সে আজ থেকে বহুদিন আগের কথা। স্বদেশী আন্দোলন তখন বাংলা তথা বাঙ্গালীকে এক নতুন তরঙ্গের সন্ধান তখনো না দিলেও, তার সলতে পাকানো শুরু হয়ে গিয়েছিল অবশ্যই। এহেন সময় কলিকাতার বিডন স্ট্রিটের অধিবাসী শ্রী উপেন্দ্রনাথ সাহার পুত্রের সংখ্যা ছিল নয়। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন কালক্রমে জগদ্বিখ্যাত। তিনিই হলেন শ্রী ভবেন্দ্রমোহন সাহা, সুবিখ্যাত ব্যায়ামবীর, কুস্তিগীর। বাঙ্গালীর পরম আদরের ভীম-ভবানী। বৃকোদর অর্থাৎ মধ্যম পান্ডব ভীমের পরাক্রমে আচ্ছন্ন বাঙ্গালীর দেওয়া এই সাধের নাম মাথায় তুলে নিয়েছিলেন তিনি।
তাঁর জন্ম ১৮৯১ সালে। কিন্তু শৈশব হতে প্রায় ১৪ – ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর একমাত্র আতঙ্ক ছিল ম্যালেরিয়া। অবশ্য এই মহারোগের হাত হতে তখনকার দিনের কটি বাঙ্গালী পরিবার শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পেরেছিল তা এক গবেষণার বিষয়। তাঁদেরই একজন হলেন ভবেন্দ্রমোহন। অসুখে ভুগে একেবারে শীর্ণকায় হয়ে পড়লেন। একবার যদি সামান্য কিছু আরোগ্য লাভ করেন তো আবার স্বল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ম্যালেরিয়ার ভূত কাঁধে আবার জাঁকিয়ে বসে। প্রায় একেবারে জেরবার হয়ে তাঁর মন, শরীর সবসময়েই থাকতো শ্রান্ত। এই অবস্থায় না করা যায় লেখাপড়া না সংসারের জন্য কোন প্রয়োজনীয় কাজ। এই সময় একদিন তাঁর সাথে হঠাৎ একটি সমবয়স্ক ছেলের সামান্য কারণে বেশ ঝগড়া লাগে। ঝগড়া ক্রমশ হাতাহাতি ও মারামারিতে গিয়ে দাঁড়ায়। দুর্বল, ম্যালেরিয়া রোগী ভবানী আর পারবে কতক্ষণ যুঝতে? যা প্রত্যাশিত তাই হল। ভবানাই প্রায় একতরফা বেদম মার খেলো। পরাজিতের ভাগ্যে এর পরে কি থাকে আর? উপহাস; এক্ষেত্রেও তাই। মার খেয়ে, সকলের উপহাসের পাত্র হয়ে ভবানীর মনে এলো এক তীব্র ধিক্কার। সিদ্ধান্ত নিলেন, যদি বাঁচতে হয় তো প্রকৃত মানুষের মতই বাঁচতে হবে। নিজ শরীরের প্রতি যত্ন দেওয়া শুরু ও কি করে শক্ত সমর্থ হওয়া যায় তার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। এটাকেই বোধহয় জীবনের সন্ধিক্ষণ/turning point বলে।
যথা ভাবা তথা কাজ – ভবানী গিয়ে উপস্থিত হলেন বিখ্যাত অম্বিকাচরণ গুহ/অম্বু বাবুর আখড়ায়। স্মরণে রাখা প্রয়োজন, এই আখড়াতেই অনুশীলন করতেন শ্রী নরেন্দ্রনাথ দত্ত নামক এক যুবক, পরবর্তীকালের স্বামী বিবেকানন্দ। এই গৃহে প্রসিদ্ধ আখড়া বাঙ্গালী সমাজকে কিভাবে গড়ে তুলেছিল তার পরিচয় আমার আগের প্রবন্ধগুলিতে পেয়েছেন আপনারা। সমগ্র ভারতবর্ষের আখড়া জগতে তা ছিল এক তীর্থক্ষেত্র; অতএব, বহু নামকরা পালোয়ান কুস্তি লড়তে আসতো এখানে। এবং অম্বুবাবু গত হলেও তাঁর পুত্র ক্ষেতুবাবু তখনও জীবিত ও পূর্ণমাত্রায় সক্রিয়।
ভবানী ক্ষেতুবাবুর আখড়ায় ভৰ্ত্তি হলেন । এই আখড়ায় বাঙালীর গৌরব গোবরবাবুও এই সময়ে কুস্তি শিখতেন। ভবানী আখড়ায় ভর্তি হয়ে প্রত্যহ নির্ধারিত সময়ে এসে প্রবল উৎসাহের্ সাথে কুস্তি শিখতে আরম্ভ করলেন ।
এখানে অবশ্যই বলা প্রয়োজন, শারীরিক শক্তিসঞ্চয় এক দুরূহ সাধনা। তুচ্ছ বা অবহেলা করলে এ সাধনায় শুধু যে সিদ্ধি লাভ হয় না, তা নয়। মারাত্মক ক্ষতিরও সম্ভাবনা থাকে। এবং বাঙ্গালীর ঔদাসীন্য ও নিশ্চেষ্টতা তো এক ঐতিহাসিক সত্য। bulldog tenacity নেই বললেই চলে। আমাদের বাঙ্গালীদের বিদ্যা, বুদ্ধি আছে যথেষ্ট; নেই শুধু অধ্যবসায়। হলে জগৎ জয় কোন অসম্ভব কাজ নয়। রবীন্দ্রনাথ সখেদে বলেছিলেন, “
আমরা সঙ্কল্প করি কিন্তু আরম্ভ করিনা, আরম্ভ করি ত শেষ করিনা।.”
যখন তাঁর উনিশ বছর বয়স তখন প্রোফেসর রামমূর্তি (কোডি রামমূর্তি নাইডু, যিনি ভারতের স্যান্ডো নামেও প্রসিদ্ধ ছিলেন) তাঁর সার্কাস নিয়ে কলকাতায় এসেছিলেন। একদি ভবানী তাঁর সতীর্থদের সাথে খেলা দেখতে গিয়ে দেখেন তিল ধারণের স্থান নেই, হতাশ ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হঠাৎ রামমূর্তি তাকে ডাকেন “তুমি খেলা দেখিতে আসিয়াছ?” উত্তর হ্যাঁ শুনে ভবানীর হাত ধরে সস্নেহে বললেন, “তুমি আমার সঙ্গে আইস ; আমি তোমাকে ভাল জায়গা দিতেছি।” ..বীরকায় পুরুষ বিস্মিত নেত্রে ভবানীর অপূর্ব অঙ্গ সৌষ্ঠব লক্ষ্য করছিলেন। তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন,— “তোমার বয়স কত ?”
ভবানী বললেন,–“ঊনিশ ।”
“এই বয়সেই তোমার এমন শরীর! আমি অনেক কুস্তিগীর পালোয়ান দেখেছি। এমন তো দেখি নাই ! তোমার মত যুবক পাইলে আমার সর্ব্ববিদ্যা দিয়া পারদর্শী করিয়া তুলি।”
ভবানী তখনই জানতে পারেন ইনিই সুবিখ্যাত প্রোফেসার রামমূর্তি। (রামমুর্তি প্রচন্ড বলবান ছিলেন।তার খালি গায়ে কোন ছবিনেই কারন তিনি রোমশ ছিলেন।তার বিখ্যাত শিষ্য ছিলেন পৃথ্বীরাজ।রামমুর্তির হাতি নেওয়ার খেলা ভারতে যুবসমাজে সাড়া ফেলে ছিল।অনেকে তা অভ্যেস ও করত। দক্ষিণ ভারতে তাকেও কলির ভীম নামে ডাকা হয়)
রামমূর্তিকে দেখে ভবানীর মধ্যে যেন একটা তুফান খেলা করতে আরম্ভ করল। ভবানী রাতারাতি একদিন রামমূর্তির দলের সাথে পালিয়ে একেবারে রেঙ্গুন এসে উপস্থিত হলেন। রেঙ্গুন থেকে সিঙ্গাপুর, যাভা প্রভৃতি স্থানে ঘুরিয়া বেড়াতে লাগলেন । .রামমূর্তি যখন যবদ্বীপে তখন সেখানকার একজন ওলন্দাজ কুস্তিগীর তাঁর সাথে কুস্তি লড়তে চাইলেন। রামমূর্তি তো অস্বীকার করতে পারেন না, কারণ তাতে নিজেরই অসম্মান। রামমূর্তি রাজি হলেন। কাছেই ভবানী ছিলেন, তিনি বলিলেন—ওস্তাদজী, আমি আপনার সাগরেদ। উনি আগে আমার সঙ্গে লড়ুন। তারপর তো আপনি আছেনই ।..রামমূৰ্ত্তি খুশী হয়ে বললেন, “বহুত আচ্ছা বেটা, — লড়ো।” তিন মিনিটে সাহেবের কুস্তির সাধ মিটে গেল। ভবানীর প্রথম প্রতিযোগিতাই সফল হল ।
কিন্তু রামমূর্ত্তির দলে ভবানীর বেশীদিন থাকা পোষাল না। ভবানী বাড়ী ফিরলেন। তিনি প্রফেসর বোসের সার্কাসেও অনেক খেলা দেখাতেন।
সাংহাইতে একজন আমেরিকান পালোয়ান ভবানীকে কুস্তিতে আহ্বান করে। বাজি ১,০০০ ডলার। লোকটা হেরে যায়। কিন্তু প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ভবানীকে মারার চেষ্টা করে। ভবানী স্থানীয় কনসালকে জানালে কনসালের চেষ্টায় ভবানীর জীবন রক্ষা হয়। কনসাল ভবানীর শক্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তাব দেন, তিনি মোটর চালাবেন, ভবানী যদি গাড়ী থামাতে পারেন, গাড়ী তার। ভবানী গাড়ি টেনে ধরে রাখল।এবং তিনি নূতন মিনার্ভা গাড়ীখানা পুরস্কার পেলেন। ভবানী দুইখানা —মোটর হাতে টেনে রাখতে পারতেন।
৫ মণ(190 kg) ওজনের বারবেল অল্প আয়াসেই ভেঁজে দেখাতেন। সিমেন্টের পিপের উপর লোক বসিয়ে পিপের ধার দাঁত দিয়ে তুলে শূন্যে ঘোরাতেন। বুকের উপর চল্লিশ মণ পাথর চাপিয়ে বিশ পঁচিশটি লোককে বসিয়ে খেয়াল খাম্বাজ বাজাতে বলতেন । একবার দুটো বুনো হাতী বুকে নিতে গিয়ে কলির প্রহ্লাদ ভবানীর পেট ফেটে যায়। । অনেক কষ্টে বেঁচে ফেরেন সে যাত্রায়। এর পর তিনি মুর্শিদাবাদের নবাবের একটা বুনো হাতী অনায়াসে বুকের উপর দিয়ে চালাতে দিয়ে অক্ষত দেহে উঠে এসে নবাব বাহাদুর, লাট সাহেব ও অনান্য দর্শকদের চমকে দেন । একবার তিনি ভরতপুরের মহারাজের তিনখানা শক্তিশালী মোটর গাড়ি হাত দিয়ে টেনে সকলকে বিস্মিত করে দিয়েছিলেন।
ভবানী দেশ বিদেশের অনেক প্রসিদ্ধ ও নামজাদা পালোয়ানের সঙ্গে কুস্তি করেছিলেন, কিন্তু কখনও কারও কাছে হেরে যান নি । যেখানে তিনি নিজে জিততে পারেননি, সেখানেও তিনি হারেননি —অন্ততঃ সমান সমান হয়েছিল। এ বিষয়ে তিনি তাঁর গুরুর মান ও নাম রেখেছিলেন ।
তাঁর প্রতিপক্ষ সে সব পালোয়ানও আবার যেমন তেমন পালোয়ান নয়— সকলেই নামজাদা দিগ্বিজয়ী মল্লবীর। এক সময় প্রসিদ্ধ কুস্তিগীর গিরিজা চোবের সাথে তার কুস্তি হয়। সে কুস্তি সমান সমান হয়। একবার কাশী ধামে তাঁহার সাথে প্রসিদ্ধ মল্লবীর স্বামীনাথের কুস্তি হয়। তাতে ভবানী জয়ী হন। পরে ভারতবিখ্যাত কালু পালোয়ানের পুত্র ছোট গামার সহিত তাঁর কুস্তি হয়। সে কুস্তিও সমান সমান যায় । একবার মজিদ পালোয়ানের সঙ্গে তাঁর কুস্তি হয় ; তাও সমান সমান যায়। বিদেশে যত পালোয়ানের সঙ্গে তাঁর কুস্তি হয়েছিল, সব গুলোতেই তিনি জিতেছিলেন।
ভবানী ১২০ খানি স্বর্ণ ও রৌপ্য পদক পেয়েছিলেন । এছাড়া ছাড়া শাল, আলোয়ান, আঙটি, মোটর গাড়ী, নগদ টাকাও যথেষ্ট পেয়েছিলেন।
ভবানীর খেলা দেখে রসরাজ অমৃতলাল নাকি বলেছিলেন, “মহাভারতের ভীম এমনি একজন বীর ছিলেন। তুমি দেখিতেছি কলিকালের ভীম। আজ হতে আর তুমি শুধু ভবানী নয় বাবা.., তুমি ভীম ভবানী।”
শ্রী অনিলচন্দ্র ঘোষ তাঁর বিখ্যাত বইতে ভীম-ভবানীর diet-র বিবরণ দিয়েছেন —-“প্রাতে ২০০ শত বাদামের সরবৎ, এক ছটাক গাওয়া ঘি, মধ্যাহ্নে সাধারণ ভাত ডাল; অপরাহ্নে ২ বা ২০০ টাকার ফল ও ৫০টি বাদামের সরবৎ ও এক সের মাংস ; রাত্রে আর সের আটার রুটি ও তিন পোয়া মাংস—ইহাই ছিল ভীম ভবানীর দৈনন্দিন আহার।” তবে অনেকের মতে অতিরিক্ত আহার তাঁর মৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল।তার মৃত্যুর খবর বেরিয়েছিল আনন্দ বাজার পত্রিকায়। মৃত্যু কালে ডাক্তার স্টেথোস্কোপ দিয়েও তার বুকের স্পন্দন পাননি, চার ইঞ্জি পুরু মাসলের জন্যে।
মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্ব্বে তিনি রোলার অভ্যাস করছিলেন।ডাক্তার বলেছিলেন, এটাও তার মৃত্যুর একটা কারণ বটে। তার মৃত্যুর পর ৮ জন কাঁধ দিয়েছিল এত বড়ো চেহারার ভার ছিল তার।
জীবদ্দশায় নয় শুধু, তাঁর মৃত্যুর পরেও ভীম-ভবানী বাঙ্গালী যুবকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন তাঁর অপার শক্তি সামর্থ্যের জন্য। বহু আখড়ায় দেখা যেত তাঁর ছবি জ্বলজ্বল করছে। বাঙ্গালীর শক্তিচর্চার উপাখ্যানে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
হাওড়ার নরসিংহ দত্ত কলেজে ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতক পাঠরত।
অবসরে বইপড়া,হাওয়াইন গীটার ও তবলা বাজানো, ও অবশ্যই আখড়ায় ব্যায়াম।
Comment here