It is not the occasion for lazily sitting tight on past achievements or for senselessly gloating and getting dizzy over perhaps unexpected success. And on the other hand, it would be unreasonable to be cynical, pessimistic or skeptical over the up-to-date realizations, whatever they are. At every stage progress spells preparedness for the next war against the new evils of the day.
We have climbed a height indeed,
But alas, the highest is yet to come!
—PROF. BENOY KUMAR SARKAR
(DOMINION INDIA IN WORLD-PERSPECTIVES,
CALCUTTA, 1949, pp. 119-120)*
সমগ্র উনবিংশ শতাব্দীব্যাপী বাংলার বৌদ্ধিক-বস্তুগত অভিমমুখগুলিকে কেউ কেউ নবজাগরণ বা ‘রেনেসাঁস’ বলেছেন; যদিও কোন একটি বিশেষ শাসনতন্ত্রের মধ্যে সামাজিক ক্ষেত্রে বৌদ্ধিক চেতনার পরিবর্তন যদি সামাজিক বিভিন্ন স্তরের মনস্তত্ত্বের গভীরে প্রতিফলিত হয় তবে তাকে অবশ্যই নবযুগকে বা জাগরণ বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু বস্তুগত দিক থেকে সেই জাগরণ সামাজিক অগ্রগতি বা উন্নতির অভিমুখে নাও হতে পারে। কিন্তু বঙ্গীয় আধুনিকতা বা যুগের পরিবর্তনের পর্বে সমস্ত সামাজিক সংকট ও দ্বন্দ্বের অবসান ঘটেছিল সেকথাও বলা সম্ভব নয়। কেননা পূর্ববর্তী কয়েক শতাব্দীব্যাপী বাংলার আর্থিক সমৃদ্ধি সামাজিক ক্ষেত্রে সমস্ত প্রজার জীবনে স্থিতি ও শান্তি-শৃঙ্খলা এসেছিল এমন দাবীও কেউ করতে পারবেন না। রাজনৈতিকভাবে সামাজিক ন্যায় আর সমৃদ্ধির অভিমুখগুলি পরিবর্তন সাপেক্ষ। উনিশ শতকের বাংলা হয়ে উঠেছিল ভারতীয় উপমহাদেশব্যাপী আরব-পশ্চিমী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় সনাতন সংস্কৃতি আত্মমর্যাদা-গড়িমা ও স্বরাজ রাজনৈতিক সংস্কৃতি নির্মাণের আঁতুর ঘর। পূর্বভারতে প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছরের আরব-ইসলামীয় রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের মধ্যেই ঘাপটি মেরে ছিল ক্ষয়িষ্ণু প্রতিস্পর্ধী বাঙ্গালী হিন্দুর রাজনৈতিক সংস্কৃতি; বিচ্ছিন্নভাবে স্থানীয় প্রশাসনিক ক্ষমতাতন্ত্রের দোসররূপেই তা টিকে ছিল। স্বয়ং বিদ্যাসাগর মহাশয় মার্শম্যানের প্রেরণায় ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ (১৮৪৮) রচনাকালে অষ্টাদশ শতকের নবাবী শাসনে রাজবল্লভ-আলিবর্দি-নিবাইশ মহম্মদ-সায়দ মহম্মদ-সকতজঙ্গ-সিরাজদৌল্লা-মোহনলালদের শাসনে নিষ্ঠুন প্রজাশোষণ-নিপীড়নের কাহিনী সম্পর্কে সচেতন করেছিলেন। বর্তমান সন্দর্ভে এই আলোচনার গভীরে না গিয়েও কেবলমাত্র স্তুতি আর গোঁজামিলের ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন হবার প্রয়াস যেন আমাদের থাকে।
মূর্শিদকুলি খান কর্তৃক স্বাধীন স্বতন্ত্র বাংলা প্রদেশ (১৭১৭ -১৭৫৭) স্থাপনে স্থানীয় শাসকগোষ্ঠী হিসাবে মূলত দেওয়ানী ও রাজস্ব বিভাগে হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল অনস্বীকার্য। বৃহত জমিদারী গঠন ও ইজারাদারদের মাধ্যমে নিয়মিত রাজস্ব আদায় সুনিশ্চিত করার ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক-প্রশাসনিক অভিমুখগুলি পরবর্তী কোম্পানি শাসনাধীনে ও পিতৃতান্ত্রিক ভিক্টোরিয়া শাসনতন্ত্রে প্রায় দু’শো বছর পাঁচশালা-দশশালা-চিরস্থায়ী ব্যবস্থা দ্বারাই টিকে ছিল; অন্তত রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ইংরেজ বণিক গোষ্ঠী ও পরবর্তীকালের পিতৃতান্ত্রিক ভিক্টোরিয়ো শাসনতন্ত্রেরর ওপরও পূর্ববর্তী শাসনতন্ত্রের মোঘল-নবাবী ঝাঁঝ ছিল পুরোমাত্রায়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনতন্ত্রের ইমারত যতই আধুনিকতার মোড়কে নেমে আসুক না কেন, বাংলার আর্থিক ভিত্তি ছিল জমিদারী বন্দোবস্ত বা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। বাংলার রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক সংস্কৃতির উত্তোরণ ও তার ধারক-বাহক সব শ্রেণীর ঔপনিবেশিক প্রজার জীবনগাথা ছিল এর সাথে বাঁধা। ঔপনিবেশিক শিক্ষা ও তা নিয়ন্ত্রিত আধুনিক শিল্পায়নে মুৎসুদ্দীগোষ্ঠী আর স্বাধীন-স্বতন্ত্র স্বদেশী পুঁজির উদ্ভবের টানাপোড়েনের মধ্যেই গড়ে উঠছিল ঔপনিবেশক বিরোধী রাজনীতির দ্বন্দ্বের সূত্রগুলি। বাংলার ভূমিই ছিল সেই দ্বন্দ্বের বৌদ্ধিক আঁতুরঘর। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে শেষ পর্যায়ে শুধু বাংলাই নয় সমগ্র ভারতভূমিই হয়ে উঠেছিল পরিণত বৌদ্ধিক মণীষার কর্মভূমিতে; বিশ্বব্যাপী ছিল সেই কর্মচেতনার বিচ্ছুরণ।
স্বদেশী বিপ্লব ও বাংলার গৌরবময় শিক্ষাস্বরাজ আন্দোলনের প্রাক্-প্রস্তুতি পর্ব
ঊনবিংশ শতকের বাঙ্গালী মনীষার সাংগঠনিক প্রকাশ ঘটে সংবাদপত্র প্রকাশনা ও আলোচনা সভা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। আদর্শভিত্তিক স্বতন্ত্র মতামত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে রামমোহন রায়-এর আত্মীয় সভা ও ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা কাহিনী হিন্দু সমাজের সংস্কার প্রক্রিয়ার নান্দীমুখ। উদীয়মান যুক্তিবাদী নবীন যুবকগোষ্ঠীর হাতে ব্রাহ্মসমাজের ভাঙন অব্যাহত থাকলেও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ববোধিনীর পত্রিকায় ঐতিহ্য আর আধুনিকতার উপস্থিতিতেই সূচনা হয়েছিল জাতীয়তার নবমন্ত্র। ১৮৬৫ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ন্যাশানাল পেপার’-এর কার্যভার নবগোপাল মিত্রের হাতে সমর্পন করেন। ইতিমধ্যে রাজনারায়ণ বসুর প্রতিষ্ঠিত ‘জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভা’ প্রেরণাকল্পে রচনা করেন ‘Prospectus of a Society for the promotion of National Feeling among the educated natives of Bengal’ নামে একটি সন্দর্ভ, যা প্রথমে ‘ন্যাশানাল পেপার’-এ ছাপা হয়, পরে তা হবহু তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার চৈত্র, ১৭৮৭ শক-এ (১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দ) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এই সন্দর্ভই ছিল নবগোপাল মিত্র প্রতিষ্ঠিত জাতীয় চৈত্র-মেলা বা ‘হিন্দু মেলা’র (১২৭৩ চৈত্র সংক্রান্তিতে/ খ্রিস্টাব্দ ১৮৬৭ ১২ই এপ্রিল) ভাবাদর্শগত ভিত্তি। ‘মহা হিন্দু সমিতি’ ন্যায় সংগঠনের গড়ে তোলার আবশ্যিকতা রাজনারায়ণ বসু ভেবেছিলেন সমকালীন শিক্ষিত বাঙ্গালীর পশ্চিমীপ্রেম ও পরাঙ্মুখ বৌদ্ধিক ব্যাধিকে প্রত্যক্ষ করে।
উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাঙ্গালী বৌদ্ধিক মনীষার আন্তর্জাতিকীকরণ ঘটল শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের ভাবাদর্শে উদ্বেলিত স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো ধর্ম সভার (১৮৯৩) বক্তৃতায়। ধর্মসভায় বিশ্বের দরবারে সনাতন ভারতীয় আধ্যাত্মিক দর্শনের উন্মোচনের সাথে সাথেই শুরু হয়েছিল পশ্চিমী বৌদ্ধিক আধিপত্যবাদকে সম্পূর্ণ চ্যালেঞ্জ জানানোর বৌদ্ধিক লড়াই। স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশচন্দ্র বসু, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, প্রফুলচন্দ্র রায় সনাতন ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক দর্শন, বস্তুবাদ ও বিজ্ঞানচর্চায় ভারতবর্ষকে বিশ্বের আঙিনায় প্রতিষ্ঠা করলেন। আর বঙ্গদেশের আরেক সেনাপতি বিনয় কুমার সরকার (জন্ম মালদার মকদুমপুর, ১৮৮৭ সনের ২৬ ডিসেম্বর মতান্তরে ২২শে অক্টোবর – মৃত্যু ১৯৪৯ ২৪ নভেম্বর, আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসি) বস্তুনিষ্ঠ ভারতবর্ষ তথা প্রাচ্যতত্ত্বের প্রতিনিধি হয়ে পশ্চিমী জ্ঞানপীঠগুলির সঙ্গে কখন তর্কযুদ্ধে, কখন প্রত্যক্ষ সন্দর্ভে লিপ্ত হলেন। বিংশ-শতাব্দীর প্রথমার্ধের শেষ সাড়ে তিন দশকব্যাপী অধ্যাপক সরকার নিয়োজিত থেকেছেন প্রাচ্য-প্রতীচ্যের রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের তুলনামূলক তাত্ত্বিক ও দার্শনিক সন্দর্ভ রচনায়; যার যৌক্তিক প্রয়োজনীয়তা আজ প্রায় শতবর্ষ পরেও প্রাসঙ্গিক। বর্তমান আলোচনার কেন্দ্রভূমি তিনিই; প্রাথমিক গৌরচন্দ্রিকা অবশ্য তাঁর জন্মভূমি ও কর্মভূমির অতীতকে ফিরে দেখা মাত্র। আর তাঁর সম্পর্কে আলোচনায় আমি গঙ্গা জলে গঙ্গা পূজোর বিধিতেই আস্থা রেখেছি। তাঁর জ্ঞানচর্চার কর্মকাণ্ড ও লেখনীর তল পাওয়া আমার পক্ষে ধৃষ্টতামাত্র; কেননা তিনি বিশ্বের বহুজাতির ভাষা ও সমাজ-অর্থনীতি-ইতিহাস-রাজনীতি নিয়ে ভেবেছেন লিখেছেন; আমার পক্ষে তাঁর সম্পর্কে কিছু বলা বা লেখা দস্তুর মতোই এক স্পর্ধা বটে। তবে তাঁকে নিয়ে আমার এই ধৃষ্টতার কারণ অবশ্যই বাঙ্গালী হিন্দুর দার্শনিক ও তাত্ত্বিক আন্তর্জাতিকতাবাদের অন্যতম স্রষ্টা হিসাবেই।
ডঃ রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় তাঁর সম্পর্কে লিখছেন “……. ১৯০১ সালে মাত্র তেরো বছর বয়সে মালদা জিলা স্কুলের ছাত্র হিসাবে বিনয় কুমার সরকার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম হয়ে রেকর্ড স্থাপন করেন।…… পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর গ্রীষ্মের ছুটিতে বহরমপুরে তাঁর দেশের বাড়িতেই বিনয় কুমার সরকারের সাথে তাঁর প্রথম সাক্ষাত এবং ঘনিষ্ঠতা। তিনি তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র হিসাবে ইডেন হিন্দু হোস্টেলে থাকেন এবং বিনয় কুমারও এর পর তার সহযোগী হন এবং পরবর্তী বেশ কয়েক বছর তাঁরা একসাথে কাটান …..।” ১৯০২ সালে রাধাকুমুদ মুখার্জী ‘ডন সোসাইটি’র প্রতিষ্ঠাতা সতীশ চন্দ্র মুখার্জীর ব্যক্তিত্বে আকৃষ্ট হন, (সতীশ চন্দ্র মুখার্জী তখন নিয়মিত ইডেন হিন্দু হোস্টেলে ছাত্রাবাসে যাতায়াত করতেন) বিনয় কুমার সেই সময় প্রেসিডেন্সি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। উভয়ই সেই সময়ে ‘ডন সোসাইটি’র কার্যকলাপের সাথে সরাসরি যুক্ত হন। (বিনয় কুমার সরকার – এ স্টাডি, হরিদাস মুখার্জী; কলকাতা, মার্চ, ১৯৫৩)। তখন ‘ডন সোসাইটি’ অফিস ছিল ‘মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউসন’ এর ঘরে যার বর্তমান নাম বিদ্যাসাগর কলেজ।
বিনয় সরকার নিজের ছাত্রজীবনকে স্মৃতিকে মনে করে বলছেন “ …… ১৯০২ সালে “দেশের কথা” জিনিসটা আমার কাছে নূতন ঠেকেছিল। ….. “দেশ”, “দেশের কথা”, “স্বদেশ-সেবা”, “দেশের জন্য স্বার্থত্যাগ” শব্দগুলি শুন্লাম সতীশবাবুর সংস্পর্শে…..। ১৯০১ সালে কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশন দেখেও স্বদেশ সেবার কারখানা মনেই হয়নি। ….. “দেশ” আর “স্বার্থত্যাগ” এই দুটো পারিভাষিক আমি সতীশবাবুর আবহাওয়ায় দখল ক’রে নিলাম।……” সতীশ বাবুর মজলিশেই বিনয় কুমার সরকার রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-এর কথা প্রথম শোনেন। পরবর্তী কালে তিনি বঙ্গ-বিপ্লবের প্রেরণা ও বাঙ্গালীর ভারত ভূমি থেকে বিশ্বভুবন জয়ের পিছনে “রামকৃষ্ণ সাম্রাজ্য”-এর প্রকাশ বলে বারংবার তাঁর বই “ইয়ং এশিয়া” উল্লেখ করেছেন। যুবক-বাঙ্গালী-যুবক-ভারত-যুবক এশিয়ার জাগরণ যেভাবে বিশ্বের আঙিনায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং হচ্ছে তাকে তিনি রামকৃষ্ণ –বিবেকানন্দের ভাবাদর্শের সাম্রাজ্য বলেই অভিহিত করেছেন। বিবেকানন্দকে তিনি যুবক ভারতের কার্ললাইল বলে অভিহিত করেন। (“বিনয় সরকার অ্যাণ্ড রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ মুভমেন্ট”; হরিদাস মুখার্জী, গোলপার্ক-কলকাতা, সেপ্টেম্বর, ১৯৮৮)।
১৯০৫ সালে তাঁরা দুজনেই ইডেন হিন্দু হোস্টেল ত্যাগ করে কিছুদিন ‘ফিল্ড অ্যান্ড একাডেমি’ নামক মেস-এ ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকার সম্পাদক স্বামী ব্রহ্মাবান্ধব উপাধ্যায়ের ন্যায় ব্রিটিশ শাসন বিরোধী আপোষহীন দেশব্রতী মানুষের অভিভাবকত্বে কাটান। ১৯০৫ সালে বঙ্গ বিভাজন ঘোষণার সাথে সাথেই বাংলার সামাজিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে পরিবর্তন আসে। ১৯০৫ সালের ৭ই আগস্ট বিলিতি পণ্য বয়কটের মাধ্যমে “বঙ্গ বিপ্লব”-এর সূত্রপাত। তখন প্রতিটি দিনই বাংলার বুকে জুড়ে নানান বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড সংবাদপত্রের শিরোনামে স্থান পাচ্ছে। “ডন সোসাইটি’ -এর সদস্যগণ (সমগ্র ছাত্র সমাজ) ‘স্বদেশী আন্দোলন’-এ প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েন। স্বদেশী আন্দোলনের বৌদ্ধিক নেতৃত্ব থাকেন বিপিন চন্দ্র পাল, সতীশ চন্দ্র মুখার্জী, স্যার অরবিন্দ ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হীরেন্দ্র নাথ দত্ত, নগেন্দ্রনাথ ঘোষ, ভগনী নিবেদিতা প্রমূখ। আর স্বদেশী আন্দোলনের সংগঠকদের মধ্যে ছিলেন দেশের তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত আইনজ্ঞ শ্রী রাসবিহারী ঘোষ, স্যার গুরুদাস ব্যানার্জী, আশুতোষ চৌধুরী ও বোমকেশ চক্রবর্ত্তীর ন্যায় ব্যক্তিবর্গ…….।”(বিনয় সরকারের বৈঠকে, হরিদাস মুখার্জী সম্পাদিত; দেশ পাবলিকেশন, কলিকাতা পৃষ্ঠা. ১৬৪ -১৯৯)
বঙ্গ-স্বদেশী বিপ্লবের গোড়া থেকেই বিনয় কুমার সরকারের ন্যায় আত্মত্যাগী কর্মনিষ্ঠ তরুণ ছাত্রদের অগ্রণী ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল; বিশেষত স্বদেশী আন্দোলনের বিচ্ছুরণ দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ল জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন ও সশস্ত্র বৈপ্লবিক আন্দোলনের মাধ্যমে। …… ১৯০৬ সালের মার্চ মাসে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠা এবং ন্যাশানাল কাউন্সিল অব এডুকেশন-এর প্রাণপুরুষ মনীষী সতীশচন্দ্র মুখার্জীর তত্ত্বাবধানে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত ন্যাশানাল কলেজ এবং ন্যাশানাল স্কুল। কলকাতা বাইরে সারা বাংলা জুড়ে জেলাস্তরে স্বদেশী শিক্ষা আন্দোলনের ছোঁয়া পৌঁছে দিতে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিনয় কুমার সরকার। তাঁর পূর্বপুরুষের আবাসভূমি বিক্রমপুরের সমহটি এবং তাঁর জন্মস্থান মালদার মকদুমপুরে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের তত্ত্বাবধানে স্কুল স্থাপিত হয়। তাঁর মতে “১৯০৫ সালের ৭ই আগস্ট থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত বাংলা নর-নারী যা কিছু করেছিল তা ‘বঙ্গ বিপ্লব’-এরই অন্তর্গত। তাঁর ভাষায় ১৯০৫-এর আগস্ট মাস থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত কর্মকাণ্ড ছিল ‘বঙ্গ বিপ্লব’-এর প্রথম ডোজ। ছোট মেয়াদের এই বঙ্গ-বিপ্লব-এর ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল ১৯০৫-০৬ সনের চিন্তা ও কর্মরাশির মধ্যেই।
বঙ্গ-স্বদেশী-স্বরাজ যুগের ঘটনাবলীর প্রথম পারিভাষিক — বয়কট, দ্বিতীয় স্বদেশী, তৃতীয় স্বরাজ, আর চতুর্থ জাতীয় শিক্ষা। তাঁর কথায়, “১৯০৫ সনের ৭ই আগস্ট বিলকুল নয়া অবস্থার উৎপত্তি হল। ….. নয়া ঢঙের বা নয়া রঙের বঙ্গ-জীবন বিদেশীদের মগজে নয়া খেয়াল পায়দা করেছিল।” “……. বাঙ্গালীর বাচ্চা আমি,–বাঙ্গালীর চোখে দুনিয়া দেখি। আমার কাছে ১৯০৫ হচ্ছে বিংশ শতাব্দীর প্রথম বৎসর। এই সময় শুরু হয় গৌরবময় বঙ্গ-বিপ্লব। এ খাঁটি যুগান্তর।” ……গভীরভাবে দেখ্লে বলতে হবে যে, এই বিপ্লব বা যুগান্তর আজও এসে ঠেকে নি অর্থাৎ শেষ হয় নি। ……১৯১১ সাল পর্যন্ত বঙ্গ-বিপ্লবের সময় টানার কারণ “সেই সময় ব্রিটিশ রাজ বঙ্গ ভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয়। দুটুকরো-করা বাংলায় আবার জোড়া লাগে। বঙ্গ-ভঙ্গের বিরুদ্ধেই বাংলার নরনারী বিলাতী বয়কট জারি করেছিল। সুতরাং বঙ্গ-ভঙ্গের রদ হওয়াটা বঙ্গ-বিপ্লবের অন্যতম স্বার্থকতা। এই ঘটনাকে বঙ্গ-বিপ্লবের বড় খুঁটা বিবেচনা করা উচিত।”
১৯০৬-এর মার্চ জাতীয় শিক্ষা পরিষদের শিক্ষাপ্রণালী বাজারে জারি হওয়ার পেছনে সতীশ চন্দ্র মুখার্জী ও তাঁর ডন সোসাইটির ভূমিকা ছিল সর্বাধিক। বিনয় সরকারের ভাষায় ‘শিক্ষা স্বরাজ ডন সোসাইটির সন্তান।’ সতীশ চন্দ্র মুখার্জী, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন জাতীয় শিক্ষার পাঠক্রম প্রস্তুতের প্রাধান কাণ্ডারী। জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ছিল ষোল আনা বে-সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়। ভারতবর্ষের শিক্ষা বিপ্লবের সূত্রপাত এখান থেকেই। “টেক্নিক্যাল শিক্ষার বন্দোবস্ত করা হল, সার্বজনিক ও বাধ্যতামূলক। এই পাঠশালায় ভর্তি হওয়া মাত্রই শিশুকে হাতে-কলমে কাজ শিখতে হত। ইস্কুল বিভাগে ভাষা, সাহিত্য, অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে পদার্থ-বিজ্ঞান, রসায়ন, উদ্ভিদ-বিজ্ঞান, প্রাণ-বিজ্ঞান, স্বাস্থ্যতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়গুলি সার্বজনীন ও বাধ্যতামূলক করা হয়। ইস্কুল বিভাগের সর্বনিম্ন শ্রেণী হতে কলেজ বিভাগের সর্বোচ্চ শ্রেণী পর্যন্ত সবকিছু শিখবার জন্য বাংলা ভাষাকেই বাধ্যতামূলক ও সার্বজনীন বাহন করা হয়েছিল।” জাতীয় শিক্ষাপরিষদের ব্যবস্থায় বঙ্গ-বিপ্লব ও স্বরাজ একসাথেই বাংলাদেশের জেলায় জেলায় পৌঁছে গেল। এতবড় যুগান্তর ভারতীয় নরনারীর পক্ষে স্বপ্নেরও বাইরে ছিল বলা চলতে পারে।
জাতীয় শিক্ষা পরিষদের তত্ত্বাবধানে কলেজ বিভাগের শিক্ষা প্রণালীর বিশেষত্ব হল –
১) প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস, দর্শন, সুকুমার শিল্প, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে পঠন-পাঠন ও গবেষণার উপর জোর দেওয়া হল।
২) পালি, হিন্দি ও মারাঠি ভাষা শেখবার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। এই তিন ভাষার সাহায্যে প্রাচীন ও বর্তমান ভারতের সঙ্গে ছাত্রদের আত্মিক যোগাযোগ সুদৃঢ় করবার লক্ষ্য ছিল।
৩) ‘ফরাসী এবং জার্মান ভাষা শেখবার ব্যবস্থাও ছিল। আধুনিক ইয়োরামেরিকার জ্ঞানবিজ্ঞানের সঙ্গে ছাত্রদের সাক্ষাৎ সম্বন্ধ কায়েম করানো পরিষৎ নিজ কার্য তালিকায় অন্তর্গত করে।।…..এই কল্পনা, আকাঙ্খা বা স্বপ্নই তো শিক্ষাক্ষেত্রের বঙ্গ বিপ্লব। বস্তুতঃ এতবড় মোসাবিদা নিয়ে কাজ করবার পক্ষপাতী কোনো-কোনো জননায়োক ছিলেন না। ঝগড়া হয়েছিল প্রথমেই। এমন কি বেঙ্গল ল্যাণ্ডহোল্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভায়ই (১৬ই নভেম্বর, ১৯০৫)তারক পালিত, নীলরতন সরকার, প্রাণকৃষ্ণ আচার্য ইত্যাদি নেতারা স্বতন্ত্র ব্যবস্থার কথা আন্দোলন রজ্জু করেন।……তাঁদের মোসাবিদায় টেক্নিক্যাল শিক্ষা ছাড়া অন্যকিছুর ব্যবস্থা ছিল না।…….. সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী বে-সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় কায়েম করার কথা তাঁদের প্রস্তাবে ছিল না। তাঁরা বেঙ্গল টেক্নিক্যাল ইনস্টিটিউট নামে কলেজ স্থাপন করলেন (১৯০৬)।” “সতীশ-মণ্ডলে”র প্রায় সবাই জাতীয় শিক্ষাপরিষদের প্রস্তাবে সায় দিলেন। রাসবিহারী ঘোষ, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, আবদুল রসুল, হীরেন দত্ত, মতি ঘোষ, বিপিন পাল, আশুতোষ চৌধুরী রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ইত্যাদি অনেক জননায়কই ষোল কলায় পূর্ণ ঢঙের বে-সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ নিয়ে জাতীয় শিক্ষ পরিষৎ কায়েম করলেন (১৯০৬)। তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নাম হল বেঙ্গল ন্যাশানাল কলেজ অ্যাণ্ড স্কুল। মফঃস্বলে তাঁদের অধীনে ১৯০৬-০৮ সনে বোধ হয় শ’-খানেক ইস্কুল ও পাঠশালা ছিল। সারা বাংলায় প্রায় হাজার-পাঁচেক ছাত্র হয়েছিল প্রথম বছর-দুয়েক। এই দুই স্বদেশী প্রতিষ্ঠান কয়েক বৎসর স্বতন্ত্র ভাবে চলতে লাগল। কিন্তু ১৯১০ সনে দুটো মিলে গেল নাম হল বেঙ্গল ন্যাশানাল কলেজ অ্যাণ্ড টেক্নিক্যাল ইনস্টিটিউট। দুটোকে একত্রে চালাবার কর্তা হল জাতীয় শিক্ষা পরিষদ। বর্তমানে যাদবপুরে রয়েছে কলেজ অব এঞ্জিনিয়ারিং অ্যাণ্ড টেক্নলজি। জাতীয় শিক্ষাপরিষদের মাধ্যমে ডন সোসাইটির পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হল।
১৯০৬ সনের মাঝামাঝি থেকেই ‘ডন ম্যাগাজিন’ -এর তৃতীয় যুগ শুরু হোল। ১৮৯৩ থেকে ১৯০২ পর্যন্ত ছিল দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক যুগ। ১৯০২ থেকে ১৯০৬-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত ছিল ভারতীয় তথ্য-নিষ্ঠা ও সংখ্যা-নিষ্ঠার যুগ। আর জাতীয় শিক্ষার যুগ। সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ‘ডন ম্যাগাজিন’-এ প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস, দর্শন ও সংস্কৃতির গবেষণা বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশ করতে থাকেন। জাতীয় শিক্ষাপরিষদের উদ্দেশ্যকে বৃহত্তর ভারতের প্রেক্ষিতে দেখতেন। তাই ভারতীয় সংস্কৃতি বিষয়ক অনুসন্ধান-গবেষণা, এবং জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন বিষয়ক সকল প্রকার সংবাদ ও মন্তব্য প্রকাশ করা হতো।
স্বদেশী যুগের (১৯০৫-১১) ইতিহাস গবেষণার গুরুস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে রমেশচন্দ্র দত্ত (১৮৪৮-১৯০৯), হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১), দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯), অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় (১৮৬১-১৯৩০), যদুনাথ সরকার (১৮৭০-১৯৫৮) প্র্রমুখ ছিলেন বিশেষভাবে সম্মানীয়। প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণালব্ধ লেখা ‘ডন ম্যাগাজিন’-র মাধ্যমে প্রকাশিত হত। সতীশচন্দ্র মুখার্জী নিজস্ব রচনা ছাড়াও হারাণচন্দ্র চাকলাদার, রাধাকুমুদ মুখার্জী, রবীন্দ্রনারায়ণ ঘোষ, বিনয় কুমার সরকার, উপেন্দ্রনাথ ঘোষাল, রাজেন্দ্র প্রসাদ প্র্রমুখের লেখা অস্বাক্ষরিত অবস্থায় ‘ডন ম্যাগাজিন’-এ ছাপানো হতো। এই প্রবীণ-নবীন এর সমন্বয়ের ঐতিহাসিক-সমাজতাত্ত্বিকদের লেখাতেই লঙ্কা, সুমাত্রা, যম্বুদ্বীপে প্রাচীন হিন্দু-বৌদ্ধ সংস্কৃতির সম্পর্কের কথা বাঙ্গালীর হাত দিয়েই ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের দরবারে পৌঁছেছিল। ভারতীয় সমুদ্র-বাণিজ্যের ইতিহাস (১৯১১) বিষয়ক বই রচনায় রাধাকুমুদ মুখার্জীর ওপর সতীশ চন্দ্র মুখার্জীর প্রেরণা ছিল সর্বাধিক। পরবর্তী কালে ঘরোয়া আড্ডায় নিজের ছাত্রদের কাছেই বিনয়কুমার সরকারের অপকট স্বীকারোক্তি – “সতীশবাবুর আবহাওয়ায় পড়েছিলাম ব’লে জীবন ধন্য হয়েছে।” ***
ডন ম্যাগাজিন ছাড়াও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের “প্রবাসী” ও “মর্ডান রিভিউ”-য়ে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় যাতে ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐক্য সম্পর্কে গবেষণালব্ধ লেখা প্রকাশিত হয়। “দি ফাণ্ডামেন্টাল ইউনিটি অব ইণ্ডিয়া” নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিতও হয়। স্বদেশী আন্দোলনের যুগে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের “প্রবাসী” ও “মর্ডান রিভিউ” প্রত্রিকাদ্বয়ের কাছে বাঙ্গালী ও সমগ্র ভারতবাসীই ঋণী। বঙ্গ-বিপ্লবের যুগে সংবাদ, তথ্য প্রকাশ, টীকা-টিপ্পনীর মাধ্যমে বাঙ্গালী ও ভারতবাসীকে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সজাগ রেখেছিলেন। তিনি ছিলেন সেই বিপ্লব যুগের অন্যতম আদর্শ-নিষ্ঠ, চৌকস ও কর্মদক্ষ স্বদেশসেবক।
১৯০৭ সালের প্রথম দিকেই বিনয় কুমার সরকার জাতীয় শিক্ষাপরিষদের তত্ত্বাবধানে থাকা বেঙ্গল ন্যাশানাল কলেজ অ্যাণ্ড স্কুলের একজন তরুণ আত্মত্যাগী সেবক হয়ে উঠতে লাগলেন। ওই বছরে জুন মালদহ জাতীয় শিক্ষা-সমিতির অধীনে ১৯০৭-১১ সনের মধ্যে মালদহ জেলার সদরে ও বিভিন্ন পল্লীতে গোটা এগারো নৈশ, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠিত হল। এর পিছনে বিনয় সরকারে উদোগে ছিল দস্তুরমতো। ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা ১০০০ পর্য্যন্ত হয়েছিল। সমগ্র মালদহ জেলাব্যাপী একটা জাতীয় শিক্ষা সমিতি গয়ে তোলা হল, যার নাম হয়েছিল — মালদহ-জাতীয়-শিক্ষা-সমিতি। পরবর্তীকালে এর সাথে কলকাতার জাতীয় শিক্ষাপরিষদের যোগাযোগও স্থাপিত হয়। অধ্যাপক নৃপেন্দ্রনাথ দে কর্তৃক সম্পাদিত “কলেজিয়ান” নামক ইংরেজি পাক্ষিক পত্রিকায় এই সকল অধ্যায় সম্পর্কে সুবিস্তৃত আলোচনা করেছেন।
বিনয়কুমার সরকারের প্রথম লেখাই ছিল জাতীয় শিক্ষা সম্বন্ধীয়। “জাতীয় শিক্ষা পরিষৎ ও বঙ্গসমাজ” নামে প্রথম লেখাটা প্রকাশিত হয়েছিল “মালদহ সমাচার” সাপ্তাহিকে। এই লেখারই ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয় অমৃতবাজার পত্রিকায় (জুলাই-আগস্ট ১৯০৬)। যদিও তাতে লেখকের নাম ছিল না। ১৯০৭ সালে জুন মাসে মালদহ জাতীয় শিক্ষাসমিতি প্রতিষ্ঠার পর “বঙ্গে নবযুগের নূতন শিক্ষা” নামে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। আগস্ট মাসেই ডন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় মালদহ জাতীয় শিক্ষা সমিতির পরিচালনা-প্রণালী সম্বন্ধে ইংরেজি প্রবন্ধ। সেই প্রবন্ধটি পড়ে শ্রী অরবিন্দ ঘোষ এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তাঁর “বন্দেমাতরম্” নামক ইংরেজি দৈনিকে মন্তব্য লেখেন। এমনকি বিপিনচন্দ্র পালও তাঁর “নিউ ইণ্ডিয়া” সাপ্তাহিকে (সেপ্টেম্বর মাস) সম্পাদকীয় প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। বঙ্গ-বিপ্লবের প্রথম পর্বে বিনয় কুমার সরকারের গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল শিক্ষাতত্ত্ব, শিক্ষাপ্রণালী ও শিক্ষার ইতিহাস। পরবর্তী কালে সেইসব প্রবন্ধ একত্রিত করে ‘শিক্ষাবিজ্ঞান’ নামে প্রকাশিত হয়। ১৯০৭-১০ ন্যাশানাল কলেজে বিনয় সরকার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ নেন। শিক্ষাবিজ্ঞানের ভূমিকা (১৯১০), প্রাচীন গ্রীসের জাতীয় শিক্ষা (১৯১০), ভাষাশিক্ষা (১৯১০), সংস্কৃতশিক্ষা (১৯১১), শিক্ষা-সমালোচনা (১৯১২), শিক্ষা-সোপান [স্টেপস টু এ ইউনিভারসিটি] (১৯১২) প্রকাশের মধ্যে দিয়ে বিনয়কুমার সরকার বন্ধু মহলে “শিক্ষাবিজ্ঞান সরকার” নামে পরিচিত হন। “ইতিহাস-বিজ্ঞান ও মানবজাতির আশা” বইটির ইংরেজি সংস্করণ ১৯১৩ লণ্ডন থেকে “দ্য সায়েন্স অব হিস্ট্রি অ্যাণ্ড হোপ অব ম্যানকাইণ্ড” নামে প্রকাশিত হয়। স্বদেশী বঙ্গ-বিপ্লবের যুগেই তাঁর উৎসাহেই জনৈক লোকসংস্কৃতি গবেষক ঐতিহাসিক-সমাজতাত্ত্বিক-সাহিত্যিক হরিদাস পালিতের “আদ্যে গম্ভীরা” গ্রন্থটি (১৯০৮) হিন্দু ভারতবর্ষের লোকাচার-লোকশিল্প—লোকসাহিত্য-লোকসঙ্গীত-লোকনৃত্য-বাদ্য-লোকধর্ম-লোকপ্রবাদ-লোকাচার-নৃতত্ত্ব বিষয়ক সংস্কৃতির চর্চার পথপ্রদর্শক বলে উল্লেখ করেছেন। এই গ্রন্থের প্রেরণা থেকেই তিনি “দ্য ফোক-এলিমেন্ট ইন হিন্দু কালচার” বইটি লেখেন।
১৯০৯ খ্রী: থেকে এলাহাবাদ পাণিনি কার্যালয়ের গবেষক হিসাবে বেশ কিছু গবেষণাধর্মী গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ১৯১৪ খ্রী: থেকে ১৯২৫ খ্রী: তিনি বিশ্ব পর্যটন করেন এবং পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। ১৯২৬-১৯৪৯ খ্রী: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ধনবিজ্ঞান পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা ও ‘আর্থিক উন্নতি’ মাসিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থসংখ্যা শতাধিক।
বাংলা ভাষায় তাঁর লিখিত অন্যান্য গ্রন্থাবলীর মধ্যে “ঐতিহাসিক প্রবন্ধ” (১৯১২), “বিশ্বশক্তি (১৯১৪), “বর্তমান জগৎ” (তের খণ্ড, ১৯১৪-৩৫), “হিন্দু রাষ্ট্রের গড়ন” (জাতীয় শিক্ষাপরিষৎ গ্রন্থাবলী – ২, রাজেন্দ্রলাল সরকার কর্তৃক প্রকাশিত, কলিকাতা, ১৯২৬), “নয়া বাংলার গোড়াপত্তন” (প্রথম ভাগ, ১৯৩২), “একালের ধন-দৌলত ও অর্থশাস্ত্র” (দুই খণ্ড ১৯৩০-৩৫), “বাড়তির পথে বাঙালী” (১৯৩৪), “বাংলায় দেশী-বিদেশী” (১৯৪২), “নিগ্রোজাতির কর্মবীর”, (১৩খ-), “ধনদৌলতের রূপান্তর”, “চীনা সভ্যতার অ আ ক খ”, “বাংলায় সমাজ বিজ্ঞান” (চক্রবর্তী চ্যাটার্জী অ্যাণ্ড কোম্পানি লিমিটেড, সেপ্টেম্বর, ১৯৩৮)।
“হিন্দু রাষ্ট্রের গড়ন” গ্রন্থের ভূমিকা তিনি লিখছেন সূদূর ইতালির বোৎসেন, ত্রেস্তিনো থেকে ১৪ই নভেম্বর ১৯২৪ সালে। তিনি বলছেন “রাষ্ট্র বিজ্ঞান কোনো একটা বিদ্যার নাম নয়, “জুরিস-প্রুডেন্স্” বা আইন-তত্ত্ব, ধন-বিজ্ঞান, নগর-বিজ্ঞান, রাজস্ব-বিদ্যা, লড়াই-বিদ্যা, “আবাপ” বা আন্তর্জাতিক লেনদেন-তত্ত্ব ইত্যাদি নানা বিদ্যার সমবায়ে রাষ্ট্র-বিজ্ঞান গঠিত হয়।……..গণতন্ত্রের রাষ্ট্রই হউক বা রাজ-তন্ত্রের রাষ্ট্রই হউক প্রত্যেকের শাসনে এইসকল প্রকার বিদ্যা কাজে লাগে।…….তাহার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক ওঠা বসারই নৃতত্ব [“অ্যান্থ্রপলজি”] এবং চিত্ত-বিজ্ঞান (“সাইকলজি”) ও আবশ্যক। ……. হিন্দু নরনারী সাত শ’ বৎসর ধরিয়া গণ-তন্ত্রের “রাজ” চালাইতেছে, আর ষোল সতের শ’ বৎসর ধরিয়া রাজতন্ত্রের “রাজ” চালাইতেছে। ……”
গ্রন্থটির চারটি অধ্যায়ের নাম “হিন্দু নরনারীর শাসন-দক্ষতা”, “হিন্দুরাষ্ট্রে স্বরাজ”, “সাম্রাজ্য-শাসনে হিন্দুসমাজ” ও “গণতন্ত্রে হিন্দুরাষ্ট্র”। অধ্যাপক সরকার এই গ্রন্থে একাধিকবার তুলনামূলক আলোচনা করেছেন প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইউরোপীয় রাষ্ট্রিক গড়নের সাথে। তিনি লিখছেন, “এই আবহাওয়ায় হিন্দু জাতি শক্তি-যোগী এবং টক্কর-প্রিয়। ভারতের নরনারী এইসকল কর্মক্ষেত্রে হিংসা-ধর্মী এবং বিজিগীষু। রাষ্ট্রীয় লেনদেন—কি “তন্ত্র”র কাজকর্ম, কি “আবাপে”র কাজকর্ম, সবই ভারতবাসীর হাতের জোরের আর মাথার জোরের প্রতিমূর্ত্তি। প্রত্যেক অস্ত্র চালনায়, প্রত্যেক খাজনা আদায়ে, প্রত্যেক “শ্রেণী”-স্বরাজে আর প্রত্যেক জমী-জরিপে লোকগুলার রক্তের স্রোত ছুটিতেছে আর মাথার ঘাম পায়ে পড়িতেছে। …… হিন্দু রক্ত-দরিয়ার তেজ মাপিতে চেষ্টা করাই বর্তমান গ্রন্থের উদ্দেশ্য। খৃষ্ট-পূর্ব চতুর্থ শতব্দী থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত হিন্দু জাতির রাষ্ট্র সাধনার জরীপ করা সম্ভব।” প্রসঙ্গত উল্লেখ্য তখনও পর্যন্ত দক্ষিণের বিজয়নগর রাজ্যের রাষ্ট্র দর্শন-ইতিহাস-রাজস্বনীতি-যুদ্ধবিদ্যার কলাকৌশল ও অস্ত্রসম্ভার, প্রশাসন-কারুশিল্প-স্থপতিবিদ্যা-বাণিজ্যিক লেনদেন সম্পর্কিত বিষয়গুলির ওপর বিস্তারিত গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়নি; তাই হিন্দু জাতির রাষ্ট্র গড়নের উপকরণের মাল-মশলা আর কিছু অবশ্যই এই পর্বে পাওয়া যেতে পারে।
স্বদেশী বিপ্লবের যুগে বাংলার মাটিতে বাঙ্গালীর যে জাগরণ তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন তাকে “রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ভাব-সাম্রাজ্যের” উত্তরণ হিসেবেই দেখেছেন। বাঙ্গালীর স্বরাজ ভাবনা-শিক্ষাস্বরাজ-কৃষ্টি-স্বরাজ শিল্প-স্বরাজ, রাজনৈতিক-স্বরাজকে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। বিবেকানন্দের তারুণ্যের তেজে উদ্ভাসিত বাঙ্গালী নবযৌবন লাভ করেছিল। বাঙ্গালীর বীর্যশক্তি নূতনভাবে আত্মপ্রকাশ করল। তিনি বলেন বাংলার “অনার্য” নরনারী আর্য ধর্ম ও সংস্কৃতিকে নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতির বশে এনেছিল। তথাকথিত “আর্য-ধর্ম ও সংস্কৃতি অনার্য বাঙ্গালীর প্রভাবে পড়িয়া অনার্যীকৃত হয়েছে। ইহাকেই বলিব অবাঙ্গালী সংস্কৃতির বাঙ্গালীকরণ। হিন্দুধর্ম বা বৌদ্ধধর্ম অনায়াসে বাঙ্গালীর মন জয় করিয়া লইতে পারে নাই। বাঙ্গালী ধর্মের নিকটও ইহাদের মাথা নোয়াইতে হইয়াছে। …..বাঙ্গালীর সৃষ্টিশক্তি ইসিলামকেও সহজে পথ ছাড়িয়া দেয় নাই। ইসলামকেও বাঙ্গালীদের নিকট পরাজয় স্বীকার করিতে হইয়াছে। …..প্রাচীনকালের মতো মধ্যযুগেও বঙ্গ-সংস্কৃতির ভিতর দো-আঁসলা কৃষ্টির আসর গুলজার ছিল। ……. অনেকবারই বলা হইয়াছে যে ‘অনার্য’, আদিম, বুনো, ‘পারিয়া’ (অর্থাৎ অনার্য বাঙালী বা কাক ও পায়রাজাতীয় নরনারীর সংস্কৃতি ও ধর্মের সঙ্গে বৈদিক ও বৌদ্ধধর্মের একটা বোঝাপড়া বা আপোষ, সমঝোতা বা সমন্বয় সাধিত হইয়াছিল), ‘কাক-পায়রা’, ‘পাহাড়ী’ ইত্যাদি নরনারীর ধর্ম ও সংস্কৃতি হইল খাঁটি বাঙ্গালীর খাঁটি স্বদেশী ধর্ম ও/বা সংস্কৃতি।”
সকল যুগেই, বাঙ্গালীর স্বরাজ ধর্ম-সংস্কৃতি-কৃষ্টির আত্তিকরণে খাঁটি বাঙ্গালীপনা বিদ্যমান। বিপুল মিশ্রতাকে ধারণ করেই বঙ্গ-সংস্কৃতির বুনিয়াদে –নেপাল, ভুটান, চীন, ব্রহ্মদেশ, আসাম একদিকে এবং উড়িষ্যা, ছোটনাগপুর, বিহার অন্যত্রও বাঙ্গালীর ‘হাড়মাস’ লৌকিক-লোকায়ত সংস্কৃতির বুনিয়াদ যেমন দৃঢ়তর, তেমনি বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়েও সে সুবিস্তৃত হয়েছে এবং আজও ক্রমবর্ধমান। (বিনয় কুমার সরকার ‘আর্য ও ‘অনার্য’ বলতে ভাষা বিষয়ক অর্থে ব্যবহার করতেন, শরীরের গড়ন বিষয়ক নয়।)
এইপর্বে আলোচনায় ইতি টানার আগে মনীষী বিনয় কুমার সরকারের লেখা কয়েকটি গ্রন্থের উল্লখে করা হল পাঠকদের অবহিত করার জন্য।
“হিন্দু সমাজের বাস্তব ভিত্তি” চার খণ্ড (“দ্য পজিটিভ ব্যাকগ্রাউণ্ড অব হিন্দু সোসিওলজি” ১৯১৪, ১৯২২, ১৯২৭ ও ১৯৩৭), “হিন্দুর চোখে চীনা ধর্ম” (“চাইনিজ রিলিজিয়ন থ্রু হিন্দু আইজ”, সাংহাই, ১৯১৬), “হিন্দু সংস্কৃতিতে জনসাধারণের দান” (“দ্য ফোক-এলিমেন্ট ইন হিন্দু কালচার”, লণ্ডন ১৯১৭), “হিন্দুজাতির রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র দর্শন” (“দ্য পোলিটিক্যাল ইনস্টিটিউশ্যনস্ অ্যাণ্ড থিয়োরিজ্ অব দি হিন্দুজ্”, লাইপৎসিগ, ১৯২২), “যুবক এশিয়ার ভবিষ্যনিষ্ঠা” (“দ্য ফিউচারিজম্ অব ইয়নগ এশিয়া”, লাইপৎসিগ, ১৯২২), “ইতালিয়ান ভাষায় হিন্দুজাতির রাষ্ট্রনীতি” (“হিন্দু পলিটিক্স ইন ইতালিয়ান”, কলিকাতা, ১৯২৬)। “১৯০৫-এর পরবর্তী রাষ্ট্র-দর্শন” (“দ্য পোলিটিক্যাল ফিলজফিজ্ সিন্স ১৯০৫”, প্রথম খণ্ড, মাদ্রাজ, ১৯২৮ ও শেষ তিন খণ্ড, লাহোর, ১৯৪২)। “ইনট্রোডাকশন টু হিন্দু পজিটিভিজম” (১৯৩৭), “ভিলেজেস অ্যাণ্ড টাউনস্ অ্যাজ্ সোস্যাল প্যাটার্ণস” (১৯৪১)।
* প্রবন্ধের সূত্রপাত যে ইংরেজি উদ্ধৃতিটি দিয়ে হয়েছে সেটি তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত সর্বশেষ গ্রন্থ ‘ডোমিনিয়ান ইণ্ডিয়া ইন ওয়ার্ল্ড-পারস্পেক্টিভস্’ (১৯৪৯) থেকে নেওয়া।
*** স্বদেশীযুগের ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিকদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের কাহিনী এবং বাঙ্গালীর গৌরবম বঙ্গ-বিপ্লবের কথা আজ বর্তমানের আইপিএলমুখী বাঙ্গালী জাতি সম্পূর্ণভাবে বিস্মৃত হয়েছে। ১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে একদল কুচক্রী এবং হিংসুটে মনোভাবাপন্ন তথাকথিত নিম্ন ও মধ্য মেধার কংগ্রেসী-মার্কসবাদী বৌদ্ধিকগোষ্ঠী সমগ্র বাঙ্গালীর সৃষ্টিশীলতাকে কলুষিত করেছে এবং তাদের কর্মকাণ্ড ও কর্মপ্রেচেষ্টাকে ভাববাদী ও সাম্প্রদায়িক বলে গালও পেড়েছে। সাম্প্রতিক কালে শতদ্রু সেন সূদূর নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে বসেও বিনয়বাবুর অনূদিত গ্রন্থ ‘শুক্রনীতিসার’কে a nineteenth century forgery বলতে দ্বিধা বোধ করেনি। (অথচ এই গ্রন্থের রচনাকাল আনুমানিক অষ্টম-নবম শতক)।
সহায়্ক গ্রন্থসূচী:
১। ১৯১৪ সনে ‘শুক্রনীতি’র ইংরেজি অনুবাদ বিস্তারিত টীকা-টিপ্পনীসহ এলাদবাদের পাণিনি কার্যালয়ের তরফে মেজর বামন দাস বসু কর্তৃক প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটি আজও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ভারতীয় সমাজতত্ত্বের এক অত্যন্ত মূল্যবান প্রামাণিক আকর গ্রন্থ ।
২। (বিনয় সরকারের বৈঠকে, বিংশ শতাব্দীর বঙ্গ-সংস্কৃতি, প্রকাশকাল শ্রী হরিদাস মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত, ১৯৪২, ২৮শে ডিসেম্বর)
৩। হরিদাস মুখার্জী, ‘বিনয় কুমার সরকার এ স্টাডি’,(ইংরাজি) ১৯৫৩, দাশ গুপ্ত অ্যান্ড কোঃ, কলকাতা, গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন রাধা কুমুদ মুখার্জী, স্বদেশী যুগের শিক্ষা আন্দোলনে বিনয় কুমার সরকার ভূমিকা সম্পর্কে তার অনুজ সহযোদ্ধা বন্ধু (কমরেড) সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কতগুলি কথা বলেছেন।
৪। সুমিত সরকার, ‘দ্য স্বদেশী মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল ১৯০৩-১৯০৮’; প্রথম প্রকাশ, নভেম্বর ১৯৭৩, পিউপিলস্ পাবলিসিং হাউজ, পৃষ্ঠা ১৪৯-১৮১, ন্যাশনাল এডুকেশন, চতুর্থ অধ্যায়) টীকা-টীপ্পনী দ্রষ্ট্যব্য।
৫। হরিদাস মুখার্জী, “ইতিহাস-চর্চায় বিনয় সরকার”, (বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষৎ, জুলাই, ১৯৫৭)।
৬। হরিদাস মুখার্জী, “বিনয় সরকার অ্যাণ্ড রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ মুভমেন্ট”; গোলপার্ক-কলকাতা, সেপ্টেম্বর, ১৯৮৮।
৭। শতদ্রু সেন, “বিনয় কুমার সরকার –রেস্টোরিং দ্য নেশন্ টু দ্য ওয়ার্ল্ড, রাউটলেজ্ টেলর অ্যাণ্ড ফ্রান্সিস গ্রুপ, ২০১৫।
৮। ভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, “দ্য পলিটিক্যাল আইডিয়াজ অব বিনয় কুমার সরকার”; কে.পি. বাগচি অ্যাণ্ড কোম্পানি, কলকাতা, ১৯৮৪।
৯। স্বপন কুমার ভট্টাচার্য্য, “ইন্ডিয়ান সোসিওলজি – দ্য রোল অব বিনয় কুমার সরকার” বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, বর্ধমান, ১৯৯০।
১০। গুইসেপ্পে ফ্লোরা, “বিনয় কুমার সরকার অ্যাণ্ড ইতালি – ক্যালচার, পলিটিক্স অ্যাণ্ড ইকিনমিক ইডিওলজি”, ইন্দিরা পালিত সরকারের ভূমিকাসহ; ইতালিয়ান এমব্যাসি ক্যালচারাল সেন্টার, নিউ দিল্লী, ১৯৯৪
টীকা-টীপ্পনী:
(সুমিত সরকার মহাশয়ের তথাকথিত ভ্রান্ত আর্দশধর্মী বিশ্বাসে লেখা বিভ্রান্তিকর একপেশে এবং আংশিক তথ্য পরিবেশনের ওপর ভিত্তি করে লেখা ‘স্বদেশী আন্দোলন’ গ্রন্থে এই বইটির উল্লেখ পর্যন্ত নেই। সম্প্রতি (২০১৬) সেই বিকৃত এবং আংশিক তথ্য দ্বারা সমাদৃত গ্রন্থটির ব্ল্যাকওয়েল পুনঃপ্রকাশ করেছে এবং তাতে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বহুল পরিচিত ও সমাদৃত বাঙ্গালী সাবর্লটান ঐতিহাসিক দীপেশ চক্রবর্তী মহাশয় ও মূলত উপনিবেশিক যুগের কৃষিব্যবস্থা নিয়ে গবেষণাকারী নিলাদ্রী ভট্টাচার্যের প্রশস্তিমূলক কিছু সংযোজন করা হয়েছে। অথচ উভয়ে কেউই স্বদেশী যুগের ইতিহাস নিয়ে কোন গবেষণাধর্মী লেখা লেখেন নি।)
সর্বোপরি স্বদেশী যুগের শিক্ষা বিষয়ক Pedagogy –এর ওপর বিনয় কুমার সরকারের লেখা গ্রন্থগুলির উল্লেখ পর্যন্ত নেই। সুমিত সরকারের ‘স্বদেশী আন্দোলন’ গ্রন্থে নেই, অথচ তিনি ন্যাশানাল এডুকেশন নিয়ে চতুর্থ অধ্যায়ের ছত্রে ছত্রে সতীশ চন্দ্র মুখার্জী তির্যকপূর্ণ সমালোচনা করেছেন!! সতীশচন্দ্রের কালেকটেড ওয়ার্কস পরবর্তীকালে ছাপা হলেও তিনি সেগুলো খুঁটিয়ে দেখার প্রয়োজনবোধ করেননি। এমনকি পরবর্তী কালের সংস্করণে তার সংযোজনও করেন নি।
ন্যাশানাল এডুকেশন নিয়ে চতুর্থ অধ্যায়টিকে কেন্দ্র করে তিনি স্বদেশীযুগের বঙ্গ-বিপ্লব ও শিক্ষা স্বরাজ আন্দোলন সম্পর্ককে সমগ্র বাঙ্গালী জাতি এবং ভারতবর্ষ ও বিশ্ববাসীর কাছে সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন করেছেন। এমনকি এই অধ্যায়ে বিনয় কুমার সরকারের শিক্ষা বিষয়ক লিখিত প্রবন্ধ এবং গ্রন্থগুলির উল্লেখ পর্যন্ত নেই; অথচ ন্যাশানাল এডুকেশন সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর সমালোচনা আছে। এই পাঠ উনি শিখেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের বিতর্কিত অধ্যাপক নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহের কাছ থেকে। যিনি হিংসা, বিদ্বেষ, মানসিক বিকৃতির পরিচয় দিয়ে Hundred Years of the University of Calcutta (Vol. I January, Chapter VII and VIII, 1957) তে বিনয় কুমার সরকারের গবেষণামূলক গ্রন্থগুলির উল্লেখই করেননি। এইভাবে বিনয় সরকারের গবেষণা ও কাজকর্মকে বাঙ্গালীর জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান থেকেই উধাও করে দেওয়া শুরু হয়।
সতীশ্চন্দ্র মুখার্জী ও অরবিন্দের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে এবং অরবিন্দ ঘোষের ন্যাশনাল কলেজ থেকে পদত্যাগের প্রসঙ্গেও অধ্যাপক সুমিত সরকার তাঁর গাঁজাখুরি মনগড়া কথা বলেছেন। যার প্রমাণ, ১৯০৮ সালের ১৩ই জানুয়ারি পুণায় প্রদত্ত ভাষণে শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনে প্রাণপুরুষ সতীশ চন্দ্র মুখার্জীর কথা গর্বের সাথে উল্লেখ করেন। উভয়ের মধ্যে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের সাথে স্বদেশী আন্দোলনের সময় ন্যাশনালিস্ট পার্টি ও বিপ্লবী আন্দোলনের সম্পৃক্তকরণ নিয়ে মতভেদ হয়। সরাসরি শিক্ষাকেন্দ্রের নাম তার সাথে জড়ালে স্কুল ও কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হবে – এই আশঙ্কা যা সতীশচন্দ্র মুখার্জীর ছিল তা অমূলক নয়।)
প্রত্নতত্ত্ববিদ, গবেষক ও সমাজকর্মী। । এবং বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের সক্রিয় কর্মী।
Comment here