সেই কোন ছোটোবেলা থেকে যে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনছি তা আজ আর মনে নেই।বাংলা বা মুম্বাইএর যেসব শিল্পী রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেছেন তাদের প্রায় সকলের গান শোনবার সুযোগ হয়েছে।রেকর্ড,ক্যাসেট,সিডি,এম পিথ্রি,রেডিও,সিনেমা বিভিন্ন মাধ্যমে যখন যেমন সুযোগ পেয়েছি সেইসব গান শুনে স্নাত হয়েছি সেইসব গানের অমৃতধারায়। যাঁরা এইসব গান গেয়েছেন তাঁদের অনেকের গান সামনে থেকে শোনবার সুযোগ পেয়েছি।প্রণাম করেছি পায়ে হাত দিয়ে।আমার অটোগ্রাফ খাতা ভরে উঠেছে তাঁদের স্বাক্ষরে।সেই সব অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়ার জন্যই এই ধারাবাহিকের ভাবনা।কাঞ্জিক এর শ্রীমতী দোলন ঘোষ আমাকে সুযোগ করে দিয়েছেন এই লেখার।জানিনা স্বল্প পরিসরে কতটুকু পারবো তবে আন্তরিক চেষ্টা থাকবে ষোলোয়ানা এটা বলতেই পারি।
১৯৩৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর নিউ থিয়েটার্সের ব্যানারে প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত ‘মুক্তি’ ছবিটি মুক্তি পায়।এই ছবিতে সুরকার পংকজকুমার মল্লিক চাইলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করতে।কিন্তু তখন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ জীবিত।তাই যে কোনো ছবিতে তাঁর গান ব্যবহার করতে গেলে তাঁর অনুমতির প্রয়োজন।
সেসময় রবীন্দ্রনাথ রচিত একটি কবিতার সুর করেছিলেন পংকজকুমার মল্লিক। রবীন্দ্রনাথকে সেই সুরের রেকর্ডিং পাঠানো হলো।রবীন্দ্রনাথ শুনলেন ও খবর পাঠালেন যে গানটি স্বয়ং সুরকার পংকজকুমারের কন্ঠেই শুনতে চান।পংকজকুমার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে গেলেন। সঙ্গে ছবির পরিচালক প্রমথেশ বড়ুয়া।বৈঠকখানা ঘরের এক কোণে পংকজকুমার হারমোনিয়াম নিয়ে দেওয়ালের দিকে মুখ করে গানটি গাইতে শুরু করলেন।গান শেষ হলো।ঘরে উপস্থিত রয়েছেন অনেকেই। পংকজকুমার মুখ নীচু করে বসে রয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে পংকজকুমারকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘অসাধারণ গেয়েছ তুমি।আমার ইচ্ছা আমার বাকি লেখা যেগুলো রইলো যার সুর আমি করে উঠতে পারলুম না তুমি তার সুর দিয়ো।’পংকজকুমার পরবর্তীতে বলেছেন যে ঐদিন তাঁর জীবনে ঈশ্বরের আশীর্বাদ পাওনা হয়ে গেলো’।স্বয়ং পংকজকুমার অভিনয় করলেন সেই ছবিতে।গাইলেন নিজের সুর করা রবীন্দ্রনাথের লেখা সেই গান ‘ দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা পরা ঐ ছায়া’।এই ছবিতে ছিলো আরও তিনটি রবীন্দ্রসঙ্গীত।পংকজকুমার নিজে গেয়েছিলেন ‘ আমি কান পেতে রই’ এবং ছবিরা নায়িকা কানন দেবী নিজের গলায় গেয়েছিলেন’ আজ সবার রঙে রঙ মিলাতে হবে ‘ এবং ‘ তার বিদায়বেলার মালাখানি’।
‘নিউ থিয়েটার্স’এর পিনাকি চক্রবর্তীর বই থেকে এমনটাই পাওয়া যায়, আবার পঙ্কজ মল্লিক নিজের জীবনী আমার যুগ আমার গান এ লিখেছেন মুক্তি ফিল্ম এর পরিকল্পনার অনেক আগেই তিনি শেষ খেয়া কবিতাটিতে সুর দিয়ে গাইতেন। সেটা শুনতে পেয়ে কবি পুত্র রথীন ঠাকুর একদিন একটি চিঠি লিখে পঙ্কজ কে দ্যাখা করতে বলেন। পঙ্কজ মল্লিক গেলে পরে তিনি পঙ্কজ কে রবীন্দ্রনাথ এর কাছে নিয়ে যান গান টি শোনানোর জন্য। রবীন্দ্রনাথ প্রায় সমাহিত অবস্থায় গান টি শোনেন। এদিকে রবীন্দ্র নাথ এর সামনে গান শোনাতে গিয়ে পঙ্কজ এতই ঘাবড়ে যান যে গান শেষ করেই কারুর অনুমতি না নিয়েই তিনি দৌড়ে ঘর থেকে পালিয়ে যান।
এর কিছু দিন বাদে পঙ্কজ মল্লিক মুক্তি ছবিতে গান টি ব্যবহার এর জন্য রবীন্দ্র নাথ এর কাছে যান তাঁর অনুমতি নিতে জোড়া সাঁকো তে নয় আম্র পালি ভবনে প্রশান্ত চন্দ্র মহালনাবিশের বাড়িতে। সেখানে কবি কে গানটি শোনালে পরে কবি সানন্দে অনুমতি দেন এবং কবিতাটি গান হিসেবে ছবিতে ব্যবহার এর জন্য দু-টি শব্দ পাল্টে দেন।
রবীন্দ্রসঙ্গীতকে বাঙালির মাথার শিয়রে পৌঁছে দেওয়ার কাজে যে কজন মানুষ নিরলস পরিশ্রম করে গিয়েছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন পংকজ কুমার মল্লিক।পিতা মণি মোহন মল্লিক ছিলেন একজন সঙ্গীত অনুরাগী সঙ্গীতজ্ঞ দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও ক্ষেত্রমোহন গোস্বামীর পর তিনি সান্নিধ্যে আসেন দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের।এর পরই পংকজকুমার মল্লিক রবীন্দ্রঙ্গীতের প্রেমে পড়েন।এই গান তাঁর ধ্যানজ্ঞান হয়ে ওঠে।শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক পরিবেশের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে আপামর বাঙালির গান করে তুললেন পংকজকুমার।লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছিলাম নিউ থিয়েটার্স ও পংকজকুমার মল্লিক এই মণিকাঞ্চন যোগের কথা। নিউ থিয়েটার্সের ব্যানারে ছবিতে পংকজকুমার সুর দিয়েছেন আর রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রয়োগ ঘটাননি এমনটা খুব কমই হয়েছে।জীবনমরণ( ১৪. ১০.১৯৩৯) ছবিতে কুন্দনলাল সায়গলকে দিয়ে গাওয়ালেন ‘ আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান’ ও ‘ তোমার বীণায় গান ছিলো’ এবং সতী দেবী গাইলেন ‘ ফিরবে না তা জানি’।ডাক্তার (৩.৮.১৯৪০) ছবিতে নিজে গাইলেন ‘ কি পাইনি তার হিসাব মিলাতে’। আবার যেখানে নিজে সুরকার নন সেখানেও সঙ্গীত পরিচালকরা আস্থা রেখেছিলেন তাঁর কন্ঠের ওপর।এমন ছবির সংখ্যাও তো কম নয়। যেমন ‘ওরে সাবধানী পথিক’, (অভিজ্ঞান সঙ্গীত পরিচালক রাইচাঁদ বড়াল),মরণের মুখে রেখে( অধিকার সঙ্গীত পরিচালক- তিমিরবরণ) আমার ভুবন তো আজ( অভিজ্ঞান – সঙ্গীত পরিচালক কৃষ্ণচন্দ্র দে)ইত্যাদি।
এই প্রসঙ্গে আরও একটি গল্প বলতে ইচ্ছা করছে ১৯৭২ এর ১৫ সেপ্টেম্বর মুক্তি পেলো শংকু মহারাজের কাহিনী নির্ভর ছবি ‘ বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা’।এই ছবিতে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন যন্ত্রানুষঙ্গে গাওয়ালেন ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’। এই গানে যেভাবে তিনি বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন তা সত্যিই অনবদ্য।
বিভিন্ন সময়ে নানা রবীন্দ্রসঙ্গীত তিনি রেকর্ড করেছিলেন।’ ভুবনেশ্বর হে’, ‘যে ধ্রুবপদ দিয়েছ’,’ খরবায়ু বয় বেগে’,’ আমার প্রাণের গভীর গোপন’,’ এমন দিনে তারে বলা যায়’,’ সঘন গহন রাত্রি’,’ ওগো তুমি পঞ্চদশী’,’ আমার ভাঙা পথের রাঙা ধূলায়’,’ এই করেছ ভাল’,’ জয় করে তবু ভয় কেন ‘ ইত্যাদি গানগুলি যেন পংকজকুমার মল্লিকের গান হয়েই রয়েছে।
কলকাতা বেতারের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন ওতপ্রোতভাবে।১৯২৭ এর ২৬ সেপ্টেম্বর তিনি সর্বপ্রথম বেতারে অনুষ্ঠান করেন।সেদিন তিনি দুখানি রবীন্দ্রনাথের গান গেয়েছিলেন।সেই গানদুটি হলো ‘ এমন দিনে তারে বলা যায়’ এবং ‘ একদা তুমি প্রিয়ে’।তারপর ১৯৭৫ এর শেষভাগ অবধি তিনি ছিলেন কলকাতা বেতারের সঙ্গে সম্পৃক্ত।’মহিষাসুরমর্দিনী ‘ ছাড়াও রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার আসরকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
নানা পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন তিনি।দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।অসংখ্য শ্রোতার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পেয়েছেন সারাজীবন ধরে।১৯৭৮ এর ১৯ ফেব্রুয়ারি চিরবিদায় নিয়েছেন এই সুরকার ও শিল্পী।রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়নে এনেছিলেন বলিষ্ঠতা।পংকজকুমার মল্লিক তৈরি করেছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনের এক স্বতন্ত্র ধারা।আজও তাঁর গান রসিক শ্রোতাদের আনন্দ দেয়।তিনি আছেন সকলের অন্তঃকরণে রত্নসিংহাসনে।
– পেশাগতভাবে সরকারী কর্মী, সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়েই বাঁচেন, লেখলেখির মাধ্যমে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাথে যুক্ত।
কি চমৎকার রচনা! মন ভরে গেল। দেবব্রত বিশ্বাসের উপর একটা লেখার জন্য অধীর অপেক্ষায় রইলুম।