রাজনীতিস্বভূমি ও সমকাল

কলকাতা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম – মাসিক বসুমতী – ১৯৪৬

‘মাসিক বসুমতী’তে প্রকাশিত কলকাতায় মুসলিম লীগের ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’— ১৯৪৬  

ভাদ্র, ১৩৫৩ (২৫শ বর্ষ, ১ম খণ্ড, ৫ম সংখ্যা, পৃষ্ঠা – ৫৯৮-৬০২)

কলিকাতায় দাঙ্গা

মন্ত্রিমিশন যে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা পেশ করেন, ভারতীয় কংগ্রেস তাহা ক্তকগুলি সর্ত্তাধীনে গ্রহণ করিতে স্বীকৃত হন। মুসলিম ইহাতে আপত্তি জানান। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, মিশনের পূর্ব্ব প্রস্তাবে কংগ্রেস আপত্তি করিলে লীগ তা গ্রহণ করিতে সম্মত হন। ভাবে মনে হয় কংগ্রেস যাহা করিবেন, লীগ ঠিক তাহার উল্টো করিবেন। মুসলিম লীগের অন্তর্বর্ত্তী সরকার গঠন এবং গণ-পরিষদে যোগদান করিতে অস্বীকার করিবার ফলে, লর্ড ওয়াভেল কংগ্রেসের হাতেই সম্পূর্ণরূপে এই ভার ছাড়িয়া দেন। লীগের আপত্তির কারণ এই যে, কংগ্রেস দীর্ঘ-মেয়াদী অথবা প্রাদেশিক কোন কল্পনাই পুরোপুরি ভাবে গ্রহণ করেন নাই। তবে কংগ্রেসকে অন্তর্বর্ত্তী সরকার গঠনের ভার কেন দেওয়া হইল কেন? গণ-পরিষদের সার্ব্বভৌম অধিকারও লীগ স্বীকার করিতে রাজী নহেন। ৮ই আগস্ট কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির অধিবেশনে এই সকল অভিযোগের উত্তর কংগ্রেস দিয়াছেন। তাঁহারা জানাইয়াছেন যে, কোন কোন বিষয়ে আপত্তি থাকিলেও মোটের উপর তাঁহারা সমগ্র ভাবেই মিশনের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করিয়াছেন। ইহাতে প্রদেশ সমূহের স্বাধীনতাও স্বীকার করা হইয়াছে এবং ইহাও বলা হইয়াছে যে, মণ্ডলীভুক্ত হইবার প্রশ্ন সম্পূর্ণ্রূপে প্রাদেশিক। গণ-পরিষদের সার্ব্বভৌম অধিকারের অর্থ, বাহিরের কোন শক্তি ভারতের শাসনতন্ত্র রচনায় হস্তক্ষেপ করিতে পারিবে না।

কংগ্রেস শাসনভার গ্রহণ করিবার সিদ্ধান্ত করিয়া লীগকে এবং শিখ-সম্প্রদায়কে গণ-পরিষদে যোগ দিবার আমন্ত্রণ জানান। শিখ-সম্প্রদায় সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিলেন, কিন্তু লীগ অগ্রাহ্য করিলেন। যাহার ফলে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ ঘোষণা। পাকিস্তান লাভ করিবার জন্য ১৬ই আগস্ট তাঁহারা সংগ্রাম-দিবস নির্দ্ধারণ করিলেন।

১২ই আগস্ট বৃটিশ সরকারের নির্দ্দেশানুসারে লর্দ ওয়াভেল পণ্ডিত নেহেরুকে অন্তর্বর্ত্তী সরকার গঠনের আলোচনার জন্য নিমন্ত্রণ করেন। পণ্ডিত নেহেরু মিঃ জিন্নাকে সহযোগিতার জন্য আহ্বান করেন, এমন কি, সাক্ষাৎ পর্য্যন্তও করেন, কিন্তু মিস্টার জিন্না সে আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন। পাকিস্তান অর্থে পাক-ই-স্থান অর্থাৎ পবিত্রভূমি বোঝায়। তাহা লাভ করিবার জন্য ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ যে কত দূর ‘পাক্‌’ অর্থাৎ পবিত্র ভাবে অনুষ্ঠিত হইয়াছিল, তাহার পরিচয় আমরা পাইয়াছি। সংগ্রাম দিবস পালন সম্বন্ধে ১৬ই আগস্টের পূর্ব্বে লীগ-নেতাদের মধ্যে অনেক জল্পনা-কল্পনা চলে। কেহ বলেন,–এই সংগ্রাম অহিংস। কেহ বলেন,–ইহা বৃটিশের বিরুদ্ধে, কেহ বলেন—ইহা আইন অমান্য আন্দোলন। তবে যিনি যে ভাবে বলুন না কেন, ইহা যে হিন্দুদের বিরুদ্ধে আক্রমণ এ কথা কেহই স্পষ্টতঃ বলেন না। উপরওয়ালারা নির্দেশ দিলেন,–প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসে হরতাল পালন করা হইবে। হরতাল পালনে কাহাকেও বাধ্য করা হইবে না। সম্পূর্ণ শান্ত ভাবে বৃটিশ গভর্ণ্মেন্টের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হইবে। সকলেই মনে করিল, ৯ই আগস্ট কংগ্রেস যে ভাবে আইন অমান্য আন্দোলন চালাইয়াছিলেন ইহাও সেইরূপ। ১৬ই আগস্ট বুঝি ভবিষ্যতের আর একটি পূণ্যময় দিবস।

৯ই আগস্ট আর ১৬ই আগস্ট। ভারতের ইতিহাসে এই দুইটি দিনই স্মরণীয় হইয়া থাকিবে। ৯ই আগস্ট আমাদের একটি পূণ্যময় স্মৃতি। সেদিন দেশভক্তদের শোণিতে রাজপথ লাল হইয়াছিল, স্বাধীনতার জন্য, দাসত্ব-শৃঙ্খল মোচনের জন্য। সেদিন পুরুষ, নারী, বৃদ্ধ,যুবা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের গুলীত্র সামনে দাঁড়াইয়াছিল, বুক পাতিয়া, মস্তক উন্নত করিয়া। সেদিন ভারতের বীর মান বাঁচাইতে প্রাণ দিয়াছিল। সেদিনের কথা স্মরণ করিলে গর্ব্বে বুক ফুলিয়া উঠে। সে আত্মবলিদান সার্থক হইয়াছে। সকলেই একবাক্যে স্বীকার করিয়াছেন, ভারতের মুক্তি-সংগ্রামের এই অপূর্ব্ব রূপ জগতে দুর্লভ। এ জাতিকে পরাধীন করিয়া রাখা বিশ্বের কলঙ্ক!

আর ১৬ই আগস্ট। সেদিনের কথা ভাবিলে লজ্জায় মাথা হেঁট হইয়া যায়। ঘৃণায় লেখনী সরে না। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দিবস পালনের আশ্বাসের পিছনে কি হীন ষড়যন্ত্র! শুনা গিয়াছিল বিক্ষোভে বৃটিশের বিরুদ্ধে, কিন্তু কার্য্যতঃ দেখা গেল তাহা কেবল হিন্দুদের বিরুদ্ধে। ৯ই আগস্ট যে কলকাতার রাজপথ ধন্য হইয়াছিল বহু বীরের রক্তে, নিয়মতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনে সেই রাজপথ কলঙ্কিত হইল ১৬ই আগসট, কাপুরুষতাপূর্ণ ছুরিকাঘাতে, নরহত্যায়, লুঠ-তরাজে। যেখানে ক্ষমতা-গর্বিত বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের স্বার্থ বজায় রাখিবার জন্য নিরীহ, নিরস্ত্র, অহিংস জনসাধারণের উপর নির্ব্বিচারে গুলী বর্ষণ করিয়াছিল, সেইখানে ভাই ভাইয়ের বুকে ছুরি মারিল, মায়ের কোল হইতে সন্তান কাড়িয়া হত্যা করিল, ভগিনীকে রাজপথে উলঙ্গ করিল, ধর্ষণ করিল। ইহাই কি প্রত্যক্ষ সংগ্রামের স্বরূপ? ইহাই কি পাকিস্থানের নমুনা?

দলীয় প্রয়োজনের জন্য প্রধানমন্ত্রী ১৬ই আগস্ট সরকারী ছুটি বলিয়া ঘোষণা করিয়াছিলেন। কোন এক দলের প্রয়োজনে এইরূপ ছুটি ঘোষণা, বোধ হয় সরকারী ইতিহাসে এই প্রথম। এই সম্পর্কে তাঁহার উক্তি উল্লেখযোগ্য—‘শান্তিরক্ষার জন্যই এই ছুটি দেওয়া হইয়াছে। দোকানে ইট-পাটকেল ছোড়া, অথবা ট্রাম, বাস ও মোটর গাড়ী হইতে লোকজন বাহির করিয়া আনা এবং ঐ সকলে অগ্নি প্রদান করিয়া অভিপ্রায় পূর্ণ করার সুযোগ দেওয়া অপেক্ষা সংঘর্ষ এড়াইবার জন্য সরকারী ছুটির ব্যবস্থা ভাল।“ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ প্রদর্শনে তিনি এই ধরণের ভয়ের এবং সন্দেহের কথা উল্লেখ করিলেন কেন? কেবল ছুটি ঘোষণা করিয়াই তিনি ক্ষান্ত হয়েন নাই। তিনি ঘোষণা করিয়াছিলেন—তিনি ঐ দিন পূর্ণ স্বরাজ চাহেন। সরকারী চাকুরিয়া হিসাবে হ্রতালের কথা তিনি বলিতে পারেন না। তাহা ছাড়া তিনি লীগের ভক্ত হইতে পারেন, মুসলমানদের হরতাল করিতে বলিতে পারেন, কিন্তু অ-মুসলমানদের তাহাতে যোগ দিতে বলিবার তাঁহার কোন অধিকার নাই। ইহা তাঁহার সম্পূর্ণরূপে প্রধান মন্ত্রিত্বের ক্ষমতার অপব্যবহার। সংখ্যালঘিষ্ঠ হিন্দুদের হেয় করিবার ঘৃণিত প্রচেষ্টা। দবচেয়ে আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে বাঙ্গালার গভর্নর ইহার অনুমোদন করিলেন। সাম্প্রদায়িক সুবিধার জন্য এই ছুটি তাঁহার নাকচ করিবার পূর্ণ ক্ষমতা ছিল, এবং ইহাই তাঁহার কর্ত্তব্য ছিল। জনসাধারণের মনে যদি তাঁহার প্রতি অশ্রদ্ধা অথবা অবিশ্বাস জন্মে, ইহাতে বিস্ময়ের কিছুই নাই। তিনি নিজেই ইহার জন্য দায়ী।

এই ছুটির প্রতিবাদে ১২ই আগস্ট বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদের অধিবেশনে কংগ্রেস দল এক মূলতুবী প্রস্তাব উত্থাপন করিতে চাহেন, কিন্তু ডেপুটি স্পীকার তাহাতে সম্মতি দেন না। এমন কি, এই প্রস্তাবের সমর্থনে যে বক্তৃতা দেওয়া হয়, তাহা পর্য্যন্ত সংবাদপত্রে প্রকাশ নিষিদ্ধ হইয়া পড়ে। কেন? বোধহয় অকাত্য যুক্তির সন্তোষজনক উত্তর দেওয়া অসম্ভব বলিয়া।

প্রত্যক্ষ সংগ্রামের স্বরূপ সম্বন্ধে খাজা নাজিমুদ্দীন যাহা বলেন, তাহাও প্রণিধানযোগ্য—“আমরা অহিংস নহি, বাঙ্গালার মুসলমানকে আর প্রত্যক্ষ সংগ্রামের রূপ বুঝাইয়া বলিবার প্রয়োজন নাই।” ইহাকে শান্তিপূর্ণ বাণী বলিয়া ভুল করিবার কোন অবকাশ নাই। তথাপি ছুটি নাকচ হইল না।

এই সম্পর্কে বাঙ্গালার অন্যতম সচিব মিস্টার মহম্মদ আলী বলেন যে, “সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ অনিবার্য্য বলিয়াই সরকার ছু্টি ঘোষণা করিয়াছেন। মিস্টার সুরাবর্দীমুসলিম লীগের অনুগত, সেই লীগ হরতাল ঘোষণা করিলে তিনিও হরতাল ঘোষণা করিতে বাধ্য।” সবই ঠিক। কিন্তু সেই জন্য তিনি সরকারী ছুটি ঘোষণা করিবার অথবা লীগ-বর্হিভূত ব্যক্তিদের হরতাল করিতে বাধ্য করিবার অধিকার রাখেন না। অতএব দেখা যাইতেছে যে, দাঙ্গা অনিবার্য্য জানিয়াই ছুটী ঘোষণা করা হইয়াছিল এবং এই হত্যা লুণ্ঠন প্রভৃতির জন্য বাঙ্গলার সচিবসঙ্ঘ, বিশেষ করিয়া প্রধান সচিব দায়ী।

ব্যবস্থাপক সভায় ১৫ ই অগাস্ট এই ছুটি সম্পর্কিত আলোচনায় মিস্টার সুরাবর্দ্দী বলেন, এই প্রত্যক্ষ সংগ্রাম পাকিস্থান বিরোধী সকলেরই বিরুদ্ধে। য়ুরোপীয় দলের নেতা মিস্টার মার্গ্যান বলেন যে, তাঁহাদের মতে সরকার এই ছুটি ঘোষণা করিয়া সুবুদ্ধির পরিচয় দেন নাই। ইহাতে হাঙ্গামার সম্ভাবনা বাড়াইয়া তোলা হইয়াছে। কিন্তু এই আপত্তি সত্ত্বেও তাঁহাদের সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিতে সাহস হয় নাই। এ কাপুরুষতা অমার্জ্জনীয়। ‘মুখে এক মনে আর এক’ এই জন্যই য়ুরোপীয়রা ভারতবাসীর শ্রদ্ধা, বিশ্বাস অথবা সৌহৃদ আজও অর্জ্জন করিতে পারেন নাই।

১৬ই আগস্ট এই প্রত্যক্ষ সংগ্রাম আরম্ভ হইল। প্রাতঃকাল হইতেই বিভিন্ন অঞ্চলের লীগপন্থী মুসলমানেরা দলে দলে লাঠি, ছোরা, বল্লম, লৌহদণ্ড, সড়কি, সোডার বোতল ইত্যাদি লইয়া ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্থান’ ধ্বনি করিতে করিতে কলিকাতার রাজপথে বাহির হইয়া পড়িল। অক্টারলনি মনুমেন্টের এক সভা হয় এবং বহু উত্তেজনাপূর্ণ হিন্দু ও কংগ্রেস বিরোধী বক্তৃতা চলে। ফলে দাঙ্গার সম্ভাবনা সুনিশ্চিত হইয়া যায়। প্রধান মন্ত্রীও সেই সভায় এক বক্তৃতা দেন লীগের একান্ত অনুগত ভক্ত হিসাবে। ফিরিবার পথে তাহারা পাকিস্থান-বিরোধী হিন্দু-মুসলমান দোকান পাট একরকম জোর করিয়াই বন্ধ করিয়া দেয় ও হরতাল পালন করিতে বাধ্য করে। আপত্তি করিলেই হত্যা ও লুণ্ঠন চলে। দেখিতে দেখিতে রাজধানী গুণ্ডারাজে পরিণত হয়। পুলিশ সম্পূর্ণভাবে নিস্ক্রিয় থাকে। কোথায় দর্শক, কোথাও অংশীদার হিসাবে তাহার ছুটিয়া বেড়ায়। বাধা দিবার জন্য কোন চেষ্টাই করে না। তাহাদের সম্মুখেই বেপরোয়া লুঠতরাজ, নৃশংস নরহত্যা, নির্মম অগ্নিসংযোগ কার্য্য চলিতে থাকে। মির্জ্জাপুর, হ্যারিসন রোড, কলেজ স্ট্রীট মার্কেট, রাজাবাজার, মাণিকতলা, গড়পার, চিৎপুর, ধর্ম্মতলা, ওয়েলেসলী, ওয়েলিংটন, ক্ষিদিরপুর, মেটেবুরুজ ইত্যাদি অঞ্চলের অবস্থা অত্যেন্ত শোচনীয় হইয়া উঠে। পথে পথে মৃতদেহ, দোকান-ঘর ভস্মীভূত, বুকফাটা আর্তনাদ আর গুণ্ডাদের বীভৎস উল্লাস। সমস্ত প্রকার যান-বাহন এমনকি হাওড়া, শিয়ালদহের লোকাল ট্রেন চলাচল পর্য্যন্ত বন্ধ হইয়া যায়।

স্বতঃই প্রশ্ন জাগিতে পারে, এই সময় শান্তি ও শৃঙ্খলা-দপ্তরের কর্ত্তা প্রধান সচিব মিস্টার সুরাবর্দ্দী অথবা নগরের শান্তিরক্ষক পুলিশ কমিশনার কি করিতেছিলেন? প্রকাশ্য তিনি লাল বাজারের কন্ট্রোলরুমে বসিয়াছিলেন, কিন্তু কি কন্ট্রোল করিতেছিলেন? এক পুলিশের কার্য্যে বাধা দান ছাড়া আর কিছু করিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয় না। বার বার প্রশ্ন করিয়াও কন্ট্রোল রুমে কি কারণে গিয়াছিলেন? তাহার কোন সদুত্তর পাওয়া যায় নাই। এখন তিনি বলিতেছেন, পুলিশকে সক্রিয় করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন। কিন্তু পুলিশ কমিশন্র কোনরূপ তৎপ্রতা দেখান নাই। আমাদের বক্তব্য এই যে, পুলিশ যখন তাঁহার কথা অমান্য করিয়াছে তখন সেই মুহূর্ত্তে তাঁহার পদত্যাগ করা উচিত ছিল। শান্তি ও শৃঙ্খলা-দপ্তর আগলাইয়া ক্ষমতাহীন প্রধান সচিবের আসন কামড়াইয়া পড়িয়া থাকা উচিত ছিল না। কিন্তু ক্ষমতা ও অর্থের মোহ ত্যাগ করিবার জন্য, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবার জন্য যে সৎ-সাহস ও বীরত্বের প্রয়োজন, মিস্টার সুরাবর্দ্দীর বোধ হয় তাহা নাই। পুলিশ কমিশনর বলিতেছেন যে তিনি তখনই প্রধান সচিবকে বলিয়াছিলেন যে, কলিকাতায় দাঙ্গা যে ভীষণ এবং ব্যাপক আকার ধারণ করিয়াছে তাহাতে তিনি পুলিশ দ্বারা শান্তি ফিরাইয়া আনিতে অক্ষম। তিনি আরও বলিয়াছিলেন যে, পুলিশ সংখ্যায় পর্য্যাপ্ত নহে, অবিলম্বে সামরিক সাহায্য লওয়া প্রয়োজন। কাহার দোষ তাহা বিচার করিতে আমরা বসি নাই। কোন্‌ পক্ষ প্রথমে আঘাত করিয়াছিল তাহা নির্ণয় করিবারও চেষ্টা করিতেছি না। আমরা কেবল এইটুকুই বলিতে চাহি যে, প্রধান সচিবের দায়িত্ব এবং কর্ত্তব্য জ্ঞানের অভাবে এবং কর্ত্তব্য পালনে গাফিলতীর জন্য কলিকাতায় এই ভীষণ হত্যালীলা, লুঠ-তরাজ হইয়াছে।

১৬ই আগস্ট সমস্ত দিন এই অরাজকতা চলে, যাহাতে প্রাণের ও ধন-সম্পত্তির কোন মূল্যই থাকে না। সেই দিনের মৃত্যু-সংখ্যা নির্ণয় করা অসম্ভব; তবে জানা যায় যে, ১৬৯ জন ব্যক্তি প্রাণ হারাইয়াছে। মুসলমান-প্রধান পল্লীতে হিন্দুদের নৃশংস ভাবে হত্যা, নির্ম্মম ভাবে গৃহ ধ্বংস হইতে থাকিলে হিন্দু যুবকেরা বিপন্নদের উদ্ধার করিবার জন্য দলবদ্ধ হয়। হিন্দুরা স্বপ্নেও ভাবে নাই যে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম গুণ্ডামীরই নামান্তর। ফলে প্রথম দিকটায় তাহারা বিস্মিত, স্তম্ভিত এবং কিংকর্ত্তব্য-বিমূঢ় হইয়া পড়ে। লীগের অভিযোগ-হিন্দুদের আত্মরক্ষার চেষ্টা করা উচিত হয় নাই। অবাধ হত্যা ও লুণ্ঠন কার্য্যে বাধা পাইয়া তাহারা ক্ষেপিয়া উঠে ও প্রচার করিতে থাকে, হিন্দুরা মারপিত করিতেছে। দায়িত্ব-জ্ঞানহীন লীগ অনুগত পুলিশের বহু উচ্চপদস্থ কর্ম্মচারী গুণ্ডাদের অভিযোগে স্বীকার করিয়া লন এবং তদনুযায়ী প্রতিকারের-প্রেচেষ্টাও করেন। আত্মরক্ষা যে পাপ, এবং সেই পাপের জন্য সাজা পাইতে হয়, অথচ যাহারা আক্রমণ করে তাহার পাপীও নহে, সুতরাং সাজাও পাইতে পারে না, এই প্রথম দেখিলাম। বোধ হয় ইহা একমাত্র লীগ-মন্ত্রীদল শাসিত বাঙ্গালা দেশেই সম্ভব।

দ্বিতীয় দিবসেও এই কাণ্ডজ্ঞানহীন হত্যা ও লুঠতরাজ চলিতে থাকে। প্রকাশ যে, সেই দিন হতের সংখ্যা দুই শতাধিক এবং আহতের সংখ্যা দেড় সহস্রাধিক। পুলিশের তৎপরতা পূর্ব্ববৎ শিথিল থাকে। হিন্দুদের আত্মরক্ষার চেষ্টায় মুসলমান নিহত হয় নাই এ কথা বলা যায় না, তবে মুসলমান গুণ্ডাদেরমত নৃশংস হত্যা, নিরীহ অধিবাসীদের গৃহে অগ্নিসংযোগ অথবা রমণীদের উপর পাশবিক অত্যাচার সম্ভব নয়। কারণ, আত্মরক্ষা আক্রমণ নহে। তাহা ছাড়া এই বিপর্যয়ের জন্য লীগ পূর্ব্ব হইতেই প্রস্তুত ছিল। হিন্দুরা ইহার বিন্দু-বিসর্গও জানিত না।

শুনা যায়, এই জন্য বাহির হইতে গুণ্ডা ও অস্ত্রাদি আমদানী করা হইয়াছিল। আলিগড় হইতে প্রেরিত অস্ত্রপূর্ণ বহু বাক্স বিভিন্ন স্থানে ধরা পড়িয়াছে। এই হাঙ্গামার জন্য বহু দিন হইতে কলিকাতায় তোড়-জোড় চলিতেছিল। লক্ষ লক্ষ গুণ্ডা লরী যোগে আনা হইয়াছিল। ছোরা, লাঠি, বন্দুক, পেট্রল ইত্যাদি সংগ্রহ করিয়া রাখা ছিল। শহরে ১৪৪ ধারা ও সান্ধ্য আইন ১৭ই আগস্ট জারী করা হয়। কোন কোন স্থানে মিলিটারী পাহারাও বসান হয় কিন্তু সময়োপযোগী সতর্কতা অবলম্বন করা হয় নাই। ফলে অরাজকতা পূর্ণমাত্রায় চলিতে থাকে। তৃতীয় দিন রবিবারেও অবস্থা অপরিবর্তিত থাকে, তবে অগ্নিসংযোগ কিছু কম হয়। রবিবারে সামরিক বাহিনী খুব কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করার অবস্থাটা কিছু পরিমাণ আয়ত্তাধীন হয়। অনেক স্থলে উন্মত্ত জনতার উপর গুলী বর্ষণের ফলে বেশ কিছু লোক প্রাণ হারায়।

মাত্র প্রথম তিন দিনের দাঙ্গা-হাঙ্গামার মৃত্যু-সংখ্যা পাঁচ শতেরও অধিক এবং আহতের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার। এই তিন দিনে ফায়ার ব্রিগেড বারো শতেরো অধিক স্থানে অগ্নিনির্ব্বাণের জন্য যায়। যত ‘কল’ পাইয়াছিল, তাহার এক-তৃতীয়াংশ স্থানেও তাহারা যাইতে পারে নাই। পোস্ট আফিস, টেলিফোন, যানবাহন, দোকানপাট সমস্তই বন্ধ থাকে। রেশনের ও দুগ্ধ তরিতরকারীর অভাবে লোকেদের জীবন দুর্বিসহ হইয়া উঠে। হাসপাতালে রোগী ঔষধ ও পথ্য অভাবে মৃত্য বরণ করে।

এক এক সময়ে আমাদের মনে হয়, বোধ হয় ১৬ই আগস্ট ছুটী ঘোষণা না করিলে ব্যাপারটা এত দূর গড়াইত না। লীগ-গুণ্ডারা দেখিল বাঙ্গালার সচিবসঙ্ঘ লীগদলের, এবং সরকারী ছুটী ঘোষণায় মনে করিল, সরকার তাহাদের সহায়। সুতরাং তাগাদের ইচ্ছামত কার্য্যে করিতে তাহারা পারে। ফলে তাহাদের দুঃসাহস অত্যধিক বাড়িয়া গেল। তাহার উপর খাজা সাহেবের বাণী—‘মুসলিম লীগ অহিংসক নহে’—ইন্ধনের কার্য্য করিল। তাঁহাদের কার্য্যের যে এই পরিণত হইবে, সে কথা বুঝিবার ক্ষমতা সচিবসঙ্ঘের নিশ্চয়ই ছিল। তাঁহারা ইহাও জানিতেন যে, সংঘষ অনিবার্য্য। এইখানে উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, মিস্টার সুরাবর্দ্দী খাদ্য-সচিব থাকিতে বাঙ্গালায় দুর্ভিক্ষ হয়, তাহার প্রভাব বাঙ্গালা আজ পর্য্যন্ত কাটাইয়া উঠিতে পারেন নাই। এইবার আইন ও শৃঙ্খলার সচিব হিসাবে এই কলঙ্কময় দাঙ্গা। দুর্ভিক্ষও তাঁর অব্যবস্থার জন্য, এই দাঙ্গার কারণও তাঁহার অব্যবস্থায়। তাই ভগবানকে জিজ্ঞাসা করি—আর কত দিনে –কত দিনে বাঙ্গালা দেশ এই রাহুমুক্ত হইবে।

শুধু দায়িত্বহীনতার পরাকাষ্ঠা দেখাইয়া তিনি নিবৃত্ত হন নাই, অপপ্রচারের চূড়ান্ত দেখাইয়াছেন। শুক্রবার সমস্ত দিন ধরিয়া নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও বেপরোয়া লুঠতরাজ চলিতে থাকে। রাত্রিকালে মিস্টার সুরাবর্দ্দী বলেন –‘অবস্থার উন্নতি হইয়াছে’। অথচ বাঙ্গালা সরকারের বিবৃতিতে প্রকাশ—‘সে রাত্রে অবস্থার কোন অনুভবযোগ্য উন্নতি সাধিত হয় নাই এবং ১৭ই প্রভাতেই অবস্থা আরও শোচনীয় হয়’। এই ধরণের লির্জ্জলা মিথ্যা ভাষণ বোধ হয় একমাত্র মিস্টার সুরাবর্দ্দীতেই সম্ভবে।

শুক্রবার হইতে মঙ্গলবার পর্য্যন্ত এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড চলিতে থাকে। রাজপথে শব-শকুন, কাক, কুকুর, শবের গলিত মাংস ভক্ষণ করিতেছে। অলিতে গলিতে, ময়লার গাদায়, ড্রেনে, গঙ্গায়, খালে, সর্ব্বত্র মৃতদেহ, বাতাস দুর্গন্ধ-দূষিত। কলিকাতাবাসী স্তম্ভিত আতঙ্কিত। এবীভৎস দৃশ্য বোধ হয় কোন দেশে কেহ কখনও দেকেহ নাই! এই ধরণের চূড়ান্ত অরাজকতা জগতে দুর্লভ।

বিলাতের ‘টাইমস’ পত্রও এই অবস্থার জন্য মুসলিম লীগ সচিব-মণ্ডলীকে দায়ী করিয়াছেন। আরও বলিয়াছেন যে, হিন্দুরা সরকার এবং পুলিশ হইতে কোনরূপ সাহঅ্যা না পাইয়া বাধ্য হইয়া আত্মরক্ষার কার্য্য নিজেদের হাতে লয়।

লোকের ধন-প্রাণ, এবং দেশের শান্তিরক্ষার চূড়ান্ত অক্ষমতা এবং অযোগ্যতা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হইবার পরও, এবং বাঙ্গালায় এক মুসলিম লীগ ছাড়া সকল শ্রেণীর পুনঃ পুনঃ অনুরোধ সত্ত্বেও বাঙ্গালার গভর্ণর কেন যে সচিবসঙ্ঘ সরাইয়া ১৩ ধারা প্রয়োগ দ্বারা শাসন-ভার নিজ হস্তে হ্রহণ করিলেন না, তাহা বোঝা শক্ত। সরান দূরে থাক তাঁহাদের কোন কার্য্যে বাধা পর্য্যন্ত প্রদান করেন নাই। যাঁহারাই লীগের নির্দ্দেশ না মানিয়া স্বাধীন ও সুষ্ঠভাবে নিজ কর্ত্তব্য পালন করিয়াছেন, লীগ সচিবসঙ্ঘ তাঁহাদের তখনই সরাইয়া লীগভক্তদের সেই স্থানে মোতায়েন করিয়াছেন। কলিকাতা পুলিশে উত্তর ও দক্ষিণ উভয় বিভাগেই সুই জন মুসলমান নিয়োগ করার উদ্দেশ্য কি অত্যেন্ত সুস্পষ্ট নহে?

অবস্থা চরম সীমায় পৌঁছিবার পরও শান্তিরক্ষার জন্য সামরিক সাহায্য লওয়া হয় নাই, পুলিশকে প্রস্তুত থাকিতেও বলা হয় নাই। অথচ মিস্টার সুরাবর্দ্দী ও তাঁহার সমর্থকেরা বলেন যে তিনি লাল বাজারের কন্‌ট্রোল-রুমে বসিয়া তিন দিন ধরিয়া আহার-নিদ্রা ত্যাগ করিয়া কিসে শান্তিরক্ষা হয় তাহার ব্যবস্থা করিতেছিলেন। অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করিতেছেন যে, তিনি পুলিশকে নিস্ক্রিয় থাকিবার নির্দ্দেশ দিয়াছিলেন। এমনও শোনা গিয়াছে যে, কেবল মুসলমান পুলিশের উপরই শান্তিরক্ষার ভার অর্পণ করা হইয়াছিল। মুসলমান দারোগাদের পক্ষপাতিত্বের কথা কানে আসিয়াছে। কোন এক থানার পাশের বাড়ী হইতে মুসলমানেরা গুলী বর্ষণ করিয়া কয়েক জন হিন্দুকে আহত করিয়াছে, কিন্তু দারোগা তাহাদের গ্রেপ্তার করিবার অথবা অস্ত্র কাড়িয়া লইবার কোন চেষ্টাই করেন নাই, এ খবরও পাওয়া গিয়াছে। অনেকে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন যে, লীগ গুণ্ডারা আক্রমণ করিবার পর যখন হিন্দুরা আত্ম-রক্ষার্থ তাহাদের তাড়া করিয়াছে, তখন তাহারা থানায় আশ্রয় লইয়াছে। দারোগা দয়াপরবশ হইয়া তাহাদের ভাশ্রয় দিয়াছেন এবং হিন্দুদের গ্রেপ্তার করিয়াছেন। এ দয়া যে তাঁহারা হিন্দুদের উপর কখনও দেখান নাই, তাহা বলাই বাহুল্য। আমরা ঘুরিয়া দেখিয়াছি, অধিকাংশ স্থলেই লুণ্ঠিত দোকান, গৃহ, অথবা ভস্মীভূত গৃহ হিন্দুদের। হিন্দুরা নিশ্চয়ই নিজেরা তাহা করিয়া লীগ গুণ্ডাদের নামে দোষারোপ করিতেছে না। পার্ক সার্কাস, ধর্ম্মতলা, চৌরঙ্গী ইত্যাদি বহু স্থানে হিন্দুদের দোকান, গৃহ, লুণ্ঠিত, ভস্মীভূত, কিন্তু মুস্লমানের দোকানে অথবা গৃহে আঁচড়টি পর্য্যন্ত লাগে নাই। লীগের সভাপতি এবং ‘আজাদ’-পত্রের স্বত্বাধিকারী মৌলনা আক্রম খাঁর চোখের সামনে তাঁহার হিন্দু-বন্ধুর গৃহ লুণ্ঠিত হইল, অধিকাংশ অধিবাসীদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হইল। কিন্তু তিনি বিশেষ কিছু করিয়াছিলেন বলিয়া শোনা যায় নাই। অথচ গুণ্ডাদের আক্রমণের পূর্ব্বে তিনি বন্ধুকে আশ্বাস ও অভয় দিয়াছিলেন। উত্তর-কলিকাতায় তদানিন্তন ডেপুটি কমিশনর মিস্টার খোন্দকারের পক্ষপাতিত্বের কথা লিখিবার প্রবৃত্তি হয় না।

এক জন লীগ-গুণ্ডার নিকট প্রধান সচিবের স্বাক্ষরযুক্ত পেট্রল কুপন পাওয়া যায়। ইহাও শুনা গিয়াছে যে, মিস্টার সুরাবর্দ্দী লীগের ব্যবহারের জন্য পেট্রল চাহিলে এক জন রাজকর্ম্মচারী তাহাতে আপত্তি করেন। প্রধান সচিব নিজের ক্ষ্মতার হুমকি দেন, তাহাতেও সেই দায়িত্বশীল কর্ম্মচারী এই ধরণের দলীয় কাজের জন্য পেট্রল দিতে অস্বীকার করেন। তখন মিস্টার সুরাবর্দ্দী ‘রিলিফ’ কাজের জন্য পেট্রল চান, কর্মচারিটি তাহা ‘স্যাংশন’ করিতে বাধ্য হ’ন। অবশ্য কোন্‌ কাজে সেই পেট্রল ব্যবহৃত হইয়াছিল তাহা একমাত্র প্রধান সচিবই বলিতে পারেন।

গত ২৫শে আগস্ট শ্রীযুত শরৎচন্দ্র বসু-প্রমুখ কংগ্রেসী নেতাদের অনুরোধে বড়লাট লর্ড ওয়াভেল নিজে আসিয়া কলিকাতার পর্য্যুদস্ত স্থানগুলি প্রদর্শন করেন এবং বহু জনের বক্তব্য শোনেন। টেরেটী বাজারের ধ্বংসলীলা দেখিয়া তিনি বলেন যে লালবাজারের এত সন্নিকটে এই ধরণের কাণ্ড হইতে পারে তিনি সচক্ষে না দেখিলে বিশ্বাস করিতে পারিতেন না। শরৎ বাবু তাঁহার নিকট বাঙ্গালার গভর্ণরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে তিনি মিস্টার সুরাবর্দ্দীর সঙ্গে যাইয়া মুসলমানদের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা দেখিয়া আসেন, অথচ তাঁহার (শরৎ বাবুর) সহিত কোন স্থানে যাইতে রাজী হন না। গভর্ণরের পক্ষে এ পক্ষপাতিত্ব অমার্জ্জনীয়।

দাঙ্গার পর মাস খানেক কাটিয়া গিয়াছে, কিন্তু অতর্কিতে গোপনে ছুরি মারা এখনও বন্ধ হয় নাই। ২/৪টি করিয়া প্রত্যহই চলিতেছে। ৫ই সেপ্টেম্বর ৩ জন নিহত এবং ২৫ জন আহত হয়। শহরের আতঙ্ক এবং চাঞ্চল্য এখনও দূর হয় নাই। ২৩শে সেপ্টেম্বর কলিকাতায় ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামায় ৯ জন হত এবং ৬২ জন আহত হয়। বিভিন্ন অঞ্চলে বেপরোয়া মার-পিট এবং যথেচ্ছ ছোরাছুরি চলে। জনতার উপর পুলিশ দুইবার গুলী বর্ষণ করে এবং বহু স্থানে কাঁদুনে গ্যাস ব্যবহার করিতে হয়। লালবাজারের সন্নিকটস্থ লালদীঘিতে একটি মৃতদেহ ভাসমান অবস্থায় দেখা যায়। ২৪শে সেপ্টেম্বর পার্কসার্কাস অঞ্চলে ট্রামযাত্রীদের উপর লীগ-গুণ্ডারা আক্রমণ করে। আঘাতের ফলে হাসপাতালে এক জনের মৃত্যু হয়। শরের বিভিন্ন স্থানে মোট ছুরিকাহতের সংখ্যা ১১ জন। লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, সর্ব্বত্র প্রথম আক্রমণ মুসলমানেরাই করিতেছে। এই দু”সাহসের কারণ বাঙ্গালার গভর্ণর।

বড়লাট কলিকাতার দাঙ্গা-হাঙ্গামা সম্পর্কে এক তদন্ত কমিশন নিয়োগের প্রস্তাব করেন। কিন্তু বাঙ্গালার লীগ-মন্ত্রীত্ব বজায় থাকিতে সেই কমিশন কত দূর নিরপেক্ষভাবে কাজ করিতে পারিবেন তাহা বলা শক্ত। যিনি প্রধানত দায়ি তিনিই যদি প্রধানমন্ত্রীর গদীতে আসীন থাকেন, তাহা হইলে নিরপেক্ষ বিচার সন্দিহান হওয়া বোধ করি অন্যায় নয়।

মুসলিম লীগ যে তীব্র হলাহল উদ্‌গিরণ করিয়া সারা ভারতের, বিশেষতঃ বাঙ্গালার দেহ জর্জ্জরিত করিয়া তুলিতেছে, তাহার কূফল হইতে বাঙালী হিন্দুকে কেমন করিয়া রক্ষা করা যায়, তাহা লইয়া চারি দিকেই আলোচনা চলিতেছে। বাঙ্গালার ব্যবস্থাপক সভায় বাঙালী হিন্দু সংখ্যালঘিষ্ঠ দল্ল মাত্রে পরিণত হইয়া একেবারে অসহায় হইয়া পড়িয়াছে। বাঙ্গালা গভর্ণমেন্টে হিন্দুর স্থান নাই। মুসলিম লীগের নেতারা এখানে একাধারে পাকিস্থানী নীতির পাণ্ডা ও সরকারি শাস্তিরক্ষক। যাঁহারা সাপ হইয়া আমড়াইতেছেন, তাঁহারাই আবার ওঝার রূপ ধরিয়া বিষ ছাড়াইবার ভাণ করিতেছেন। ফলে দাঙ্গা-হাঙ্গামার আর শেষ নাই। কলিকাতার দূষিত আবহাওয়া মফঃস্বলের ভিন্ন ভিন্ন সহরে এবং গ্রামে ছড়াইয়া পড়িতেছে। অচিরে মুসলিম লীগের মনোবৃত্তির যে পরিবর্ত্তন হইবে সে সম্ভাবনা দেখা যাইতেছে না। অধিকন্তু বাঙ্গালার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে দুই-চারিজন জাতীয়তাবাদী মুসলমান নেতা ছিলেন তাঁহারাও ক্রমশঃ ভয়েই হউক আর ভক্তিতেই হউক লীগের দলে গিয়া যোগ দিতেছেন।

দিনে দিনে বাঙ্গালী হিন্দুর পক্ষে নির্বিঘ্নে জীবনধারণ করা অসম্ভব হইয়া উঠিতেছে। বাঙ্গালায় বৃটিশ শাসনকর্ত্তা বা বৃটিশ জাতিভূক্ত রাজ-করম্মচারীরা যে ভেদনীতির প্রশ্রয় দিয়া আপনাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বজায় রাখিতে ব্যস্ত, এরূপ মনে করিবার অনেক কারণ ঘটিয়াছে। সুতরাং বাঙ্গালার বর্ত্তমান শাসনপ্রণালীর আমূল পরিবর্ত্তন না হইলে সে দেশে আবার শান্তি ফিরিয়া আসিবে তাহা মনে করা কঠিন। কেহ কেহ বলেন, গণ-পরিষদে যখন সারা ভারতের জন্য নূতন শাসন-প্রণালী রচিত হইবে তখন সাম্প্রদায়িক পৃথক নির্ব্বাচন-প্রথা, সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা প্রভৃতির যে সমস্ত ব্যবস্থা দ্বারা বাঙ্গালা দেশে বৃটিশ গভর্ণমেন্ট হিন্দুদের প্রভাব খর্ব্ব করিয়াছেন। সেই সমস্ত ব্যবস্থাগুলি পরিবর্ত্তিত হইবে, এবং বাঙ্গালার হিন্দু ও মুসলমান নেতৃবৃন্দ সমবেত ভাবে এ দেশের শাসন-কার্য্য পরিচালনা করিয়া ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়গুলির মধ্যে বিশ্বাস ও প্রীতি ফিরাইয়া আনিবেন। কিন্তু মুসলিম লীগের বর্ত্তমান মনোভাব যে অদূর ভবিষ্যতে পরিবর্ত্তিত হইবে তাহা মনে করিবার কোন কারণ আমরা দেখিতে পাইতেছি না। বিশেষতঃ বৃটিশ মন্ত্রীগ্মিশন ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশমণ্ডল সৃষ্টি করিয়া প্রচ্ছন্ন ভাবে পাকিস্থান গঠনের যে প্রস্তাব করিয়াছেন, নির্বিষ্ট-চিত্তে তাহা পাঠ করিলে ভবিষ্যতের সব আশাই লোপ পায়। সেই প্রস্তাব কংগ্রেস মানিয়া লইতে স্বীকৃত হইয়াছেন। সুতরাং গণ-পরিষদেও বাঙ্গালা ও আসামের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান প্রতিনিধিরাই যে এই প্রদেশগুলির শাসন-ব্যবস্থা রচনা করিবেন তাহাতে সন্দেহ নাই। কাজেই পৃথক নির্ব্বাচন-প্রথা ও সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার হাত হইতে মুক্তিলাভ করিবার কোন সম্ভাবনাই গণপরিষদের মধ্যে নিহিত নাই।

বাঙ্গালার মুসলিম লীগ সমগ্র বাঙ্গালা দেশকে পাকিস্থানে পরিণত করিতে দৃঢ়সঙ্কল্প; এবং তাঁহারা যদি কৃতকার্য্য হন তাহা হিলে ভবিষ্যতে যে বাঙ্গালা দেশ হইতে হিন্দু-সংস্কৃতি লোপ পাইবে তাহা সহজেই বুঝিতে পারা যায়। এক্ষেত্রে বাঙ্গালী হিন্দুর সংস্কৃতি বা৬চাইবার উপায় কি?—এ প্রশ্ন অনেকের মনেই উদয় হইয়াছে। সুদূর ভবিষ্যতে বাঙ্গালার রূপ কেমন দা৬ড়াইবে সে আলোচনা করিয়া আপাততঃ কোণ লাভ নাই। যাহারা শক্তিমান তাহারাই যে জীবন-সংগ্রামে জয়ী হইবে তাহা স্বতঃসিদ্ধ। কাজেই যাঁহারা বাঙ্গালী হিন্দুর ধর্ম্ম, সাধনা ও সংস্কৃতি মূল্যবান বলিয়া মনে করেন, বর্ত্তমানে কি উপায় অবলম্বন করিলে বাঙ্গালী হিন্দুকে শক্তিমান করিয়া তুলিতে পারা যায়, সে সম্বন্ধে আলোচনা করিয়া একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া তাঁহাদের অবশ্য কর্ত্তব্য।

সুস্থ-মস্তিষ্ক হিন্দু ও মুসলমান নেতারা যদি সম্মিলিত ভাবে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের শাসনের স্বরূপ জনসাধারণের নিকট উদ্‌ঘাটিত করেন এবং যাহাতে দুই সম্প্রদায় একত্রে শান্তি পূর্নভাবে জীবন-যাপন করিতে পারে সেই নির্দ্দেশ দেন, তবেই জাতির মঙ্গল। হিন্দুরা মুসলমানদের অথবা মুসলমানরা হিন্দুদের বাদ দিয়া বাঙ্গালা দেশে থাকিতে পারিবে না। পরস্পরের স্বার্থ ওতঃপ্রোত ভাবে জড়িত।এই ‘Divide and Rule’ পলিসিবৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য, সে কথা ভুলিলে চলিবে না। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে আমরা তাহাদের হস্তের ক্রীড়নক হইয়া নিজেদের সর্ব্বনাশ নিজেরাই করিতেছি।

Comment here