তর্পণে প্রণত মসী

দুর্গোৎসব – মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা

– শ্রী সোমেন সেনগুপ্ত 

বাংলাদেশে দুর্গাপূজা ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়েছিল ১৭৫৭ সাল থেকে। সেই বছরেই পলাশীর প্রান্তরে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজকে পরাজিত করেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সৈন্যরা। সিরাজের পরাজয় আবেগপ্রবণ বাঙ্গালীকে যতই দুঃখ দিক না কেন ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলে।

সে আমলের কিছু ধনী জমিদারদের কাছে সিরাজের এই পরাজয় ছিল ইসলামিক শাসন থেকে মুক্তির সোপান। তাই লর্ড ক্লাইভকে ধন্যবাদ জানানোর জন্যই রাজা নবকৃষ্ণ দেব শ আরো অনেকে মহা ধুমধাম সহযোগে দুর্গোৎসবের প্রচলন করেন। নবকৃষ্ণ দেবের বাড়ীতে তো ক্লাইভ স্বয়ং প্রধান অতিথি হিসেবে দেবী দর্শনে আসেন। এর বহু বছর পর ১৮২৯ সালে লর্ড বেন্টিঙ্ক নবকৃষ্ণ দেবের বাড়ীতে দুর্গোৎসব দেখতে যান। তখন অবশ্য নবকৃষ্ণ দেব আর বেঁচে নেই।

শুরুটা যেমনভাবেই হোক না কেন, এই দুর্গোৎসব কিন্তু পরবর্তীকালে মাতৃ বন্দনার প্রতীকে পরিণত হয়ে বহু মানুষকে পরাধীনতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামিল করেছে।

বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর “আনন্দমঠ” উপন্যাসে দেশ মাকে দেবী দুর্গার সাথে বন্দনা করেছেন।  তাঁর “বন্দেমাতরম” গানের শেষে দুর্গার বন্দনা আছে (সেই অংশটি আমাদের জাতীয় সংগীত নয়)

“আনন্দমঠ” উপন্যাসে মহেন্দ্রকে গুরু ভবানন্দ দূর্গা ও জগদ্ধাত্রী মূর্তি দর্শন করিয়ে দেশসেবায় অনুপ্রাণিত করেন।

স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড়মঠে একবার দুর্গাপূজা করেন। তিনি পূজায় পশু বলি অনুষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন কিন্তু সারদামণির তীব্র আপত্তিতে তিনি পিছিয়ে আসেন।

ঋষি অরবিন্দ ঘোষ তো নিজের বাড়িতেই দুর্গা বা অম্বা মন্দির স্থাপন করেন: তাঁর প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় এই শতকের প্রথম দশকে উত্তর কলকাতার ৩৯, কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীটে এক অভিনব দুর্গাপূজা হয়। দেবীর মূর্তির বদলে সেদিন সেখানে পূজিতা হন নানা অস্ত্র। বলাই বাহুল্য, এ ছিল সহিংস বিপ্লবের গোপন প্রস্তুতি।

কলকাতার বহু বারোয়ারী দুর্গোৎসব এক সময় ছিল বিপ্লবের কর্মস্থল। এর সব থেকে ভালো উদাহরণ হল উত্তর কলকাতার সিমলা ব্যায়াম সমিতির দুর্গোৎসব, , যার প্রারম্ভ হয়েছিল যুগান্তরের শ্রী অতীন্দ্রনাথ বসুর নেতৃত্বে।  এই পূজার আড়ালে প্রতি বছর সারা বাংলার বিপ্লবীরা একত্রিত হতেন। এটা বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ পুলিশ দু’বছরের জন্য এই পূজা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। এটা বিশের দশকের ঘটনা।

অন্যদিকে হাওড়ার শিবপুরের রায় চৌধুরী পরিবারের জমিদারবাড়ীতে, পুজোয় দেবীর সামনে একটি সাদা পাঁঠা বলি দেওয়া হতো। সাদা পাঁঠাটিকে মনে করা হতো কোন ব্রিটিশ পুরুষ।

নেতাজী সুভাষচন্দ্রের সাথে বহু পূজার যোগাযোগ ছিল।  তিনি ১৯৩৮ ও ১৯৩৯ সালে বাগবাজার সার্বজনীন দুর্গোৎসবের সভাপতি ছিলেন। কুমারটুলি  সার্বজনীন দুর্গোৎসবেরও তিনি সভাপতি হয়েছেন। সিমলা ব্যায়াম সমিতির মাঠে বসে তিনি সাধারণ মানুষের সাথে অন্নকূট ভোগ গ্রহণ করেছেন।

মান্দালয় জেলে বন্দী অবস্থায় তার দুর্গাপূজার কথা তো আমরা সকলেই জানি।

 

(প্রথম প্রকাশ – “জ্যোতি” পত্রিকা, ১৯৯৮ সাল)

Comment here