রাজনীতিস্বভূমি ও সমকাল

*চামে কাটা মজুমদার*

-Woke Hunter

 

সম্প্রতি ১৯শে জুন কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরীরা পুনরায় মোগল বংশের সাথে থাকা তাদের “বন্ধুত্বের” অটুট সম্পর্ককে জাহির করতে মোগল দরবারের আয়োজন করেছে তাদের বরিশার বড় বাড়িতে।মধ্যযুগীয় মোগল দরবারের আদলে সাজানো এই সভায় ওমান থেকে এসে হাজির হয়েছেন মোগলদের বংশধর মমতাজ হোসেন চৌধুরী এবং তাঁর স্ত্রী মৈত্রেয়ী চৌধুরী।চাঁদের হাট বসিয়ে কপচানো হয়েছে বিদেশী আক্রমণকারী মোগলদের “সহিষ্ণুতার”কাহিনী।

এই তথাকথিত ব্রাহ্মণ পরিবারের মোগলপ্রীতি নতুন নয়। সোশ্যাল মিডিয়াতে এই পরিবারের এক আধজনের সাথে কথা বললেই মুঘল সম্রাটদের প্রতি, এঁদের মোগলপ্রীতির গভীরতা আঁচ করতে পারবেন।হাজার হোক মুঘলদের বদান্যতাতেই সাবর্নদের লক্ষ্মীলাভ হয়েছিল বলে কথা! কিন্তু,কতজন জানে এই আনুগত্যের সাথে ওতপ্রতভাবেজড়িত থাকা কলঙ্কের ইতিহাস?

১৫৭০সালে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন জিয়া গঙ্গোপাধ্যায়ের ঘরে এক পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। লক্ষ্মীপুজোর দিন জন্মগ্রহণ হওয়ায় সন্তানের নাম দেওয়া হয় “লক্ষ্মীকান্ত”। সন্তানের জন্ম হওয়ার মাত্র তিন দিন পর সন্তানের মা মারা যান।স্ত্রীর অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর শোকে ব্যাকুল জিয়া নিজের সদ্যোজাত সন্তানকে ঈশ্বরের কৃপায় সমর্পণ করে আত্মারাম ব্রহ্মচারীর কাছ থেকে সন্ন্যাসগ্রহণ করেন। কামদেব ব্রহ্মচারী নাম ধারণ করে কাশিধামের উদ্দেশ্যে রওনা হন।

অন্যদিকে,নিজের পিতার অবর্তমানে লক্ষ্মীকান্ত বেড়ে উঠতে থাকেন।আত্মারাম ব্রহ্মচারীর একান্ত প্রচেষ্টায় লক্ষ্মীকান্ত সংস্কৃত ওন্যায় শাস্ত্রের পাশাপাশি আরবি,ফারসি ও গণিত চর্চায় দক্ষ হয়ে ওঠেন।পড়াশোনার পাঠ শেষ করে লক্ষ্মীকান্ত যোগ দেন যশোরের রাজ্সরকারের রাজস্ব বিভাগেরচাকরিতে।যশোরের প্রবাদপ্রতিম ভবিষ্যত সম্রাট প্রতাপাদিত্যের পিতা মহারাজা শ্রীহরি গুহ ওরফে বিক্রমাদিত্যের নজরে পড়ে যান প্রতিভাবান ব্রাহ্মণ লক্ষ্মীকান্ত। দ্রুত উন্নীত হন রাজস্ব বিভাগের প্রধান কর্মচারীতে।

পরবর্তীকালে মহারাজা বিক্রমাদিত্য অবসর গ্রহণের আগে নিজের রাজ্যকে ভাই জানকীবল্লভ গুহ ওরফে বসন্ত রায়কে ছয় আনা এবং যুবরাজ প্রতাপাদিত্যকে দশ আনা ভাগ বাঁটোয়ারা করে দেন। বসন্ত ওমহারাজ প্রতাপাদিত্যের মাঝে সংঘাতের সেই শুরু। মহারাজ প্রতাপাদিত্য ছিলেন স্বাধীনচেতা,পরবর্তীকালে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজেরমতোই দুচোখ জুড়ে মুঘলমুক্ত স্বাধীন হিন্দু সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখেছিলেন।

যৌবনে আগ্রায় থেকে মুঘলদের রাজদরবারে ওদের  রাজনীতি,যুদ্ধনীতি,মানসিকতা…সবই আয়ত্ত করেছিলেন। মানসিংহ আর টোডরমলের পরিচালনায় সমস্ত ভারতকে গ্রাস করতে মরিয়া মুঘলদের অধীনতার থাবা থেকে বাংলাকে স্বাধীন রাখতে একে একে বুক বাঁধছিলেন বাংলার বিদ্রোহী হিন্দু শাসকেরা। চাঁদ রায়,কেদার রায়,লক্ষ্মণ মানিক্য এঁরা কেউই বিনা যুদ্ধে মেনে নেননি বিদেশী সেরেস্তাবাদি মুঘলদের বশ্যতাকে। এই বঙ্গবীরদের প্রধান এবং অগ্রগণ্য ছিলেন যশোরেশ্বর মহারাজা প্রতাপাদিত্য।পর্তুগীজ ক্যাপ্টেন আগষ্টাস পেড্রোর নৌবহর এবং কুকী, ঢালি,অশ্বারোহী,তীরন্দাজ ও গুপ্ত সৈন্যের প্রতাপে পিছু হঠতে বারে বারে হয়েছিল মুঘল সৈন্যকে।

অপরদিকে প্রতাপাদিত্যের কাকা বসন্ত রায় ছিলেন একদম ভিন্ন চরিত্রের।তিনি মুঘলদের সাথে আপোষ করতে ভ্রাতুষ্পুত্রকে প্রভাবিত করবার চেষ্টা করছিলেন বারেবারে।কাকার এই মুঘলপ্রীতি প্রতাপাদিত্য মোটেই ভালো চোখে দেখতেন না।মুঘলদের সাথে মিলে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয় তার আঁচ করতে পেরেছিলেন।একদিন হঠাৎই বসন্ত রায়ের ছেলে গোবিন্দ প্রতাপাদিত্যকে তীর ছুঁড়ে হত্যা করবার চেষ্টা করেন।মহারাজ অবিলম্বে প্রথমে গোবিন্দ ও কাকা বসন্ত রায়কে হত্যা করতে বাধ্য হন। এই বসন্ত রায়ের প্রতি বিশেষ অনুগত ছিলেন লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়।সময় নষ্ট না করে লক্ষ্মীকান্ত রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যান এবং অপেক্ষা করতে থাকেন সঠিক সময়ের জন্যে।

ঘটনাক্রমে,বসন্ত রায়ের আর এক ছেলে রাঘব রায় প্রতাপাদিত্যের ভয়ে মানকচুর বনে লুকিয়ে থেকে প্রাণ বাঁচায় যার কারণে লোকে তাকে কচু রায় নামে চেনে।বসন্ত রায়ের জামাই রূপরাম বসু এবং এই কচু রায় দুইজনে মিলে দিল্লিতে মুঘল দরবারে গিয়ে তাদের রাজ্য উদ্ধারের জন্য আকুতি জানালে, মুঘল বাদশাহ আকবর মান সিংহকে মহারাজ প্রতাপাদিত্যের রাজধানী আক্রমণের আদেশ দেন।

এখানেই শুরু সাবর্ণদের প্রধান ভূমিকা। রাজা মান সিংহ আদেশ পাওয়া মাত্রই বাংলার দিকে কুচ করতে শুরু করেন। অভিযানের মাঝে ক্লান্তি দুর করতে বারাণসীর কাছে তাঁবু ফেলবার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। সেখানে দেখতে পেলেন অসংখ্য বাঙ্গালী সাধু সন্ন্যাসীর সমাগম। মান সিংহবাংলার আবহাওয়া এবং প্রকৃতির ব্যাপারে অনভিজ্ঞ হওয়ার কারণে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে তাদের থেকে বিভিন্ন ছোট বড়ো কথা জানতে থাকেন।এই সন্ন্যাসীদের মাঝেই তাঁর সাথে দৈবাৎ একজন অত্যন্ত পণ্ডিত সাধকের সাক্ষাৎ হয়।খোঁজ খবর করে জানতে পারলেন,ইনিই কামদেব ব্রহ্মচারী। ইনি হলেন মুঘল সম্রাট হুমায়ূনের বিশ্বস্ত সেনাপতি পঞ্চানন গঙ্গোপাধ্যায়ের নাতি।

মান সিংহ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে দেরী করলেন না। প্রতাপাদিত্য শাক্ত জেনে কামদেবের কাছ থেকে শক্তিমন্ত্রে দীক্ষা নিলেন। পরিবর্তে জেনে নিলেন যশোর সাম্রাজ্যের বিষয়ে অত্যন্ত নিগূঢ় গোপনীয় তথ্য। যা পরবর্তীকালে বাংলার স্বাধীন হিন্দু যশোর সাম্রাজ্যের দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষাকে ভাঙতে সাহায্য করেছিল মুঘল সৈন্যকে।

সাবর্ণ রায়চৌধুরীপরিবারের অবদান শুধু এখানেই শেষ নয়। ১৬০৯ সালে মান সিংহ বাংলার মধ্যে যখন ইতিমধ্যেই প্রবেশ করেছিলেন এবং যশোরের দিকে যাত্রা করবার সময়ে স্থানীয় জাগীরদারদের হাত করতে মরিয়া,তখন রামরূপ বসু লক্ষ্মীকান্তকে মান সিংহের আনা কামদেব ব্রহ্মচারীর লেখা চিঠি পৌঁছে দিলে,লক্ষ্মীকান্ত গোপনে এসে মুঘল বাহিনীতে যোগদান করেন। শুধু যে যোগদান করেছিলেন তা নয়।বহুদিন ধরে যশোরের প্রশাসনে উচ্চপদে কর্মরত থাকায় লক্ষ্মীকান্ত প্রতাপাদিত্যের সামরিক প্রস্তুতির ব্যাপারে অনেক কিছু জানতেন। যা তিনি যুদ্ধ চলাকালীন মান সিংহকে পুরোটাই খুলে বলেন।

এই বিশ্বাসঘাতকতার পুরষ্কার হিসেবে কামদেব তাঁর শিষ্য মান সিংহের কাছে ছেলে লক্ষ্মীকান্তকে ভূস্বামী বানাবার জন্যে অনুরোধ করেন। গুরুর এই আদেশকে মান সিংহও খুশি হয়ে দক্ষিণবাংলার আটখানা সমৃদ্ধ পরগনার জমিদারি লক্ষ্মীকান্তকে উপহার দেন। লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় হয়ে উঠলেন লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার রায়চৌধুরী।

বাঙ্গালী ভূঁইয়াদের প্রবল প্রতিরোধ এবং অসংখ্য বীর সৈনিকের রক্তের বিনিময়ে স্বতন্ত্র হওয়া বঙ্গভূমি তিনভাগে বাঁটোয়ারা করে শোষণ করতে থাকলেন মুঘলদের মোসাহেব তিন ব্রাহ্মণ মজুমদার: বড়িশার জমিদার লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার, নদীয়ার জমিদার ভবানন্দ মজুমদার এবং বাঁশবেড়িয়ার জমিদার জয়ানন্দ মজুমদার। হিন্দু স্বাধীনতা সূর্যকে নিভিয়ে দিয়ে সেইদিন বাংলাকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছিলেন এই তিন জমিদার। অনেকের মতে,বাঙ্গালী ছেলে মেয়েদের জনপ্রিয় “ইকির মিকির”ছড়ায় এই মজুমদারকেই “চামেকাটা” অর্থাৎ নিম্নাঙ্গের চামড়া কাটাবলে অলক্ষ্যেবিদ্রুপ করেছিল বাংলার অসহায় বাঙ্গালী জনসাধারণ।

এই তিন মজুমদারের বাকি দুটো পরিবার বর্তমানে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলেও,সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার এখনও যথেষ্ট প্রতিপত্তিশালী অবস্থায় টিকে আছে এবং নিজেদের পূর্বপুরুষের শঠতাকে আড়াল করতে বাঙ্গালী ক্ষাত্রবীর্যের মূর্তরূপ সম্রাট প্রতাপাদিত্যের চরিত্রকে কলঙ্কিত করবার চেষ্টা করছে নানাভাবে।

(লেখক পরিচিতি: বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে MSc(Physics) পাঠরত)

Comment here