রাজনীতিস্বভূমি ও সমকাল

জোরামথাঙ্গা সরকার বাঁচাতেই সীমান্ত বিবাদ!

এমএনএফে গোষ্ঠী কোন্দল চরমে অন্যদিকে মিজোরামের বিধানসভা নির্বাচন দোরগোড়ায়
∆ হামলাবাজরা সাধারণ নাগরিক না এমএনএফের প্রশিক্ষিত ক‍্যাডার!
∆ এই জোরামথাঙ্গা এমএনএফের সশস্ত্র বিপ্লবে লালডেঙ্গার দ্বিতীয় কমান্ডিং অফিসার ছিলেন

সীমান্ত জমি বিবাদকে কেন্দ্র করে মিজোরাম-অসম সীমান্তে যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটে গেলো এমন সংঘর্ষ গাওলান উপত্যকা কিংবা বারামুলা সেক্টরে প্রতিবেশী দেশের সীমান্তে প্রত‍্যাশিত বটে। কিন্তু একই রাষ্ট্র ব‍্যবস্থার অধীন দুটো রাজ‍্যের সীমা বিবাদ যখন রক্তক্ষয়ী রূপ নেয় তখন বুঝে নিতে হবে এর পেছনে কোনো রহস্যময় কারণ রয়েছে! প্রশ্ন করাটা খুবই স্বাভাবিক, সামান্য সীমান্ত জমি দখলকে কেন্দ্র করে মিজোরামের এতোটাই আগ্রাসী হয়ে ওঠার পেছনে কারণ কী? উত্তরের সন্ধানে অবশ‍্যই ডুব দিতে হবে অতীতে।

সোমবার অসম-মিজোরাম সীমান্তে অসম পুলিশ বাহিনীর ওপর মিজোরামের পক্ষে যারা হামলা চালিয়েছে তাদের আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ মিজো নাগরিক বলে মনে হলেও তেমনটা নয়! ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, যারা আক্রমণ চালিয়েছে তারা নিজেদের কাজে যথেষ্ট সাবলীল। বন্দুক ধরার কায়দা থেকে শুরু করে বন্দুক চালানো, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ্য ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে । প্রশিক্ষিত না হলে এত সাবলীলভাবে কোনও ‘সিভিলিয়ান’ অন্তত এভাবে বন্দুক চালাতে পারতেন না! প্রথম প্রশ্ন, হামলাবাজরা কি মিজোরামের সাধারণ নাগরিক? স্পষ্ট উত্তর, একেবারেই নন। তথ‍্য সমর্থিত সূত্রের দাবি, হামলাকারীদের সিভিলিয়ান বলে মনে করাটা ভুল হবে। তাদের প্রত‍্যেকেই আসলে এমএনএফের প্রশিক্ষিত ক‍্যাডার! এমএনএফ হচ্ছে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট। বর্তমানে এটি একটি রাজনৈতিক দল এবং এই দলের সরকারই মিজোরামের শাসনে অধিষ্ঠিত। বর্তমানে এই দলের সভাপতি জোরামথাঙ্গাই মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী।

১৯৮৬ সালে ভারত সরকারের সঙ্গে ‘মিজো শান্তি চুক্তি’ স্বাক্ষর করে তৎকালীন বিদ্রোহী গোষ্ঠী এমএনএফ। এই সংগঠন দীর্ঘদিন নিজেদের দাবি আদায়ে, মিজো জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সশস্ত্র আন্দোলন চালাচ্ছিল। পরবর্তী সময়ে তারা সমাজের ‘মূল স্রোতে’ ফিরে এসে ভারত সরকারের সঙ্গে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে।

উল্লেখ্য,জোরামথাঙ্গা এমএনএফের সশস্ত্র বিপ্লবে লালডেঙ্গার দ্বিতীয় কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। পরবর্তী সময়ে সমাজের মূল স্রোতে ফিরে আসার পর এমএনএফকে স্বীকৃতপ্রাপ্ত রাজনৈতিক দলের মর্যাদা প্রদান করা হয়।

বর্তমানে এই এমএনএফে গোষ্ঠী কোন্দল চরমে। এমএনএফের হার্ডকোর শিবিরের বিশ্বাস, জোরামথাঙ্গা সহ সংগঠনের যারা ক্ষমতার অলিন্দে রয়েছেন, তারা দুর্নীতি, ক্ষমতার লোভ ইত‍্যাদিতে এতটাই ডুবে গেছেন যে তারা তাদের মূল লক্ষ্য ‘মিজো জাতীয়তাবাদ’কে প্রতিষ্ঠা করা থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। কোনও কোনও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের অনুমান কট্টরপন্থী এমএনএফ গোষ্ঠীটি মনে করে ক্ষমতায় থাকা দলের প্রতিনিধিদের লক্ষ‍্যভ্রষ্ট হওয়া থেকে ফিরিয়ে আনতে তাদেরই মাঠে নামতে হবে। এবং সেই লক্ষ‍্যেই নিজেদের স্বার্থ আদায়ে সীমান্তে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি করে উন্মত্ত রক্তক্ষয়ী অশান্তি সৃষ্টি চলছে এবং সম্প্রতিক তাণ্ডব চালানো হয়েছে। এবং এইভাবে চাপ সৃষ্টি করেই মিজো উগ্র জাতীয়তাবাদী জনমত তৈরি করতে আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। এমএনএফের গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব সীমান্ত বিবাদ ও শরণার্থী সমস্যাকে উসকে দিয়ে মূলতঃ মিজো সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিতে চাইছে। তথ‍্য সমর্থিত সূত্রের দাবি, নিজেকে মিজো জাতীয়তাবাদের ধারক-বাহক বলে প্রমাণ করতেই কট্টর পন্থী এমএনএফের গোষ্ঠীর এমন কর্ম-কাণ্ডকে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা। কারণ,তিনি খুব ভালো করেই জানেন যে উগ্র মিজো জাতীয়তাবাদকে উপেক্ষা করে তিনি ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবেন না।

২০২৩ সালে মিজোরামের বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই নির্বাচনকে সামনে রেখে বিজেপি আগে থেকেই রাজ‍্যের চাকমা-রিয়াং উপজাতি অধ‍্যুষিত এলাকাগুলোতে নিজেদের পরিসর বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। সেটা মেনে নিতে পারছে না এমএনএফ। তাদের ক্ষোভ, বিজেপি স্বতন্ত্রভাবে রাজ‍্যে প্রবেশ করে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবে কেন? তাদের কথা হচ্ছে,কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের গঠন করে দেওয়া উত্তর-পূর্বের রাজ‍্যগুলোর যৌথ সংগঠন ‘নেডা’ তো রয়েছে এবং সেখানে প্রতিটি রাজ‍্যের প্রতিনিধি আছেন। কিন্তু ‘নেডা’র বাইরে থেকে পৃথকভাবে বিজেপির মিজোরাম দখলের চেষ্টায় গোঁসা তাদের! ফলে ক্ষেপে গিয়ে কেন্দ্রের এবং অসমের বিজেপি সরকারকে চাপে রাখতে সীমান্ত বিবাদকে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে তারা।

অন্যদিকে, মায়ান্মারে সেনা শাসন জারি হওয়ার পর সেদেশে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে। মানুষ পালিয়ে ভারতে এসে আশ্রয় নিতে শুরু করলে কেন্দ্র সরকারের পক্ষ থেকে এ ব‍্যাপারে আপত্তি জানানোর পাশাপাশি সীমান্ত সিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়। কারণ ভারত সরকার মায়ান্মারের সেনা শাসকদের বিরাগভাজন হতে চায় না। মায়ান্মার পাল্টি খেয়ে চীনের পক্ষে চলে গেলে ভারতকে এর খেসারত দিতে হবে। কিন্তু ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্তে বেঁকে বসে মিজোরাম সরকার।

এদিকে,জোরামথাঙ্গা জানিয়ে দেন, মায়ান্মার থেকে যারা আশ্রয়ের খোঁজে আসছে তারা আমাদের ভাই-বোন। মিজোরাম সরকার তাদের আশ্রয় দেবে। শুধু তাই নয়, তথ‍্য সমর্থিত সূত্রের দাবি অনুযায়ী, মায়ান্মারে সেনা শাসন থাকলেও বার্মিজ ‘আণ্ডারগ্রাউন্ড সরকার’ এর প্রায় সকল পদাধিকারীরাই মিজোরামে আশ্রয় নিয়ে আছেন!

মজার ব‍্যাপার হচ্ছে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উপজাতি রাজ‍্যগুলোর যখনই কোনো বিষয়ে কেন্দ্রকে চাপে ফেলতে হয়, দর কষাকষির পর্যায়ে নিয়ে আসতে হয় তখনই তারা সীমান্ত বিবাদ, শরণার্থী ইস‍্যু, জঙ্গি সমস‍্যাকে সামনে তুলে ধরে। একই রাষ্ট্রের বাসিন্দা হওয়া স্বত্ত্বেও ‘বিশৃঙ্শলা সৃষ্টিকারী’ জঙ্গি সুলভ আচরণ তখন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। অভ‍্যন্তরীণ কোন্দল, উগ্র জাতীয়তাবাদের পোষকতার লক্ষ্যে কেন্দ্র সরকারকে চাপে ফেলার এই ফন্দিগুলো বার বারই তারা ব‍্যবহার করে আসছে। সঙ্গে বজায় রাখে ‘চীন জুজু’। চাপ সৃষ্টি করতে যখন তারা ব‍্যর্থ হয় তখন তারা চীন জুজু দেখিয়ে ভারত সরকারকে ভয় দেখানোর ফন্দি আঁটে। তাছাড়া প্রতিবেশী দেশ চীনও ভালোই জানে যে, ভারত সরকার কোনো বিষয়ে তাদের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করলে ভারত সরকারকে বাগে আনার অস্ত্র হবে ভারত ভূখণ্ডের উত্তর-পূর্বের উপজাতি রাজ‍্যগুলো। নাগা চুক্তি নিয়ে সম্প্রতি কেন্দ্র সরকারকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, নাগা চুক্তির ক্ষেত্রে কেন্দ্র তাদের দাবি না মানলে তারা চীনের সঙ্গে মিশে যেতে বাধ‍্য হবে। এটাও এক ধরনের রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা ছাড়া আর কিছু নয়!

 

(প্রবন্ধটি ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে প্রতিবেশী আসাম রাজ্যের জনপ্রিয় ‘দৈনিক প্রান্তজ্যোতি’ তে)

(Picture courtesy: NDTV) 

Comment here