সংস্কৃতিসাদাকালো রঙমাখা

ধর্মমঙ্গল ও ধর্ম উপাসনায় গোপভূমের ভূমিকা

– শ্রী জ্যোতিষ্মান সরকার

 

পুকুর পাড়ে ধর্ম রুপরামকে দর্শন দিয়ে বলেন, 

আমি ধর্মঠাকুর বাঁকুড়া রায় নাম।
বার দিনের গীত গাও শোন রূপরাম

রূপরামের নিবাস ছিল বর্দ্ধমান জেলার দক্ষিণ প্রান্তে কাইতির নিকটবর্ত্তী শ্রীরামপুর গ্রামে। ‘ কৰির পিতার নাম শ্রীরাম চক্রবর্ত্তী, মাতার নাম দময়ন্তী। কবির অল্পবয়সে পিতৃবিয়োগ হইয়াছিল বলিয়া পিতার উল্লেখ তাঁহার কাব্যে বড় পাই না। একটি অর্বাচীন পুথির শুধু একস্থলে ভনিতায় কবির পিতার নাম পাওয়া গিয়াছে ।

শ্রীরাম চক্রবর্ত্তীর বেটা শ্রীরামপুরে ঘর,
পলাশনের মাঠে ধর্ম্ম যাবে দিলা বর ।

কবি বোধ হয় মায়ের বিশেষ আদবের ছেলে ছিলেন তাই ভনিতায় পুনঃ পুনঃ মায়ের নাম কবিয়াছেন ।

রূপরাম গীত গান দৈমন্তী-নন্দন।

তরাসে কাপিল তনু তালপাত পাবা।
পালাবার পথ নাঞি বুদ্ধি হইল হারা
বাড়িতে বসিতে ভাই বলিল কুবচন ।
জননী সহিত নাঞী হইল দরশন ৷৷
দাদা বড় নিদারুণ বলে উচ্চস্বরে ।
কালি গিয়াছ পাঠ পড়িতে আজি আইলা ঘরে ৷

ভাইরা প্রহার করে রুপরামকে গৃহ থেকে বিতাড়ন করেন।উত্তরপশ্চিম-মুখে চলিয়া রূপরাম শানিঘাট গ্রামে পৌঁছিল। সেখানকার ঠাকুরদাস পাল তাহাকে “না বলিতে ভিক্ষা দিল আড়াই সের ধান।” আড়াই সের ধান দিয়া চিড়া-ভাজা কিনিয়া রূপরাম দামোদরের জলে স্নানপূজা সারিয়া জলযোগে বসিল । দমকা হাওয়ায় চিড়া ভাজা গেল উড়িয়া অগত্যা কবি নদীর জল পান করিয়া উদর ভরাইল, কিন্তু দেহে এমন বল নাই যে খুঙ্গি- পুঁথি বহা যায় । সেখান হইতে চলিয়া রূপরাম পৌছিল দিগনগর (পাঠান্তর দীঘলগ্রাম, দীঘলনগর) গ্রামে । পথে শুনিল, সেখানে তাঁতিদের বাড়িতে খুব ঘটা করিয়া “কৰ্ম্ম” হইতেছে। রূপরাম দৌড়িল তাঁতি-ঘরে। সেখানে চিড়া-দধির খুব ঘটা, কিন্তু খই নাই যাহা হউক পাঁচ দিন উপবাসের পর ফলার সারিয়া কবি দক্ষিণা পাইল পনেরো (পাঠান্তর দশ ) গণ্ডা কড়ি। তাহার মধ্যে আবার দেড় বুড়ি কাণা !

গোয়ালাভূমের রাজা গণেশরায় নাম।
বিপ্ৰকুলচূড়ামণি বড় ভাগ্যবান্ ৷ তারে গিয়া স্বপনে বলেন নিরঞ্জন । প্রতিষ্ঠা করিতে তারে দিল নানা ধন ॥
এতক দিলেন দ্রব্য শুন সৰ্ব্বজন । আচম্বিতে দুটি পালি দিল দরশন ৷৷ পালিত দেখি মহারাজা আনন্দিত
মনে ।..দ্বাদশ মঙ্গল জুড়াইল শুভক্ষণে ॥

গোপভূমের মহারাজার গণেশ রায়ের রাজপুরোহিতের স্বপ্নে এসে ধর্মরাজ দেখা দেন ।একথা রাজসভায় রাজাকে জানালে রাজসভায় এক অলৌকিক ঘটনা ঘটে।যা দেখে রাজা ধর্ম পূজার সিদ্ধান্ত নেন।

রাজা গণেশ রায়ের সময়কাল ও বংশপরিচয়

রাজমহলের মধ্যে যবে ছিল শুজা। পরম কল্যাণে যত আছিল [ত] প্ৰজা ॥
বর্দ্ধমানে যবে ছিল খালিপে হাকিম ।
[তার পরা]’-জয় হইল দক্ষিণে মহিম ॥

এই পঙতি অনুযায়ী বোঝা যায় শুজার সময়কালের প্রারম্ভে এই কাব্য লেখা হয় ।

সেকালের প্রথামত রূপরাম তাঁহার কাব্যের রচনাকাল এইরূপ হেঁয়ালীতে জ্ঞাপন করেয়াছেন

শাকে শীমে জড় হইলে যত শক হয়,
তিন বাণ চারি যুগ বেদে যত রয় রসের উপরে রস তায় রস দেহ,
এই শকে গীত হইল লেখা করা নেই।’

শ্রীযুক্ত যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি মহাশয় এই হেঁয়ালীর সমাধানে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। তিনি হিসাব করে পেয়েছিলেন ১৫২৬ শকাব্দ অর্থাৎ ১৬০৪-০৫ খ্রীষ্টাব্দ ।

রাজা গণেশ রায়ের সময়কাল ও বংশপরিচয় – 

রাজমহলের মধ্যে যবে ছিল শুজা।
পরম কল্যাণে যত আছিল [ত] প্ৰজা ॥
বর্দ্ধমানে যবে ছিল খালিপে হাকিম।
[তার পরা]’-জয় হইল দক্ষিণে মহিম ॥

এই পঙতি অনুযায়ী বোঝা যায় শুজার সময়কালের প্রারম্ভে এই কাব্য লেখা হয় ।

সেকালের প্রথামত রূপরাম তাঁহার কাব্যের রচনাকাল এইরূপ হেঁয়ালীতে জ্ঞাপন করিয়াছেন – 

শাকে শীমে জড় হইলে যত শক হয়,
তিন বাণ চারি যুগ বেদে যত রয় রসের উপরে রস তায় রস দেহ,
এই শকে গীত হইল লেখা করা নেই।’

শ্রীযুক্ত যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি মহাশয় এই হেঁয়ালীর সমাধানে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। তিনি হিসাব করে পেয়েছিলেন ১৫২৬ শকাব্দ অর্থাৎ ১৬০৪-০৫ খ্রীষ্টাব্দ ।

যখন গোয়ালভূমির(গোপভূম) রাজা হিসেবে গণেশ রায়ের বর্ণনা হয়েছে তবে ইনি রাজা মহেন্দ্রর বংশীয় সন্দেহ নেই ।

রাজা মহেন্দ্রের পর ৪ প্রজন্মের তথ্য কুলগ্রন্থে পাওয়া যায় (নরেন্দ্র>যোগেন্দ্র>ধ্বজনারায়ণ>রণভীম)। কিন্তু পরের ১১ টি নাম কুলজীটি পোকায় কেটে দেওয়ায় পাওয়া যায় না। তার পর যে নাম পাওয়া যায় তা হল বৈদ্যনাথ রায়। গণেশ রায় যে রাজা বৈদ্যনাথ রায়ের পূর্বজ তাতে সন্দেহ নেই।

সম্ভবত এই সময় থেকেই সদগোপ সমাজে ধর্মপূজা প্রচলন হয়। আজো বহু সদগোপ পরিবারে ধর্ম ঠাকুর বাবা কূর্ম মূর্তিতে বাঁকুড়া রায় রুপে পূজিত হন ।

সূত্র –

১)সদগোপ কুলীন সংহিতা খন্ড ১ – শ্রী শরৎচন্দ্র ঘোষ
২)সদগোপ তত্ত্ব  – শ্রী মোক্ষদপ্রসাদ রায়চৌধুরী
৩) গোপভূমের স্বরুপ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি – শ্রী শিবশঙ্কর ঘোষ
৪) ধর্মমঙ্গল রুপরাম

 

(লেখক পরিচিতি: শ্রী জ্যোতিষ্মান সরকার B.Tech Ceramic Technology তে পাঠরত)

Comment here