অতীত যা লেখেনিরাজনীতিশক্তিচর্চাস্বভূমি ও সমকাল

|| মহারাজা বিক্রমজিৎ ঘোষ – বাঙ্গালার হিন্দু যোদ্ধা যিনি দিল্লির সুলতানদের সতেরো বার পরাজিত করেন ||

– শ্রী স্নেহাংশু মজুমদার

 

উজানীনগরেশ্বর মঙ্গলকোটাধিপতি বিক্রমকেশরী মহারাজাধিরাজ বিক্রমজিৎ ঘোষ (১৩০৩-১৩২৭খ্রি:) ছিলেন চতুর্দশ শতকের মধ্যভাগে বাঙ্গালার গোপভূম জনপদের মঙ্গলকোট রাজ্যের এক পরাক্রমী সনাতনী শাসক । ইনি আলাউদ্দিন খিলজি থেকে মহম্মদ বিন তুঘলক পর্যন্ত একাধিক দিল্লির সুলতানদের দ্বারা প্রেরিত গাজী আক্রমনকারীদের ক্রমাগত ১৭ বার শোচনীয়ভাবে পরাস্ত করে হিন্দু স্বাতন্ত্র্যের গৌরবের জয়ধ্বজ স্বমহিমায় অক্ষুণ্ন রাখেন । রাজা বিক্রমজিতের শাসনে মঙ্গলকোট রাজ্যের সীমানা উত্তর পশ্চিমে জামতাড়া (অধুনা ঝাড়খণ্ড) থেকে পশ্চিমে কর্ণসুবর্ণ ও দক্ষিণে দামোদর নদের উত্তর সীমান্ত পর্যন্ত সুবিস্তৃত আকার ধারণ করে ।

ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বজ্রভূমির পুণ্যমৃত্তিকায় যদুবংশীয় ক্ষত্রিয় সদগোপকুলে উজাণীনগরের রাজা শ্বেতাদিত্যের বংশে জন্মগ্রহণ করেন যুবরাজ বিক্রমজিৎ । মঙ্গলকোটের সদগোপ রাজবংশ ধর্মীয়ভাবে ছিল সদাশিব মহাদেবের পরমশৈব উপাসক, যদিও একজন যদুবংশীয় শাসক হিসেবে মহারাজা বিক্রমজিৎ ধার্মিক গৌড়ীয় বৈষ্ণব ছিলেন, তাঁর রাজসভায় বিখ্যাত বাঙ্গালী কবি জয়দেব কর্তৃক গৌড়েশ্বর লক্ষ্মণসেনের রাজসভায় রচিত “গীতগোবিন্দ” কাব্যের নিত্যচর্চা হতো ।

মঙ্গলকোট রাজ্যের কুলদেবী ছিলেন মা অভয়া চণ্ডী, যাকে স্মরণ করে বীর সদগোপ সৈন্যগণ যুদ্ধযাত্রা করতো। মঙ্গলকোট ছিল এক প্রাচীন সমৃদ্ধ নগর এবং বাঙ্গালার প্রাচীন বাণিজ্য কেন্দ্র । বাংলার কেন্দ্রীয় পাল, সেন ও দেব সম্রাটদের শাসনে মঙ্গলকোট থেকে দক্ষিণে লঙ্কা এবং পূর্বে ব্রহ্মদেশ, শ্যামদেশ, চম্পাদেশ থেকে বালি দ্বীপ পর্যন্ত বাণিজ্য হতো। মঙ্গলকোটের সদগোপ যোদ্ধাদের হাতে রাজ্যের নয়প্রকার সামরিক শক্তির পূর্ণ ক্ষমতা ছিল।

সমগ্র উত্তরাপথে দিল্লি সালতানাতের প্রবল ক্ষমতার সময়েও পূর্ব ভারতে গৌড়বঙ্গ একটি স্বাধীন হিন্দুরাজ্য হিসেবে সালতানাতের প্রসারে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল । ইতিপূর্বেই গৌড়েশ্বর বঙ্গাধিপতি মধুসূদন সেন মগধ জয় করে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুদ্ধগয়ার গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন । সেনবংশের পর বাঙ্গালার শাসনে আসে বঙ্গজ দেব রাজবংশ, যে বংশের পরাক্রমী নৃপতি বঙ্গাধিপতি দশরথদেবের (দনুজ রায়) সম্মুখে অভিবাদন জানাতে বাধ্য হন স্বয়ং দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন ।

১২৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ শে জুলাই মামলুক বংশের অবসান ঘটিয়ে খিলজি বংশ ‘তখত এ দিল্লিহ’ (تاج و تخت دهلی است) দখল করার সাথে হিন্দুস্তানের রাজনীতিতে এক অভ্যুত্থান ঘটে । মাত্র ৪ বছরের মধ্যেই ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে এই বংশে সুলতান হিসেবে অধিষ্ঠিত হয় কুখ্যাত আলাউদ্দিন খিলজি । ১২৯৯ এ আলাউদ্দিন গুজরাট আক্রমন করে এবং ১৩০১ এ রণথোম্বর দখল করে নেয় । ১৩০৩ এ খিলজি বাহিনী দ্বারা চিতোর আক্রমন ও বিজয় সম্পন্ন হয় ।

সমগ্র পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর সময়েই আলাউদ্দিনের নজরে আসে গৌড়বঙ্গের হিন্দুরাজ্যসকল । দিল্লির অধীন বিহারের নবাবসকল এসময় অন্তর্কলহে দুর্বল হয়ে পরে ফলে গৌড়ীয় তরবারির উন্নত ধার দিল্লির পতাকা ছিন্ন করতে থাকে । এমন মুহূর্তে পূর্ব ভারতে পুনরায় দিল্লির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি গৌড়বঙ্গ আক্রমনের সিদ্ধান্ত নেন ।

●⚔️ সদগোপ-খিলজি সংঘর্ষ (১৩০৩-১৩২০ খ্রি:) –

১৩০৩ সালে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি প্রেরিত দেহলি সালতানাতি সেনাবাহিনী এবং সালতানাত সমর্থিত উজবেক গাজী আক্রমণকারীরা সিপাহসালার খান মহম্মদ ও হাজী ফিরোজের নেতৃত্বে বাঙ্গালা আক্রমন করে । দিল্লি থেকে বাঙ্গালা আক্রমনের পথে সর্বপ্রথম যে হিন্দু রাজ্যের অবস্থান ছিল তা গোপভূম মঙ্গলকোট । মঙ্গলকোট রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তের পাহাড়ি জঙ্গলে দিল্লির সুলতানি বাহিনী তাদের আস্তানা তৈরি করে প্রথম আক্রমনের আয়োজন শুরু করে ।

মঙ্গলকোট রাজসিংহাসনে এসময় সগৌরবে অধিষ্ঠান করছেন নবাভিষিক্ত নৃপতি মহারাজ শ্বেতপুত্র বিক্রমজিৎ । উজবেকিদের আক্রমনের সংবাদ শ্রবণপূর্বক তিনি উজানীনগরের সীমান্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা করেন । যুদ্ধের পূর্বেই ফৌজদার খান মহম্মদ রাজা বিক্রমজিৎকে একটি হুমকিমূলক চরমপত্র প্রেরণ করে আত্মসমর্পণ করতে বলেন, তার সাথে সুলতান আলাউদ্দিনের নৃশংসতার বর্ণনাসহ পশ্চিম ভারতে খিলজি বাহিনীর অত্যাচারের বর্ণনা করেন ।

খান মহম্মদের অপমানজনক পত্র শ্রবণমাত্র রাজা বিক্রমজিৎ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন ও প্রত্যুত্তরে যুদ্ধের বার্তা দেন। ৭১০ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে, সদগোপ বাহিনী রাজধানী থেকে শুরু করে এবং দুটি বিভাগে সজ্জিত হয়ে অজয় নদের তীরে ব্যূহ গঠন করে । উত্তর পশ্চিম দিক থেকে উজবেক বাহিনী আঘাত শুরু করলে শীঘ্রই দুই পক্ষের মধ্যে বিধ্বংসী যুদ্ধ শুরু হয়

মঙ্গলকোট রাজ্যের সদগোপ অশ্বারোহী বাহিনী সেসময় সমগ্র ভারতবর্ষের সুশৃঙ্খল ও ক্ষিপ্রতম অশ্বারোহী বাহিনীর অন্যতম ছিল । ক্রমাগত পূর্ণ এক শতক ধরে পরিচালিত একাধিক তুর্কি অশ্বারোহী আক্রমনের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য রাঢ়ভূমের রাজন্যবর্গ বহুকাল থেকেই অশ্বারোহী বাহিনীর সংস্কার করেন । সিপাহসালার খান মহম্মদ ও হাজী ফিরোজ তথা খিলজি গাজী বাহিনী এমন মারাত্মক দ্বিমুখী অশ্বারোহী আক্রমনের জন্য প্রস্তুত ছিল না, যার ফলস্বরূপ সদগোপরা খিলজিদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক বিজয় অর্জন করেছিল।

অজয় নদের দক্ষিণ তীরে মঙ্গলকোট সদগোপ সেনাবাহিনী যুদ্ধে বিজয় লাভ করে । সিপাহসালার খান মহম্মদ ও হাজী ফিরোজ নিহত হয় ও তাদের কবরপ্রাপ্তি ঘটে । এর পরেও সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি ১৩১৬ সাল পর্যন্ত মোট ১৩ বছর ধরে গোলাম পাঠান, শাহ সিরাজউদ্দিন, মহম্মদ ইসমাইল গাজী ইত্যাদি একাধিক আওলিয়া গাজী সিপাহসালার প্রেরণ করেন, কিন্তু মহারাজ বিক্রমজিৎ ঘোষের নেতৃত্বে মঙ্গলকোট রাজ্যের বীর সদগোপ যোদ্ধাদের তরবারির আঘাতে প্রত্যেক গাজী প্রাণ হারিয়ে কবরে পতিত হয় ।

●⚔️ সদগোপ – তুঘলক সংঘর্ষ (১৩২০-১৩২৭ খ্রি:) –

১৩২৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক মঙ্গলকোট আক্রমনের উদ্দেশ্যে সিপাহসালার সৈয়দ শাহ তাজউদ্দীন, খাজুদ্দীন চিশতী ও শেখ আব্দুল্লাহ গুজরাটি দের সাথে ধারাবাহিকভাবে উজবেকি সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন । দিল্লী সালতানাতি গাজী বাহিনীর আক্রমণ সম্পর্কে সচেতন মহারাজা বিক্রমজিৎ তাঁর সদগোপ যাদব বাহিনীকে সংহত করতে শুরু করেন। মহারাজা বিক্রমজিতের নেতৃত্বে সাহসী সদগোপ বাহিনী গোপভূমের কুলদেবী মা অভয়া চণ্ডীর উদ্দেশ্যে প্রণাম করে বীরদর্পে সীমান্তে যুদ্ধযাত্রা শুরু করে । আগ্রাসী মঙ্গলকোট অশ্বারোহী বাহিনী শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়ে উজবেক গাজীদের ওপর আছড়ে পরে। এবার মঙ্গলকোট পশ্চিম সীমান্তের পাহাড়ি অঞ্চলের আটবিক জনগোষ্ঠী সকলও এই ধর্মসংগ্রামে অংশগ্রহণ করে যুদ্ধে অতুল বীরত্ব প্রদর্শন করে । সন্ধ্যার সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথেই সদগোপ বাহিনী পুরো উজবেকি সেনাদের মৃতদেহের পাহাড় দাঁড় করিয়ে দেয়, যা মহারাজার আদেশে অজয় ​​নদের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

এভাবেই সাল ১৩০৩ থেকে ১৩২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন, শিহাবুদ্দিন, কুতুবউদ্দিন, গিয়াসউদ্দিন ও মহম্মদ বিন তুঘলক একের পর এক মোট ১৭ বার গৌড়বঙ্গ আক্রমণ করেছিলেন, কিন্তু মহারাজা বিক্রমজিৎ ও মঙ্গলকোট রাজ্যের সদগোপ যোদ্ধাগণ সফলভাবে সেই ১৭ আক্রমন প্রতিরোধ করে গৌড়বঙ্গ ও হিন্দু স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেন । তাঁর ধর্মনিষ্ঠা ও পরাক্রমের কারণেই, বজ্রভূমির কুলীন রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণগণ তাঁকে “বিক্রম-কেশরী” অভিধায় ভূষিত করেন।

রাজা বিক্রমজিৎ ঘোষের রাজধানী ছিল উজানীনগর। এই সেই স্থান যেখান থেকে বেশিরভাগ মধ্যযুগীয় শিলালিপি সংগ্রহ করা হয়েছিল । প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিক শ্রী রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় মঙ্গলকোটের যুদ্ধসকলে রাজা বিক্রমজিতের কাছে পরাজিত ১৭জন গাজী আওলিয়াসকলের মধ্যে ১২ জনের নাম উদ্ধার করেছেন । তারা হলেন –

১. খান মুহাম্মদ শাহ
২. হাজী ফিরোজ আলী
৩. গোলাম পাঠান
৪. মোহাম্মদ ইসমাইল গাজী
৫. শেখ আবদুল্লাহ গুজরাটি
৬. মাখদুম শাহ মহম্মদ
৭. সৈয়দ শাহ তাজউদ্দীন
৮. খাজুদ্দীন চিশতী
৯. শাহ হাজী আলী
১০. শাহ সিরাজউদ্দিন
১১. পীর গোরা
১২. গজনভি

কবিকঙ্কন শ্রী মুকুন্দরাম চক্রবর্ত্তীর ‘চণ্ডীমঙ্গল’কাব্যেও মহারাজ বিক্রমজিৎ-এর উল্লেখ রয়েছে, মহারাজের পৃষ্ঠপোষণায় মধ্যযুগের বাঙ্গালার বিখ্যাত ব্যবসায়ী বণিক ধনপতি শ্রেষ্ঠী সিংহল যাত্রা করে প্রচুর ধনরত্ন ও অর্থ উপার্জন করেছিলেন । ‘শেখ শুভোদয়া’ নামক মধ্যযুগীয় পুঁথিতেও রাজা বিক্রমকেশরীর উল্লেখ রয়েছে । মধ্যযুগে খিলজি ও তুঘলক আক্রমন ১৭ বার প্রতিহত করে বাঙ্গালার হিন্দু স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ন রাখার জন্য মহারাজ বিক্রমজিৎ হিন্দুজাতির কাছে চিরপ্রণম্য হয়ে রয়েছেন ।

● তথ্যসূত্র:

১) সদগোপ কুলীন সংহিতা-মোক্ষদাপ্রসাদ রায় চৌধুরী

২) পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, প্রথম খণ্ড – বিনয়কুমার ঘোষ

৩) উজানী মঙ্গলকোটের ইতিবৃত্ত – স্বপনকুমার ঠাকুর (প্রকাশিতব্য)

৪) Burdwan District Gazetteers, J C K Peterson

৫) আঠারো শতকের বাঙলা ও বাঙালি – অতুল সূর

৬) বৃহৎ বঙ্গ, দীনেশ চন্দ্ৰ সেন

৭) বীরভূমের ইতিহাস- গৌরীহর মিত্র

 

(লেখক পরিচিতি – শ্রী স্নেহাংশু মজুমদার উদ্ভিদবিজ্ঞানের স্নাতক স্তরে, দ্বিতীয় বর্ষ। বঙ্গীয় সনাতনী ইতিহাস সন্ধানী ও প্রচারক।)

অঙ্কনে – শ্রী বুদ্ধদেব বাগ

Comment here