অতীত যা লেখেনি

বাংলা চলচ্চিত্রের গন্ধর্বকন্যা – ললিতা

(গত পর্বের লিঙ্ক)

বিভাস ছবির রোমাঞ্চকর কাহিনী শোনাবো ব’লে অনেকটা সময় মাঝে চ’লে গেল।আসলে করোনাকাল সব কিছুকেই ওলট-পালট করে যে। যাই হোক, ললিতা দি’র সঙ্গে সাক্ষাতের কথা বলতে গিয়ে গত পর্বে বলেছিলাম এক অভূতপূর্ব যোগাযোগের কথা। লাইভ সে অনুষ্ঠানে ফোন করছিলেন অনেকে।সবারই নস্টালজিয়ায় লেগেছে তখন প্রবল নাড়া। তার মাঝেই এলেন অনিন্দিতা রায়চৌধুরী।অদ্ভুত আবেগস্পৃষ্ট কণ্ঠে ধন্যবাদ দিলেন প্রথমেই ললিতা দি’কে সরাসরি এনে দেবার জন্য,আর , আরও বেশি ক’রে কারণ তাঁর মাধ্যমে উনি ফিরে গেছেন আবার তাঁর বাবার স্মৃতিতে।

আমার জিজ্ঞাসার আগেই অনিন্দিতা দি বলতে থাকলেন, ‘আমার বাবার ছবি ‘বিভাস’এর নায়িকা ললিতা দি’র কথা শুনতে শুনতে আমার বাবা, নৃপেন কাকু (নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়) – এঁদের সব্বার কথা ম’নে পড়ে যাচ্ছে। আমার বাবা বিনু বর্ধন এ ছবিতে পদ্ম’র ভূমিকায় ললিতা দি কে নিয়ে পড়েছিলেন মহা সমস্যায়। আঁচনা বা অচিনপুর গ্রামের মহাজন, তারকেশ্বর ডাক্তারের মেয়ে পদ্ম। কিন্তু এ অভিনেত্রীকে গ্রামের মেয়ে সাজাবেন কি করে পরিচালক!?… যেমন উত্তমের প্রায় সমান দৈর্ঘ্য, তেমনি চাঁদের আলোর মত দীপ্ত রঙ,আর সর্বোপরি অসম্ভব অভিজাত,মনীষাদীপ্ত মুখশ্রী- একে গ্রামের স্বল্পশিক্ষিত, সরল,শুধুমাত্র নায়কের জন্যই অপেক্ষমানা নারী – কি ক’রে করা সম্ভব!!? চুলে গামছা জড়িয়ে, কোমর বেঁধে কাপড় পরিয়ে -নানাভাবে দেখে অনেক চেষ্টায় তাকে একটা গ্রাম্য চেহারা দেওয়া গেল শেষ অব্দি।’

বিস্মৃতি থেকে খুব প্রিয় কোনো স্মৃতিতে ফেরার যে আনন্দময় যাত্রা, সেই ছায়া আমি তখন দেখছিলাম উল্টোদিকের মানবীটির মুখে।

ওদিকে অনিন্দিতা দি তখন দিয়ে চলেছেন আরও এক রোমহর্ষক তথ্য।

ছবির প্রিমিয়ারে এসে সমরেশ বসু বললেন, ‘এ কি!? আমার উপন্যাস কোথায় এতে?’

তাঁকে সবাই বুঝিয়ে বললেন যে, ‘বাংলা ছবিতে বিভাসের সঙ্গে বিবাহিতা বিদ্যুৎ এর সম্বন্ধ দর্শক সমালোচনার মুখে পড়ত’ ।

বিদ্যুৎকে যে ধাতুতে গড়েছিলেন ঔপন্যাসিক, তার ভেতরের লুকোনো আগুনই সঞ্চারিত হয়েছিল বিভাসের মধ্যে;আর তাতেই তার ওই শক্তিমান অচলায়তনের বিপক্ষে প্রতিবাদের শক্তি সাহস যুগিয়েছিল। কিন্তু ষাটের দশকের ছবিতে বিবাহিতা গৃহস্ত্রীর সঙ্গে পরপুরুষ নায়কের প্রেম দেখানো প্রায় অসম্ভব, আর সে জন্যই সে সম্পর্ক নির্মাণ হয় পদ্মকে ঘিরে।

কোথা দিয়ে যেন কেটে গেল দেড়টি ঘন্টা।মনে হচ্ছিল এ আলাপচারিতা যেন শেষ না হয়। 

অনুষ্ঠান শেষে বেরিয়ে স্টুডিওর সবুজ দরজা অব্দি যেতে যেতেই ডিউটি রুমে হু হু ক’রে ফোন ঢুকতে শুরু করেছিল।
ললিতা দি সব মিলিয়ে খুউব খুশি হয়েছিলেন সেদিন।

কিন্তু খুশি বদলে যাওয়া দেখতেও আমায় অপেক্ষা করতে হয় নি বেশিদিন।ওঁর বাড়ীতে যাতায়াত আমার নিয়মিত ছিলই তারপর থেকে। একদিন দেখলাম খুবই বিমর্ষ। বাড়ী ছেড়ে দেবার জন্য চাপ অনেকদিন থেকেই ছিল -এটা জানতাম।সেদিন বললেন “জান, আমার বড় ছেলেকে আর এই বাড়ীওয়ালার ছেলেকে একই সঙ্গে দুই কোলে বসিয়ে খাওয়াতাম ছোটবেলায়।সেই ছেলে আজ যতরকমভাবে সম্ভব আমায় চাপ দিচ্ছে, এই ঘরদুটো ছাড়ার জন্য।কি করি বল ত’!?”

আসলে, ঐ বয়সে নতুন বাড়ি খুঁজে শিফটিং এর ঝক্কি নেবার মত ক্ষমতা,অর্থ কোনোটাই তাঁর নেই তখন।তাইই পেরে উঠছিলেন না।

এরপর হঠাৎই একদিন তাঁর ফোন নম্বর অমিল ‘হল।অনেক চেষ্টাতেও ললিতা দি’র খবর পেলাম না। এর বেশ কিছুদিন পর উত্তমকুমারের জন্মদিনে ‘উত্তম স্মরণ অনুষ্ঠানে দেখা।অন্যত্র শিফট করার খবর জানালেন। সেদিন শরীর অত্যন্ত ভাঙা দেখালেও কালো জর্জেটে কিরকম যেন অপার্থিব লাগছিল।জানালেন খুব অসুখ থেকে উঠেছেন সবে। নতুন নম্বর দেয়ানেয়া হল। কাজের প্রয়োজন তখন তাঁর যথেষ্ট -এ কথা বোঝা গেল, যদিও মুখে বললেন না কিচ্ছু। এই একটা জিনিষ কোনোদিন করতে পারেন নি ব’লেই বারবার তাঁর কাজ কেড়ে নিয়েছেন অন্যেরা। ব’লেছিলেন, ছবির শ্যুটিং শুরুর দিন, মেক আপ,চুল সব ক’রে সেট এ গিয়ে হতবাক হয়ে দেখেছেন নায়িকার দৃশ্য টেক চলছে এবং তাঁর নিজের জায়গায় আর কেউ। কিচ্ছু না ব’লে চোখের জল গিলে নিয়ে ট্যাক্সি ধ’রে বাড়ী ফিরে এসেছেন।একাধিকবার ঘটেছে এ ঘটনা। বলতে বলতে যদিও সাশ্রু হয়ে উঠেছে চোখ,তবুও একবারের জন্যও সেই পরিচালক,ছবি বা ওঁকে রিপ্লেস করা নায়িকার নাম কিছুতেই বলেন নি – এমনই সম্মান,ভালবাসা তাঁর কাজের ক্ষেত্রের প্রতি এবং সতীর্থদের প্রতি ত বটেই।

পারিবারিক শিক্ষাও লক্ষ্যণীয়, এর পিছনের।এত বছর পরেও দাগ লাগতে দিলেন না সহকর্মীদের কারো গায়ে।
বলেছিলেন, ওঁর বাবার কথা। গোটা ভারতের ইতিহাস তিনি ইংরেজিতে ছন্দোবদ্ধ করে গিয়েছিলেন,এবং ঐতিহাসিক টয়েনবী তা দেখে আপ্লুত হয়েছিলেন।

এ গল্প যতই করা করা যায়, শেষ হয় না…

এর কিছুদিন পর পরলোক সংক্রান্ত একটা ছবিতে ওঁকে কাস্ট করেছিলেন এক নতুন পরিচালক।

ললিতা দি তার আগেই কাটিয়েছিলেন ইহলোকের মায়া..

পঞ্চাশের দশকে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ফিলোজিফিতে ফার্স্টক্লাস সেকেন্ড।

আমার কেবল চোখে ভাসে তাঁর সেই মুখ,একরাশ আকুলতা নিয়ে যে মুখ বলেছিল, জীবনটা আর একবার পেলে পড়াশোনা করতাম, শুদ্ধু পড়াশোনা…

 

Comment here