্তায় হেঁটে দেখি l মুক্তবাজারই মুক্তির রাস্তা l মাত্র ৫ বছর লাগবে পরিবর্তন হতে l ১৯৯০ সালে TCS কর্মী নিত শুধুমাত্র IIT র কম্পিউটার, ইলেকট্রনিক্স এর ছাত্র l ১৯৯৪ সালে অন্যান্য সরকারি কলেজের মেটালার্জি, সিভিল, মাইনিং সব l.মাত্র তিন বছরে শুধুমাত্র সংস্কারের দ্বারা কম্পিউটার শিল্পের বাজার কোথায় নিয়ে গিয়েছিলেন কলিযুগের চানক্য এটা তার একটা ছোট্ট উদাহরণ l আর ২০০০ থেকে NIIT, আপটেক, গ্লোবসিন l অর্থাৎ মাত্র দশ বছরে IIT র কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার যে চাকরি করতেন সেই চাকরির নাগাল পেল বিজ্ঞান ও বাণিজ্যের স্নাতকরা l ঠিক এই গতিতেই, আমাদেরও ভাগ্য পাল্টাতে পারে l শুধু দরকার সঠিক দিশা l
(ব্যৱহৃত ছবিটি একসময়ের বাঙ্গালী হিন্দুর আর্থিক আত্মনির্ভরতা ও ব্যবসায়িক সাফল্যকে প্রমাণ করে)
Comment here
You must be logged in to post a comment.