-শ্রী সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়
“আর এক পর্যায়ের মুদ্রা ময়নামতীতে পাওয়া গেছে, অধিকাংশই রৌপ্যমুদ্রা, সংখ্যায় সুপ্রচুর, ওজনে হালকা, এবং বোধ হয় একাধিক মূল্যমানের। যত মুদ্রা পাওয়া গেছে সবই প্রকৃতিতে এতই একই রকমের যে এর ভেতরে কোনও ক্রমবিবর্তন-বিবর্ধন নেই বললেই চলে, অর্থাৎ কালের কোনও চিহ্ন যেন এগুলির উপর মুদ্রিত নেই। এই মুদ্রাগুলির একদিক আছে বিন্দুবলয় চক্র, তার ভেতকে একটি রেখাচক্র; আর বাঁদিক ঘেঁষে আছে একটি উপবিষ্ট বৃষমূর্তি। অন্য দিকে আছে দুইটি বৃত্ত,বাইরে রেখাবৃত্ত, ভেতরে বিন্দুবৃত্ত।…আবার অন্য কতকগুলি মুদ্রায় যে লেখাটি আছে তাকে হরিকেল বলা চলে।”
শ্রী নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙ্গালীর ইতিহাস, আদি পর্বে হরিকেলের মুদ্রা সম্পর্কে একথাই বলা হয়েছে। আমাদের স্কুলের পাঠ্য বইয়ে হরিকেলের কথা বলা হয় না। যদিও এর কথা না বললে বাংলার ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায় বলে বোধ করি। মুদ্রায় হারানো ও প্রাচীন সভ্যতার পঞ্চম পর্বে হরিকেলের কথা।
নীহাররঞ্জন রায়ের লেখা প্রসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন, এখনও পর্যন্ত হরিকেলের চারটি মূল্যমানের মুদ্রা আমি দেখছি, সম্ভবত তার চেয়ে বেশি পাওয়াও যায়নি। সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় যেটি পাওয়া গেছে সেটি পূর্ণমানের মুদ্রা হলে একটি তার অর্ধেক ও আরেকটি এক চতুর্থাংশ। সোজা কথায় একটি ১ টাকা হলে বাকি দু’টি ৫০ পয়সা ও ২৫ পয়সা। আর একটি আকারে বড় মুদ্রাটির দ্বিগুণ। অর্থাৎ সেটির মান পূর্ণমানের দ্বিগুণ বলে ধরা যেতে পারে।
হরিকেলের অবস্থান ঠিক কোথায় ছিল তা এখনও পর্যন্ত অজানা। সপ্তম শতকে চিনা পরিব্রাজকের লেখা এবং পরবর্তীকালে যেসব লিপি ও রচনায় এর উল্লেখ রয়েছে তা থেকে আন্দাজ করা হয় এর অবস্থান ব্রহ্মপুত্রের উত্তরে ছিল না, আরাকান পর্যন্ত ছিল না, চট্টগ্রাম সম্ভবত হরিকেলের সীমার মধ্যেই ছিল। উত্তর সীমা মোটামুটিভাবে শ্রীহট্ট, দক্ষিণে সমতট ছিল এর অন্তর্ভুক্ত। পূর্বে মণিপুর ও আরাকান ছিল এর বাইরে। তবে পশ্চিমের সীমা কতদূর ছিল সে সম্পর্কে সেভাবে কিছু জানা যায় না।
আনুমানিক অষ্টম শতকে রচিত আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প গ্রন্থে বঙ্গ, সমতট ও হরিকেল, এই তিনটিকে পৃথক স্থান বলে উল্লেখ করা রয়েছে। পঞ্চদশ শতকের ‘রুদ্রাক্ষমাহাত্য’ (ত্ম নয়) ও ‘রুপচিন্তামোণিকোষ’ (রূপচিন্তামণিকোষ নয়) পাণ্ডুলিপিতে শ্রীহট্ট ও হরিকোলাকে অভিন্ন অঞ্চল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন লিপি থেকে জানা যায়, হরিকেলের অস্তিত্ব সপ্তম শতক থেকে অন্তত একাদশ শতক পর্যন্ত ছিল।
হরিকেল রাজ্যের রাজারা ছিলেন চন্দ্রবংশীয় ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। আরাকানের চন্দ্রবংশীয় রাজাদের যে মুদ্রা পাওয়া যায় হরিকেলের মুদ্রার সঙ্গে তার যথেষ্ট সাজুয্য রয়েছে। শ্রী রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘প্রাচীন মুদ্রা’ বইয়ে লিখেছেন, “অতি প্রাচীনকালে আরাকানে ভারতীয় উপনিবেশ স্থাপিত হইয়াছিল। খৃষ্টীয় সপ্তম অথবা অষ্টম শতাব্দীতে আরাকানে ভারতীয় রাজগণ রাজত্ব করিতেন। ইঁহাদিগের অন্য কোন পরিচয় অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই, তবে রম্যাকর, ললিতাকরষ শ্রীশিব প্রভৃতি নাম দেখিয়া বোধ হয় যে, এইসকল আরাকান রাজগণ ভারতীয় ব্যক্তি ছিলেন। ইঁহারা চন্দ্রবংশজাত, এবং ৭৮৮ হইতে ৯৮৭ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত রাজ্য ভোগ করিয়াছিলেন। ইঁহাদিগের মুদ্রায় একদিকে উপবিষ্ট বৃষ মূর্ত্তি এবং অপরদিকে এক নূতন প্রকারের ত্রিশূল দেখিতে পাওয়া যায়।” এখানে যে মুদ্রাটি রয়েছে সেটিতে ব্রাহ্মী হরফে হরিকেল লেখা রয়েছে। মুদ্রাটির বর্ণনা দিয়েছেন নীহাররঞ্জন রায় স্বয়ং।
ভারতে সপ্তম শতকের মুদ্রায় রুপোর চল তেমন ছিল না, এমনিতেই রুপো ভারতে পাওয়া যেত না। বঙ্গদেশে সেভাবে প্রাচীন কোনও মুদ্রা পাওয়া যায়নি, যা পাওয়া গেছে তা বাণিজ্যিক কারণে এখানে এসেছে বলে ধারণা করা হয়। তাই হরিকেলের মুদ্রায় যে রুপো রয়েছে সেগুলি আরাকান বা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কোনও দেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে বলে ইতিহাসবিদরা মনে করেন।
হরিকেল নিয়ে আরেকটা কথা না বললে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। উদন্তপুরীর রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বল্লভানন্দ নামে এক ধনী ব্যক্তির থেকে বল্লাল সেন দেড় কোটি সুবর্ণমুদ্রা ধার চান। কিন্তু তার বিনিময়ে হরিকেলের রাজস্ব দাবি করেন। তাতে বল্লাল সেন রেগে গিয়ে বল্লভানন্দের ধনসম্পত্তি কেড়ে নেন। বণিকরাও সৎশূদ্রদের সঙ্গে আহারে আপত্তি রয়েছে বলে রাজপ্রাসাদে খাওয়াদাওয়ার আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেন।বল্লাল সেন তাতে আরও রেগে গিয়ে বণিকদের শূদ্রের স্তরে নামিয়ে দেন। তাঁদের পূজার অধিকার কেড়ে নেন। বণিকরা তখন দাসদের সম্পত্তি দিয়ে হাত করেন। বল্লাল সেনও কৈবর্তদের জলচল করে দেন। মালাকার, কুম্ভকার, কর্মকারদের সৎশূদ্র করে দেন। শেষপর্যন্ত ব্যবসায়ীরা আর ব্রাহ্মণ রইলেন না।
এথেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, সেই সময় হরিকেল জনপদ থেকে ভাল পরিমাণ রাজস্ব আদায় হত, অর্থাৎ এই জনপদ আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ ছিল।
(লেখক পরিচিতি – প্রাক্তন সাংবাদিক, বর্তমানে ভাষাতত্ত্ববিদ; ইতিহাস চর্চা ও মুদ্রা সংগ্রহ তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান অঙ্গ)
Comment here