রাজনীতিস্বভূমি ও সমকাল

লোহিয়া আয়লো রে!

ভারতবর্ষ তখন সবে প্রজাতন্ত্রী। প্রতিবেশী নেপাল, দুই পাকিস্তান জ্বলছে । দেশের ভেতর দেশীয় রাজাদের হুঙ্কার তখনও থামেনি । কখনও নরম, কখনও গানপয়েন্টে রেখে তাদের ভারতের মানচিত্রে সংযুক্ত রেখে লৌহমানব সর্দার প্যাটেল ভারতবর্ষের সীমানা যতটা সম্ভব ঠিক রাখার চেষ্টা করছেন । নেহেরুজি প্রধানমন্ত্রী হলেন ঠিকই তবে বর্ডার-উদ্বাস্তু সমস্যা, খাদ্যআন্দোলন – এ সমস্ত কিছু নিয়ে জর্জরিত । কুর্সিটা না যায় এই তার চিন্তা । দেশের প্রথম নির্বাচন শেষ । ইন্দুবেটির মার্কিন মূলুক, ইউরোপ ভ্রমণ স্পনসর করছে সোভিয়েত । এই তাদের গোপন ইনেভস্টমেন্ট|

জয়প্রকাশ নারায়ণ এবং ড: রাম মনোহর লোহিয়া কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে সোস্যালিস্ট পাটি অফ ইন্ডিয়া তৈরি করেছেন যারা দেশের মধ্যে বৃহত্তম কংগ্রেস বিরোধী শক্তি । প্রাক্তন বিপ্লবীরা একজোট হচ্ছেন এই ছাতার তলায় । আজাদ হিন্দের সৈনিকেরা এসে যোগ দিচ্ছেন । রয়েছে সুভাষচন্দ্রের ফরওয়ার্ড ব্লকও | তবে তা বহু বিভক্ত | রুইকার দল জোট করেছে সমাজতন্ত্রীদের সাথে |…..

ফুরিয়ে আসা জ্বলন্ত চারমিনারটা বাম হাতে ধরে ডান হাতেরটা ঠোঁটে রেখে জ্বালিয়ে নিতে চেষ্টা করছিলেন বৃদ্ধ ক্রান্তিকারী ৷ বার বার নিভে যাচ্ছে । মানুষপ্রমাণ খোলা জানলা দিয়ে শহুরে বাতাস আছড়ে পড়ছে “ইণ্ডিয়ান কফি হাউস”-এ | চলছে সমাজতন্ত্রের পাঠ । এই বয়স্ক মানুষটার মধ্যে কাশী দেখতে পায় এক নতুন ভারতবর্ষকে । চাষীর ভারত, শ্রমিকের ভারত । স্বামীজি দেশ স্বাধীনে এমন মানুষই চেয়েছিলেন ।

কাশীর ভালো লাগে গল্প শুনতে । বিশ্বযুদ্ধের সময় লোহিয়াজির নানান প্রয়াস ৷ আজাদহিন্দের সাথে তাঁদের যোগাযোগ । দেশে সুভাষচন্দ্রের বার্তা প্রচার । ইউসুফ মেহেরালির লেখা পোস্টার | কিভাবে তারা রাত জেগে ব্রিটিশবিরোধী পোস্টার সাঁটাতো বিভিন্ন শহরে । আগস্ট বিপ্লবের কথা । দেশবন্ধুর অধীনে বাংলা যেমন ছিল, লোহিয়াজির বোম্বে কংগ্রেস ছিল তেমনই সহিংস কংগ্রেস ৷ আই.বি.-এর নজর এড়িয়ে পাহাড়ে জঙ্গলে থেকে রেডিও ট্রান্সমিশান।

“বড়লাট তুমি ধূর্ত! ধর্মের ছলে টানছো রাশ । জনজাগরণ, চরকায় সর্বনাশ !…..এই চরকা কিন্ত সমাজতন্ত্রী প্রতীক কাশী, বাপুজির নয় ।”ইনফিউসানে চুমুক দিতে দিতে বেলা গড়িয়ে যায় । গল্পে গল্পে ডিটেনশানের কথা; পুনা, লাহোর জেল । বরফগলা জল পড়ছে অবিরাম কপালের মাঝখানে । নিম্নাঙ্গ রক্তে ভেসে যায় । ছোট্ট ঘুলঘুলি দিয়ে নতুন ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখে লোহিয়া। যে স্বপ্ন দেখছে তার নেতা পূর্ব এশিয়ার বারুদের গন্ধে | …..সহযোদ্ধাদের লাশ কাঁধে এগিয়ে চলা | কে বলে এই দেশ বিনা রক্তপাতে স্বাধীন হয়েছে? স্বাধীনতার মূল্য জানেন জয়প্রকাশ নারায়ণ, ইউসুফ মেহেরালি, ড: লোহিয়ার মত সোস্যালিস্টরা ।

“ডক্টরজি, ফির ক্যায়া হুয়া?”ছাত্র ফেডারেশানের দাপুটে নেতা কাশীকান্ত মৈত্র মন্ত্রমুগ্ধ৷ সে আরও শুনতে চায় ।

“তুম তো সুভাষবাবু কো আপনা গুরু মানতে হো কাশী। ম্যায়ভি! মেরে ফৈজাবাদকে ঘর মে আজ ভি উনহিকা  ফোটো দিওয়ার পে হ্যায় । উনহি কা দিআ হুয়া !…..আজাদ হিন্দ রেডিওর প্রচার সংলাপ আমরা আগে থেকেই পেয়ে যেতাম । ইউসুফ আলির সাথে মিলে আমি বসে সেই বক্তব্যগুলির কংগ্রেসীকরণ করতাম | এমনভাবে সেই কথাগুলোকেই প্রচার করতাম যাতে কংগ্রেসীদেরও মনে লাগে । মনে ধরে সর্বসাধারণেরও ।

বোম্বে শহরটার মধ্যে ঘন ঘন বাড়ি বদলে বদলে চলত আমাদের রেডিও সেন্টার ৷ তখন “আগস্ট বিপ্লব”দেশজুড়ে এক অন্য মাত্রা পেয়েছে । গান্ধীজিও আর বাধা দেননি । জায়গায় জায়গায় মানুষ সহিংস হয়ে উঠছে । দেশের ১৩ শতাংশ স্বাধীন করে ফেলেছে উত্তেজিত জনতা । ভাবতে পারো? আমি লর্ড লিনলিখগোকে এক খোলা চিঠি লিখে সে কথা জানিয়েছিলাম । এই গুনেগার পলিটিশিয়ানরা, এদের কি ভূমিকা ছিল আগস্ট কে ক্রান্তি মে?

ভুলো মৎ কাশী, মহাসংগ্রাম আভি ভি জারি হ্যায় । আমাদের লড়াই আজ তিনটি সি-এর বিরুদ্ধে । দেখতে হবে দুঃখবরণ সংগ্রাম গড়ার ক্ষমতা যেন থাকে । প্রথম সি কংগ্রেস, দ্বিতীয় সি ক্যাপিটালিজম, তৃতীয় সি কম্যুনালিজম | মেরা ন্যাঁরা হ্যায়, তিন সি হটাও!”

দেশাত্মবোধ কতটা প্রবল হলে কেউ এমন রাজনীতির সাজানো বাগান ছেড়ে বিরোধী হতে পারে । লোহিয়াজি হাত  মেলালে দৌলত, শহরৎ কি না পেতে পারতেন । কিন্তু জাতীয়তাবোথের বশে একসময়ের গান্ধীবাদি এই নেতা আজ ভয়ানক কংগ্রেসবিরোধী । কাশীকান্ত মনে মনে ভাবে এমন খাঁটি দেশপ্রেমী কজন আর রাজনীতিতে আছে এ দেশে ।

এছাড়া চাপা  স্বরে বলেন লোহিয়াজি, নেপালের তানাশাহীর বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা | নেপালের তানাশাহীর বিরুদ্ধে  লোহিয়াজিদের বন্দুক ধরার লোমহর্ষক কাহিনী ! সাহিত্যিক ফণিশ্বরনাথ রেণু সেই সময় নিয়ে একটা উপন্যাস লিখছে। এই বই হয়ত দিনের আলো দেখবে না কোনদিন । ডক্টর লোহিয়া সেই পাণুলিপির কিছু কিছু অংশ নকল করে রাখেন নিজের ঝোলায় । কাশীকে পড়তে দেন । বিরাটনগর ইস্টার্ন কমাণ্ড হেডকোয়ার্টারে হামলা…

“কাশী তুম হামারে পাটি মে আ যাও! দেশ অব নয়ি পটরি পে চলেগা !”

কলেজে রাজনীতি সে করে ঠিকই কিন্তু জীবনভর রাজনীতি? না এতটা সে ভাবে না। মা বাড়িতে তাড়া দিচ্ছে একটা চাকরী জোগাড় করতেই হবে । দেশ নিয়ে সে ভাবে । কিন্ত এমন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে কাশী । এতটা সাহসী হওয়া অপরাধ । “ঘবড়াও মৎ কাশী! মাজি সে ম্যায় বাত করুক্গা!”লোহিয়াজির খর্বকায় শরীর । দৃঢ়তার হাত রাখলেন তার কাঁধে । তারপরই কাশির দমক আসায় পকেট থেকে রুমালটা বের করলেন ।লোহিয়াজির নাক দিয়ে আজও রক্ত পড়ে । ব্রিটিশ পুলিশ ছাপ রেখে গেছে ষোলো আনা ।

শ্রদ্ধেয় শ্রী কাশীকান্ত মৈত্র রাজনীতিতে পা রাখলেন । বিপ্লবী লীলা রায়ের সাথে পরিচয়, “জয়শ্রী”পত্রিকার সাথে যুক্ত হওয়া এবং সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে চলা ।…….

বছর গড়িয়ে গেছে । লোহিয়াজি চলে গেছেন | এই সেদিন গেলেন প্রাক্তন মন্ত্রী এডভোকেট শ্রী কাশীকান্ত sমৈত্র | তাঁর মহাপ্রয়াণে গভীর শোকের ছায়া নেমে এল। আমৃত্যু “জয়শ্রী” পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন ৷ ঐতিহাসিক “জয়শ্রী” পত্রিকা চিরকালই ছিল সমাজতন্ত্রের ধারক ও বাহক ।

 

Comment here