আমার ইতিহাসস্বভূমি ও সমকাল

হায়দ্রাবাদের ভারতভূক্তির ৭৫ বছর এবং Operation Polo র তিন বিস্মৃত বাঙালি সেনানায়ক

– সৌম্যদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

 

১৯৪৮ সাল, সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষে গজিয়ে উঠেছে এক নতুন সমস্যা। কিছু দেশীয় রাজ্য ভারত বা পাকিস্তান এ যোগ না দিয়ে চাইছে স্বাধীন ভাবে থাকতে, কিন্তু এ তো সম্ভব নয়, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা হবে কি করে তাহলে?

🔶 Operation Polo র প্রাককথন 🔶

নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করা এই রকম একটি দেশীয় রাজ্য ছিল হায়দ্রাবাদ। নিজাম মির ওসমান আলী খান আসফ জাহ সপ্তম নিজে স্বাধীনভাবে তার রাষ্ট্র পরিচালনা করতে চাইতেন তার নিজস্ব সেনাবাহিনীর সঙ্গে। কিন্তু সেই সময় তেলেঙ্গানা আন্দোলন শুরু হয় যা নিজাম আটকাতে ব্যর্থ হয় এবং মুসলিম চরমপন্থী নেতা কাসিম রাজভী ও তার দল রাজাকারদের ক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে,রাজাকারদের সমর্থন দেয় মজলিস এ ইত্তেহাদুল মুসলমিন বা MIM নামক রাজনৈতিক দল যারা হায়দ্রাবাদে বসবাসকারী হিন্দুদের জোরপূর্বক ধর্মান্তর এবং প্রয়োজনে হত্যা করে হায়দ্রাবাদ কে সম্পূর্ণ মুসলিম রাজ্য করে গড়ে তুলতে চায়। এমতাবস্থায় ১৯৪৭ এ নিজাম ভারতের সাথে একটি standstill agreement করতে রাজি হন, কিন্তু এই agreement কাসিম রিজভী ও রাজাকারদের পছন্দ হয়নি, তাই তারা হায়দ্রাবাদে MIM এর সাহায্য নিয়ে বিশাল জনসভা এবং ঝামেলা করতে থাকে যার ফলস্বরূপ নিজামের প্রধানমন্ত্রী ছাতরি র নবাব মহম্মদ আহমেদ সৈয়দ খান এই agreement বাতিল করার কথা বলতে বাধ্য হন।

এরপর রাজাকারদের মধ্যস্থতায় পাকিস্তান হায়দ্রাবাদ রাজ্যকে ১৫ মিলিয়ন পাউন্ড দেয় এবং অর্ধ সরকারি সেনাবাহিনী গড়ে তোলায় সাহায্য করে। ভারতীয় মুদ্রা বন্ধ করা,পাকিস্তানের সাহায্য নেওয়া এবং রাজাকারদের সেনাবাহিনীতে নেওয়া ভারতের বিপক্ষে যেতে থাকে। রাজাকারদের উত্থান কে ধ্বংস করতে “হায়দ্রাবাদের ভারতভূক্তি” অত্যন্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

🔶 Operation Polo 🔶

সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল হাই প্রোফাইল বৈঠকে ঘোষণা করেন ভারতীয় সেনাবাহিনী হায়দ্রাবাদ আক্রমণ করবে। গর্ভনর জেনারেল চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী নিজামকে আনুষ্ঠানিকভাবে টেলিগ্রামে জানিয়ে দেন ভারত আর বসে থাকবে না। এই অপারেশন এর আনুষ্ঠানিক নামকরণ হয় Operation Polo. অপারেশন এর Tactical Commander নির্বাচিত হন লেফটেন্যান্ট জেনারেল মহারাজা রাজেন্দ্র সিংজি জাদেজা। তাঁর কাজ ছিল মূলত অফিসিয়াল।

 

🔶 তিন বাঙালি সেনানায়ক 🔶

••Operation Polo র On field Commander নির্বাচিত হন 1 Armoured Division এর General Officer Commanding মেজর জেনারেল ( পরবর্তীতে স্থলসেনা প্রধান) জয়ন্ত নাথ চৌধুরী, তিনি শোলাপুর অক্ষ বরাবর আক্রমণের নেতৃত্ব দেন। জেনারেল চৌধুরী ভারতীয় সেনাবাহিনীর অন্যতম প্রখ্যাত একজন সেনাপ্রধান। ৬’৩” উচ্চতার অ্যাথলিট সুলভ চেহারার অধিকারী তিনি তাঁর সুন্দর করে কাটা গোঁফের জন্য সেনাবাহিনীতে “মুচ্ছু” নামে পরিচিত ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি বার্মা, পূর্ব্যআফ্রিকা এবং পশ্চিমের মরুভূমি অঞ্চলের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং অত্যন্ত বীরত্ব প্রদর্শন করেন। ১৯৬১ সালে Operation Vijay বা Annexation of Goa এ তিনি স্থলসেনার কমান্ডার ছিলেন। তিনি ১৯৬২ সালে সেনাপ্রধান হন এবং ১৯৬৫ ভারত পাকিস্তান যুদ্ধকালীন সময়ে সেনাপ্রধান ছিলেন এবং ঐ যুদ্ধেই ভারতীয় সেনা লাহোর ফ্রন্ট অবধি দখল করে নেয়, এই অপারেশন হয়েছিল সম্পূর্ণরূপে তাঁর তত্ত্বাবধানে এবং মদতে। এই যুদ্ধের পর তিনি একটি অর্ধ সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার কথা বলেন যা ভারতের বর্ডার অঞ্চলে শান্তিকালীন সময়ে রক্ষার কাজ করবে, এই বাহিনীই সীমা সুরক্ষা বল বা BSF নামে পরিচিত।

••বিজয়ওয়াড়া দিয়ে আক্রমণের নেতৃত্ব দেন General Officer Commanding Southern Command মেজর জেনারেল অজিত অনিল রুদ্র। মেজর জেনারেল রুদ্র প্রথম এবং দ্বিতীয় উভয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মোনস, সোমে র যুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বার্মা ও র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ভারত স্বাধীন হবার পর তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে ছিলেন এবং স্বাধীন ভারতের ভারতীয় স্থলসেনার গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। King’s Commission পাওয়া প্রথম ভারতীয় সেনা আধিকারিক দের একজন ছিলেন তিনি।

••ভারতীয় বায়ুসেনার হয়ে আক্রমণের নেতৃত্ব দেন এয়ার ভাইস মার্শাল ( পরবর্তীতে বায়ুসেনা প্রধান) সুব্রত মুখার্জী। এয়ার মার্শাল মুখার্জী ভারতীয় বায়ুসেনার অন্যতম কিংবদন্তি এক ব্যক্তিত্ব। Royal Air Force College Cranwell এ ট্রেনিং করা প্রথম ছয়জন ভারতীয়র মধ্যে তিনি একজন। ১৯৩৬ এ উত্তর পশ্চিম ফ্রন্টিয়ার এ পাঠানদের বিদ্রোহ দমন করেছিলেন তিনি এই অঞ্চলের বন্ধুর প্রকৃতির মধ্যেও তিনি জয়লাভ করেন। ১৯৩৯ এ তিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে একটি স্কোয়াড্রন এর দায়িত্ব পান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোহট এয়ারবেসের দায়িত্বে ছিলেন তিনি এই সময়। এক্ষেত্রেও তিনি প্রথম ভারতীয়। ১৯৫৪ সালে তিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে বায়ুসেনা প্রধান হন এবং ১৯৬০ এ তাঁর অসময়ে মৃত্যুর আগে অবধি এই পদে ছিলেন। তিনি ভারতীয় বায়ুসেনার পিতা বলে পরিচিত।

জেনারেল চৌধুরী, মেজর জেনারেল রুদ্র, এয়ার মার্শাল মুখার্জী তিনজনই ছিলেন বাঙালি।

 

🔶 অপারেশন বর্ণনা 🔶

১৩ সেপ্টেম্বর:-
ভোর ৪ টায় ভারতীয় সেনা পাঁচ দিক থেকে হায়দ্রাবাদ এ আক্রমণ করে।
ভারতীয় বায়ুসেনা আক্রমণ শুরু করে, ভাইস মার্শাল মুখার্জীর নেতৃত্বে হায়দ্রাবাদের air fields ও অস্ত্র তথা যুদ্ধ সামগ্রী ধ্বংস করতে থাকে। সাথে Southern Army Command এর লিফলেট ছড়ানো চলতে থাকে।
পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণকারী মেজর জেনারেল চৌধুরী র নেতৃত্বাধীন দল অতি সহজেই রাজকার ও হায়দ্রাবাদের সৈনিকদের পরাস্ত করে নালদুর্গ, তুলজাপুর সহ বিরাট অংশ দখল করে নেয়।
দক্ষিণ পূর্ব দিক থেকে আসা মেজর জেনারেল রুদ্র র নেতৃত্বাধীন দল প্রথমে সামান্য গোলাগুলির দ্বারা প্রতিরুদ্ধ হলেও বিকালের মধ্যে কোডার মুঙ্গালা অঞ্চল দখল করে নেয়।

১৪ সেপ্টেম্বর:-
ভাইস মার্শাল মুখার্জীর নেতৃত্বাধীন বায়ুসেনা রাজেশ্বর অঞ্চলের হায়দ্রাবাদী প্রতিরোধ শেষ করে দেয় এবং স্থল সেনা রাজেশ্বর দখল করে নেয়।
মেজর জেনারেল চৌধুরী র নেতৃত্বে কঠিন লড়াইয়ের পর দৌলতাবাদ দখল হয়।
মেজর জেনারেল রুদ্র সূর্যপেথ অঞ্চল দখল করার সময় কিছু ভারতীয় সেনা বীর গতি প্রাপ্ত হন কিন্তু শেষ অবধি দখল সম্পূর্ণ হয়।
ওসমানাবাদ ও য়েরমালা দখল হয়।

১৫ ই সেপ্টেম্বর :-
মেজর জেনারেল চৌধুরী র নেতৃত্বে হুমনাবাদ ও ঔরঙ্গাবাদ দখল করে নেয় ভারতীয় সেনা।
অন্যদিকে মেজর জেনারেল রুদ্র র নেতৃত্বাধীন দল সূর্যপেথ এর পর খামমাম দখল করে নেয়। হসপেথ অঞ্চলে কিছু চেষ্টা চালায় রাজকার রা কিন্তু ভারতীয় ৭৫ মিলিমিটার বন্দুকের সামনে পরাজিত হয়।

১৬ ই সেপ্টেম্বর:-
বেলা একটার মধ্যে মেজর জেনারেল চৌধুরী র নেতৃত্বাধীন টাস্কফোর্স জাহিরাবাদ দখল করে নেয়। প্রথম দিকে প্রতিরোধ হলেও বিশাল সংখ্যক ও উন্নত ট্রেনিং প্রাপ্ত ভারতীয় সেনাকে আটকাতে পারেনি রাজাকাররা।
ইতিমধ্যে মুনিরাবাদ ষ্টেশন ভারতীয় সেনার দখলে চলে আসে।
এবং ভারতীয় বায়ুসেনার লিফলেট ছড়ানো ও সমর্থন কার্যক্রম চলতে থাকে।
ভারতীয় সেনাবাহিনী এই দিন সেকেন্দ্রাবাদ থেকে মাত্র নব্বই কিলোমিটার এর কম দূরত্বে অবস্থান করে।

১৭ ই সেপ্টেম্বর:-
১৭ ই সেপ্টেম্বর সকালেই ভারতীয় সেনা বিদার অঞ্চলে প্রবেশ করেকরে। হায়দ্রাবাদ কে চারদিকে ঘিরে ফেলে মেজর জেনারেল চৌধুরী ও মেজর জেনারেল রুদ্র র নেতৃত্বাধীন বাহিনী। বিদার, চিত্তল, হিঙ্গুলী, সেকেন্দ্রাবাদ এর কিছু দূরের অঞ্চল সেনাবাহিনীর দখলে চলে আসায় হায়দ্রাবাদ ও রাজকার বাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত হয়ে পড়ে।

🔶 আত্মসমর্পণ 🔶

ভারতের এজেন্ট-জেনারেল কে এম মুন্সির সাথে নিজাম ১৭ ই সেপ্টেম্বর বিকাল চারটেয় দেখা করেন এবং পাঁচটার সময় যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হয়।

১৮ ই সেপ্টেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী সেকেন্দ্রাবাদ এ প্রবেশ করে। Armored Tank র পাশ থেকে GOC Flag লাগানো গাড়িতে করে প্রবেশ করেন অপারেশন পোলোর ফিল্ড কমান্ডার মেজর জেনারেল জয়ন্ত নাথ চৌধুরী। অন্য দিক থেকে আসেন হায়দ্রাবাদ সেনার প্রধান মেজর জেনারেল সৈয়দ আহমদ এল ইদ্রুস।
মেজর জেনারেল ইদ্রুস আত্মসমর্পণ ঘোষণা করেন মেজর জেনারেল চৌধুরী র কাছে।

মেজর জেনারেল চৌধুরী এবং ইদ্রুস একে অপরকে চিনতেন আগে থেকেই। মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে একসাথে ছিলেন দুজন ই।
ইদ্রুস:- ” Well Muccho, we met again but under different circumstances. “
চৌধুরী:- ” Business is business. You’ll be responsible for law and order until my TPS takes over. Have a smoke. “
সেকেন্দ্রাবাদ এ একটি ছোট আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান এভাবেই হয়েছিল। মেজর জেনারেল চৌধুরী ও মেজর জেনারেল ইদ্রুস একসাথে ধূমপান করেন এবং তারপর এজেন্ট জেনারেল মুন্সির বাড়িতে চলে যান।

এই ঘটনার কিছু দিন পর মেজর জেনারেল জয়ন্ত নাথ চৌধুরী হায়দ্রাবাদ এর মিলিটারি জেনারেল রূপে নির্বাচিত হন এবং একবছর (১৯৪৯ অবধি) এই পদে আসীন ছিলেন। 

 

 

হায়দ্রাবাদ এর ভারতভূক্তি নিঃসন্দেহে এক বড় সাফল্য ছিল ভারতের জন্য । কিন্তু এই অপারেশন কে সফল করে তোলা তিনজন সেনা আধিকারিক এর নাম মানুষ প্রায় জানেনা বললেই চলে। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে যে ভূমিকা পালন করেন ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ , অপারেশন পোলো এ জেনারেল জয়ন্ত নাথ চৌধুরী র সেই ভূমিকা ই ছিল। এবং জেনারেল চৌধুরী ও সেই একই সম্মান ও প্রচারের দাবিদার।

আজকের এই লেখা আমি সমর্পণ করলাম জেনারেল জয়ন্ত নাথ চৌধুরী, এয়ার চিফ মার্শাল সুব্রত মুখার্জী এবং মেজর জেনারেল অজিত অনিল রুদ্র র প্রতি। ইতিহাস এ বিস্মৃত তিন মহাবীর সেনানায়ক কে আমার তরফ থেকে শতকোটি নমন। আশা রাখি একদিন এনাদের কথাও প্রকাশিত হবে মূলধারার মিডিয়ায় এবং সাধারণ মানুষ এঁদের চিনবে। আর বাঙালি যে সেনাবাহিনী তে অংশগ্রহণ করেনা সেটা যে সর্বৈবভাবে মিথ্যা তাও প্রমাণিত হবে ।

।।জয় হিন্দ।।

 

(লেখক পরিচিতি: পদার্থবিদ্যা স্নাতক, সঠিক ইতিহাস সন্ধানী ও প্রচারক, চরমপন্থী জাতীয়তাবাদী, শক্তিচর্চায় নিবেদিত এক বাঙালি যুবক)

Comments (3)

  1. প্রতিবেদনটি অসাধারণ।

  2. ১৯৪৭ এর ১৫ই অগাস্টের পর নিজাম ভারতীয় মুদ্রা বাতিল করে কি নিজস্ব মুদ্রা চালু করেছিলেন না পাকিস্তানের মুদ্রা ব্যবহার করেছিলেন হায়দ্রাবাদ রাজ্যে।

  3. জয় হিন্দ।

    লেখককে আন্তরিক অভিনন্দন। আলাপিত হতে আগ্রহী।

    sgango1966@gmail.com

Comment here