-শ্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
সন ১৯৬৪। মাস জানুয়ারী। প্রধানমন্ত্রীর আসনে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু। তার মাত্র দেড় বছর আগে চীনা আক্রমণে ভারত পর্যুদস্ত, নেহেরুর ভুল নীতি, বা বলা ভাল, নীতিহীনতার কারনে ভারতের মুখ পুড়েছে আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায়, সামরিক শক্তির পুনর্গঠনের কাজ চলছে ঢিমেতালে, যেমনটি নেহেরুর পুরো সময়কাল জুড়েই হয়ে থাকতো। এরকম একটি সময়ে, মূহ্যমান ভারতে এক নতুন উপদ্রব বিনা নোটিশে এসে হাজির হোল সুদূর কাশ্মীরে, শ্রীনগরে।
শ্রীনগরের হজরতবাল মসজিদ, যেখানে নাকি হজরত মহম্মদের চুল সংরক্ষিত আছে এবং যার জন্যই সে মসজিদ ঐ নামে নামাঙ্কিত, সেখান থেকে খোদ সেই চুলের গুচ্ছ (মোট ক’টি চুল আছে সেখানে হজরত মহম্মদের, তা যদিও অনুল্লিখিত) চুরি হয়ে গিয়েছে বলে ঐ মসজিদের ইমাম ঘোষণা করে দিলেন।
যেরকমটি হয়ে থাকে, সেই ঘোষনা গুজবনির্ভর না সত্যি নাকি উদ্দেশ্যপ্রনোদিত না কোনও ষড়যন্ত্র, সেসব বুঝে ওঠার আগেই ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমরা ক্ষিপ্ত হয়ে রাস্তায় নেমে আসলেন। তাদের সমস্ত ক্ষোভ উগড়ে দিলেন ভারত সরকারের বিরুদ্ধে। নেহেরু সরকার আরেকটি বড় বিপর্যয়ের সম্মুখীন। সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে বিভিন্ন জায়গায়, দিল্লি বম্বে মাদ্রাজ কলকাতা সহ সমস্ত ভারতে ১৪৪ এবং আরো নানান ধারা বলবৎ হোল। সেনা ও আধা সেনাবাহিনী টহল দিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নেহেরুর কালঘাম ছুটে গেল। পুর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ঐ ইস্যুকে সামনে রেখে শুরু হল হিন্দু নিধন যজ্ঞ এবং বিতারিত করা হোল হাজার হাজার হিন্দু পরিবারকে, উচ্ছেদ করা হোল তাদের হাজার বছরের বাস্তু ভিটা থেকে। যারা পারলেন তারা কোনওমতে জান-মাল বজায় রাখতে নিঃস্ব হয়ে কপর্দকশূন্য হয়ে শিয়ালদহ সহ সব স্টেশনে আশ্রয় নিলেন। বাহাত্তর ইঞ্চি পাইপ সমূহ তাদের অস্থায়ী ঠিকানা হোল পরবর্তী ১০-১৫ বছরের জন্য। সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে আরেক দফা হিন্দু বাঙ্গালী উদ্বাস্তু এসে আশ্রয় নিলেন নিজভূমে পরবাসী হয়ে। আর ভারত জুড়ে তান্ডব চললো কিছুদিন, যেন, কনকনে শীতের রাতে ঘন বসতির পর বসতি জ্বালিয়ে কোশলরাণী শীত নিবারণ করছেন।
এমতাবস্থায় কিছু কিছু জায়গায় এই একতরফা বিশৃঙ্খল আচরণ ও এহেন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এবং সরকারি সম্পত্তি বিনষ্ট করারও বিরুদ্ধে কোনও কোনও এলাকায় পাল্টা বিক্ষোভ হোল। দাঙ্গা পরিস্থিতির উদ্ভব হোল। দাঙ্গাও হল বেশ কিছু জায়গায় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। মুসলিম হিন্দু উভয় পক্ষেরই ক্ষতিসাধন হোল। কিন্তু হজরতবাল কে চুরি করেছে, কেন করেছে, কিভাবে চুরি হয়েছে – তার কোনও হদিশ প্রশাসন পেল না খুঁজে।
কলকাতায় যে পাল্টা বিক্ষোভ হয় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কৈশোরত্তীর্ণ এক অকুতোভয় সদ্য যুবক – নাম শ্রী ভূদেবচন্দ্র সেন। উদ্বাস্তু অঞ্চলের এক সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। দু’ চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন দীনবন্ধু আ্যন্ড্রুজ কলেজে স্নাতক হবার লক্ষ্যে। দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়ায় অবস্থিত সেই কলেজের শিক্ষকদের প্রিয় ছাত্র ভূদেব জাতীয়তাবাদী নীতির একনিষ্ঠ অনুগামী ছিলেন এবং সক্রিয় সদস্যও ছিলেন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের (এবিভিপি)। সে সময়ে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে কংগ্রেস ও বামদলগুলির প্রাধান্য সত্বেও, মুলত তাঁরই নেতৃত্বে এবিভিপি-র পদচারণা শুরু হয় দীনবন্ধু এন্ডরুজ কলেজে যার স্থায়িত্ব ছিল স্বল্পকালের সেই টালমাটাল সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে।
হজরতবাল-কেন্দ্রিক সংগঠিত সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে ভূদেব সেনের নেতৃত্বে শক্ত প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠে যার কোন সদুত্তর ছিল না প্রশাসনিক স্তরে। কিন্তু প্রয়োজন ছিল এই বর্ধিত জাতীয়তাবাদী চেতনাকে অঙ্কুরে নষ্ট করার। ফলতঃ আর এক অঙ্কের অবতারণা হয়, পর্দার নেপথ্যে, ভূদেবকে থামাবার জন্য। ঘৃণ্য সেই নতুন দৃশ্যে আমরা দেখি ভূদেবকে বিচ্ছিন্ন করে আততায়ী পুলিশ অফিসার, যিনি ঘটনাচক্রে একজন তথাকথিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের, তিনি তাড়া করে দীনবন্ধু আ্যন্ড্রুজ কলেজ চত্বরে অনধিকার প্রবেশ করে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জে গুলি করেন ভূদেবচন্দ্র সেনকে লক্ষ্য করেন। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ভূদেব। তার নিথর দেহ সম্মানিত হয় স্বাধীন ভারতের সর্বপ্রথম পুলিশের গুলিতে নিহত জাতীয়তাবাদী ছাত্রনেতার মৃত্যু হিসেবে, ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে রয়ে যাবার মহান কৃতিত্বে। মাত্র ১৭ বছর বয়স তখন ভারতের স্বাধীনতার, ভূদেবচন্দ্র সেনেরও প্রায় তাই।
আত্মবলিদানের মধ্যে দিয়ে ভূদেব সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের প্রথম মৃত্যুঞ্জয়ী ছাত্রনেতা হয়ে রয়ে গেলেন ইতিহাসের পাতায়। তার পর পরই হজরতবাল মসজিদ থেকে ঘোষিত হয় যে, ‘চুরি’ হয়ে যাওয়া সে চুল সমগ্র পাওয়া গিয়েছে ফিরে। সাম্প্রদায়িক শক্তি যতটা ক্ষতি সাধন করতে চেয়েছিল, ততটাই সাধিত করে স্তিমিত হয়ে যায়। ধীরে ধীরে পৃথিবী আবার শান্ত হয়। কিভাবে সেই একগুচ্ছ চুল যা হজরত মহম্মদের বলে বিবৃত, তা ফিরে পেল তার কোন সরকারি কৈফিয়ত পাওয়া গেল না। এটুকুই জানা গেল যে ‘চুরি’ হয়ে যাওয়া সেই মহার্ঘ বস্তু আবার পাওয়া গিয়েছে। শুধু ভূদেব আর ফিরে আসে না মায়ের কাছে, পরিবারের কাছে, দেশমাতৃকার কাছে। ভারতমাতার আরেকটি সুসন্তানের জীবনদীপ নির্বাপিত হয় অপরিনামদর্শি এক অত্যাচারী পুলিশের হাতে।
জনশ্রুতি; ভূদেব সেদিন, যেদিন পুলিশের গুলিতে কলেজ চত্বরে লুটিয়ে পড়েন, বাড়ি থেকে বের হবার আগে মা-র কাছে এক গ্লাস জল খেতে চেয়েছিলেন। হতভাগ্য সেই মহান সন্তানের মা যখন জল নিয়ে আসতে গেছেন প্রিয় পুত্রের পিপাসা নিবারণের জন্য, ততক্ষনে ভূদেব রওয়ানা দিয়ে দিয়েছিলেন নিজ বধ্যভূমি দীনবন্ধু এন্ডরুজ কলেজের উদ্দেশ্যে।
শোকাহতা সেই মা, দুর্ভাগা সেই মা, আত্মবলিদানে অমর হয়ে যাওয়া সেই ছাত্রনেতার মা, তারপর বহু বহুদিন এসে কলেজের সেই জায়গায় এক গ্লাস জল পরম মমতায় ঢেলে দিতেন; চোখের জলের সেই মহাসাগর পেরিয়ে এসে, যেখানে তাঁর ভূদেব লুটিয়ে পড়েছিল পুলিশের গুলিতে – তাঁর ভূদেব, যে শেষ এক গ্লাস জল চেয়ে না খেয়েই বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছিল নিজের সামান্য তৃষ্ণা না মিটিয়ে – তাঁকে যে ভারতমাতা ডাকছে সেই দেশমাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে। নিজপুত্রের সেই তৃষ্ণা মেটাবার চেষ্টা করতেন শোকে অধীর এক মা।
পরবর্তী ছাত্র আন্দোলনগুলোয় অস্থির রাজনীতির আবর্তে সেই ভূদেব বেশ কিছু দিন আড়ালে রয়ে গেছিলেন। হঠাৎ করে একদিন একটি বাম রাজনৈতিক দল ভূদেবচন্দ্র সেনকে তাদের ‘শহীদ’ বলে প্রচার শুরু করে। একটি রাজনৈতিক কিন্তু অনৈতিক ছিনতাই সংগঠিত হয় সেই বামদলের কুৎসিত এক চিত্রনাট্যে, যা সত্যিকারের সিনেমাকেও লজ্জায় ফেলে দেবে। তারপর বেশ কয়েকদফায় ভূদেবকে তাদের সমর্থনকারী ছাত্র বলে উল্লেখ করে করে যখন জনমানসে ভূদেবচন্দ্র সেনের আসল ইতিহাস বিস্মরণ করাতে সমর্থ হয়, তারপরই আরেক কুৎসিত পন্থায় তাঁর নাম উচ্চারণ করা উল্লেখযোগ্যভাবে কমতে কমতে শূন্যে এসে দাঁড়ায়। ওদের কোন দায় ছিল না ভূদেবকে মর্যাদা দেবার। ইতিহাসকে ভুল পথে চালনা করাই একমাত্র উদ্দেশ্য।
ভূদেবচন্দ্র সেনের শহীদবেদিটি দীর্ঘকাল পড়ে রয়েছে অযত্নে, দীনবন্ধু এন্ডরুজ কলেজের প্রাঙ্গণে।
সময় এসেছে সেই মহান ছাত্রনেতার প্রতি যোগ্য সম্মান নিদর্শন করার। সময় এসেছে ভূদেব-এর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার। সময় এসেছে ছিনতাই হয়ে যাওয়া শহীদ ভূদেবকে ইতিহাসের পাতায় যথাযোগ্য স্থান দেবার। কোন ঘৃণ্য বামপন্থী চক্রান্ত নয়, কোনও বামপন্থী রাজনৈতিক অনৈতিকতা নয়, কোনও ভাবের ঘরে চুরি হয়ে যাওয়া নয় – প্রকৃত ঐতিহাসিক তথ্যনির্ভর হয়ে শ্রী ভূদেবচন্দ্র সেন-কে প্রতিষ্ঠা করা হোক এই পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকৃত পশ্চিমবঙ্গে, আত্মবলিদানের নিরিখে এই মহান ছাত্রনেতা অমর হয়ে জ্বল জ্বল করুক ধ্রুবনক্ষত্র হয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের দিগনির্দেশক হয়ে। তার সাথে প্রয়োজন সেই ঘটনার সত্যানুসন্ধানের। কি প্রকারে, কলেজের অধ্যক্ষের বিনা অনুমতিতে এক পুলিশ অফিসার খুন করে এক ছাত্রনেতাকে। এর পেছনের উদ্দেশ্য কি আরো কূট ছিল? সমর্থ জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ যাতে বামপন্থী চিন্তাধারাকে স্তিমিত করতে না পারে তার জন্যই এই নৃশংসতা? একটি নিরপেক্ষ তদন্ত প্রয়োজন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে যে বাংলার ভূমিতে জাতীয়তাবাদী, দেশপ্রেমিক বিচারধারা হ্রাস পায়নি কখনোই।…
শ্রী ভূদেবচন্দ্র সেন সমাদৃত হন এই সমাজে; হয়ে উঠুন পরিবর্তনের – জাতীয়তাবাদের আলোকবর্তিকা।
স্বাধীন ভারতের প্রথম জাতিয়তাবাদী আত্মবলিদানকারী ছাত্র ভূদেব সেন আমরা তোমায় ভুলছি না। ভুলবো না।
