(দশম পর্বের পর)
ছয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা।মার্কাস স্কোয়ারে তখন বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলন হতো। সে সময় আবার কৃত্তিবাস পত্রিকার যুগ। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসেএই পত্রিকার গুরুত্ব কম নয়। মার্কাস স্কোয়ারে ওই সম্মেলনে কৃত্তিবাস পত্রিকার কবিরা স্টল দিতেন।স্টলের অঙ্গসজ্জা করেছিলেন পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়। সেখানে জড়ো হতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, তারাপদ রায়, প্রমুখ কবি। বাংলা সাহিত্যের তরুণ কবিদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠতো ওই অঞ্চল।
কৃত্তিবাস পত্রিকার প্রসঙ্গ যখন উঠেই এলো তখন কৃত্তিবাস পত্রিকাকে ঘিরে কবি-সাহিত্যিকদের যে আড্ডা তার প্রসঙ্গ উল্লেখ করতেই হবে। এই কৃত্তিবাস পত্রিকার আড্ডা যাদের ঘিরে সংঘটিত হতো তাদের মধ্যে ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, তারাপদ রায়, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, কবিতা সিংহ, মানস রায়চৌধুরী,সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, অলোকরঞ্জন দাসগুপ্ত, শঙ্কর চট্টোপাধ্যায় এবং সর্বোপরি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। উত্তর কলকাতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যে বাড়িতে থাকতেন সেই বাড়ির একতলায় ছিল কৃত্তিবাস পত্রিকার দফতর। সেখানেই আড্ডা,লেখা নির্বাচন বা সাহিত্যচর্চা। আবার মাঝে মাঝে গোলদিঘির ধারেও বসতো এঁদের আড্ডা।এই মানুষগুলি কখনো ভিড় জমাতেন কলেজ স্ট্রিটে কফি হাউসে।কফিহাউসের আড্ডায় মাঝে মাঝে আসতেন শঙ্খ ঘোষ। দেশপ্রিয় পার্কের কাছে সুতৃপ্তি নামক রেস্তোরাঁয় বা শংকর চট্টোপাধ্যায়ের বৈঠকখানায় কৃত্তিবাসের কলমচিরা একত্রিত হতেন। আসলে শ্রাবণ ১৩৬০- এর কৃত্তিবাস পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সেই পত্রিকার সঙ্গে উদীয়মান কবি-সাহিত্যিকেরা একাত্ম হয়ে ওঠেন। প্রথম সংখ্যায় সম্পাদকীয়তে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন,” আসল কথা হল তরুণদের একটি গোষ্ঠী বা দল গড়ে ওঠা।… এই দলে সম্মিলিত আড্ডায় মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং পারস্পরিক বন্ধুত্ব যত দৃঢ় হয় লেখার আত্মস্বতন্ত্রতা তত পায়। এখানকার আড্ডার আসরের একটি গল্প বড়ো মজার।একদিন সন্ধ্যেবেলায় কৃত্তিবাস পত্রিকার দপ্তরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এসে উপস্থিত হলেন। সঙ্গে রয়েছেন সমরেশ বসু, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, ও বরুণ চৌধুরী।
” দফতরে ঢুকেই শক্তিদা একটা মস্ত হাঁক পাড়লেন,এই কে আছ, কবিতার ফাইল নিয়ে এসো।
সুনীলদা সহাস্যে বললেন, এইতো কৃত্তিবাসে মতি হয়েছে। দেখছি ফাঁকি না দিয়ে লক্ষ্মী ছেলের মতো কবিতা গুলো দেখে দাও।নইলে পঁচিশে বৈশাখের আগে কাগজ বেরোবে না। শক্তিদা ফাইল নিয়ে বসলেন। কোনো কবিতাই পড়লেন না। একটি একটি কবিতা ফাইল থেকে নিচ্ছেন আর ধ্যার ব্যাটা কিসসু লিখতে পারে না বলে দুমড়ে মুচড়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলে দিচ্ছেন। সারা ঘরে পাখার হাওয়ায় উড়ন্ত কবিতা- যাকে বলে কবিতার তুলো ওড়ে। সুনীলদা প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন- আরে আরে কি করছ শক্তি, অনেক কবিতা আমন্ত্রিত। ওগুলো ফেলে দিচ্ছ কেন? সুনীলদার কথায় কোন কাজ হল না। পনেরো কুড়িটা কবিতা ফাইলে রেখে শক্তিদা বেরিয়ে গেলেন। আমরা সবিস্ময়ে লক্ষ করলাম বলে দেওয়া কবিতাগুলো সুনীলদা পরম মমতায় তুলে রাখছেন” কবি শ্যামলকান্তি দাসের কলমে ধরে পড়া এই ঘটনাটি অন্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কি আমাদের সামনে উপস্থিত করে।
( ক্রমশঃ)
– পেশাগতভাবে সরকারী কর্মী, সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়েই বাঁচেন, লেখলেখির মাধ্যমে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাথে যুক্ত।
valo
[…] পর্বের […]