আলিপুর সেশনস কোর্ট সবে তখন ফাঁসির সাজা শুনিয়েছে। কাঠগড়ায় দাঁড়ানো উল্লাসকর গেয়ে উঠেছিলেন, সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে। ফাঁসি অবশ্য হল না, তবে যা হল তার থেকে তা মন্দ কিছু ছিল না। হাতে পায়ে লোহার বেড়ি পরে কালাপানি যাত্রা। সেই আন্দামান, যেখানে পৌঁছে দেওয়ার কাজটা সহজে করত ব্রিটিশ পুলিশ কিন্তু ফিরে আসার উপায় ছিল না। সেলুলার জেলের অমানুষিক অত্যাচার, অদ্ভুত সব রোগ আর আবহাওয়া ভেঙে চুরে শেষ করে দিত লোহার মত সব শরীর। মনও।
স্বাধীনতার পর ভারত সরকার দায়িত্ব নিয়ে সেলুলার ভাঙার কাজে নেমেছিল। কে জানে, ইতিহাসের এত গুরুত্বপূর্ণ অংশ মুছে দেওয়ার কী তাড়া পড়েছিল তাদের। জানাজানি হওয়ার পর দেশবাসীর প্রতিবাদে পুরোটা ভাঙতে না পারলেও সেলুলারের সিংহভাগই এখন আর নেই। তাই কিছু বই ছাড়া জানার বিশেষ উপায় নেই, ঠিক কোথায় কীভাবে কাটত উল্লাসকরদের দিন রাত। জেলে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন তিনি, মাদ্রাজে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা চলে। কিন্তু পুরোপুরি সেরে ওঠা আর হল কোথায়। তাই সেলুলারে গলায় লোহার আংটা পরা ন্যাড়া মাথা যে তরুণের ছবি আমরা দেখি, তা আদৌ মেলে না তাঁর পরবর্তী ছবির সঙ্গে। গাল ভাঙা, দীপ্তিহীন চোখের ওই বৃদ্ধকে দেখে বড় কষ্ট হয় শুধু।
উল্লাসকর দত্ত। তাঁর আগে পরে, এখনও, এমন নাম আর কানে পৌঁছেছে কি? শুধু নাম যদি কোনও মানুষের চরিত্র তুলে ধরতে পারে, তা ছিল উল্লাসকরের নাম। তাঁর জীবন, জীবন যাপন, উন্মাদ রোগ, প্রেম, মৃত্যু- সব কিছুর মধ্যে ওই প্রবল জীবনের উল্লাস। জীবন তাঁকে খুব বেশি কিছু দেয়নি। কিন্তু বেঁচে থাকার আনন্দটুকু দিয়েছিল দুহাত ভরে। তাই শরীর ভেঙে যাওয়া বৃদ্ধ উল্লাসকর পৌঁছে গিয়েছিলেন একষট্টিতে শিলচর ভাষা আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারানো ১১ জনের মৃতদেহের সামনে, হাতে ছিল ফুলের তোড়া। এর ৪ বছর পর চলে গেলেন উল্লাসকরও।
জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কালীকচ্ছ গ্রামে। ডাকনাম পালু। বাবা দ্বিজদাস দত্ত বৈদিক শাস্ত্রে পণ্ডিত, আবার ইংল্যান্ড থেকে কৃষিবিজ্ঞান পড়ে এসেছিলেন, শিবপুর বিই কলেজে (তখন শিবপুর সিভিল ই়ঞ্জিনিয়ারিং কলেজ) অধ্যাপনা করতেন। রসায়নে আগ্রহ তৈরি হয় রুপোর চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো উল্লাসকরেরও। সেখান থেকে পিকরিক অ্যাসিডের বোমার রসায়ন শিক্ষা। অরবিন্দের ভবানী মন্দিরের আদর্শে মায়ের নামে তৈরি বোমা, কালী মায়ের বোমা। সেই বোমা পরীক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ হারালেন প্রফুল্ল চক্রবর্তী, আর উল্লাসের প্রাণ সংশয়। তার আগে অবশ্য তিনি ইংরেজ অধ্যাপককে জুতো মেরে কলেজ ছেড়ে চলে এসেছেন। নাম লিখিয়েছেন বারীন ঘোষদের দলে। বিপ্লবীদের জন্য কঠোর নিয়মের বিধিনিষেধ তৈরি করেছে অনুশীলন সমিতি কিন্তু সৃষ্টিছাড়া, লাগামছাড়া উল্লাস প্রেম করছেন। বিপিন পালের ছোট মেয়ে লীলা তাঁর বান্ধবী, তাঁর ইচ্ছে উল্লাস পড়াশোনা করুন, অধ্যাপক হোন। এফএ ফেল করা, প্রেসিডেন্সি কলেজে রাসেল সাহেবকে জুতো পেটা করা উল্লাস চলে এসেছেন মুম্বইয়ের ভিক্টোরিয়া টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। প্রেসিডেন্সিতে পড়েছে পোস্টার, হাউস টু লেট। অ্যাপ্লাই টু লর্ড কার্জন। জীবনটা এখান থেকে বদলে যেতে পারত। অধ্যাপক বাবার ছেলে অধ্যাপনা করতে পারতেন, ইঞ্জিনিয়ার হওয়াও বিচিত্র ছিল না। কিন্তু উল্লাসকর আর কবে মেনে চললেন ধরা বাঁধা ছক!
পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে ফিরে এলেন উল্লাস। শিবপুরের বাড়িতে বানিয়ে ফেলেছেন নিজের ল্যাবরেটরি। নাইট্রোগ্লিসারিন আর পিকরিক অ্যাসিড দিয়ে তৈরি হচ্ছে বোমা। আবার সেই বারীন ঘোষ, উপেন বাঁড়ুজ্যেদের দল। বোমা চাই, এমন বোমা যা রাজপুরুষকে মারতে পারবে, টলিয়ে দেবে ইংরেজ সাম্রাজ্য। শিবপুরের ল্যাবে তৈরি হল বোমা, মাইন, হাসিখুশি, অন্যের নকল করায় ওস্তাদ, এফএ ফেল উল্লাসের হাতে। ছোটলাট অ্যান্ড্রু ফ্রেজারকে ওড়াতে হবে, রেললাইনের ওপর পাতা হল তাঁর তৈরি মাইন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ছোটলাটের ট্রেন লাইনচ্যুত হল ঠিকই কিন্তু তার বেশি কিছু হল না। ফ্রেজারও অক্ষত রইলেন। তারপর দেওঘরের দিঘিরিয়া পাহাড়, বোমা পরীক্ষা হবে। ছোঁড়ার সময় একটু হিসেবের এদিক ওদিক, ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলেন প্রফুল্ল চক্রবর্তী। পাশেই দাঁড়ানো উল্লাসকর বেঁচে গেলেন ঠিকই, গুরুতর আহত হলেন।
এভাবেই নানা আঁকাবাঁকা পথে এগিয়েছে বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম হোতা উল্লাসকরের জীবন। যতটা প্রতিশ্রুতি নিয়ে জীবন শুরু করেছিলেন উল্লাস, ততটা পূর্ণতা পেল কই? তবে জীবনটাকে বরাবর অট্টহাসিতে উড়িয়ে দেওয়া উল্লাসকে এরপর আমরা দেখি মুরারিপুকুর লেনের বাগানবাড়িতে পুলিশের হাতে ধরা দিতে। ধরা দেওয়াই, কারণ পুলিশ যখন বাগানবাড়িতে ঢুকছে, উল্লাস তখন একটা আমগাছের নীচে শুয়ে। উঠে বসে দেখতে থাকেন সব কিছু। ইচ্ছে করলে তিনি পালাতে পারতেন, সেই সুযোগ তাঁর ছিল। কিন্তু সতীর্থদের গ্রেফতার হতে দেখে তিনি নিজেকে বাঁচাতে চাননি। “ভারতের বিপ্লব প্রচেষ্টা’ বইতে বিপ্লবী আন্দোলনের সেই প্রথম পর্যায়ের সীমাবদ্ধতা নগ্ন করেছিলেন হেমচন্দ্র দাশ। কিন্তু উল্লাসকর সম্পর্কে লিখেছিলেন, “..উল্লাসের মত এত সরল, মহৎ, কপটতার লেশমাত্রহীন, ভাবপ্রবণ যুবককে বৈপ্লবিক তাণ্ডবলীলার কর্ম্মী করা যে নিতান্ত হৃদয়হীনতার ও নির্ব্বুদ্ধিতার কায হ’য়েছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।” (বানান অপরিবর্তিত)
বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, পরবর্তী যুগের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে একেবারে প্রথম যুগের এই বিপ্লবীদের চরিত্রের কতটা তফাত ছিল। উল্লাসরা ছিলেন খোলামেলা, ধারণা ছিল, গোয়েন্দা পুলিশ তাঁদের কিছু করতে পারবে না, সাবধান হওয়ার কথা মাথায় রাখতেন না। বারীন তো পারলে লোক ডেকে ডেকে বলতেন বোমার কথা। ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিলেন হেমচন্দ্র। পুলিশ বাগানের দিকে নজর রাখছে জানতে পারার পর বোমা, বোমার খোল, রাসায়নিকে ভরা দুটো বাক্স উল্লাসকে গঙ্গায় ডুবিয়ে দিতে বলা হয়। উল্লাস সেগুলো রেখে আসেন হ্যারিসন স্ট্রিটে তাঁর দুই বন্ধু নগেন ও ধরণী গুপ্তর বাড়ি (সম্পর্কে এঁরা বিপ্লবী বাদল গুপ্তের কাকা)। বলেছিলেন, বই আছে। পুলিশি খানাতল্লাশিতে গ্রেফতার হন আদ্যন্ত নিরপরাধ নগেন-ধরণীও।
জেলে দিব্যি ছিলেন উল্লাস। হাসি, মজা, বারীন, উপেনের কথায় পুলিশে স্বীকারোক্তি দেওয়া। নগেন, ধরণী যে অপরাধী নন, তা তিনি বারবার বলেছিলেন। আবার ডেপুটি সুপারিনটেন্ডেন্ট রামসদয় মুখার্জির আশ্বাসবাণীতে ভুলে গিয়ে ফলাও করে এজাহার দিয়েছিলেন। মারধর, অত্যাচারের ভয়ে নয়, সেই ভয় তাঁর ছিলই না। আন্দামানে জেলার ব্যারি এই উল্লাসকেই তিরিশ ঘা চাবুকের ভয় দেখালে তিনি বলেছিলেন, আমায় কুপিয়ে কেটে মেরে ফেলার চেষ্টা করে দ্যাখো.. তবু আমার না-কে হ্যাঁ করাতে পারবে না। আমার নাম উল্লাসকর দত্ত।
এই সারল্য, কঠোরতা মিলেই গড়ে উঠছিল উল্লাসকরের চরিত্র। বিশ শতকের শুরুর উত্তাল বাংলায় যেন পথ ভুলে চলে এসেছিলেন তিনি। যে জীবন তাঁর প্রাপ্য ছিল, তা হয়তো কর্তব্যে দৃঢ়, ভাবালুতাহীন বিপ্লবী জীবন নয়।
এজাহারে শেষ রক্ষা হয়নি। আলিপুর আদালত বারীন, উল্লাসের ফাঁসির আদেশ দেয়। উল্লাস বিচারককে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, বেঁচে থাকার দায় থেকে বাঁচা গেল। যে ব্রিটিশ শাসন তিনি মানেন না, তার কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে বেঁকে বসেছিলেন। তারপর বাবা, মায়ের কথায় রাজি হন। তাতে ফাঁসি হল না, হয়ে গেল ২০ বছর কালাপানির সাজা। সেলুলারে পুলিশ, ওয়ার্ডেনদের নির্মম অত্যাচার, হাড়ভাঙা পরিশ্রম সহ্য করেও তিনি গলা ছেড়ে গান গেয়ে উঠতেন। মধ্য কুড়ির যুবকের গমগমে গলায় কেঁপে উঠত বোবা পাথর। তারপর একদিন উল্লাস ঠিক করলেন, তিনি আর কাজ করবেন না। ঠিক করা মানে ঠিক করা, তার আর নড়চড় নেই। তাঁকে বলা হল, ডাক্তারকে শরীর খারাপের কথা বলে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যেতে, না হলে কাজ করতেই হবে। কিন্তু তাঁর তো শরীর খারাপ হয়নি, শুধু অত্যাচারের ভয়ে মিথ্যে বলা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। আর অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাজ করলে আত্মার অসম্মান হবে।
শাস্তি হল। এক সপ্তাহের দাঁড়া হাতকড়ি। অর্থাৎ দুহাতে ওপর থেকে হাতকড়া পরিয়ে দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে রাখা। প্রথম দিনই প্রচণ্ড জ্বর এসে গেল এক সময় লোহার শরীর থাকা উল্লাসের। কে আর সে খবর রাখবে। প্রহরী যখন দেখতে পায়, তখন সেই অবস্থাতেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন তিনি। তারপর বদ্ধ উন্মাদ। জেলের হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে দেওয়া হচ্ছে ইলেক্ট্রিক শক। পাঠানো হল মাদ্রাজে, মানসিক চিকিৎসালয়ে। তখনকার মানসিক অবস্থার কথা তিনি বিশদে লিখেছেন আত্মজীবনীতে।
এত কিছুর মধ্যেও উল্লাস কিন্তু ভোলেননি তাঁর লীলার কথা। তাঁকে দেখতে পেতেন তিনি, কথাবার্তা বলতেন। খবর রেখেছেন, লীলা ইংল্যান্ডে গেছেন পড়াশোনা করতে। দেশে ফিরে এসেছেন, চাকরি করছেন কৃষি বিভাগে। উল্লাসের জীবন এক জায়গায় থমকে গেলেও লীলা এগিয়ে চলেছেন নিজের ছন্দে। এদিকে বাংলায় ফিরেছেন উল্লাসও। কিছুদিন অন্তরীণ দশা কাটিয়েছেন। লীলার কাছে আর যাননি, কলকাতা থেকে সোজা সাইকেলে চলে গিয়েছেন পণ্ডিচেরী। তাঁর বিপ্লব জীবনের গুরু অরবিন্দ ঘোষকে ফিরিয়ে আনতে। অরবিন্দের জীবন বদলে গিয়েছে পুরোপুরি, বাংলার বিপ্লববাদের জনক তখন আধ্যাত্মিক গুরু। কিন্তু উল্লাস তা শুনবেন না কিছুতেই। তাঁর এক কথা, অরবিন্দ এখানে থাকবেন কেন।
অথচ সব বাধা পেরিয়ে অরবিন্দের সঙ্গে দেখা হলেও তাঁকে কিছুই বলতে পারলেন না উল্লাসকর। একটা কথাও না বলে চলে এলেন কলকাতা।
হ্যারিসন রোডে ঘিয়ের দোকান দিয়েছেন উল্লাস। যথাসর্বস্ব চুরি হয়ে গেছে। তাঁর ঠাঁই হয়েছে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের সিঁড়ির নীচে। দ্বিজদাস দত্তের ছেলের বিছানা তখন মড়ার খাটিয়া, টিনের কৌটো জলের গ্লাস। এর মধ্যে খবর এসেছে, লীলা বিয়ে করেছেন। রয়েছেন বোম্বাইতে, তাঁর ভাই নিরঞ্জনের বাড়ি। প্রথম যৌবনের প্রেমিকার প্রতিটি চিঠি গুছিয়ে রাখা উল্লাসকর আগুনের মত জ্বলে উঠেছেন, চলে গিয়েছেন বোম্বাই, বহু বছর আগে যে শহরে তিনি পড়তে এসেছিলেন। লীলার কাছে গিয়ে তাঁর সামনে পুড়িয়েছেন সবকটা চিঠি। তারপর ধুতির খুঁটে পোড়া চিঠির ছাই বেঁধে আবার ফিরে আসা।
বাজ পড়ে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে এক সময়ের তরুণ সতেজ বটগাছ। ভারতীয় বিপ্লব আন্দোলনের ইতিহাসে চিরজীবী হয়ে রয়েছেন উল্লাসকর, বদলে তিনি কী দিয়েছেন তার হিসেব রয়ে গিয়েছে তাঁর গোটা জীবন জুড়ে।
দুই খণ্ড হয়ে গিয়ে স্বাধীন হয়েছে দেশ। উল্লাসের ব্রাহ্মণবাড়িয়া এখন বিদেশ। শিয়ালদহ স্টেশনে শরণার্থীদের ভিড়, ঘুরে ঘুরে দেখেন উল্লাস। ভাবেন, কসমস ভলান্টিয়ার্স নামে সংগঠন তৈরি করবেন, কাজ হবে শরণার্থীদের সাহায্য করা। কিন্তু শরীর যে ভেঙে পড়েছে। জেলের প্রচণ্ড পরিশ্রম, ইলেক্ট্রিক শকের মূল্য দিচ্ছেন উল্লাস। মাঝে মধ্যেই হয় প্রচণ্ড খিঁচুনি, ফেনা উঠতে থাকে মুখ থেকে। এরই মধ্যে খবর পেলেন, লীলা গুরুতর অসুস্থ। বিধবা হয়েছেন, বাতে পঙ্গু হয়ে ভর্তি রয়েছেন পিজি হাসপাতালে। চলে গিয়েছে চাকরিও। হাজির হলেন উল্লাস। রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করলেন তাঁর মানসপ্রতিমাকে।
মধ্য ষাটের পঙ্গু স্ত্রীকে নিয়ে শুরু হয় উল্লাসের বিবাহিত জীবন। যেখান থেকে যা পেতেন নিয়ে আসতেন স্ত্রীর জন্য। যেখানে যেতেন বুকে করে নিয়ে যেতেন তাঁকে। বিয়ের পর ব্রাহ্ম সমাজের সিঁড়ির তলা ছেড়ে দিতে হয়, বন্ধুরা দেখে দেন ভাড়া বাড়ি। কিন্তু ভাড়া মেটানোর, সংসার চালানোর সামর্থ্য কই। বিধান রায় স্বাধীনতা সংগ্রামীর পেনশনের ব্যবস্থা করতে চাইলেও উল্লাস পরিষ্কার বলে দেন, যে সরকার দেশভাগ করেছে তার থেকে এক পয়সাও চাই না তাঁর। তাঁর স্ত্রী যদি এই টাকা নেন তবে তাঁকে তিনি ডিভোর্স দেবেন। বাধ্য হয়ে বারীনরা তাঁর অজ্ঞাতে তাঁর জন্য সরকারি অর্থের ব্যবস্থা করেন। নিজেরাই সই করে তাঁর হয়ে টাকা নিতেন তাঁরা। বিধান রায় তাঁর জন্য হাওড়া লাইনে বাসের পারমিটের ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু উল্লাস তাতেও রাজি হননি।
কয়েক বছর এভাবেই ভেসে বেড়ানোর পর লীলাকে নিয়ে শিলচর চলে যান উল্লাস। ভাষা আন্দোলনে উত্তাল শিলচরে ১১ জন শহিদের দেহের সামনে তাঁকে দেখা যায় ফুলের তোড়া হাতে। যে আগুন, যে অস্থিরতা একদিন পরাধীন দেশে তাঁকে ঘরছাড়া করেছিল, তারই স্ফুলিঙ্গ কি তিনি দেখতে পেয়েছিলেন স্বাধীন ভারতের কমলা ভট্টাচার্য, বীরেন্দ্র সূত্রধরদের মধ্যে?
এর পরের বছর লীলা মারা যান। উল্লাস অবশ্য তা বিশ্বাস করতেন না, স্ত্রীর জন্য দরজা খোলা রাখতেন, খাবারের ভাগ রাখতেন। যদি সে এসে পড়ে? ৩ বছর পর মারা যান উল্লাসও।
যে প্রবল জীবনীশক্তি, তুখোড় মেধা আর আকাশের মত হৃদয় তাঁকে বিপ্লবের যূপকাঠে উত্সর্গ করেছিল, তারই হয়তো আর এক নাম প্রেম। নিজের জীবন নিংড়ে বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে এক প্রেমের কাহিনী লিখেছিলেন উল্লাসকর। দেশমাতার ছবি মিলে মিশে গিয়েছিল তাঁর প্রেমিকার মুখে। তাই উল্লাসকর দত্তের জীবন যেন কখনও শেষ না হওয়া এক ভালবাসার গল্প।
এত যন্ত্রণা, এত বঞ্চনা, এত বিশ্বাসঘাতকতা, এমন অগাধ ভালবাসা কোথায় ঠাঁই পেত, যদি উল্লাসকর না থাকতেন?
পেশাগত অবস্থানে সুবর্ণলতা হলেন একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ নারী সাংবাদিক।
Comment here