– শ্রী জ্যোতিষ্মান সরকার
সন ১৫০৩ পর্যন্ত হিজলীতে শাসন করে হিজলীর শেষ রাজা গোবর্ধন দাস ভুঁইয়া হুসেন শাহের উড়িষ্যা অভিযান চলা কালে পাঠান বাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধ করতে গিয়ে মারা যান।
খুব সম্ভবত ইসমাইল গাজির অধীনে সৈন্য হিসেবে তাজ খাঁ এখানে আসে।
লোহানী সালতানাতের ইতিহাস কি!? কিভাবে উঃ উড়িষ্যা ও দক্ষিণ মেদিনীপুর জুড়ে এই অত্যাচারী হিন্দু বিদ্বেষী রাজশক্তির বিস্তার হল জানুন বিস্তারিত।…..
সেখানে তখন থেকেই মসনদ ই আলী তাজ খাঁ লোহানী হিজলি বালাসোর বারিপাদা অঞ্চলে লোহানী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে হোসেন শাহের অধীনে।
হিজলী সেই সময় একটা দ্বীপ ছিল: ভাটি অঞ্চলের মধ্যেই এই অঞ্চল তখন পড়ত।১৫৩০ তে প্রতাপরুদ্রের মৃত্যুর পর হোসেন শাহের শাসন অধীনে উড়িষ্যার পুরী চলে আসে । তখন হিজলী বালাসোর সহ উড়িষ্যার বিরাট অঞ্চলের শাসক নিযুক্ত হয় তাজ খাঁ লোহানী।[ ১২]
- ময়নাগড়ের ষড়যন্ত্র:
১৫৬০ সালে ময়নাগড়ের রাজা সুরথ সিংহকে তার মন্ত্রী ভীমসেন মহাপাত্রের সাথে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করে তাজ খাঁ লোহানী ও তার পুত্র ইশা খাঁ। এভাবে পশ্চিম মেদিনীপুরেও নিজের প্রভাব সুদৃঢ় করে।
তাজ খাঁ লোহানী মসনদ ই আলী ঘোষণা করে ।ইশা খাঁ পরবর্তীতে সিংহাসনে বসে স্বাধীন সুলতান ( কররানি অধীনস্থ না)। ভীমসেন মহাপাত্র দেওয়ান নিযুক্ত হয়।[ ২]
- ধৃষ্টতাপূর্বক কর্ণগড় অধিকার:
লক্ষণ সিংহের ভ্রাতা শ্যাম সিংহের সহায়তায় ১৫৯০ খ্রি: কর্ণগড়ের রাজা লক্ষণ সিংহকে হত্যা করে ইশা খাঁ কর্ণগড় দখল করে শ্যাম সিংহকে হাতের পুতুল হিসেবে সিংহাসনে বসায়। যদিও সেটা স্থায়ী হয়নি।ভুরিশ্রেষ্ঠর রাজা রুদ্রনারায়ণ লক্ষণ সিংহের ভ্রাতাকে সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে।[১]
- মান্দারান জাহানাবাদের যুদ্ধ:
১৫৯০ খ্রি: তে মান্দারান জাহানাবাদ অঞ্চলে বিষ্ণুপুরের সামন্ত শাসক আক্রমণ করে বীরেন্দ্র সিংহকে ইশা খাঁর ভ্রাতা কতলু খাঁ লোহানী হত্যা করে। পরবর্তীতে আরো উত্তরবর্তী হয়ে বিষ্ণুপুর আক্রমণের প্রয়াস করে । কিন্তু মুঘল ও বীর হাম্বিরের মিলিত বাহিনীর সম্মুখীন হয় কতলু খাঁ। পশ্চাদপসরণের চেষ্টা করলে ভুরিশ্রেষ্ঠ রাজ রুদ্রনারায়ণ দামোদরের ( এখনকার কানা দামোদর/ কানা নদী ) তীরবর্তী বাহিরগড় দুর্গের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।[১][৪]
ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তৈরী সেই সময় পাঠান শিবির থেকে আসে সন্ধির প্রস্তাব পাঠান অধিপতি কোতুল খাঁ-এর এই সন্ধি প্রস্তাবের অস্তরালে লুকিয়ে ছিল এক দুরভিসন্ধি। বিচক্ষণ রাজা বীর হাম্বীর জগৎ সিংহকে এই বিষয়ে সাবধান করে দেন পূর্বেই। কিন্তু স্বীয় শক্তিমত্তায় দর্পিত জগৎ সিংহ বীর হাম্বীরের কথায় কর্ণপাত করেন না। ফলতঃ একদিন গড়মান্দারণ যাবার পথে অকস্মাৎ আক্রান্ত হয়ে পাঠানদের হাতে বন্দী হন জগৎ সিংহ। জগৎ সিংহের এই ভয়াবহ পরিণতির খবরে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন স্বয়ং মান সিংহ। রণবীর বীর হাম্বীর তখন পাঠান অধিপতি কোতুল খাঁকে আক্রমণ করে বন্দীমুক্ত করেন জগৎ সিংহকে। এর ফলে মান সিংহ তথা মোগল শাসকের সাথে বীর হাম্বীরের গড়ে ওঠে এক সুসম্পর্ক। পক্ষান্তরে কোতুল খাঁ তথা পাঠান সেনাবাহিনী পরিণত হয় চিরশত্রুতে। এই শত্রুতার বশবর্তী হয়ে তারা বিষ্ণুপুরের অধীনস্থ গড়মান্দারণের সামস্ত সর্দার বীরেন্দ্র সিংহকে হত্যা করেন এবং গড়মান্দারণ দুর্গকে সম্পূর্ণরূপে ধূলিসাৎ করেন।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করি, সাহিত্য-সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসের পটভূমিকা রচিত হয় এই গড়মান্দারণের অধুনা বিলুপ্ত শৈলেশ্বর শিবমন্দির ও শিবলিঙ্গকে কেন্দ্র করে।”গড়মান্দারণ দুর্গ ধ্বংস করার অব্যবহিত পরেই মল্লবাহিনীর আক্রমণে মারা যান কোতুল খাঁ। কোতুল খাঁর সমাধি কোতুলপুরে বিদ্যমান এবং তাঁর নামানুসারেই স্থানটির নাম হয় কোতুলপুর। কোতুলপুর বিষ্ণুপুরের পূর্ব দিকে মাইল ২০ দূরে অবস্থিত। অপ্রত্যাশিত এই বিপর্যয়ে পাঠান সৈন্যদের সাহস ও মনোবল ভেঙে পড়ে। এমতাবস্থায় কোতুল খাঁর অসহায় পুত্র নাসির খাঁ যুদ্ধের পথ পরিহার করে সন্ধি করেন
দ্রুত যোগাযোগব্যবস্থার সুবিধার জন্য তিনি সমগ্র মল্লভূম জুড়েই উঁচু উঁচু স্তম্ভ তৈরি করেছিলেন। শত্রু আক্রমণের খবর এতে তাঁর কাছে অনেক আগেই খুব সহজে পৌঁছে যেত। এই স্তম্ভগুলোকে তখন বলা হত ‘মাচান’। আজও বাঁকুড়ায় কোনো কোনো জায়গায় এইসব স্তম্ভের ভাঙা অংশ দেখা যায়। বাঁকুড়া স্টেশনের কাছে ‘মাচানতলা’ অঞ্চলের নামকরণের কারণও এটিই। যদিও নাম থাকলেও এই অঞ্চলের মাচানটি বহুকাল আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে।
হাম্বীরের প্রতাপ এতই ছিল যে, বিষ্ণুপুরের ওপর থেকে কর চাপানোর চেষ্টা বাদশা আকবর হাম্বীরের জীবনকালে করেনি আকবর ।
কতলু খাঁর বাহিনী পরাজিত হয় ও রণে ভঙ্গ দিয়ে পলায়ন করে কতলূ ।ও আহত অবস্থায় কোতলপুরে মারা যায় সেই থেকে ঐ অঞ্চলের নাম কোতলপুর।এখনো ওখানে পাঠান উত্তরসূরিরা বসবাস করে।[ ৪]
এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ঈশা খাঁ মেদিনীপুর সহ ভঞ্জভূম( ময়ূরভঞ্জ) বিস্তৃত অঞ্চলের কর্তৃত্ব হারায় ও লক্ষণ সিংহের পৌত্র রাজা ছোটু রায়কে পরবর্তী শাসক হিসেবে সিংহাসনে বসানো হয়।[ ১]
- হিজলির যুদ্ধ (১৫৯১ খ্রি:) রায়শ্রেষ্ঠ মহারাজ প্রতাপাদিত্যের উড়িষ্যা বিজয় ও শ্রীক্ষেত্র জগন্নাথ মন্দির পুনরুদ্ধার । [৬]
সাগরদ্বীপ অঞ্চলে মহারাজ প্রতাপাদিত্যের নৌঘাঁটি ছিল। ঈশা ও কতলু খাঁর আগ্রাসী নীতিতে রাঢ়ের একের পর এক হিন্দু রাজ্য আক্রান্ত হচ্ছিল। [৪]
এইসময় ঈশা খাঁ বসন্ত রায়ের সঙ্গে সমঝোতা করে যশোর আক্রমণের পরিকল্পনা করেন ঈশা খাঁ।এই সংবাদ জানতে পেরে প্রতাপাদিত্য পিতৃব্য বসন্ত রায়কে হত্যা করেন । বসন্ত রায়ের এক পুত্র কচু রায় আগ্রায় আশ্রয় নেয়।[৬] এবং কোন সুযোগ না দিয়ে হিজলি নৌবন্দরে সরাসরি আক্রমণ করেন। যুদ্ধে ঈশা খাঁ মারা যায় দুর্গ রক্ষা করতে করতে।[২][৫][৭][৪]
শ্রী রজনীকান্ত চক্রবর্তীর গৌড়ের ইতিহাস অনুসারে সাগরদ্বীপে প্রতাপাদিত্যের নৌঘাটি ছিল। খুব সম্ভবত সেখান থেকেই হিজলি আক্রমণ পরিচালনা হয়। [১১]এই যুদ্ধে যশোর বাহিনীর হয়ে নেতৃত্ব দেন সান ফ্রান্সিসকো রুড্ডা
১৫৯১ খ্রিঃ উড়িষ্যার অত্যাচারী red শাসক ঈশা খাঁ লোহানীকে পরাজিত করে উড়িষ্যার পুরী বালাসোর অঞ্চল নিজের অধীনে আনেন মহারাজ প্রতাপাদিত্য।এই যুদ্ধে ঈশা খাঁ মারা যায়। নায়েব ভীমসেন মহাপাত্র জলে ডুবে আত্মহত্যা করেন। [২][৮][৫]
হিজলী আরেকটি যুদ্ধের জন্য বিখ্যাত। ১৩৬৭ তে রাজা হরিদাস ভুঁইয়ার নৌশক্তির সামনে যেভাবে গুঁড়িয়ে গেছিল শিকন্দর শাহের বাহিনী তার জন্য।[১১]
হিজলীর যুদ্ধের পরবর্তীতে ইশা খাঁয়ের পুত্র জামাল খাঁ যশোরের অধীনে সামন্ত শাসক ছিল।যে মুঘলদের সাথে সঙ্ঘর্ষে মারা যায়।[৩]
জামাল খাঁয়ের মৃত্যুর পর ইসলাম খাঁর অধীনতা মেনে নেয় পরবর্তী লোহানী শাসক সলিম খাঁ।[১০]
- বাঁশুরি গড়ের যুদ্ধ:
পরবর্তীতে ওসমান খাঁ লোহানী ভুরশুট আক্রমণ করে ১৬০৯ তে।ভবশঙ্করীর বাঁশুরির যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পশ্চাদপসরণ করে।
ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের মহারানী ভবশঙ্করী, মহারাজ রুদ্রনারায়ণ রায়’র স্ত্রী; বাংলায় তিনি ‘রায়বাঘিনী’ নামে খ্যাত । উড়িষ্যার সুলতান ওসমান খান ১২০০০ আফগান সৈন্য নিয়ে ভূরিশ্রেষ্ঠ আক্রমন করলে বাশুড়ির যুদ্ধে আফগানদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। জানা যায়, তিনি হাতির পিঠে চেপে নিজস্ব hand cannon ‘রুদ্রাগ্নিশক্তি’ প্রয়োগে আফগানদের কার্যত ধ্বংস করে দেন, সেযুগের যুদ্ধপ্রযুক্তিতে যা ছিল অভিনব ।[১]
- মোগলমারীর যুদ্ধ:
১৬১১ তে মোগলমারীর যুদ্ধে সুবর্ণরেখার তীরবর্তী মোগলমারীর যুদ্ধে মুঘল সৈন্যদের বিরুদ্ধে ওসমান খাঁ ১১০০০ সৈন্য নিয়ে মুখোমুখি হয় ও পরাজিত হয়ে ওসমান খাঁর মৃত্যু হয়।[৯]
তথ্যসূত্র:
১) রায়বাঘিনী ও ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজকাহিনী – শ্রী বিধূভূষণ ভট্টাচার্য।
২) মেদিনীপুরের ইতিহাস – শ্রী যোগেশচন্দ্র বসু
৩ ) বৃহৎ বঙ্গ – শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন
৪) মল্লভূম বিষ্ণুপুর – শ্রী মনোরঞ্জন চন্দ্র
৫) Proceeding of the Asiatic Society, for Decernier 1868 10 Reiney
৬) যশোর খুলনার ইতিহাস – শ্রী সতীশচন্দ্র মিত্র
৭ ) প্রতাপাদিত্য চরিত্র – শ্রী রামরাম বসু
৮) নদীয়া কাহিনী – শ্রী কুমুদনাথ মল্লিক
৯) History of Bengal Vol2 – Sir Jadunath Sarkar
১০) পুরুলিয়া – শ্রী তরুণ দেব ভট্টাচার্য
১১) গৌড়ের ইতিহাস – শ্রী রজনীকান্ত চক্রবর্তী
১২) বৃহত্তর তাম্রলিপ্তের ইতিহাস- শ্রী যুধিষ্ঠির জানা
(লেখক পরিচিতি: শ্রী জ্যোতিষ্মান সরকার B.Tech Ceramic Technology তে পাঠরত।)
Comment here