-শ্রী সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়
একটা ষাঁড়, শ্বেতবর্ণ প্রভু বা ক্যাভালো মারিনহো, কৃষ্ণাঙ্গ গর্ভবতী বা ক্যাটিরিনা, রাখালবালক ভ্যাকুইরো যাদের নাম মেটিয়াস, চিকো কিংবা পাই ফ্রান্সিসকো এবং আরও কয়েকজন রাখাল আর স্থানীয় লোকজন যাঁরা ইন্ডিও, ইন্ডিয়া ও ক্যাবোক্লো উপজাতির। আর থাকেন পুরোহিত ও চিকিৎসক। সেই চিকিৎসক আদিবাসী কবিরাজও হতে পারেন। দর্শকদের সক্রিয় অংশগ্রহণও জরুরি।
উৎসবের মরসুমে আজ ঠিক হারানো সভ্যতা নয়, বরং ক্রীতদাসপ্রথা উচ্ছেদ হওয়ার পরে প্রান্তিক মানুষজন আর গ্রামীণ শ্রমজীবীদের হতাশাময় জীবনে বিনোদনের আলো বুম্বা মেউ বোই। হারানো সভ্যতা কথা না বললেও হারানো অসভ্যতা ও তার থেকে সৃষ্টি হওয়া এক শিল্প আজকের মুদ্রা বিষয়ক লেখায়। গ্রামের প্রান্তিক শ্রমজীবী ও সদ্য কৃতদাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া মানুষজনের জীবনের সেই কষ্টের কথা উঠে আসে যে মুখোশাভিনয়ের মাধ্যমে, আজ সেই কথা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সৃষ্টি হওয়া বিনোদনের এই আঙ্গিক সময়ের সঙ্গে অনেকটাই বদলেছে একবিংশ শতাব্দীতে এসে।
১৯৯২ সালে ব্রাজিলের ৫০,০০০ ক্রুজেইরো নোটের একদিকে ছাপা হয়েছে এই নাচের একটি দৃশ্য, একাধিক চরিত্র। মুদ্রায় থাকা ছবি একটু ভালভাবে খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, শিল্পীরা পোশাকের মতো করে এগুলি পরে রয়েছেন, অনেকটা পুরুলিয়ার ছৌনাচের সঙ্গে তুলনীয়। চরিত্রগুলির গলার কাছে মানুষের মাথা রয়েছে, অর্থাৎ মানুষের থেকে আকৃতিতে বড় হয় মুশোখ-সহ অভিনেতা। এর ফলে দর্শকরা কিছুটা দূর থেকেও অভিনয় দেখতে পারবেন, আবার বাস্তবের চেয়ে একটু বড় করেও চরিত্রগুলিকে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়।
বুম্বা মেউ বোইয়ের গল্প কোথাও প্রতিবাদের, কোথাও হতাশার। তবে যে ধরনের আর্থসামাজিক ও পেশার মানুষ এই বিনোদন সৃষ্টি করেছেন তাঁদের সকলের জীবনই কোনও একটা সূত্রে বাঁধা, যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের রামা কৈবর্ত আর হাসিম শেখদের জীবনের মতো। স্থানভেদে গল্প, কথকতার ধরন বদলে গেলেও মূল বক্তব্য মোটের উপরে একই থাকে। উঠে আসে নিপিড়িত মানুষের রোজনামচা। সেখনে থাকে পোয়েটিক জাস্টিস, আনন্দ বলতে তো এই টুকুই। যেমনভাবে গল্পে শেষ পর্যন্ত জিতে যায় কেন্দ্রীয় চরিত্রে থাকা মানুষটি, অন্তত হৃদয় জিতে নিতে পারে দর্শকের।
দাসত্ব, সন্তানের জন্ম দেওয়া আর পশুদের মতো জীবনযাপন নিয়ে তৈরি লোকগাথায় মিশে যায় স্থানীয় আদিবাসী, আফ্রিকা আর ইউরোপের সংস্কৃতি। গ্রামের রাখাল কিংবা দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া সহায়সম্বলহীন এক ব্যক্তির গর্ভবতী স্ত্রী আর পোষ্যকে নিয়ে যে গাথা মনে করিয়ে দেয় অষ্টাদশ শতকের বর্বরতাকে। মনে করিয়ে দেয় বর্ণবিদ্বেষ, জাতিবিদ্বেষ, সামাজিক লড়াই। যার বিরুদ্ধে আইন হলেও এখনও হয়ত মানুষের মনে কোথাও না কোথাও রয়ে গেছে। নইলে এই সংস্কৃ্তি আজও কেন একইভাবে একশ্রেণীর মানুষের কাছে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে রয়ে গেছে সেই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য।
স্থান-কাল-পাত্রভেদে শত শত গল্প, অনেকটাই কাল্পনিক। সেইসব কল্পনার উৎস খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে একজন অন্তত এই লোকসংস্কৃতি নিয়ে গভীরভাবে কাজ করেছেন। তিনি নৃতত্ত্ববিদ লুই দা কামারা কাসকুদো। একাধারে ইতিহাসবিদ, লোকসংস্কৃতি বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্য, শব্দতত্ত্ববিদ বা লেক্সিকোগ্রাফার, সাংবাদিক ও আইনজীবী কামারা কাসকুদো অধ্যাপনা করেছেন ফেডেরাল ইউনিভার্সিটি অফ রিও গ্রান্দে দো নর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ে। ব্রাজিলের লোকশিল্প-লোকগাথা নিয়ে তাঁর লেখা ৩১টি বইয়ে ৮ হাজারের বেশি পৃষ্ঠা রয়েছে। ৫০,০০০ ক্রুজেইরোর এই নোটের সামনের দিকে তাঁর ছবি ছেপেছে ব্রাজিল।
বুম্বা মেউ বোইয়ে বাদ্যযন্ত্রের বড় ভূমিকা রয়েছে। শুরুতেই বাজনা। বেশ কিছুক্ষণ ধরে বাজতে থাকে। তারপরে ধীরে ধীরে গল্প এগতে থাকে। স্থানীয়দের অবদমিত হওয়া, কৃষ্ণাঙ্গদের উপরে অত্যাচার, তাদের মুক্তি আর জীবনের কথা, ব্যথা বেদনা আনন্দ, ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গ উপনিবেশিক সঙ্গে ব্যান্ডের বাজনা, অর্কেস্ট্রা, কোরাসের সঙ্গে মিশে যায় দর্শকদের কোরাস। কখন যেন তাঁরাও একাত্ম হয়ে যান। মিলেমিশে যায় তাঁদের ভাষা, সংস্কৃতি। তিন মহাদেশের মিশ্র সংস্কৃতি এমন পর্যায়ে গেছে, মুদ্রায় জায়গা করে নিয়েছে এমন নিদর্শন খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
(লেখক পরিচিতি – প্রাক্তন সাংবাদিক, বর্তমানে ভাষাতত্ত্ববিদ; ইতিহাস চর্চা ও মুদ্রা সংগ্রহ তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান অঙ্গ)
Comment here