বিপন্নতার মানব মুখরাজনীতি

সম্প্রীতি কাগজে কলমে, সাম্প্রদায়িকতা সরেজমিনে

নড়াইলে সাম্প্রদায়িক হামলা: অজ্ঞাত ২৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তার ৩ (দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ১৮ জুলাই, ২০২২)। একটু পেছনে যাওয়া যাক।  কুমিল্লায় দুর্গামণ্ডপে কোরআন অবমাননাকে কেন্দ্র করে তিন জেলায় মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার ৯ মাসেও বেশির ভাগ মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। গত বছরের অক্টোবরে কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চাঁদপুরে এ হামলার ঘটনা ঘটে। তিন জেলায় সব মিলিয়ে মোট ৫১টি মামলায় ৪৩৯ জনকে জ্ঞাত এবং ৫ হাজার ৭০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। এর মধ্যে নোয়াখালীতে মাত্র তিনটি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। অথচ ঘটনার ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও বাকি ৪৮টি অর্থাৎ ৯৪ শতাংশ মামলার তদন্ত এখনো শেষই হয়নি (প্রথম আলো, ১৮ জুলাই ২০২২)।

(নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া গ্রামের সাহা পাড়ায় হামলার পরের ছবি – ছবি : সংগৃহীত)

আরেকটু পেছনে যাওয়া যাক।  সুনামগঞ্জের শাল্লায় হিন্দুপল্লিতে হামলায় আটক ২২ জন, আসামি দেড় সহস্রাধিক (ডয়চে ভেলে, ১৯ মার্চ, ২০২১)। লক্ষ্য করেন, প্রতিবার এইরকম অসংখ্য অজ্ঞাত আসামি করা হয়। আদতে তাদের কিছু কি হয়? হয় না। কুমিল্লা এবং সুনামগঞ্জের শাল্লায় কিছুই হয়নি। এতেই প্রমাণিত হয় রাষ্ট্রের এই বিষয়ে আগ্রহ নেই।

আজ পর্যন্ত ৫০ বছরে যতগুলো সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে তার কোনো বিচার হয়নি। আরও সংক্ষেপে বললে, ২০ বছর ধরে সাম্প্রদায়িক হামলার কোনো বিচার হয়েছে? হয়নি। অথচ ২০ বছর ধরে সবচেয়ে বেশি মানুষকে সাম্প্রদায়িক করা হয়েছে।

শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, চলচ্চিত্র সব মাধ্যমে মানুষ সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠছে। এই সৃজনশীল অঙ্গনকে আমরা ভাবতাম প্রগতিশীল। উদার। তারাই আসলে নিশ্চুপ। সাম্প্রদায়িক হামলা হলেই কারও মুখে কোনো কথা নেই। কথা বললেই মনে হয় তাদের জেলে নেওয়া হবে।

(অশ্রুসিক্ত দিপালী রাণী সাহা, কোলে নাতনী রাই সাহা)

দেশে বন্যা হোক, দুর্যোগ হোক দেখবেন মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে কোটি কোটি টাকা তুলছে। একেকজনের টাকা সংগ্রহের সংবাদ গণমাধ্যম প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করছে। যেন গণমাধ্যমের এইটাই কাজ। সামাজিক সংগঠনগুলো পর্যন্ত ঝাঁপিয়ে পড়ছে।

অথচ সাম্প্রদায়িক হামলা হলে কাউকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। মনে হয়, নিশ্চুপ থাকার জন্য বুঝি তাদের জন্ম। আর গণমাধ্যম, তা তো কবেই বোবা, কালা, অন্ধের অভিনয়ে ব্যস্ত।

(নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া গ্রামের সাহা পাড়ায় হামলার পরের ছবি। ছবি : সংগৃহীত)

 

এই যে মানুষকে সাম্প্রদায়িক করে তোলা, এর দায় কিন্তু রাষ্ট্রের। মানুষ যখন দেখছে উগ্রবাদীরা হিন্দুদের ওপর বারবার হামলা করছে, তাদের কোনো শাস্তি হচ্ছে না। তখন মৌলবাদীরা সাহস পায়। মানুষ যখন দেখছে হেফাজতের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার শিশুদের পাঠ্যবই পরিবর্তন করে ফেলে তখন মানুষ আসলে সাহস পায়। মানুষ যখন দেখছে, মৌলবাদীরা হামলা করছে তাদের শাস্তি না দিয়ে রাষ্ট্র ভিকটিম ধরে ধরে শাস্তি দিচ্ছে তখন মানুষ সাহস পায়। এই যে সাহস দিচ্ছে তাই আসলে কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

(নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া গ্রামের সাহা পাড়ায় হামলার পরের ছবি। ছবি : সংগৃহীত)

এই কাল, এই অন্ধকার আর পরিবর্তিত হচ্ছে না। কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, কুমিল্লার মুরাদনগর, ভোলার মনপুরা, পাবনার সাঁথিয়া, দিনাজপুরের কাহারোল, সাতক্ষীরার তালা, বাগেরহাটের মংলা, রংপুরের গঙ্গাচড়া,রাজশাহীর মোহনপুর, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, যশোরের বেনাপোল, মাগুরার মহম্মদপুর, কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী, ভোলার বোরহানউদ্দীন, সুনামগঞ্জের শাল্লা, কুমিল্লার নানুয়া দিঘীর পাড়, নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া গ্রামের সাহা পাড়াসহ অসংখ্য জায়গায় হামলা হয়েছে। বিচার হয়েছে কোনো জায়গায়? না। কোথাও হয়নি। মজার বিষয় হচ্ছে, এইসব হামলার বেশিরভাগই হয়েছে ১৫ বছরের মধ্যে।

(নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া গ্রামের সাহা পাড়ায় হামলার পরের ছবি। ছবি : সংগৃহীত)

 

২০১০ সালের পর থেকে ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননার মিথ্যা অভিযোগ তুলে হামলা করা হচ্ছে। সেই পুরোনো স্ক্রিপ্ট। আগে মাইক ব্যবহার করে হামলা হতো, পরে ফেসবুকে কোনো এক হিন্দু বা বড়ুয়ার নাম ধরে আইডি খুলে ইসলামের অবমাননা করে একটা স্ট্যাটাস বা কমেন্ট করা হয়। এই আইডি যারা খুলছে তারা থেকে যাচ্ছে আড়ালে।

সেই স্ট্যাটাস বা কমেন্টকে কেন্দ্র করে শুরু হয় বর্বরোচিত হামলা। বাড়িঘর লুটপাট, মন্দির ভাঙা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর, কোথাও নারী শ্লীলতাহানিসহ ধর্ষণ এইসব ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রদায়িক হামলার পুরো সময়ে পুলিশ, প্রশাসন, মন্ত্রী, আমলা, সচিব, এমপি সবাই থাকে নিশ্চুপ। গণমাধ্যমও নিশ্চুপ। এরপর ভুয়া আইডির নাম ধরে সেই ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের নামে মামলা হয়। মামলায় অনেককিছু প্রমাণের চেষ্টা থাকলে তা শেষ পর্যন্ত আর হয় না। কারণ যে কাজ সেই লোক করেনি তাকে দিয়ে আর কিছু প্রমাণ করা যায় না। যদিও প্রতিবার এইভাবেই সংখ্যালঘুদের ভিকটিম বানানো হয়। এরপর সরকার কিছু ত্রাণ পাঠায়। বাড়িঘর মেরামত করার জন্য জিনিসপত্র পাঠায়। স্থানীয় প্রশাসন তখন ছোটাছুটি শুরু করে। মন্ত্রীরা নড়েচড়ে বসে। বড় বড় বিবৃতি দেয়। গণমাধ্যমও সেই সংবাদ প্রচার করে।

১৫ বছর ধরে এই কাজই হচ্ছে। রসরাজ, উত্তম বড়ুয়া, বিপ্লব চন্দ্র শুভদের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। এরা কেউ কোনো ধরনের ধর্মীয় অবমাননাকর স্ট্যাটাস বা কমেন্ট করেনি। নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া গ্রামের আকাশ সাহার ক্ষেত্রেও তাই হবে। কিন্তু হামলা হয়েছে। যার যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গিয়েছে।

সাম্প্রদায়িক হামলার এই স্ক্রিপ্ট দেখে সবাই অভ্যস্ত। সরকারও এই কাজ করে অভ্যস্ত। প্রশ্ন হলো, কেন এমন হয়? কেন বিচার হয় না? কেন হিন্দুদের ওপর হামলা হলে কেউ কথা বলে না? কারণ রাষ্ট্রই আসলে চায় না। সরকার চাইলেই সব সম্ভব। যদি পদ্মা সেতুর নাটবল্টু খোলার জন্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয় তাহলে এই ক্ষেত্রে নয় কেন? কারণ সরকারের সদিচ্ছার অভাব।

(নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া গ্রামের সাহা পাড়ায় পরিবারের মধ্যে ভয়, হতাশা। ছবি : সংগৃহীত)

 

নড়াইলে হামলায় এর কোনো বিচার হবে সেই আশা কম। আমি ভাবি, একটা রাষ্ট্র কতটা উদাসীন হলে হিন্দুদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়। নড়াইলের ভুক্তভোগী দিপালী রাণী সাহা। তিনি বলেন, ‘একদল লুট করে চলে যাওয়ার পর আরেকদল লুট করতে এসে কিছু না পেয়ে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। যে ঘরটিতে আমরা লুকিয়ে ছিলাম সে ঘরটির দরজা ভাঙতে না পেরে হামলাকারীরা পাশের বাড়ির মন্দিরে হামলা করে প্রতিমা ভেঙে দেয়।’ (দ্য ডেইলিস্টার (বাংলা, ১৭ জুলাই ২০২২)

কতটা বীভৎস, বর্বর হলে তারা এই কাজ করতে পারে। গোটা ঘটনার পর স্থানীয় এমপি মাশরাফি বিন মর্তুজার ঘুম ভাঙে। ১৫ জুলাই ২০২২ তারিখে যখন হামলা হচ্ছিল তখন বারবার তার সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তার সহকারী জানান, সব দেখা হচ্ছে। এই হচ্ছে দেখার নমুনা।

সমস্যা হলো, দেশের বেশিরভাগ এমপিদের আসলে নির্বাচন করে জয়ী হতে হয়নি। তারা রাতারাতি এমপি হয়েছে। মন্ত্রী হয়েছে। ফলে জনগণের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা থাকবে না এইটাই স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতা আমাদের অসহ্য লাগছে। এই নিপীড়ন থেকে মুক্তি চাই আমরা।

ভুক্তভোগী যখন বলেন, ‘আমরা হিন্দু, এই কারণে আমাদের ওপর হামলা করেছে।’ (দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ১৭ জুলাই, ২০২২) এর চেয়ে কষ্টদায়ক কথা আর হতে পারে না।

[গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন- লোহাগড়ার দিঘলিয়া গ্রামের ইসহাক মৃধার ছেলে রাসেল মৃধা, লুটিয়া গ্রামের আজিজুল গাজীর ছেলে কবির গাজী, তালবাড়িয়া গ্রামের আমিন উদ্দিন শেখের ছেলে সাইদ শেখ, বাটিকাবাড়ি গ্রামের বারিক শেখের ছেলে রেজাউল শেখ এবং বয়রা গ্রামের সাদেকুর রহমান মোল্যার ছেলে মাসুম বিল্লাহ।….ছবি : সংগৃহীত}

 

যে বাংলাদেশ গড়তে সব ধর্মের লোকজন রক্ত দিয়েছে সেই দেশে যদি হিন্দু দেখে হামলা হয় তার চেয়ে কষ্টের, অপমানের আর কী হতে পারে। সাম্প্রদায়িকতা একধরনের বিষ। এই বিষ শরীরের এক জায়গায় ঢুকলে তা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এখন উগ্রবাদী ধর্মান্ধরা হিন্দুদের বাড়িঘর লুটপাট করছে, মন্দির ভেঙে দিচ্ছে, কাল তারা হিন্দু বাদ দিয়ে মুসলমানদের আক্রমণ করবে না, এই নিশ্চয়তা কে দেবে? কারণ উগ্রবাদী ধর্মান্ধদের কোনো ধর্ম নেই।

তাদের ধর্ম উগ্রতা, ধর্মান্ধতা, অনিষ্ট করা। তাদের এই বিষদাঁত যে কাউকেই ছোবল দিতে পারে। দেবেও। এইটাই নিয়ম। এই বিষদাঁত উপড়ে ফেলতে না পারলে অমঙ্গল অনিবার্য।কারণ ধর্মে বলা আছে, তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে। তাই এখনই ধর্মান্ধদের বিষদাঁত উপড়ে ফেলে তাদের কঠিনতর শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

(Featured image: Courtesy – livemint.com)

 

Comments (1)

  1. These ongoing persecution of Hindus in Bangladesh is perpetrated by the ruling parties- whoever is in power, becomes the dolls in the hands of these blind Islamist extremists just to be in power for long time. After so many communal violent incidents against the Hindus is Bangladesh especially during last 15 years when sheikh Hasina, the daughter of Bangabandhu is in power, what did she do against those perpetrators and the Islamist extremists? She has bent her head to them in most cases. She considers to stay in power is more important than to protect the Hindus or protect the rights of women and children. She had compromised in many of such incidents where the winners are these Hefajats and islamists extremists. Her final destination also will be decided by these extremists who are waiting to get the full power of the state like that in Afghanistan where finally Talibans got the full control of their country where the women and children are the most oppressed who are fighting for their survival.

Comment here