(আগের পর্বের লিঙ্ক)
দূর্গা পুজোর রেশ কার্তিক মাসে রয়ে যায় অনেকক্ষেত্রে। ঠিক আশ্বিন মাসের শেষ দিন অর্থাৎ আশ্বিন সংক্রান্তির সন্ধ্যায় গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতে কুমারী মেয়েরা হাতে তৈরি মাটির প্রদীপ কুলের পাতায় ধরে সুরে সুরে মন্ত্র পড়ে “কুল-কুলুতী ব্রতের”। সাথে আশ্বিন সংক্রান্তি থেকে কার্তিক সংক্রান্তি পর্যন্ত প্রতি সন্ধ্যা থেকে সারারাত প্রতি বাড়িতে সবচেয়ে উঁচু জায়গায় কিংবা লম্বা লাঠি বা বাঁশ সহযোগে কাঠামো বেঁধে তাতে ঝুলিয়ে দেয় লন্ঠন হ্যারিকেন মায় তেলের কুপি যা আমরা সহজেই আকাশ প্রদীপ নামে চিনি। লোকবিশ্বাস এই দামোদর মাস অর্থাৎ কার্তিক মাসে পরলোকগত পুরুষদের আত্মা মর্ত্যলোকে বিচরণ করেন এবং তাঁর বাড়ির সেই আলোয় তৃপ্ত হয়ে সমৃদ্ধিপ্রদান করেন।
গোটা কার্তিক মাস জুড়েই নানান ব্রত পুজোআচ্চা রয়েই যায় তার মধ্যে জনপ্রিয় যেমন “ধনতেরাস”, শব্দটি বাংলা নয় কিন্তু এটিও বাঙালি প্রথা কার্তিক কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে বিশ্বাস করা হয় ধনদেবতা কুবের-ধনদেবী লক্ষ্মী- ধন্বন্তরী দেবের আরাধনা করলে স্বাস্থ্য এবং সম্পদ সুনিশ্চিত হয়, তাই ঘরে ঘরে সাধ্যমতো চলে পূজা। পরবর্তী দিন অর্থাৎ চতূর্দশী তথা ভূতচতুর্দশী র কথা তো আমরা সকলেই জানি-মানি। এই মানিটা কীরকম? তবে তো আসতে হয় তেনাদের কথায়। আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনারা যা ভাবছেন ওটিই শোনাবো – তবে গল্পগাথা নয়, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের সক্রিয়ভাবেও তেনাদের অনুভূতি পেয়েছেন কিছু মানুষ, অন্তত এমনই তারা বলছেন!!
এই মাসটাই যেহেতু বললাম লোকবিশ্বাস মতে পরলোকগত পুরুষদিগের আত্মার শান্তি কামনার ক্ষণ, তাই এই চতূর্দশী তিথিতে প্রতি বাড়িতে তাদের পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে রাতের বেলা ১৪ টি মাটির প্রদীপ অথবা বাতি প্রজ্জ্বলন করে উঠোনে/ছাদে রেখে তেনাদের উদ্দেশ্যে প্রণাম করে আসেন কিন্তু খবরদার- কেউ কিন্তু আর সেদিন পিছন ফিরে তাকান না। সেদিন সারাটারাত প্রতি বাড়ির আলো জ্বেলেই রাখেন। এবং অধিকাংশ শোনা যায় পঞ্চভূতে বিলীন হওয়া সেসব আত্মার উপস্থিতির গায়ে কাঁটা দেওয়া অনুভূতি পেয়েছেন-ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছেন- সেদিন ভরসন্ধ্যেয় অনেকের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে পরবর্তীকালে তারাই আবার সভয়ে নিশ্চিতরুপে জানিয়েছেন – “ভূতচতুর্দশীর রাতে তোর বাড়ির কাছে যাইনি, দেখা হওয়া কথা হওয়া তো দূর”!! তাহলে কে???? এমন বহুবার গ্রামে শোনা যায়!!
রাত পোহালেই তো আসে দীপান্বিতা অমাবস্যার আলোলীকা উৎসব। প্রতি অমাবস্যাই তো তাঁর উপাসনা করার শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত এবং তন্মধ্যে দীপান্বিতা অমাবস্যা শ্রেষ্ঠতম। তিনি, তন্ত্রশাস্ত্রের প্রথম পূজিতা দেবী কালী। “কাল” অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সময়ের শুভ শক্তি তিনি, তাঁকে উপেক্ষা করে কয়জনা!! বহু জায়গায় পুজো প্রস্তুতি নানান রকম – আবার কিছু সাদৃশ্য ও লক্ষ্য করা যায়। যেমন এই আলোর উৎসবে ছেলেমেয়েরা সবাই মেতে ওঠে নানান ঘরোয়া বাজি তৈরি করতে, অবশ্যই শব্দহীন। যেমন ছুঁচোবাজি – কূলগাছের কিছু ডাল ভেঙে এনে সেসব আগুনে পুড়িয়ে সেই ভস্মে বারুদ মিশিয়ে কাগজের সরু ছুঁচালো মোড়ায় ভরে অনেক সপ্তাহ রোদ্দুরে রেখে তৈরী হয় এই বাজি। সেভাবেই তৈরী হয় ছোটবড় তুবড়ী, এবং হাতেহাতে তৈরি হয় মাটির প্রদীপ। পুজোর দিন সন্ধ্যায় গ্রামের নিয়ম হলো শুকনো কলাগাছের ডালপাতা দিয়ে খানিকটা কাকতাড়ুয়া আকারে তৈরি হওয়া “বুড়ি”কে সবাই মিলে আগুন ধরিয়ে শুরু করে পুজোর বাজি পোড়ানো। পাঁচঘরায় এই দেবী কালীকার এক ১৫০ বছরের নিয়ম আছে, তা হল – গ্রামের অতি জাগ্রতা মা সিদ্ধেশ্বরী দেবীর ১৫০ বছরের প্রতিষ্ঠিত মন্দির, তিনি অত্যন্ত জাগ্রতা। তাই পাঁচঘরার আদি নিয়ম এ গ্রামের কোনো বাড়িতে কখনোই কালীঠাকুরের ছবি-পট রাখা যায় না এবং বাড়িতে, পাড়ায়, ক্লাবে কোনো পুজোর বন্দোবস্তও করা মানা। এবং দেবীর ছবি ফ্রেমবন্দি করাও বারণ।
১৫০ বছর আগে গ্রামের একমাত্র জমিদারবাড়ির জমিদার শ্রী যোগীন্দ্র সিং প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মৃন্ময়ী বিগ্রহের সেই বিগ্রহ; এখনও সমানভাবে সালঙ্কারা এবং দুঃখনাশিনী। চতুর্ভূজা নৃমুন্ডমালিনী দেবী সিদ্ধেশ্বরী মায়ের কৃপাকথা তাঁর এখন পর্যন্ত অংশত পাকা মন্দিরের বারান্দায় সারারাত অনেকেই ঠাঁই পান, ঘুমিয়ে যান কিন্তু, দেবীর চলাচলের উপযোগী জায়গায় অর্থাৎ মন্দিরের সদর দরজার মুখোমুখি কেউ রাতভর ঘুমোনোর বন্দোবস্ত করলে ভোরবেলা অজানা কারণে তাকে মন্দিরের ডানদিকে অথবা বামদিকে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। লোককথায়, মায়ের কৃপায় তারা ঘুমের ঘোরেই সরে যান, কথিত আছে মা তখন নিকটে অবস্থিত প্রতিষ্ঠিত পুকুরে স্নানে যান।
এই দেবী সিদ্ধেশ্বরী মা পাঁচঘরায় আর একটি বাড়িতেই আছেন, রীতিমতো তন্ত্রসিদ্ধ শ্রীবিষ্টুবাবুর বাড়ি এবং গ্রামের চক্রবর্তী বাড়ির মন্দিরে বিরাজমান রয়েছেন মা শ্মশানকালী।এরও রয়েছে দীর্ঘ ৬৫ বছরের ইতিহাস। তখন চক্রবর্তী বাড়িতে ছেলেপিলেরা বেশীরভাগ ১২/১৪ বছর বয়স হতেই অজানা অসুখে হঠাৎ করেই মারা যেত। স্বাভাবিক এ অকালমৃত্যুর যন্ত্রনা থেকে রেহাই পেতে বাড়ির সকলে চিন্তিত। সেসময় তন্ত্রমন্ত্রে বিশ্বাসী বয়োজ্যেষ্ঠ শ্রী প্রবোধ চক্রবর্তী মহাশয় বিজ্ঞজনের পরামর্শ অনুযায়ী বাড়িতে দেবীকালীকার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হলেন কিন্তু কিছুদিন যাবৎ পটুয়াপাড়া বায়না দেওয়ার আগে পাশের গ্রামের শ্মশানের নিকট দিয়ে গেলেই দুতিন দিন কে যেন পিছন থেকে বলে উঠছেন- “আমাকে নিয়ে যা না, আমি থাকতে কোথায় যাস!” অবাক চিত্তে ভাবতেন কে এমন করে পিছু ডাকে তাকে?? আরো একদিন সাহস নিয়ে প্রবোধবাবু প্রশ্ন করলেন -“কে বলছেন, দয়া করে পরিস্কার করে বলুন??”
তখন সমস্ত বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে আনন্দে আপ্লুত হয়ে মায়ের ইচ্ছেতে অবিকল শ্মশান কালীর সেই মূর্তি বায়না দিয়ে গড়ে বাস্তুর মন্দিরে স্থাপন করলেন। শ্মশান কালী আমরা জানি শ্মশান নিবাসীনি। কিন্তু স্বয়ং মায়ের ইচ্ছে যদি হয় বাড়িতে আসার কার সাধ্যি সে বিধান লঙ্ঘন করা!! তখন হতে আজ ৬৫ বছর হয়ে গেল মা সাগ্রহে পূজার্ঘ্য গ্রহণ করে অধিষ্ঠিত রয়েছেন এবং অকালমৃত্যু হতে রক্ষা করেছেন। এমন মহিমান্বিত মা আমাদের – মাহাত্ম্য বর্ণনা অচিরেই আনন্দাশ্রু সমেত মাথা নত করে দেয়।
রবীন্দ্রসংগীত ও কত্থক নৃত্যশিল্পী, কথাসাহিত্যে স্নাতকোত্তর ও আকাশবাণীর ঘোষিকা। .দেশজ জীবনশৈলীর একনিষ্ঠ ধারক।
Comment here