সাহিত্যিক নবেন্দু ঘোষ এর কন্যা শ্রীমতী রত্নোত্তমা সেনগুপ্তের সঙ্গে এক আলোচনায় শীর্ষন্দু মুখোপাধ্যায় মেলে ধরেছিলেন তাঁর বেদনার্ত ম’নের একটি দিক, যে বেদনার জায়গায় এসে তিনি আর তাঁর অগ্রজ সাহিত্যিক এক বিন্দুতে মিলিত হন।
সেই কথোপকথন লিখিত আকারে আজ কাঞ্জিকের পাতায় শ্রীমতী রত্নোত্তমা সেনগুপ্তের কলমেঃ
“প্যাশনেট লেখা, অসম্ভব এক্সপেরিমেন্ট – গদ্য, গল্প, ভাষা নিয়ে – এই নবেন্দু ঘোষ আবার রিভাইভ হওয়া দরকার’,বলছেন শীর্ষেন্দু।
মুখবন্ধ : শ্রী শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় আর শ্রীমতী রত্নোত্তমা সেনগুপ্ত – এক সময় আমরা সহকর্মী ছিলাম, আনন্দবাজার পত্রিকার দপ্তরে – উনি ‘দেশ’,পত্রিকায়, আমি দ্য টেলিগ্রাফে। কিন্তু তার বহু পূর্বেই শীর্ষেন্দুদা আমার আইকন ছিলেন – যেমন ছিলেন সমরেশ বসু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্রোপাধ্যায়। সুদুর বম্বেতে বেড়ে ওঠার বছরগুলো ‘দেশ’ বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ অবিচ্ছিন্ন রেখেছিল। সেই একই ভাবে শীর্ষেন্দুদার বেড়ে ওঠার সময় নবেন্দু ঘোষ ছিলেন বাংলা বইয়ের জগতে এক শীর্ষব্যক্তি। তাই ২৭শে মার্চ, ২০১৯ সালে স্টারমার্কে বাবার ৯১তম জন্মোৎসব পালন করতে চাইলাম শীর্ষেন্দুদার কাছে সেই গল্প শুনে। কারণ ?
নবেন্দু এবং শীর্ষেন্দু- আজীবন দেশভাগের শোক বয়ে বেড়ানোয় একই অনুভবের শরিক এই দুই “প্রবাসী বাঙ্গাল”।
উইলিয়াম ডালরিম্পল ‘দ্য নিউয়োর্কার’এ জুন ২২, ২০১৫ সালে লিখেছিলেন – ভারতের বিভাজন অসংখ্য লোকের জীবন সরাসরি বা ইনডায়রেক্টলি তছনছ করেছিল। প্রায় ২০ লক্ষ লোক প্রাণ হারায়, ১৪০ লক্ষ লোক ছিন্নমূল হয়। ফলতঃ যে রিফিউজি ক্রাইসিস তৈরী হয় তা পরের প্রজন্মেও ছায়াপাত করে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, প্রাণ সংহার, নারী ধর্ষণ, অপহরণ, জোর করে ধর্মান্তকরণ এমন ব্যাপক হয় যা আগে কখন দেখা যায়নি। প্রায় ৭৫ হাজার মহিলা ধর্ষিতা হন, অনেকেরই দেহাংশ বিশেষ কেটে ফেলা হয়। এই ভয়াবহতা তাদের কতটা বিচলিত করেছিল? শোনা যাক ….
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়: দেশভাগের ফলে কিছু মানুষ ডায়রেক্ট ভিক্টিম হয়েছে। অনেকেই মাথায় বাক্স বিছানা নিয়ে কষ্ট করে সীমানা পার হয়েছে। আমরা – নবেন্দুদার এবং আমাদের পরিবার – মোটামুটি স্বচ্ছন্দে চলে এসেছিলাম। কিন্তু দেশ ভাগ আমাদের মনে একটা গভীর বেদনা, সুগভীর একটি ক্ষতচিহ্ন তৈরী করেছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আমি নবেন্দুদার কথা জানিনা কারণ উনি চার বছর বয়সে অ্যাডভোকেট বাবার সঙ্গে ঢাকা থেকে পাটনায় চলে এসেছিলেন। কিন্তু আমার লস অফ হোমল্যান্ড, যে মাটিতে আমার পূর্বপুরুষরা বসবাস করেছিলেন, যে মাটিতে আমি জন্মেছি, যে দেশকে আমার দেশ বলে জানি, সেটি যখন চলে যায় তা অস্বাভাবিক রকম বেদনাময় হয়। ১৯৪৭ সালের সেই ক্ষতচিহ্ন থেকে আজও রক্তপাত হয়। আমাকে বগলে মাদুর নিয়ে হেঁটে আসতে হয়নি কিন্তু আমার এই ৮৪ বছর বয়স পর্যন্ত ভেতরে হাহাকার রয়েই গেছে। আমার নিজের দেশ বিদেশ হয়ে গেল। আমার শেকড় যে মাটিতে, সেটা আমায় ছেড়ে আসতে হয়েছে। এখনও বেদনাটা সাংঘাতিকই আছে।
সেটা নবেন্দু ঘোষের মধ্যেও ছিল। তাই সাম্প্রদায়িকতা ব্যপারটাকে তাঁর অনেকগুলো গল্পের মধ্যেই স্থান দিয়েছেন। যেমন “দ্বীপ”। এই উপন্যাসটা একটা অ্যালিগরিক্যাল প্রেমের গল্প সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে। একটি যুবতী আর একজন যুবক এক জনমানবহীন দ্বীপে ভেসে এসেছে। সেখানে ধীরে ধীরে নানান জাতির, নানান ধর্মের নানা প্রকারের লোক আসতে থাকে – এবং শুরু হয় সেই পুরানো সংঘাত।
উপন্যাসটা আমি পড়েছিলাম অনেক দশক আগে। আমাদের ছেলেবেলায় বই বিশেষ জুটতো না। আমার বাবা রেলে চাকরী করতেন। ফলে আমি মফঃস্বলে বিভিন্ন জায়গায় বড় হয়েছি। এমন এমন জায়গায় আমরা বদলি হয়ে যেতাম – আসামে, উত্তরবঙ্গে, বিহারে – যেখানে বইপত্র পাওয়া খুবই কঠিন ছিল। আমাদের পুরো পরিবারটাই পড়ুয়া, কিন্তু কিছু কিছু সাময়িক পত্রিকা ছাড়া বইপত্র জুটতোনা। তাই খুব ছেলেবেলা থেকেই যা হাতে পেতাম তাই পড়তাম। বাড়িতেও ছোটদের পড়ায় কোনো আপত্তি ছিলনা। তখন থেকেই নবেন্দু ঘোষ পড়তাম।
নবেন্দু ঘোষের যে লেখাটা আমাকে প্রথম হিপনোটাইজ করে দিয়েছিল সেটা হল ‘ফিয়ার্স লেন’। মুসলিম মহল্লায় কলকাতায় ১৯৪৬ এর দাঙ্গার সময়ে এক মুসলমান প্রাণ হারায় একটি হিন্দু পরিবারকে রক্ষা করতে গিয়ে। এটা পড়ে আমি এতটা আন্দোলিত হয়ে যাই যে বলার নয়। এরকমও লেখা যায় ! এত রেসি, এত গতিময়, এত সাংঘাতিক অভিঘাত সম্পন্ন লেখা। এই অসাধারণ লেখা পড়ে আমি একেবারে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। যদিও ওই বইটি আর আমার কাছে নেই, তবু বলি : বাংলা সাহিত্যে ওই উপন্যাসটার কোন তুলনাই আমি পাইনা।
ওই সময়টায় অর্থাৎ তিরিশের শেষ চল্লিশের শুরুতে যারা লিখতেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন নবেন্দু ঘোষ। এই কথাটা বুঝলাম কিছু কাল পরে, যখন আমি বিশ্ব সাহিত্য পড়তে শুরু করি। টিন এজে বলা যেতে পারে। সেই সময় দুজন লেখক আমাকে অসম্ভব আকৃষ্ট করেছিলেন। একজন নরওয়ের নোবেল বিজয়ী নুট হ্যামসুন (১৮৫৯-১৯৫২) আর একজন অস্ট্রিয়ার স্তেফান জোয়াইগ (১৮৮১-১৯৪২)। জোয়াইগ আজকাল খুব একটা পঠিত হননা কিন্তু একবার পড়লে ভোলা যায়না।
জোয়াইগের যে গল্পটা প্রথম পড়ি তার নাম ছিল “অ্যামক’। “অ্যামক” মানে লুনাটিক কিংবা বলা যেতে পারে বিপর্যন্ত। এক মহিলাকে ভালোবেসে এক ডাক্তারের পতনের গল্প। বোঝা যায় জোয়াইগ ফ্রয়েডের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। প্রেমের গল্প কিন্তু বেদনাময় অবসেশানের গল্প। এবং কি অসাধারণ তার গতি। যেন ডালপালা ছেঁটে দেওয়া হয়েছে। অসাধারণ তার টান, উৎকণ্ঠা, বেগ। ওটা খুব মস্ত বড় সাহিত্যিকের ধরন। এমন ভাবে একটা প্রেমের গল্প লিখেছেন, এমন একটা পর্যায় লিখেছেন যেখানে কোন ড্রাইভার্স নেই। কিন্তু রুদ্ধশ্বাসে পড়তে হবে। একবগ্গা, একটানা গল্প, যে কোনো মিষ্টি উপন্যাসকে লজ্জা দেবে। কোন মিষ্টি নভেল নয়, মার্ডার কেস নয়, রহস্যময়তা নেই। রয়েছে কেবল গল্পকে কিভাবে তৈরি করা যায় সেই ম্যাজিক।
যেমন রয়েছে শরৎচন্দ্রের “দেবদাস’এ। কিছুদিন আগে আমাকে সমীক্ষা করতে হয়েছিল। দেবদাসের মধ্যে বহু ত্রুটি বিচ্যুতি আছে। তার প্লট কাঁচা। অনেক জিনিসের গোঁজামিল বলে মনে হয়। অনেক কিছু মেলেনা আমাদের জীবনের সঙ্গে। কিন্তু ১০০ বছর ধরে, তাঁর খুব অল্প বয়সে লেখা একটা অপরিণত উপন্যাস কি করে এখনও এতটা জনপ্রিয় ? বোধহয় ২০-২২বার সিনেমা হযেছে বিভিন্ন ভাষায়। ইনটেলেকচ্যুয়ালরা দেবদাসকে নম্বর দেবেনা, কিন্তু দেবদাস এখনও যে রাজত্ব করে যাচ্ছে এর রহস্যটা কি? সেটা আর কিছুই নয়, স্রেফ গল্প বলার ম্যাজিক। এই জাদু বিদ্যা সকলের থাকেনা। এই গুণটা অর্জন করা সম্ভব নয়, সুতরাং চেষ্টা করেও আমি আপনি পারবনা। এই নিয়ে যে আসে, সে যত কাঁচা গল্পই হোক, সে এমনভাবে থ্রো করে যে সেটা চিরকালীন কিছু একটা হয়ে যায়। যেমন “দেবদাস’। সেই রকম জোয়াইগ – আর কিছু না হোক, ইনি গল্পটা বলতে জানেন। নবেন্দু ঘোষের সাথে জোয়াইগের এই মিলটা আছে। ওইরকম ডালপালাহীন লক্ষাভিমুখী ব্যঞ্জনা, ভীষনভাবে তীক্ষ্ণ আবেগ, প্যাশন থেকে লেখা। শুধু মস্তিষ্ক দিয়ে লেখা নয়, একটা প্যাশনেট কিছু তার ভেতরে ছিল। নবেন্দু ঘোষের ২৮টা নভেল আর ১৮টা গল্পের সংকলন পুরোটা না পড়েও আমি এই কথাটা বলতে পারি।
একটা কথা বলা খুব দরকার নবেন্দু ঘোষের ভাষা নিয়ে। উনার একটা লেখা শুরু হচ্ছে “ভাবছি” কথাটা দিয়ে। একটা শব্দ যা একাধারে সম্পূর্ণ একটা বাক্য, এবং একটা প্যারা। এই ধরনের এক্সপেরিমেন্ট খুব বেশি লেখক করেননি বা করতে সাহস পাননি। নবেন্দু ঘোষ সে অ্যাডভেঞ্চারটা অ্যাকসেপ্ট করেছেন। তার আমলের লেখকদের মধ্যে একমাত্র তার, ভাষা নিয়ে আলাদা একটা ভাবনা চিন্তা ছিল যেটা অনেক লেখকের থাকেনা। যেমন তারাশঙ্কর: অসাধারণ বড় মাপের লেখক, সাদামাটা ভাষাতে লিখে যেতেন। গল্পের, ও ভাবনাচিন্তা এবং দর্শনের জোরে তিনি অনেক বড় জায়গায় চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু ভাষা নিয়েও চিন্তাভাবনা করতে হবে। বাংলা ভাষায় নানান রকম এক্সপ্রেশন নেই। লিখতে গেলে বোঝা যায় যে অনেক এক্সপ্রেশন বাংলা ভাষায় ঠিক করা যায়না। কিছু চিন্তাভাবনা করলে, বাংলার যে বাক্যগঠন প্রণালী – সিনট্যাক্স – আছে সেটাকে নানাভাবে চেঞ্জ করা যায়। বা আমাদের যে শব্দভান্ডার – ভোকাবুলারী – আছে তাকে ওলটপালট করা যায়। আজকাল তো বহু ভাষা থেকে শব্দ অন্যান্য ভাষায় ঢুকে পড়ছে। কত হিন্দি আরবি ফার্সি শব্দ ঢুকে গেছে বাংলা ভাষায়। ইংরেজির তো কথাই নেই।
তা ভাষা নিয়ে চিন্তাভাবনা নবেন্দু ঘোষের ছিল। যে কারনে তার লেখার পাঠযোগ্যতা, বিশেষ করে গল্পের গতিটা ছিল অন্য যে কোন লেখকের চেয়ে আলাদা। যেমন ‘বিচিত্র এক প্রেমগাথা” উপন্যাসে, যেটা বুদ্ধের সময় ঘটছে, প্রাকৃতের কাছাকাছি অর্থাৎ ইসলাম-পূর্ব, আরবি ফারসি রহিত বাংলার ব্যবহার করেছেন৷ গল্পের ঠিক ঠিক অভিঘাত সৃষ্টি করার জন্য যেটুকু প্রয়োজন তার বাড়তি প্রয়োগ না করে, ঠিক ঠিক শব্দকে বাছাই করে এবং পাশাপাশি বসিয়ে অভিপ্রেত অভিঘাত তৈরি করার ব্যপারে নবেন্দু ঘোষ সিদ্ধহস্ত ছিলেন। এ কথাটা তার যে কোনও লেখা – যেমন “ডাক দিয়ে যাই’ – যারা পড়েছেন তারা জানেন। “ভারত ছাড়ো” আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা উপন্যাস: চারটি চরিত্র, এক টেররিস্ট, একজন জাতীয়তাবাদী রাজদ্রোহী, এক কম্যুনিস্ট ও এক লেখককে ঘিরে ২৪ ঘন্টার ঘটনা।
আমি যে নবেন্দু ঘোষের প্রচুর বই পড়েছি তা নয়। পড়ার খুব ইচ্ছে ছিল, আগ্রহী পাঠক ছিলাম, কিছু সেই খাদ্যের জোগাড় ছিলনা। লাইব্রেরীর কোনো বালাই ছিলনা মফঃস্বল শহরগুলোতে। বেশীরভাগ লোকের বাড়িতে কোনো বইয়ের তাক থাকত না। এরকম একটা সিচুয়েশনে আমার কোনো একজন লেখকের লেখা পড়তে ইচ্ছে করলে অনেক হাঙ্গামা করে আমাকে ভিপিতে বই আনাতে হতো । সুতরাং বইয়ের জন্য একটা হা-হুতাশ ছেলেবেলায় ছিল। আজকের ট্র্যাজেডি এই যে আমার বাড়িতে এখন বই উপছে পড়ছে, তাকে জায়গা নেই, মেঝেতে বই সর্বত্র, এমনকি বইয়ের প্যাকেট খুলতে ভয় করে। রাখব কোথায় ? অনেক বই কিনেছি সখ করে। আমেরিকায় গিয়ে বই কিনেছি, বইয়ের দোকানে বসে বেছে বই কিনেছি। সে বই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়নি। এখন আর সময় নেই। আমার দুর্ভাগ্য যে আমি যৌবনকালে নবেন্দু ঘোষের লেখা খুব একটা হাতে পাইনি।
নবেন্দু ঘোষ যখন খ্যাতির মধ্যগগনে, রোজগারের জন্য তাঁকে বম্বে চলে যেতে হল। স্বেচ্ছায় যাননি। লেখক হিসাবে তিনি তখন টগবগ করছেন, একের পর এক তাঁর কালজয়ী উপন্যাস বেরোচ্ছে – ডাক দিয়ে যাই, আজব নগরের কাহিনী, প্রান্তরের গান, পৃথিবী সবার। তবু বিমল রায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে বম্বে চলে গেলেন। প্রকারান্তরে এটা ১৯৪৭ এর দেশভাগের ফল। কারণ দেশভাগ অর্থাৎ বাজার ভাগ হওয়ায় সেই সময় বাংলা বই এবং বাংলা সিনেমা – দুয়েরই সংকটকাল। তাই চিত্রনাট্য লেখক হিসাবে যোগ দিলেন সেই কিংবদন্তী পরিচালকে। বম্বেতেও ওনার অবস্থান একটা নজির। সেখানে তিনি কত স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। ৭০ এর উপর ছবি ওনার হাতে লেখা। কত হিট ছবি উনার হাত দিয়ে বেরিয়েছে। এদিকে বাংলা সাহিত্যেরও সেবা করে গেছেন। ফিফটিস, সিক্সটিস, সেভেনটিস বম্বে থেকে গল্প লিখে গেছেন। শুনেছি স্ক্রিপ্ট স্টুডিওতে বসে লিখে, বাড়িতে এসে লেখা নিয়ে বসতেন। সে সব লেখা পাঠিয়ে দিতেন কলকাতার কোন ম্যাগাজিনে। সেরকম কয়েকটা বেরোলে তারপর সংকলন বেরোতো।
সিনেমার জন্য চিত্রনাট্য লেখা তার প্রফেশন ছিল। বোম্বের এই প্রবাসে তার লক্ষীলাভ হয়েছিল কিন্তু তা আমাদের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়েছে। কারণ নবেন্দু ঘোষের কাছ থেকে আমরা আরো অনেক কিছু পেতাম, সেটা পাইনি। পরে তিনি আবার ফিরে এসেছিলেন কিন্তু তখন বয়স হয়ে গেছে অনেক।এই ক্ষতিটা ইনডায়রেক্টলি দেশ ভাগের ফলে হয়েছে। এই বেদনাটা হয়তো সরাসরি অনেক লেখায় আসেনি। আমার লেখাতেও খুব একটা আসেনি। কিন্তু এটা এখনো মনে বহন করি। তাই তার লেখায় আরেকটা জিনিস পাই – সাম্প্রদায়িকতার বিরোধ। মানুষে মানুষে পার্থক্য, ধর্মের বিরোধ, জাতপাতের বিভেদ, এটা তিনি একদম পছন্দ করতেন না। এর প্রমাণ তার লেখায় আমরা বার বার পাই।
নবেন্দু ঘোষ এখন কতটা পঠিত হন আমি জানিনা। বইপত্রগুলো বাজারে খুব একটা পাওয়া যায় না, সেটাই হচ্ছে মুশকিল। এই পুরানো লেখক যারা অসাধারণ কিছু ক্লাসিকস লিখে গেছেন, তাঁরা একটু ধুসর হয়ে যাচ্ছেন। এটা দুঃখজনক। তাদের মধ্যে বেঁচে থাকার রসদ আছে। চিরকালীন সাহিত্য হয়ে ওঠার কোয়ালিটি আছে। তা সত্ত্বেও, আধুনিক যুগের নতুন পাঠকের নতুন চিন্তাভাবনায় কিছু লেখক আবছা হয়ে যাচ্ছেন।
নবেন্দু ঘোষ তো উপেক্ষা করার মতন লেখক নন, খুব ইমপরট্যান্ট লেখক এবং সেইটা আবার রিভাইভ হওয়া দরকার।। এরকম ডালপালাহীন গদ্যর মধ্যে তীব্র একটা গতি এবং তীব্র পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্যাশন আছে – এবং সেই প্যাশনেট লেখায় আছে অসম্ভব এক্সপিরিমেন্ট, গদ্য নিয়ে, ভাষা নিয়ে, গল্প নিয়ে। এটা মানুষের জানা দরকার। তাঁর লেখার ধরনটা এই যুগের পাঠকের ও লেখকের জানার প্রয়োজন আছে। কারণ “হাউ টু রাইট’ যেমন শরৎচন্দ্র আমাদের শিখিয়ে গেছেন, সেরকম নবেন্দু ঘোষও শিখিয়ে গেছেন।
বিশিষ্ট চলচ্চিত্র সমালোচক ও লেখক। cultural analyst হিসেবে তাঁর কাজ আন্তর্জাতিক ব্যাপ্তিলাভ করেছে।
Comment here