দেশ ভাগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিকার অসংখ্য মানুষের আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন ২০১৯ আইন ফের একবার অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে বসেছে! এই আইনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী বিরোধিতা ভয়ঙ্কর জটিল রূপ নিলেও আইনটির পক্ষেও কোটি কোটি লোক সওয়াল করেছিলেন। কিন্তু এই আইনের বাস্তবায়নে ফের একবার অনিশ্চয়তার কালো মেঘ দেখা দিয়েছে!
২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের পক্ষ থেকে নির্দেশ জারি করে আইনটি কার্যকর করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অতিরিক্ত সচিব শ্রী অনিল মালিকের পক্ষ থেকে জারি করা সেই নির্দেশিকায় বলা হয়েছিল, ‘ নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯, ধারা ১, উপধারা ২ মেনে, ১০ জানুয়ারি ২০২০ থেকে আইনে কার্যকর করা হলো।’
আইনটি কার্যকর হলেও আইনের সুবিধে উপভোগে যে রুলসের প্রয়োজন, সেটা এপর্যন্ত কেন্দ্র সরকারের পক্ষে জারি করা হয় নি। সংসদীয় নিয়ম অনুযায়ী, কোনো আইন কার্যকর হওয়ার ৬ মাসের মধ্যে রুলস তৈরি করতে হবে। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনটি চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার ফলে চলতি বছরেরই ১০ জুলাই আইনটির রুলস বাস্তবায়নের ছ’মাস পূর্ণ হয়েছে। ছ’মাস পার করে গেলেও রুলস বাস্তবায়নে এপর্যন্ত কেন্দ্র সরকারের পক্ষে কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখতে মেলে নি! তবে কি এই আইন আবারও হিমঘরে ঠেলে দেওয়া হলো! প্রশ্ন রাষ্ট্রহীনের তকমা পাওয়া সেই অসহায় মানুষগুলোর!
মেনুয়্যাল অব পার্লিয়ামেন্টরি প্রসিজিওর-এর ১১.৩.১- নম্বর প্যারায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, কোনো আইন কার্যকর হওয়ার ছ’মাসের মধ্যে যদি রুলস বাস্তবায়ন সম্ভব না হয় তবে সেটা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিবের নজরে আনতে হবে। এই প্রসিজিওরেরই ১১.৩.২ নম্বর প্যারাগ্রাফে লেখা রয়েছে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক যদি ছ’মাসের মধ্যে এসংক্রান্ত আইনের ক্ষেত্রে রুলসের বাস্তবায়ন ঘটাতে ব্যর্থ হয় তবে ছ’মাসের সময়সীমা পার হওয়ার আগেই মন্ত্রককে বিষয়টিতে সংসদের সাবঅর্ডিনেট লেজিসলেশন কমিটির কাছে আরও সময় চেয়ে আবেদন জানাতে হবে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে সময় বাড়ানোর আবেদন জানাতে হলে আগে এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুমোদন নিতে হবে। সেই সঙ্গে এই সময় বাড়ানোর জন্য কমিটিকে উপযুক্ত কারণও দেখাতে হবে। এক্ষেত্রে সাবঅর্ডিনেট লেজিসলেশন কমিটি সময় বাড়ালেও একসঙ্গে তিন মাসের বেশি সময় বাড়াতে পারবে না।
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন ২০১৯ রুলস তৈরির ছয় মাসের সেই সময়সীমা পার করে গেছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী অমিত শাহের অনুমতি সাপেক্ষে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক এক্ষেত্রে সংসদের সাবঅর্ডিনেট লেজিসলেশন কমিটির কাছে সময় বাড়ানোর আবেদন করেছে কি না, সে ব্যাপারেও কেন্দ্র সরকারের পক্ষে অবস্থান স্পষ্ট করা হয় নি। কেন্দ্র সরকার যদি এক্ষেত্রে সময় বাড়ানোর আবেদন করে না থাকে তবে এই আইনের ভবিষ্যত কী? প্রশ্ন সেই রাষ্ট্রহীন হতভাগাদের!
মেনুয়্যাল অব পার্লামেন্টরি প্রসিজিওর-এর ১১.১.২ নম্বর প্যারায় বলা হয়েছে, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন ২০১৯-এর মতো আইনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক প্রথমে রুলস তৈরি করে তার আইনি ও সাংবিধানিক বিচার-বিশ্লেষণের জন্য কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রকের কাছে পাঠাবে। আইন মন্ত্রক সেটা পরীক্ষা করে ফের পাঠিয়ে দেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে। এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সেই রুলসের চূড়ান্ত রূপ দিয়ে পাঠাবে আবার সাবঅর্ডিনেট লেজিসলেশন কমিটির কাছে ,যেখানে বিচার করা হবে রুলসগুলো আইনটির রূপ অনুযায়ী সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে কি না।
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন ২০১৯- এর ক্ষেত্রে এর কোনোটাই বাস্তবায়ন হয় নি! সেই সঙ্গে পার করে গেছে ছ’মাসের সময়সীমাও! এই পরিস্থিতিতে এই আইনের ভবিষ্যত নিয়ে আইনের সমর্থকরা যথেষ্ট সন্দিহান। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের রুলস তৈরির ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ পরিস্থিতিকে অন্তরায় হিসেবে ভাবলেও সেটা কতোটা যুক্তিসঙ্গত সেটাও দেখতে হবে। ভারত সরকারের ই-গেজেটে একবার উঁকি দিলে সেই ভ্রান্তিও কেটে যাবে! ভারত সরকারের ই-গেজেটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ৯জুলাই থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত সময়কালে প্রতিরক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থ, স্বরাষ্ট্র, আইন ইত্যাদি মন্ত্রকের একাধিক আইনের ক্ষেত্রে একশোরও বেশি রুলস বা নির্দেশ তৈরি করা হয়েছে! কেন্দ্রীয় সরকার এক্ষেত্রে আন্তরিক!
শুধু তাই নয়, একাধিক রাজ্যে সরকারের গদি বদল থেকে শুরু করে কয়লা খনির বেসরকারীকরণ করে নিলাম আয়োজন, রেলের বেসরকারীকরণ ইত্যাদি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, যেখানে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি কোনো অন্তরায় হয়ে দেখা দিতে পারে নি! শুধুমাত্র সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন ২০১৯- এর রুলস তৈরির ব্যর্থতার ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির দোহাই বেমানান ঠেকে! তবে কি দেশভাগের শিকার লক্ষ-কোটি মানুষের স্বার্থরক্ষাকারী এই আইন এখন আবর্জনা হিসেবে পরিত্যক্ত হতে যাচ্ছে! এই ভাবনা আর আশঙ্কাই দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছে দেশভাগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিকার নিপীড়িত অসহায় মানুষগুলোকে!
(প্রবন্ধ টি ইতিমধ্যে আসাম রাজ্যের জনপ্রিয় সংবাদপত্র ‘প্রান্তজ্যোতি দৈনিক’ এ প্রকাশিত হয়েছে।)
সাংবাদিক, প্রান্তজ্যোতি দৈনিক, শিলচর, আসাম
Comment here