– শ্রী সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়
লড়াইটা অনেক দিনের। সাফল্যও এসেছে। আদিবাসীরা তাঁদের নিজস্ব পতাকা ব্যবহার করার অনুমতি পেয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার সরকারের থেকে। কমনওয়েলথ গেমসে সেই পতাকা উড়েছে। আর নিউজিল্যান্ডের একাধিক মুদ্রায় তাঁরা রয়েছেন। তাঁদের ভাষা এখন নিউজিল্যান্ডের স্বীকৃত ভাষা। বিশ্বের বহু দেশে মাওরি উপজাতির মানুষ ছড়িয়ে থাকলেও আজকের পর্বে তাঁদের না-হারানো সভ্যতা-সংস্কৃতি ও এক নেতার কথা। মুদ্রার মুকুরে।
এই ধারাবাহিকে শুরু থেকেই মুদ্রা আলোচ্য নয়, আলোচ্য হল মুদ্রায় উঠে আসা হারানো সভ্যতা ও সংস্কৃতি। বিভিন্ন সময় আলোচিত উগারিট, ওলমেক, তিকাল, জেনু, হরিকেল প্রভৃতি সবই হারানো দিনের কথা। সেই দিক থেকে বিচার করলে আজকের পর্ব একটু ব্যতিক্রমী।
পলিনেশিয়া বলতে যে ভৌগোলিক সীমা বোঝায়, প্রশান্ত মহাসাগরে সেই ত্রিভুজাকৃতি অংশের একেবারে উত্তরে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ, দক্ষিণে নিউজিল্যান্ড ও পূর্বে ফিজি। মোটামুটি মাঝখানে রয়েছে তাহিতি দ্বীপ। নিউজিল্যান্ড ও কুক দ্বীপের মুদ্রা সামনে রেখে আজকের পর্বে মাওরিদের কথা। বলে রাখা ভাল, তাহিতির নিজস্ব মুদ্রা ছিল।
প্রথমে টঙারোয়ার কথা। কুক দ্বীপের একাধিক মুদ্রায় তাঁর মূর্তির ছবি দেখা যায়। মাওরিদের আকাশ ও মহাসাগরের দেবতা। তিনি বলেছেন, “তিয়াকি মাই আই আহাউ, মাকু আনো কোএ ই তিয়াকি” যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, “আমাকে রক্ষা করলে আমিও রক্ষা করব।” কথাটা ঠিকই। ক্রিটিক্যাল ইকোসিস্টেম পার্টনারশিপ ফান্ডের রিপোর্ট অনুযায়ী, পলিনেশিয়া-মাইক্রোনেশিয়া অঞ্চলে ভাস্কুলার গাছপালার ৫,৩৩০টি প্রজাতির ৫৮ শতাংশের বেশি দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে এমন গাছও রয়েছে বিশ্বে যার সংখ্যা ১। ২৯০টি প্রজাতির পাখির মধ্যে ১৬০টি লুপ্তপ্রায় এবং ইউরোপীয়দের শিকারের নেশায় বিলুপ্ত হয়েছে ২৫টি প্রজাতির পাখি। স্তন্যপায়ীদের মধ্যে শুধু বাদুড়ের কথা ধরলেই বিষয়টা বোঝা যাবে। ১৫টি প্রজাতির মধ্যে ১১টিরই অস্তিত্ব এখন সঙ্কটে। এছাড়াও দুটি প্রজাতি পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আর হাওয়াইয়ান মঙ্ক সিলের মোট সংখ্যা এখন ১৬। সাপের সাতটি প্রজাতি, নোনাজলে বসবাসকারী কুমীর, গিরগিটির ৫০টি প্রজাতির অস্তিত্ব সঙ্কটে। আরও ৩০টি প্রজাতির সরীসৃপেরও দশাও একই। উভচরদের অবস্থাও তথৈবচ। আর মানুষের পাতে পাতে পড়ে নাভিশ্বাস উঠছে মাছদের। সমুদ্রও আস্তে আস্তে ফুলে উঠছে, মনে হচ্ছে রুষ্ট হচ্ছেন টঙারোয়া।
তবে এখন নতুন করে মানুষ বুঝতে শিখেছে। টঙারোয়া রুষ্ট হলে কী হতে পারে তা শুধু মাওরিরা নয় সারা বিশ্বের মানুষ বুঝতে পারছেন। তাঁরাও বলছেন একইকথা, প্রকৃতির নাম। মাওরিরা মাথায় রেখেছন টঙারোয়ার কথা। টঙারোয়া ব্লু নামে তাদের প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এমন এক নিউজিল্যান্ডবাসী যিনি মাওরি কাফমাতুয়া (বিশিষ্ট ব্যক্তি) পারিবারের সাথে যুক্ত। প্রতিষ্ঠানের নামকরণ যিনি করেছেন তিনি নিজেও মাওরি শিল্পী, বাস করেন নিউজিল্যান্ডের রাজধানী ওয়েলিংটনে। সমুদ্রের সঙ্গে তাঁদের আত্মিক যোগ ও পরিবেশভাবনা উঠে এসেছে এই নামের মধ্যে দিয়ে।
আগে নিউজিল্যান্ডের তারানাকি থেকে পরিচালিত হত এই প্রতিষ্ঠান। এখন কুক দ্বীপ, হাওয়াই, ফিজি প্রভৃতি দ্বীপে তাঁদের কাজকর্ম ছড়িয়ে পড়েছে। সমুদ্র দূষণ নিয়ে এখন তাঁরা কাজ করছেন।
মাওরিদের ভাষা অন্যরকম। এখানে স্বরবর্ণের আধিক্য বেশি। মানে টঙারোয়া শব্দের উচ্চারণ তাঁদের ভাষায় হবে: টঙ-আ-রোওআর-আআহ্। ইউরোপীয়রা পলিনেশিয়ায় আসার পরে মাওরিদের সঙ্গে একের পর যুদ্ধ হয়। প্রাচীন অস্ত্র ছেড়ে তাঁরা হাতে তুলে নেন আগ্নেয়াস্ত্র। সেই ছবি কলকাতার পুলিশ মিউজিয়ামে রয়েছে। আগ্নেয়াস্ত্র তুলে নেওয়ায় সাঁওতাল বিদ্রোহে যেভাবে সিদো-কানুদের প্রাণ দিতে হয়েছিল, তাঁদের অনেক সহজে দমন করা গিয়েছিল, মাওরিদের দমন করা ততটা সহজ হয়নি ইউরোপীয়দের পক্ষে। নিউজিল্যান্ডে তাঁরা যথেষ্ট প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ব্রিটিশরা সেখানে পাকাপাকি বসবাস শুরু করলে জমির লড়াই হয়েছে। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমির অধিকার তাঙাতা হোয়েনুয়ার (ভূমিপুত্রের), এই দাবি থেকে তাঁরা কখনও বিচ্যুত হননি। মাওরি ভাষা (তে রেও মাওরি) প্রতিষ্ঠাতার দাবিতে আন্দোলনও থামাননি। ১৯৮৭ সালে নিউজিল্যান্ড সরকার এই ভাষাকে ইংরেজির পাশাপাশি সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দেয়। নিউজিল্যান্ডের সংসদে ১২০ আসনের মধ্যে ৭টি আসন এখন মাওরিদের জন্য সংরক্ষিত।
সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে না থাকলেও নিউজিল্যান্ডের মুদ্রায় এখনও ইংল্যান্ডের রাজা-রানীর ছবি থাকে। এই দেশে ঙাতি (Ngati) ওয়াকাউই নামে অঞ্চলে আইউই (iwi) নামে মাওরি উপজাতির বাস। আইউই ও হাপু উপজাতির মিলিত সংগঠনের নাম তে আরাওয়া। পুকঅকি ছিলেন এর নেতা। তিনি ছিলেন রোটোরুয়া জেলার তে আরাওয়ার ঙাতি ওয়াকাউই উইয়ের প্রধান বা রঙতিরা। ১৮০০-এর গোড়ার দিকে তৈরি মূল মূর্তিটি নিউজিল্যান্ডের রোতোরুয়া মিউজিয়ামে রয়েছে। এটি তৈরি করেন ঙাতি ওয়াকাউ শিল্পী তে তাউপুয়া। পুকঅকির কোলে রয়েছেন তাঁর দুই পুত্র হোয়ারেঙারো ও রঅঙিতাকুকু। এরই প্রতিরূপ ছাপা হয় নিউজিল্যান্ডের ২০ সেন্ট মুদ্রায়। তাঁর দুই পায়ের মাঝে তাঁর স্ত্রী ঙাপুইয়া আছেন, যদিও দ্বিমাত্রিক ছবিতে তা বোঝা মুশকিল। পুকঅকির কোরুরুর ছবিও ছাপা হয়েছে নিউজিল্যান্ডের মুদ্রায়।
মাওরিদের সমবেত হওয়ার জায়গাকে বলে ওয়্যার তুপুনঅ বা ওয়্যারেনুই। অনেকটা আমাদের দেশের সভাস্থলের মতো, আধুনিক যুগে যাকে সংসদ বলা হয়। এর প্রবেশদ্বারের দিকে মুখ করে থাকে বার্জ বোর্ড বা মাইহাই। এর মাঝের অংশে পূর্বপুরুষের মুখোশ থাকে, যাকে বলে কোরুরু। নিউজিল্যান্ডের ১০ সেন্ট মুদ্রায় কোরুরুর ছবি রয়েছে।
মুদ্রায় ব্যবহার করা এই বিশেষ কোরুরু মুখোশটি অষ্টাদশ শতকের মাওরি যোদ্ধা নেতা পুকঅকির, যাঁর কথা আগেই বলা হয়েছে। মূল মুখোশটি ১৮৩৬ সালের, এটি ধাতব।
পলিনেশিয়ার ভৌগোলিক অবস্থান ও মানুষজন, বিশেষ করে আদিবাসীদের কথা আমাদের কাছে সেভাবে চর্চিত হয় না। তাই এই পর্বে সেই ভৌগোলিক ভূখণ্ডের সঙ্গে পরিচয় করানো হল মুদ্রার মাধ্যমে। সঙ্গে সেখানের এক আদিবাসী জনজাতির সঙ্গে, যাঁরা দীর্ঘ লড়াইয়ের পরেও ধরে রেখেছেন সংস্কৃতি – ভাষা, পোশাক, গান। ধরে রেখেছেন তাঁদের চেতনা। তাঁদের রূপকথাও ধরে রেখেছেন এখনও। তা নিয়ে মুদ্রাও আছে। সেকথা অন্য কোনও একদিন শোনানোর ইচ্ছে রইল।
(লেখক পরিচিতি – প্রাক্তন সাংবাদিক, বর্তমানে ভাষাতত্ত্ববিদ; ইতিহাস চর্চা ও মুদ্রা সংগ্রহ তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান অঙ্গ)