ভারতবর্ষের আপোষহীন জাতীয়মুক্তি আন্দোলনের প্রথম যুগের বিপ্লবী গুপ্তসমিতিগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ‘মুক্তি সংঘ’, পরবর্তীকালে ‘বেঙ্গল ভলাণ্টির্য়াস (বি.ভি.)। এই ‘মুক্তি সংঘ’-এর বৈপ্লবিক কর্মধারার প্রাণপুরুষ বিপ্লবী মহানায়ক শ্রী হেমচন্দ্র ঘোষ (ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রদেশের ঢাকা শহরে ১৮৮৪ সালের ২৪শে অক্টোবর তিনি জন্মগ্রহণ করেন)। ভারতবর্ষের সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামে গুপ্তসমিতির মাধ্যমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধীতায় এই সর্বত্যাগী বিপ্লবী গৃহী সন্ন্যাসীর বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের স্মৃতি তর্পণ করব তাঁর নিজের লেখনীর মাধ্যমে। স্বামী বিবেকানন্দের আশীর্বাদধন্য এই মহান কর্মযোগী বিপ্লবী প্রতিষ্ঠিত ‘মুক্তি সংঘ’ ও ‘বেঙ্গল ভলান্টির্য়াস’ -র সংগ্রামী ইতিহাসের কথা আজকের যুগের তরুণ-তরুণীদের কাছে অজানাই; এমনকি সেই ইতিহাস আজকের ভারতবাসীর অনেকেরই অজানা থেকে গেছে।
এর মুখ্য কারণ – তাঁদের অনন্যসাধারণ সশস্ত্র বৈপ্লবিক সংগ্রামী ইতিহাসকে মূলধারার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় লেখা কংগ্রেস-কম্যুনিস্ট গোষ্ঠীর ঐতিহসিকগণ কোন দিনই প্রাপ্য স্থান দেয়নি। তাই ইতিহাসের পাঠ্যবইতে আজও এঁদের সংগ্রামের কথা নেই, আছে ‘ফরাসী বিপ্লব’,‘রুশ বিপ্লব’, ‘চীন বিপ্লব’ হালের ‘সিঙ্গুর’ আন্দোলনের স্তাবকপূর্ণ কাহিনী। আজও বহু ভারতবাসী ভারতের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রকৃত ইতিহাসের থেকে কয়েক’শো যোজন দূরেই রয়েছেন। সর্বোপরি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস রচনা আজও অসমাপ্ত। কিন্তু কেন? ভারতবর্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদী সশস্ত্র বৈপ্লবিক সংগ্রামের অবদানকে অস্বীকার করা এবং তাদের আপোষহীন লড়াই-সংগ্রাম-আত্মত্যাগের ইতিহাসকে ‘সন্ত্রাসবাদ’, বা ‘সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ’ হিসাবে ইতিহাসের পাতায় আখ্যায়িত করা হয়েছে কোন রাজনৈতিক স্বার্থে?
আলোচনার প্রেক্ষিতে একটি বিষয় এখানে স্পষ্টভাবে বলা দরকার দেশের স্বাধীনতা বা মুক্তি সংগ্রাম কোন পথে পরিচালিত হবে, দেশীয়ভাবধারা সংস্কৃতি-রাজনৈতিক দর্শনকে সামনে রেখে আপোষহীন লড়াইয়ের মাধ্যমে; না আপোষমুখী নিয়মতান্ত্রিক আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে। আপোষমুখী নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় কখনও কখনও কতগুলি প্রশাসনিক সিন্ধান্তের নিয়মতান্ত্রিক বিরোধীতায় সাধারণ ভারতবাসী হতাশা-ক্ষোভ-যন্ত্রণার আবেগকে ব্যবহার করেছে অহিংস-গণআন্দোলন পরিচালনার নামে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতির একনিষ্ঠ অনুগত পৃষ্ঠপোষকের ন্যায় যেভাবে বাজারি দরকষাকষির মাধ্যমে কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতা ও ক্ষমতা হস্তান্তরের নির্দশন রেখেছিলেন; সম্ববত তাঁদের সেই ইতিহাসকে চাপা দিতেই ব্রিটিশ ভারতের অনেক ফাইলকে লুকিয়ে ফেলা হয়েছে, নয়তো নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। এর ইঙ্গিত আমরা পাই আচার্য রমেশচন্দ্র মজুমদারের লেখা ‘দ্য সিপয় মিউটিনি এন্ড দ্য রিভোল্ট অফ ১৮৫৭’ বইয়ের ভূমিকা অংশে। যেখানে তিনি বলেছেন কীভাবে নেহেরু পরিচালিত কংগ্রেস সরকার দিল্লি এবং পশ্চিমবঙ্গে ‘ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল রেকর্ড কমিশন’ কে কুক্ষিগত করেছিল ও সর্বসম্মতভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস রচনার প্রস্তাবকে না করে দেওয়া হয়েছিল। এবং কিভাবে ইতিহাস ১৯৫২ সালের ইতিহাস রচনার কমিটিতে অর্ধেক ঐতিহাসিক আর বাকি অর্ধেক কংগ্রেসের নেতাদের রাখা হয়েছিল। এই গৌরচন্দ্রিকা করবার প্রধানতম উদ্দেশ্য – পাঠকদের ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মত্যাগী জাতীয়তাবাদী সশস্ত্র বৈপ্লবিক সংগ্রামের কথা বা যে কাহিনীগুলি অনুচ্চারিত থেকে গেছে তার নেপথ্যের কাহিনী আপনাদের অবগত করানো।
ফিরে আসি ভারতবর্ষের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের মহানায়ক সকল বিপ্লবীদের প্রাণপুরুষ গৃহী-সন্ন্যাসী শ্রীহেমচন্দ্র ঘোষের কথায়। তিনি নিজেই আমাদের জানিয়েছেন কেন বাংলার বিপ্লবী গুপ্তসমিতির ইতিহাস লেখা কোনদিনই কারো পক্ষ সম্ভব নয়। আসুন দেখে নিই তাঁর নিজের ভাষাতেই–১৯৬৬ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী ভূপ্রেন্দ্রকিশোর রক্ষিত-রায় লিখিত গ্রন্থ ‘সবার অলক্ষ্যে’-র ভূমিকা লিখতে গিয়ে তিনি অপকটে সেই কথাগুলিই আমাদের জানিয়েছেন। তিনি লিখছেন, “বাঙলা দেশের বিপ্লবের ইতিহাস স্বাধীনতা লাভের পূর্বে পঞ্চাশ বছর জুড়ে বিস্তৃত। বাস্তবিক ক্ষেত্রে এ-ইতিহাস একাধিক গুপ্ত-সমিতির কর্ম-ইতিহাস। কোন একক ব্যক্তির পক্ষে তাঁর দলের ইতিহাসই সবটুকু জানা নেই। সমগ্র দলগুলোর সম্পূর্ণ ইতিহাস তাই যে কোন একজন বিপ্লবীর পক্ষে লেখাও অসম্ভব। এ ইতিহাস সংঘটিত হয়েছে জনসাধারণের অজ্ঞাতে। কেবল ঘটনাগুলো ঘটেছে লোকচক্ষুর গোচরে। এর ক্রমবিকাশ দীর্ঘ পঞ্চাশ বৎসরের প্রতি মুহূর্তে ব্যাপ্ত। ইহা প্রাণপুষ্ট হয়েছে সহস্র কর্মীর শ্রেষ্ঠতম কর্মলগ্নের অনবদ্য অর্ঘ্যে। ইতিহাস সৃষ্টির কর্মশালার কর্মীরা পরস্পর পরস্পরের গোপনকর্ম অপ্রয়োজনে জানতেন না। যতটা জানতেন তাও তাঁরা মন্ত্রগুপ্তি রক্ষার নিয়মে নিজেদের কাছে গোপন রাখতেই অভ্যস্ত ছিলেন।
এখন দেশ যেভাবেই হোক স্বাধীন হয়েছে। অতীত-বিপ্লবের ইতিহাস রচিত হওয়া এখন জাতির প্রয়োজন। কিন্তু নিজেদের স্মৃতি থেকে সযত্নে নানা ঘটনা উদ্ধার করে যাঁরা ইতিহাস বলতে পারেন তাঁদের অনেকে আজ ইহজগতে নেই। আমাদের চতুষ্পার্শ্বে এখনো যাঁরা আছেন, কালের ধর্মানুসারে তাঁরাও ক্রমে ক্রমে হারিয়ে যাবেন। কিন্তু এ বিষয়ে অবহিত হবার সময় এখনো আছে। এখনো বাঙলার বিপ্লব-ইতিহাস লিখিত হলে প্রত্যেকটি অতীত বিপ্লবী-দলের সুযোগ্য কর্মীদের একত্রিত হতে হবে। তাঁদের চেষ্টায় নানাদিক থেকে বহু তথ্য এখনো সংগৃহীত হতে পারে। কিন্তু তাঁদের উদ্যমেই এ কাজ সম্ভব নয়, প্রচুর অর্থেরও প্রয়োজন। ……”
স্বামীজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কিশোর বয়সেই শ্রীহেমন্দ্র ঘোষ বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তার কথা তিনি নিজেই স্বামীজীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা মহান বিপ্লবী শ্রীভূপেন্দ্রনাথ দত্ত’কে চিঠিতে জানিয়েছিলেন যার উল্লেখ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘প্যাট্রিয়েট পফেট’ গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে। বর্তমান প্রবন্ধে ব্যবহৃত চিঠির অংশ স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ ‘স্বামী বিবেকানন্দ এবং ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রাম’ (উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৮৮, ১২ জানুয়ারি)গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। শ্রীহেমচন্দ্র ঘোষ চিঠিতে লিখছেন, –
প্রিয় ডঃ দত্ত,
আপনার চিঠি পেয়েছি। আপনার ইচ্ছা অনুসারে ঢাকায় স্বামীজীর সঙ্গে আমাদের সাক্ষাতের স্মৃতিকথা নিচে লিখে দিলাম।
স্বামী বিবেকানন্দ ১৯০১ খ্রীস্টাব্দে ভারতের পূর্বাঞ্চল পরিভ্রমণে গেলে আমরা, ঢাকার তরুণদল, বিশেষতঃ শ্যামাকান্ত-পরেশনাথ আখড়ার তরুণরা, সেই যুগপুরুষের বক্তৃতা শোনবার জন্য দৌড়েছিলাম। আমি ছাড়া, আমার সঙ্গে ছিলেন আমার বন্ধু ও সহকর্মী শ্রীশ পাল, যিনি পরে ১৯০৮ খ্রীস্টাব্দে বাঙালার প্রথম শহীদ প্রফুল্ল চাকীকে গ্রেপ্তারের অপরাধে ইনস্পেক্টর নন্দলাল ব্যানার্জীকে হত্যা করেছিলেন। ছিলেন মৌলবী আলিমুদ্দিন যিনি স্বদেশী যুগে ‘মাস্টার সাহেব’ নামে পরিচিত ছিলেন। ছিলেন ১৯২৪ খ্রীস্টাব্দে ‘রডা অস্ত্র মামলা;র আসামী হরিদাস দত্তের জেষ্ঠভ্রাতা যোগেন্দ্র দত্ত এবং বাছাই করা আরও কয়েকজন। আমরা গিয়েছিলাম সেই সত্যদ্রষ্টার নির্দেশ ও আশীর্বাদ লাভের উদ্দেশ্যে। যিনি তখন ঢাকার ফরাসগঞ্জে মোহিনীবাবুর (মোহিনীমোহন দাসের) বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। আমরা সেদিন স্বয়ং স্বামীজীর মুখ থেকে সরাসরি একান্তে জানতে চেয়েছিলাম মানবতা ও স্বদেশপ্রেমের জন্য তরুণ বাঙলার কাছে তিনি সত্যিকারের কী প্রত্যাশা করেন। আমরা সেই মহান আচার্যের সঙ্গে সাক্ষাত করেছিলাম ১৯০১ সালের ১৩ ও ১৪ এপ্রিল (প্রায় পাঁচ দশক পরে স্মৃতি থেকে শ্রীহেমচন্দ্র ঘোষ এই কথা জানতে গিয়ে তারিখ দুটি সঠিক জানাতে পারেননি, সেই দিন দুটি হওয়া উচিত ৩ ও ৪ এপ্রিল)। স্বামীজী স্নেহভরে আমাদের কাছে টেনে নিয়ে পিঠ চাপড়িয়ে তাঁর প্রিয় শব্দদ্বয় ‘অমৃতস্য পুত্রাঃ’ বলে সম্ভাষণ করলেন। তাঁর স্পর্শ এবং কণ্ঠস্বর আমাদের যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে দিল। আগ্রহ ও আত্মবিনোদনে আমাদের ধমনীর স্পন্দন দ্রুততর হয়ে উঠল। সেটি ছিল দীক্ষাদানের মহিমময় স্পর্শ। ভাবলেও রোমাঞ্চ হয় ‘সাইক্লোনিক সন্ন্যাসী’ স্বয়ং আমাদের সঙ্গে কথা বলছেন! …………।
ইতি হেমচন্দ্র ঘোষ /১৮/৫/১৯৫৪।
জীবনের সায়াহ্নে এসে শ্রীহেমচন্দ্র ঘোষ অতীতের সেই মাহেন্দ্রক্ষণের কথা (স্বামীজীর সঙ্গে তাঁর এবং বন্ধুদের সাক্ষাতের দিন দুটির কথা)স্মরণ করে অন্যত্র এই প্রসঙ্গে লিখছেন “সারা ভারতবর্ষে তিনিই (স্বামীজী)তখন সবচেয়ে আলোড়নকারী ব্যক্তিত্ব। পরাধীন ভারতে স্বাধীনতার মন্ত্রগুরু, মুক্তির মন্ত্রচৈতন্যদাতা। …… সেদিন ……তাঁর মুখ থেকে সরাসরি তাঁর অগ্নিবাণী শুনছি—একথা স্মরণ করলে এখনও সারা শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে অঠে। সেদিন সেই পুরুষসিংহের মুখ থেকে নির্গত বীরবাণী আমাদের দেহে-মনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। সে তো শুধু বাণী নয়—মন্ত্র, যা অন্তরের সুপ্ত শক্তিকে উদ্বোধিত করে। প্রথম সাক্ষাতের পর আমরা স্বামীজীর সঙ্গে তার পরের দিনও দেখা করেছিলাম। ………কিন্তু স্বামীজীর সঙ্গে সাক্ষাতের স্মৃতি আজও আমার কাছে গতকালের ঘটনার মতো স্পষ্ট। স্বামীজীর মধ্যে আমরা দেখেছিলাম প্রচণ্ড দেশপ্রেমের প্রকাশ। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, আমার দেশপ্রেমের প্রকৃত শিক্ষা তাঁরই কাছ থেকে পাওয়া। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচিত হয়ে বুঝেছিলাম দেশের প্রতি ভালবাসা কাকে বলে। ভারতবর্ষের প্রকৃত জাগরণ তিনিই এনেছিলেন। ………… ।”
“…………তিনি আমাদের স্পষ্টভাষায় বলেছিলেন — “আমাদের প্রথম দরকার স্বাধীনতা—পলিটিক্যাল ফ্রীডম। তাই সর্বপ্রথম ইংরেজকে এদেশ থেকে তাড়াতে হবে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। বুলি কপচিয়ে নয়, বিল পাস করে নয়, গায়ের জোরে। সংঘবদ্ধ সংগঠিত আক্রমণের দ্বারা।(চাই) অরগ্যানাইজড্ কালেকটিভ অ্যাকশন আনডার ওয়ান লীডারশিপ। তারা (ইংরেজরা) দস্যু, তারা তস্কর, তারা পরস্বাপহারী, তারা ইন্ট্রুডারস, এক্সপ্লয়টারস, তারা ব্লাডসাকারস—আমাদের মায়ের বুকের রক্ত চুষে খাচ্ছে! ওই রাক্ষসদের তোদের বিনাশ করতে হবে। What right the Britishers have to rule our country? They shall have to go back to England. It is our birth place. To drive these intruders and plunderers away from our country, therefore, is your only religion now.”
আমরা তাঁকে বলেছিলাম — “আমাদের কিছু ধর্ম-উপদেশ দিন।“ উত্তরে তিনি বজ্রের মতো গর্জন করে উঠেছিলেন। বলেছিলেন “পরাধীন জাতির কোন ধর্ম নেই। তোদের এখন একমাত্র ধর্ম হচ্ছে মানুষের শক্তি লাভ করে আগে পরস্বাপহারীদের দেশ থেকে তাড়ানো। তারপর আমার কাছে আসিস ধর্মের কথা শুনতে। Arouse the latent powers of Man within you and with the help of that drive the usurpers, the intruders and the plunderers away from your country. That is your only ‘religion’ now. – তোদের এখন একমাত্র ধর্ম –the only program to be executed now. অন্য কোন ধর্ম এখন নেই, দেবতা নেই, সব অকেজো দেবতাকে বাদ দিয়ে তোরা শুধু দেশজননীর সেবা কর। শাস্ত্রে আছে — ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী’। অতএব, আমাদের প্রিয় জন্মভূমি ভারতবর্ষই তোদের একমাত্র ভগবান। যথাশক্তি তার সেবাই হলো তোদের এখন একমাত্র ধর্ম।” আমরা প্রশ্ন করেছিলাম “কিভাবে ইংরেজকে এদেশ থেকে তাড়াব? আমরা অস্ত্র কোথায় পাব?” স্বামীজী উত্তর দিয়েছিলেন — “আমি তা জানি না। তোমাদের উদ্দেশ্য দেশজননীর শৃঙ্খলমোচন। তার জন্য যা প্রয়োজন মনে করবে তাই করবে। যে কোন উপায়ে –by any means whatsoever – কারণ অত্যাচারী দস্যু আমাদের সর্বস্ব লিন্ঠন করছে, আমাদের দেশমাতৃকাকে নির্মমভাবে শোষণ করছে, তাঁকে নিঃস্ব, রিক্ত, সর্বস্বান্ত করে দিচ্ছে। যেভাবে হোক, যে কোন প্রকারে হোক তাকে বিনাশ করতেই হবে। (কথাগুলি বলার সময় তাঁর মুখ গভীর বেদনা এবং তীব্র ক্রোধে আরক্তিম হয়ে উঠেছিল—যেন তাঁর চোখ দিয়ে আগুন বর্ষিত হচ্ছিল।)”
“প্রায় পঁচিশ বছর আগে স্বামীজীর ভাই ভূপেন দত্তকে স্বামীজীর সঙ্গে আমাদের সাক্ষ্যাৎ সম্পর্কে লিখেছিলাম। কিন্তু একথাগুলি তাঁকে লিখিনি। কারণ ভেবেছিলাম এগুলি লোকে বিশ্বাস করবে না। বলবে গল্প বানিয়ে বলছি। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে এসে যুগাচার্যের মুখে যা শুনেছিলাম তা বলা প্রয়োজন বলে মনে করি, লোকে বিশ্বাস করুক বা না করুক।”
‘মুক্তি-সঙ্ঘ’ তথা পরবর্তী কালের ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’-এর জন্ম সত্যিকারের জন্ম হয়েছিল সেইদিনই।” বিপ্লবী মহানায়ক শ্রীহেমচন্দ্র ঘোষ লিখছেন “বস্তুতঃ সেদিনই আমি এবং আমার সতীর্থরা বিপ্লব-জীবনের যথার্থ মন্ত্রলাভ করেছিলাম। ………পরাধীন ভারতবর্ষ কাপুরুষতার বিরুদ্ধে, লজ্জাকর বিদেশী পরাধীনতার বিরুদ্ধে, অত্যাচারী ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রেরণা পেয়েছে বিবেকানন্দের কাছ থেকে। তিনি প্রত্যক্ষভাবে সংগ্রামে নামেননি শত্রুর বিরুদ্ধে—যেমন নেমেছিলেন রাণা প্রতাপ, শিবাজী, গুরু গোবিন্দ সিংহ। কিন্তু ভিন্নভাবে জাতটাকে ‘ফায়ার’ করে দিয়েছিলেন। তিনি সেনাপতি তৈরী করে দিয়ে গিয়েছিলেন, রেখে গিয়েছিলেন তাঁর অগ্নিময় বাণী যা অনুপ্রাণিত করেছিল পরবর্তী কালের মুক্তি-সংগ্রামীদের।” সমস্ত ভারতবর্ষ যে এক—সবাই যে ভারতবাসী, ভারতবর্ষ মানে যে একটি সুনির্দিষ্ট ভূখন্ডমাত্র নয়, হিন্দু-মুসলমান, ব্রাহ্মণ-শূদ্র, বাঙালী-পাঞ্জাবী সবাইকে নিয়েই যে দেশ এবং দেশ অর্থে যে দেশজননী—এই ধারণা তিনিই প্রথম বলিষ্ঠ ভাষায় বলে সচেতন করে দিয়েছিলেন জাতিকে। ……… জাতীয় জাগরণের ক্ষেত্রে স্বামীজীর শিষ্যদের মধ্যে নিবেদিতা সেই ফায়ার নিয়েছিলেন এবং সমস্ত ভারতবর্ষের যুব-স্মপ্রদায়কে ব্রিটিশের অধীনতা থেকে দেশকে মুক্ত করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ভীষণ ভয় করত। নিবেদিতার স্নেহ আমি অনেক পেয়েছি। স্বামীজীর প্রতি তাঁর যে শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালবাসা, বিশ্বাস, এবং নির্ভরতা দেখেছি তা তুলনাহীন। স্বামীজীর এই অগ্নিকন্যাকে যে দেখেছে সেই কিছুটা বুঝতে পারত সেই পুরুষসিংহ কী ছিলেন! ১৯১১ সালে তিনি দার্জিলিং-এ মারা গেলেন মাত্র ৪৪ বছর বয়সে। সে তো মৃত্যু নয়—গুরুর মাতৃভূমির জন্যে, যাকে তিনিও তাঁর নিজের মাতৃভূমি বলেই মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন, তারজন্যে তিলে তিলে এ আত্মবলিদান।”
‘উদ্বোধন’ পত্রিকায় ১৯৮৫-৮৬ সালে (বাংলার ১৩৯২-৯৩) শ্রীহেমচন্দ্র ঘোষ-মহাশয়ের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হলে, সেই সময়ের কলকাতায় তাঁর সমসাময়িক জীবিত বিপ্লবী শ্রী জীবনতারা হালদার (১৮৯৩ –১৯৮৮) স্বামী পূর্ণাত্মানন্দকে লিখেছেন (২৭ মে, ১৯৮৭)—“হেমচন্দ্র ঘোষের সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎকার যা ‘উদ্বোধন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তা পড়ে অভিভূত হয়েছি। ভারতবর্ষের মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাসের এটি একটি অত্যন্ত মূল্যবান উপাদান হয়ে থাকল। হেমচন্দ্র ঘোষ আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় ছিলেন। তাঁর দেশপ্রেম, সংগঠন প্রতিভা, নেতৃত্ব, তেজস্বিতা, সাহস, বুদ্ধিমত্তা এবং আত্মত্যাগ অসাধারণ। বাঘা যতীন, সূর্য সেন, রাসবিহারী বসু প্রমুখের সমতুল্য নেতা ছিলেন তিনি। সুতরাং তাঁর বক্তব্যের মূল কতখানি তা বলাই বাহুল্য। তুমি যখন তাঁর বক্তব্য সংগ্রহ করেছ সেসময় তিনি বাংলার (ভারতেরও হতে পারেন) মুক্তি-সংগ্রামীদের মধ্যে প্রাচীনতমও ছিলেন। তাছাড়া স্বামীজীকে দেখেছেন এমন মানুষদের মধ্যে বোধহয় একমাত্র তিনিই ছিলেন তখনও জীবিত। সেই হিসাবেও তুমি ভাগ্যবান। ……… ।”
বস্তুত স্বামীজীর বাণীই ঘুমন্ত জাতিকে সেদিন কীভাবে আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল তার পরিচয় সম্পর্কেই বাংলার বিপ্লবীকুলের ঋত্বিক শ্রী হেমচন্দ্র ঘোষ কথাগুলি বলেছিলেন। ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত রায় তাঁর ‘সবার অলক্ষ্যে’ গ্রন্থের ‘বি.ভি.-র ইতিহাস লিখতে গিয়ে বলছেন. “তাঁর পিতা মথুরানাথ ঘোষ মহাশয় সপরিবারে ঢাকা শহরে বাস করতেন। পিতা ছিলেন আইন ব্যবসায়ী। হেমচন্দ্র তাঁর চতুর্থ ও কনিষ্ঠ পুত্র। পড়তেন তিনি ঢাকা জুবলি স্কুলে। ……… ছোট বয়সেই হেমচন্দ্র ছিলেন ভিন্ন ধাতের ছেলে। স্কুলের বাইরের পুঁথিপত্র পাঠে তাঁর বিশেষ উৎসাহ ছিল। ডনকুস্তি, লাঠিখেলা, সাঁতার প্রতিযোগিতা ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর পারদর্শিতা প্রশংসা পেত। ছোট বয়স থেকেই ইংরেজের প্রভুত্ব (ভাল করে নাবুঝলেও) তাঁর ভাল লাগত না। ……… কিন্তু ১৮৯১ সালে ‘মণিপুর-যুদ্ধে’ দিঅবরুদ্ধ মহাবীর টিকেন্দ্রজিৎ ও জেনারেল থাঙ্গাল্কে ফাঁসি দেবার কাহিনী হেমচন্দ্রের শিশু চিত্তেও বৃটিশদ্রোহী ভাব ধাক্কা দেয়।” পরবর্তী কালে তাঁর নিজস্ব উপলব্ধি – “ইংরেজরা কি চেয়েছিল? তারা চেয়েছিল – to produce ‘a new class, ‘Indian’ in blood and colour, but English in taste, in opinions, in morals and intellect.’” ( The Last years of British India –Michael Edwards, p. 6 –)। কিন্তু পারেনি বিদ্যাসাগরকে, বিবেকানন্দকে, অরবিন্দকে, সুভাষচন্দ্রকে। গান্ধীজিকে ইংরেজ কোনদিন ভয় পায়নি। কারণ তাদের চোখে — “he was harmless” (Ibid.., p.48) পায়নি। একথা ওদের দেশের ঐতিহাসিকরাই বলছেন। ১৯০১ সালের স্বামীজীর সঙ্গে সাক্ষাতের কাহিনী তাঁর এবং সতীর্থদের জীবনকেই পালটে দিয়েছিল।
আনন্দমঠ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৮২ সালে। ঋষি বঙ্কিমের “আনন্দমঠ” গ্রন্থটি বিপ্লবী সংগঠনের আদর্শ ও টেকনিক এবং জীবনবেদের মর্যাদা পেয়েছিল। বিপ্লবী নায়ক শ্রীহেমচন্দ্র ঘোষ মুক্তি সংগ্রামে ভারতবর্ষের জাতীয় ‘বীজ-মন্ত্র’ রূপে পেয়েছিলেন ‘বন্দেমাতরম্’। এ প্রসঙ্গে তাঁর নিজের লেখনীতেই ফিরে যাই—“বন্দেমাতরম্ আমাদের জাতীয় সঙ্গীত—জাতীয়মন্ত্র এবং অন্যভাবে বলা যায় আমাদের জাতির মন্ত্র। “মন্ত্র” এই শব্দটির তত্ত্ব বা মর্ম সাধনার দ্বারা উপলব্ধির বিষয় – এর ভাষান্তর, ভাবানুবাদ বা তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা দুঃসাধ্য—যদিচ চেষ্টা যে হয় না এমন নয়। ‘বন্দেমাতরম্’ মন্ত্রটির উদ্গাতা ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র।”
কিন্তু এ প্রসঙ্গে একটা কথা পরিষ্কার স্মরণ রাখতে হবে; তা হ’ল এই যে, ঋষিগণ মন্ত্রের রচয়িতা নন। মন্ত্র শাশ্বত। মন্ত্র নিজে স্বয়ং ঋষি বিশেষের নিকট উদ্ভাষিত হয়েছেন, বিশেষ রূপে দর্শন দিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট ঋষিবর তা বাঙ্ময় রূপে প্রকাশ করে দিয়েছেন। ………। ”
“আমাদের ভারতবর্ষের আবহমান কালের ইতিহাসে দেখি যে, গুরু প্রদত্ত মন্ত্রে বা গুরুর দ্বারা দীক্ষিত মন্ত্রে সাধকগণ সাধারণত জগৎ সরসার পরিত্যাগ করে হিমালয়ের দুর্গম গিরি গুহায় অথবা গভীর গহন অরণ্যভূমিতে গিয়ে সাধনায় লিপ্ত হয়েছেন। আত্মসাধনা ‘বনে বা কোণে’ করতে হবে।”
“বন্দেমাতরম” মন্ত্রটি কিন্তু একেবারে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। এই “মন্ত্র”টির সাধকগণ জগৎ সংসার পরিত্যাগ করে নয়, সর্বাধিক কাম্য পরিত্যাগ করেই, দুর্গম গিরিগুহা বা গহন অরণ্যাভ্যন্তরে নয়—বনে বা কোণে নয়—জগতের মধ্যে থেকেই সংসার-সীমান্তে তাঁদের সাধনার পীঠস্থান করেছেন। আর মন্ত্রটির সাধনাও সমবেত ভাবে বহুজন সহ সাধ্য, তবেই সিদ্ধিলাভ হবে। মন্ত্রটি জাতিগত। ব্যক্তিগত নয়, ব্যক্তি বিশেষের জন্য মাত্র নয়। অন্য সকল মন্ত্র মূলতঃ Individual, আর বন্দেমাতরম্ মন্ত্রটি National.” কি প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস এবং স্থিতধী প্রাণশক্তি তিনি মনের মধ্যে ধারণ করতেন এবং এই মহান বিপ্লবীকে ধ্যানীমন্ত্রে’ সত্যদ্রষ্টা ঋষির সাধনায় নিয়ে গিয়েছিলেন – যার প্রকাশ তাঁর লেখনীতেই –“স্বয়ং ঋষি শ্রীঅরবিন্দ বলেছেন – ‘Individual National ‘Earlier Bankim was a novelist only, later Bankim is a Rishi’ স্বয়ং স্বামীজীর সঙ্গে তাঁর দুর্লভ সাক্ষাতের মুহূর্তেও তিনি শ্রীহেমচন্দ্র ঘোষকে বলেছিলেন — ‘Read Bankim Chandra—Bankim Chandra—and Bankim Chandra only.’।”
“আদি কবি বাল্মিকী ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের মুখ দিয়ে বলেছেন – “জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী—মাতৃভূমি স্বর্গ থেকে গরীয়সী। এ যুগে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র মাতৃভূমিকে অধিকতর মহিমায় মণ্ডিত করেছেন। তিনি বলেছেন, মাতৃভূমিই সেই ‘চরম’ সত্য-এর, পরম সত্যের—পরমাত্মার রূপবিশেষ মাত্র—ভিন্নতর অন্য কিছু নয়। একই সত্ত্বার প্রকাশ। দেশমাতা জগন্মাতার অভিন্ন সত্ত্বা। চিন্ময়ীর মৃন্ময়ীর রূপ। দেশমাতাই বাহুতে শক্তিরূপে অবস্থানরতা, তিনিই মুক্তি প্রদায়িনী। আবার তিনিই প্রাণস্বরূপা। তিনি শ্রী ঋদ্ধি। তিনিই ভক্তি। দেশমাতা সর্বরূপহরা সর্বস্বরূপা। “রূপম্ রূপং প্রতিরূপো বভূব”। .দেশ মাতৃকার মুক্তিযজ্ঞে সোহহং স্বামীর (ব্যাঘ্রবীর শ্যামকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়) নিকট প্রথম দীক্ষা—বীজমন্ত্র ‘বন্দেমাতরম্’। ‘মন্ত্রচৈতন্য’ হল বিশ্বপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দের স্নেহ প্রভাবে। বৃহত্তর ভারতবর্ষের যত যত মহাজন–তাঁদেরই একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্কে এ জীবন ধন্য– …….. সবাই একবাক্যে বলেছেন জাতির জীবনমন্ত্র ‘বন্দেমাতরম্’।” তাঁর জাতীয় এই বীজ-মন্ত্রের প্রতি এই অগাথ আস্থা এবং শ্রদ্ধাই সেদিনের নবীন স্বদেশসেবককে দেশমাতৃকার মুক্তিযজ্ঞে দীক্ষিত করেছিল। অশ্বিনীকুমার দত্তের ‘ভক্তিযোগ’ এবং লোকমান্য তিলকের ‘গীতাভাষ্য’ পড়েও তিনি উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন।
কৈশোরের ছাত্রজীবনেই হেমচন্দ্র ছাত্রবন্ধুদের মধ্যে পরাধীন দেশের জন্য কিছু করার মনোভাব নিয়েই সামাজিকভাবে সক্রিয় ছিলেন। তবে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, দেহে ও মনে তাদের সুস্থ, বলিষ্ঠ, নিষ্কলুষ হলেই স্বদেশানুরাগের ভাব প্রাণের অন্তর থেকে জেগে উঠবে। সেইসময়ে ঢাকা শহরে দুইজন প্রসিদ্ধ ব্যায়াম-বীর শ্রীশ্যামাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রসিদ্ধ মল্লবীর পরেশনাথ ঘোষ (পার্শ্বনাথ)। হেমচন্দ্রের শরীরচর্চার গুরু ছিলেন শ্যামাকান্ত ও পরেশনাথ। সেই সময়ে ঢাকা শহরে বহু কিশোর-যুবক তাঁদের কাছে ব্যায়াম ও কুস্তি শিক্ষা করত এবং ঢাকা ছাত্র-যুবদের মধ্যে এঁদের প্রভাবও ছিল যঠেষ্ট। হেমচন্দ্র তাঁর সাংগঠনিকশক্তি গড়ে তোলার আত্মবিশ্বাস ছাত্রাবস্থাতেই পেয়েছিলেন। স্কুলের ছাত্রবন্ধুদের নিয়ে তিনি সদ্গ্রন্থাদি পঠন-পাঠন ও নিয়মিত ব্যায়ামচর্চার মাধ্যমে শৃঙ্খলাবদ্ধ মানুষ গড়ে তোলার প্রস্তুতি তিনি নিয়েছিলেন। উপযুক্ত স্বদেশসেবক এবং দৃঢ়চিত্ত আত্মত্যাগী হবার প্রাথমিক ধাপ। পরবর্তীকালে তিনি লাঠি খেলায় দীক্ষা নিয়েছিলেন বঙ্গ-বিশ্রুত বিপ্লবী নেতা পুলিনবিহারী দাসের নিকটে। তাঁর শিক্ষা লাভের আগ্রহ, শৃঙ্খলাবোধ, এবং কর্তব্যনিষ্ঠার জন্য তাঁর তিনজন গুরুই তাঁকে স্নেহ করতেন। সেকালে ঢাকা শহর গুণ্ডার উপদ্রবের জন্য কুখ্যাত ছিল। তরুণ যুবকদের বিপথগামী করা এবং দিনে-দুপুরে মেয়েদের প্রতি কুৎসিৎ ব্যবহার করতেও এরা কুণ্ঠিত হত না। শ্যামাকান্ত, পার্শ্বনাথ, পুলিনবিহারী দাস এই গুণ্ডাদের দমনে অনেকটাই সফল হয়েছিলেন। গুণ্ডারা এঁদের তিনজনকে বাঘের মতো ভয় পেত। এরপর হেমচন্দ্র এবং তাঁর দলের নওজোয়ানেরা গুণ্ডাদের মনে ভয় সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শ্যামাকান্ত বলতেন “ব্রহ্ম সত্য, বুলেট্ও সত্য’। হেমচন্দ্র ও তাঁর দলভুক্ত যুবকগণ এই বাণী অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে সচেষ্ট ছিলেন। শ্রী ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত রায় তাঁর ‘ভারতের সশস্ত্র বিপ্লব’ গ্রন্থে (রক্ষিত রায়, রবীন্দ্র লাইব্রেরী কলিকাতা, ১৩৭৭) লিখেছেন “তাঁহার জীবনের দীর্ঘকাল কাটিয়া গিয়াছে কারাগারে এবং বন্দী-শিবিরে। তাঁহার লাঞ্ছনা ভোগ আরম্ভ হয় ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে হইতে। গুণ্ডাদলের সমাজবিরোধী দুষ্কার্য প্রতিরোধ করিতে যাইয়া হেমচন্দ্র ফৌজদারী মামলায় জড়িত হইয়া পড়েন; এবং কিছুদিন হাজতে আটকে থাকিবার পর তিনি খালাস পান। তাঁহার বিরুদ্ধে আনীত মিথ্যা মামলা টিকিল না।”
প্রাক স্বদেশী-যুগেই তরুণ হেমচন্দ্র দেশমাতার দাসত্ব শৃঙ্খলমোচনে সংকল্পবদ্ধ হয়েছিলেন এবং বিপ্লবী দলের কার্যে আত্মনিয়োগ করার দরুন তাঁকে অকালে শিক্ষায়তনের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করতে হয়। কিন্তু তাঁর জ্ঞানার্জনের জন্য তাঁর অদম্য ইচ্ছাশক্তি, মেধা ও তীক্ষ্ণ স্মৃতি-শক্তি তাঁকে বিদ্যানুশীলন থেকে নিবৃত্ত করতে পারে নি। তাঁর সতীর্থদের অনেকের ছিলেন উচ্চশিক্ষিত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী। কিন্তু একাধিক সমসাময়িকদের মতে তিনি ছিলেন জ্ঞানতাপস এবং এরকম তীক্ষ্ণ-মেধাসম্পন্ন অধ্যয়নশীল ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যেও খুব সামান্যই দেখা যায়। সমকালীন পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাস ছিল নখদর্পণে। তাঁর জীবনাদার্শ রূপায়ণে এবং বৈপ্লবিক কর্মযজ্ঞে ও ঋষিতুল্য জীবনে গঠনের প্রেরণাস্বরূপ ছিলেন স্বাদেশিকতার আদ্যাচার্য ঋষি রাজনারায়ন বসু, স্বামী বিবেকানন্দ, অরবিন্দ ঘোষ (শ্রীঅরবিন্দ) এবং ভগিনী নিবেদিতা জীবনী ও কর্মবদান রচনামালা ও ভাষণাবলী। বিপ্লবী নেতা পি. মিত্র. এবং মহিলা বিপ্লবী সরলাদেবী তাঁহাকে দিয়েছিলেন শৌর্যসাধনার শিক্ষা (শ্রী ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত রায়, রবীন্দ্র লাইব্রেরী কলিকাতা, ১৩৭৭)। .
ইতিপূর্বেই ১৮৯৭ সালেই হেমচন্দ্রের সঙ্গে উল্লাসকর দত্তের পরিচয় ঘটেছিল। বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের পিতা দ্বিজদাস দত্ত তখন ছিলেন ঢাকা কলেজের বিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং বারীন ঘোষের দাদা মনোমোহন ঘোষও ছিলেন ঢাকা কলেজের ইংরেজি অধ্যাপক। সেই সূত্রে বারীন ঘোষ ঢাকায় এলে, হেমচন্দ্র ঘোষ ও বারীন ঘোষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল। এই সময়ে রুশ-জাপান যুদ্ধে জাপানের হাতে রাশিয়ার পরাজয় এশিয়ার উপনিবেশিক শাসনাধীন জাতিগুলির মধ্যে নূতন প্রাণের সঞ্চার ঘটে; তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিপ্লবী গুপ্ত সমিতির গড়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় এবং বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে গুপ্তসমিতি গড়ে উঠতে শুরু করে। ইতিমধ্যে ‘বঙ্গ-বিচ্ছেদ’-এর সিদ্ধান্ত বাংলার তরুণ-কিশোরদের মনের মধ্যে স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করে।
১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর শ্রী হেমচন্দ্র ঘোষ ব্যারিস্টার পি. মিত্র. মহাশয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন; ‘ঢাকা অনুশীলন সমিতি’ স্থাপনের জন্য পি. মিত্র. তখন ঢাকায় এসেছিলেন। শ্রী পুলিন দাস মহাশয় ঢাকা ‘অনুশীলন সমিতি’র সম্পাদক পদে বৃত হন। হেমচন্দ্র ঘোষ সঙ্গোপনে তাঁর গুপ্তসমিতির নাম দিলেন ‘মুক্তি সঙ্ঘ’। ১৯৭৮ সালের ৫ই এপ্রিল স্বামী পূর্ণাত্মানন্দকে ‘মুক্তিসঙ্ঘ’ গঠনের কথা স্মরণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, “স্বামীজীর উদ্দীপনাময় বাণী এবং আশীর্বাদই প্রধানতঃ আমাদের বিপ্লবের পথকে বরণ করতে এবং ১৯০৫ খ্রীস্টাব্দে “মুক্তিসঙ্ঘ’ সংগঠন করতে প্রেরণা যুগিয়েছে।” ‘মুক্তিসঙ্ঘ’ নামটি শুনে গভীর আবেগভরে শ্রী ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় বলেছিলেন – “আমরা জানি বা না জানি, নবীন প্রবীণ আমাদের সকলের পিছনেই রয়েছে ঐ সাইক্লোনিক বিরাট মানুষটি। সে-ই আমাদের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক জাগরণের পিতা। আর পরমহংসদেব হলেন সেই জাগরণের পিতামহ।” এই প্রসঙ্গে বলি যে আমাদের দলের ‘মুক্তিসঙ্ঘ’ নামটি ব্রহ্মবান্ধবের খুব পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু ‘মুক্তিসঙ্ঘ’ প্রাণপুরুষ যাঁরাই ছিলেন তাঁরা এবং তাদের পরবর্তীকালের সহযোগীদের কাছে এই নাম গোপন মন্ত্রের মতো ছিল। তাঁর দলভুক্ত অনেক বিপ্লবী যুবকই সংগঠনের প্রকৃত নাম জানতেন না, আবার অনেকে জানলেও গোপনই রাখতেন। হেমচন্দ্রের ও তাঁর সহকর্মীদের অনেকেই বিপ্লবী জীবনে মন্ত্রগুপ্তির দীক্ষা আজীবন অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন।
ঢাকায় তাঁর প্রাথমিক পর্বের কর্মকাণ্ডে সহযোগী ছিলেন শ্রীশ পাল, গুণেন ঘোষ, মাখন চক্রবর্তী, হরিদাস দত্ত, খগেন দাস, রাজেন গুহ, বিভূতি বসু, ক্ষিতিপতি মিত্র, নিকুঞ্জ সেন (বড়), কৃষ্ণকান্ত অধিকারী, ডাঃ সুরেন্দ্র বর্দ্ধন, হরিদাস রায়, মুন্সী আলিমদ্দিন আহমেদ (মাস্টারসাহেব), সতীশ সাহা, প্রমথ চৌধুরী প্রমূখ। হেমচন্দ্র নিজের দলের পৃথক সত্তা বজায় রেখেই ঢাকাতে “অনুশীলন সমিতি’র সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯০৫ সালে ‘বঙ্গব্যবচ্ছেদ্’কে কেন্দ্র করে একাধারে বয়কট ও স্বদেশী আন্দোলন শুরু হলে, তাঁর তরুণ-কিশোরদের নিয়ে কর্মতৎপরতা, সাংগঠনিক ক্ষমতা ও দেশাত্মবোধের মন্ত্রদীক্ষা ক্রমশ ব্যাপ্তি লাভ করেছিল। যথার্থ বিপ্লবী কর্মী গড়ে তোলায় তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। ১৯০৫ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় বয়কট আন্দোলনে সমর্থনে সহযোগীদের নিয়ে পিকেটিং করে বিলেতী কাপড় পুড়িয়ে ফেলার জন্য তাঁকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে এবং কিছুদিন কারারুদ্ধ থাকার পর তিনি মুক্তি পান।
১৯০৬ সালে হেমচন্দ্র কলকাতায় এসে ভবানী দত্ত লেনে তাঁর এক বন্ধুর বাসায় থাকেন। ভবিষ্যৎ কর্ম-পরিকল্পনা এবং কলকাতায় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে পরিচয় এবং আলাপ-আলোচনা চালানো ছিল তাঁর প্র্রধান উদ্দেশ্য। এই সময়েই তাঁর সঙ্গে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠতা হয় এবং বৈপ্লবিক কর্মপন্থা ও সুস্পষ্ট অভিমুখ নিয়ে হেমচন্দ্র ও “ব্রহ্মবান্ধবের সঙ্গে গভীর আলোচনার ফলেই তিনিশপষ্ট করে তাঁর চলার পথ খুঁজে পান। তাঁর আশীর্বাদ হেমবাবুর বিপ্লবী-জীবনে মস্ত বড় সম্বল ছিল।” এই সময় তিনি কলকাতায় শ্রীঅরবিন্দ, ভগিনী নিবেদিতা, বিপিন পাল, সতীশ মুখার্জী (ডন্ সোসাইটি) প্রভৃতি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পরিচিত হন এবং বিপ্লবের তত্ত্ব, দর্শন, ইতিহাস ও কর্মধারা সম্পর্কে সম্যক অবহিত হবার চেষ্টাও চালিয়ে যান।
ঢাকায় ফিরে এসে হেমচন্দ্র দ্বিগুণ উৎসাহে ও যত্নে দল গড়ায় প্রবৃত্ত হলেন। ক্রমে কলকাতায় একটি আস্তানা করা হল। শ্রীশ পাল মুক্তিসংঘের কলকাতা শাখার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁকে সাহায্য করার জন্য গুণেন ঘোষ, হরিদাস দত্ত ও খগেন দাস কলকাতায় আসেন। ১৯০৯ খ্রীস্টাব্দের নভেম্বর মাসে হেমচন্দ্র বিপ্লবী দলের কার্যোপলক্ষে ত্রিপুরা-আগরতলা যান। বঙ্গ-বিভাগের পর নব-গঠিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের তদানীন্তন ছোট লাট হেয়ার সাহেব ত্রিপুরার মহারাজার প্রাসাদে এক সামাজিক উৎসবে যোগদান করেন। তৎকালে স্থানীয় পুলিশ সন্দেহক্রমে হেমচন্দ্র ঘোষকে এবং তাঁর সঙ্গী প্রখ্যাত খেলোয়াড় জ্ঞানচন্দ্র রায়কে (জ্ঞান পোদ্দার) গ্রেপ্তার করা হয়। জ্ঞান পোদ্দার সাথে সাথেই জামিনে মুক্ত হন, কিন্তু হেমচন্দ্রকে প্রায় আড়াই মাস আটক থাকতে হয়। মুক্তির পরে তাঁকে আগরতলা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।
১৯০৯ সালে হেমচন্দ্র ঘোষের সঙ্গে বিপ্লবী নেতা শ্র্রী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের (বাঘা যতীন) পরিচয় হয়। ১৯১৩ সালের দামোদর নদীর বন্যায় বহু মানুষ চরম দুর্গতি ও ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। এই বন্যায় দুর্গতদের ত্রাণের কাজে বিপ্লবীরা অপূর্ব সেবা-দানের ক্ষমতা দেখিয়েছিলেন। প্রত্যেক বিপ্লবী দলই নিজেদের সঙ্গতি ও জনবল অনুসারে সেবা কার্যে আত্মনিয়োগ করে। হেমচন্দ্র ঘোষ ও তাঁর সঙ্গীরাও এই কাজে কোনভাবেই পিছিয়ে থাকেনি। শ্রীশচন্দ্রের নেতৃত্বে হরিদাস দত্ত ও প্রতুল ঘোষ প্রমুখ আর্তত্রাণের কাজে খুবই যোগ্যতা দেখিয়েছিলেন। মহান বিপ্লবী নেতা যতীন মুখার্জি তাদের কাজে তুষ্ট হয়ে তাঁদের দলের নেতা হেমচন্দ্র ঘোষকে একটি রাইফেল ও একটি ব্রীচ-লোডার প্রতুল ঘোষের মারফৎ ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। এ উপঢৌকন সশ্রদ্ধায় গ্রহণ করে হেমচন্দ্র ঘোষ খুবই গর্বিত ছিলেন। ইতিমধ্যে তাঁর সঙ্গে রাসবিহারী বসুর যোগাযোগ হয় এবং অল্পসময়েই উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। তিনি এই সময়ে তাঁর গভীর অধ্যয়নের মধ্যে দিয়ে বিপ্লব, জাতীয়তাবাদ, বিশ্ববোধ সম্পর্কে নিজস্ব ধারণাগুলি আরও স্বচ্ছ ও জাতীয়তাব্দী বৈপ্লবিক মতাদর্শবোধ গড়ে ওঠে যেখানে বিশ্ববোধ ও বিশ্বকল্যাণের ধারণার প্রথম ধাপই হল স্বদেশের মুক্তি, এ সত্য তিনি স্পষ্টতই উপলব্ধি করেছিলেন। তাই নিজের দল আদর্শে, নিষ্ঠায় ও আভিজাত্যে সংগঠিত হতে থাকলেও তিনি কূপমণ্ডুক হয়ে থাকার পক্ষে মোটেই ছিলেন না। স্বদেশের কাজে বিপ্লবের কাজে তিনি সর্বদা যুগান্তর এবং অনুশীলন দলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন।
ইতিমধ্যেই দলের কলকাতা শাখার কার্যকলাপ শ্রীশ পালের কর্মদক্ষতায় দস্তুর মতো শুরু হয়েছে। সম্ভবত তাঁর নির্দেশেই শ্রীশ পাল শ্রী বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি ও শ্র্রী হরিশ শিকদার মহাশয়ের ‘আত্মোন্নতি’ দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তাছাড়া যতীন মুখার্জির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে হেমচন্দ্র দলের কলকাতা শাখার কার্যকলাপ পরিচালনা করেন। এক্ষেত্রে তাঁকে বিশেষভাবে সহায়তা করেছিলেন শ্রীশ পাল। শ্রীশ পালের বন্ধু গুণেন ঘোষ শ্রীশ পালের নির্দেশেই তাঁর সহকারী রূপে অবিনাশ চক্রবর্তীর (মুনসেফ) মাধ্যমে যতীন মুখার্জির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। অবিনাশ চক্রবর্তী এবং যতীন মুখার্জি জানতেন যে গুণেন ঘোষের সম্পূর্ণ আনুগত্য ছিল হেমচন্দ্র ঘোষের দলের প্রতি। গুণেন ঘোষের ডাক নাম ছিল্ল ‘হরি ঘোষ’। বাড়ি ছিল ঢাকা জেলার ‘সোল্লা’ গ্রামে। বিপিন গাঙ্গুলি ‘আত্মোন্নতি’ দলের সঙ্গে শ্রীশ পালের মাধ্যমে ‘মুক্তিসংঘে’র যৌথ প্রথম বৈপ্লবিক-অ্যাকশন সংগঠিত হয় ১৯০৮ সালের ৯ই নভেম্বর কলকাতা সার্পেন্টাইন্ লেনে। ওই দিন শ্রীশ পাল পুলিশের নন্দনাল ব্যানার্জীকে গুলি করে হত্যা করেন। ১৯০৮ সালের এপ্রিল মাসে মজঃফরপুরে ঘটনায় প্রফুল্ল চাকী যে পুলিশের হাতে ধরা পড়তেই নিজের পিস্তলের গুলিতে নিজেকে নিঃশেষ করে বাঙলার মৃত্যুঞ্জয়ী-অগ্রদূতের আসন পেয়েছিলেন, সেই মহান বিপ্লবীকে যে পুলিশ কর্মচারী গ্রেপ্তার করেছিলেন, তাকে শাস্তি পেতেই হবে। মুক্তিসংঘ ও আত্মোন্নতি-র যৌথ পরিকল্পনায় সারপেন্টাইন্ লেনে শ্রীশচন্দ্র ও রণেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি (আত্মোন্নতি দলের বীর্য্যবান তরুণ) নন্দনাল ব্যানার্জীর অপকীর্তি ও দেশদ্রোহিতার শাস্তিস্বরূপ মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি দেন। পুলিশ তো দূরের কথা, বিপ্লবীদের দু’চারজন ছাড়া সকলের কাছে নন্দলালের হত্যার কাহিনী রহস্যই থেকে যায়, এমনকি পুলিশ রিপোর্টেও তৈরি হয় বিভ্রান্তি।
১৯৬৬ সালে ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত রায় লিখিত ‘সবার অলক্ষ্যে’ গ্রন্থটির পাণ্ডুলিপি আগাগোড়া পড়ে তাকে এ্যাপ্রুভ করে হেমচন্দ্র ঘোষ সেই বইয়ের ভূমিকাও লেখেন। কিন্তু ভাবীকালের ঐতিহাসিকদের জন্য ‘ডাইরেক্ট এভিডেন্স্’ রূপে যাতে গৃহীত হয়, সেই জন্য ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত রায় হেমচন্দ্র ঘোষ কাছে একটি চিঠি মারফৎ সেই তথ্য দেশবাসীর জন্য জানাতে অনুরোধ করেন। হেমচন্দ্র ঘোষ-এর সেই চিঠিতে ‘মুক্তিসংঘ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্যগণ ও একজন প্রবীণ সদস্যের স্বাক্ষরসহ একটি চিঠি লেখেন (হেমচন্দ্র ঘোষ, রাজেন্দ্রকুমার গুহ, ডাক্তার সুরেন্দ্র বর্দ্ধন, হরিদাস দত্ত, বিভূতিভূষণ বসু)। আমি বর্তমান নিবন্ধ সেই চিঠির একটি ছোট্ট অংশ দিয়ে এই পর্বের আলোচনায় ইতি টানছি—
স্নেহের ভূপেন,
তোমার ২৫শে ফেব্রুয়ারী (১৯৬৬) তারিখের পত্রের উত্তর আমরা একত্রে দিতেছি। ‘সবার অলক্ষ্যে’ গ্রন্থের পাণ্ডলিপি আমরা যথাসময়ে আগাগোড়া পাঠ করিয়া ইতিহাস রচনার দায়িত্ব বহনের অংশ যে সমভাবে-ই আমরাও গ্রহণ করিয়াছি তাহা পত্রের প্রারম্ভেই বলিয়া রাখিতেছি।
আমাদের গুপ্তসমিতি স্বভাবতই চিরদিন গোপনে উহার কর্মক্ষেত্র রচনা করিয়াছে; কেবল মাঝেমাঝে উহার দুর্জয় আত্মপ্রকাশ সবার অগোচরে সংঘটিত হইয়াছে। ১৯০৮ সাল হইতে ১৯১৫ সালের পরিসরে এই দল ‘আত্মোন্নতি-সমিতি’র সঙ্গে সম্মিলিত হইয়া একবার আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল। তাহার বিবরণ ইতিহাসের ব্যক্ত-ঘটানা। ১৯০৮ সালের ‘নন্দলাল ব্যানার্জি হত্যা’, ১৯১২ সালে জগদ্দল জুটমিলের ইউরোপীয় ম্যানেজার ‘ওব্রায়েন্ হত্যার ষড়যন্ত্র’, ১৯১৪ সালের ২৬শে আগস্ট ‘রডা এ্যাক্শান’ এবং ১৯১৫ সনের ২৫শে আগস্ট ‘মুরারী মিত্র হত্যা’ –এই কয়েকটি ঘটনার সঙ্গেই আমাদের সংস্থা প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল। তাহার পর ১৯৩০ সাল হইতে প্রাক্ স্বাধীনতা পর্যন্ত বৈপ্লবিক-যুগের ইতিহাসে আমাদের সংস্থার ব্যক্ত অবদান দেশবাসীর অজানা নয়।
…………
‘মুক্তিসংঘ’-দলের ‘বিভি’ নামে পরিণতি এবং মুক্তিসংঘের সমাজসেবা ফ্রন্ট্ (ঢাকা শহরে)’শ্রীসংঘে’র গুপ্তসমিতি রূপে উত্তরকালীন পরিচিতির ইহাই ইতিহাস।
ইতি –
শ্রীহেমচন্দ্র ঘোষ, শ্রীরাজেন্দ্রকুমার গুহ, সুরেন্দ্র বর্দ্ধন, হরিদাস দত্ত, বিভূতিভূষণ বসু।
(৭-বি, নফরকুণ্ডু রোড,কলিকাতা—২৬, তারিখ ২৩.৩.১৯৬৬)
ভারতবর্ষের কংগ্রেস দল ও কমিউনিস্ট গোষ্ঠী কেউই সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসকে প্রকৃত সম্মান করেননি। স্বাধীনতার ২৫ বছরে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সরকার শ্রীহেমচন্দ্র ঘোষকে তাম্রফলক প্রদান করেন, কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অপেক্ষা করুন আগামী দিনে ‘বিভি’র ঐতিহাসিক দুঃসাহসিক সফল বিপ্লবী কার্যক্রমগুলির কথা জানতে।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি —
১। ‘স্বামী বিবেকানন্দ এবং ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রাম’ স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ (উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৮৮, ১২ জানুয়ারি)।
২) ‘দ্য সিপয় মিউটিনি এন্ড দ্য রিভোল্ট অফ ১৮৫৭’ – ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার, (ফার্মা কে এল মুখোপাধ্যায়, কলকাতা,১৯৫৭)।
৩) ‘সবার অলক্ষ্যে’ – শ্র্রী ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত-রায় (১৯৬৬, কলিকাতা)।
৪) ‘ভারতে সশস্ত্র-বিপ্লব’ – শ্রী ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত-রায় (রবীন্দ্র লাইব্রেরী, কলিকাতা,আষাঢ় ১৩৭৭।
৫) ‘অগ্নিযুগ’ -শ্র শৈলেশ দে সম্পাদনা (পূর্ণপ্রকাশন,কলকাতা ১৯৭৮)।
প্রত্নতত্ত্ববিদ, গবেষক ও সমাজকর্মী। । এবং বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের সক্রিয় কর্মী।
Comment here