-শ্রী সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়
ঈশ্বর প্রথমে মাটি দিয়ে মানুষ গড়লেন। ঠিক পছন্দ হল না। তারপরে গড়লেন কাঠ দিয়ে। তাতে আত্মাকে প্রতিষ্ঠা করা গেল না। শেষে ভু্ট্টা দিয়ে মানুষ গড়লেন। তাই ভুট্টা তাদের কাছে পবিত্র, আমাদের ধানের মতো। মেসোআমেরিকার প্রাচীন প্রতিটি সভ্যতাতেই ভুট্টার কদর ছিল সবচেয়ে বেশি। প্রাচীনতম ওলমেক সভ্যতা থেকেই হয়তো সেই বীজ ছড়িয়ে পড়েছিল অন্যত্র।
মেসো-আমেরিকা, মানে বর্তমান কোস্টা রিকার উত্তরাংশ, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস, এল সালভাদর, গুয়াতেমালা, বেলিজ এবং মধ্য থেকে দক্ষিণ মেক্সিকো। এখানে যেসব সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সেসবের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন ওলমেকা, ইংরেজিতে ওলমেক। ১২০০ খ্রিস্ট পূর্ব থেকে ৪০০ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত টিঁকে ছিল এই সভ্যতা। তবে সান লরেঞ্জো শহরের কাছে ৩৪০০ বছর আগেও যে এই জায়গায় সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে ওলমেকরা যে কতটা উন্নত ছিলেন তার সাক্ষ্য দেয় তৎকালীন স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের নিদর্শন। সেই সময়ের শিল্পীরা যে কত দক্ষ ও নিপুণ ছিলেন তা বোঝা যায় বিশালাকার মাথার ভাস্কর্য ও সেই সময়ের স্থাপত্য দেখলে। ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে মেক্সিকোর ২০ সেন্টাভস মুদ্রায় ছিল ওলমেক সভ্যতার নিদর্শন বিশাল পাথরের মাথা। ওলমেক সভ্যতার এইসব নিদর্শন কোনওটা রয়েছে পুরাস্থলে, কোনওটা স্থান পেয়েছে জাদুঘরে। এগুলি নিয়ে আজও কৌতূহল ফুরোয়নি নৃতত্ববিদদের মন থেকে।
আগ্নেয়গিরিজাত ব্যাসল্ট পাথরে তৈরি এক একটি মাথার ওজন ৪ টন থেকে ২৬ টন পর্যন্ত। কোনওটি আবার ফাঁপা করে দেওয়া। একটি পাথর কেটে তৈরি বা মনোলিথিক মাথাগুলোর সঙ্গে কিছুটা আফ্রিকার আদিম বাসিন্দা আর কিছুটা চিন-মঙ্গোলিয়ার বাসিন্দাদের মিল অবাক করে দেওয়ার মতো। অধর-ওষ্ঠ স্থূল, নাক চ্যাপ্টা। কোনও মুখ অভিব্যক্তি বিহীন, কোনওটি গম্ভীর, কোনওটি সহাস্য।
শত শত বছর ধরে জিনের পরিবর্তন, মিশ্রণ এবং ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতার গোড়ায় বিশাল রোগের প্রকোপে মহামারিতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অনেকাংশে হারিয়ে যাওয়া – নৃত্ববিদরা ভাবছেন জিন পরীক্ষা করে প্রাচীন ওলমেকদের উত্তরসূরীর সন্ধান পাওয়া সম্ভব কিনা, তাঁদের উৎসে পৌঁছানো যায় কিনা।
ওলমেক শব্দের অর্থ হল রবার-মানব। নাম থেকেই বোঝা যায় এই জায়গায় রবারের গুরুত্ব ছিল। জলবায়ুর পরিবর্তন নাকি ফসল ফলানোয় সমস্যা নাকি অন্য কিছু, কী কারণে এই সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল সেই ব্যাপারে তেমন কোনও দৃঢ় তথ্য এখনও গবেষকরা পাননি।
ঈশ্বরের উপাসনা করতেন এই সভ্যতার মানুষজন, এমন কিছু হাড়ের সন্ধান পাওয়া গেছে যা থেকে মনে করা হয় এখানে নরবলির প্রচলন ছিল। রাজা ছিলেন প্রধান। পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট বসতি ছিল। মনে করা হয় ওলমেক রাজার বিরোধিতা করার মতো শক্তি তখন ছিল না। ছোট ছোট জনপদ শাসন করতেন রাজার নিযুক্ত প্রতিনিধিরা। পরবর্তীকালেও বিশ্বে এই পদ্ধতি দেখা গেছে।
ওলমেক সভ্যতার নিদর্শন হিসাবে শুধু বিশাল মাথা নয়, সূক্ষ্ম কাজে ভরা অনেক ধরনের মূর্তি পেয়েছেন পুরাতত্ত্ববিদরা। পাথরের আলাদা। মুখের অবয়বে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। পূর্ণ অবয়বও পাওয়া গেছে। আর পাওয়া গেছে এমন স্থাপত্য যা স্থাপত্যবিদ্যার সাক্ষ্য বহন করলেও থামের চিহ্ন সেখানে নেই। মেক্সিকো উপসাগর থেকে ৬৮ কিমি ভিতরে সান লরেঞ্জো শহরের নিচে এখনও হয়ত চাপা পড়ে রয়েছে সভ্যতার অবশেষ। লা ভেন্তা শহরও ব্যতিক্রম হবে না।
অ্যাজটেক ও মায়া সভ্যতার চেয়ে ঢের পুরনো এই সভ্যতা নিয়ে কৌতূহলের অন্ত নেই মেসোআমেরিকান অঞ্চলে, তবে উৎস থেকে ধ্বংস পর্যন্ত লেখার জন্য যে তথ্য প্রয়োজন তার অভাব অবশ্যই রয়েছে।
(লেখক পরিচিতি – প্রাক্তন সাংবাদিক, বর্তমানে ভাষাতত্ত্ববিদ; ইতিহাস চর্চা ও মুদ্রা সংগ্রহ তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান অঙ্গ)
ভাল লেখা। তবে সাংবাদিক প্রাক্তন হন না। কোনও পেশাদারই হন না মনে হয়।