(পূর্বের অংশের পর)
– শ্রী অলোক ভট্টাচার্য
অজিত সান্যাল -অবন্তী কুমারের ভাই ও সুলেখার দাদা বিখ্যাত নৃত্যবিদ বুলবুল চৌধুরী দলের নর্তক রূপে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কলা প্রদর্শন করে খ্যাতি অর্জন করেন। বুলবুল চৌধুরীর মৃত্যুর পর ঢাকাতে বিএএফএ বুলবুল academy of ফাইন আর্টস এর পরিচালনার ভার সামলেছেন। তাঁর লেখা ‘দুই দেশ দুই মন’। পরবর্তীতে বর্ধমানবাসী হন এবং সেখানেই তাঁর দেহান্তর হয়। এছাড়াও কড়োকদির অনেক মানুষ আইন অধ্যাপনা চিকিৎসা বিদ্যা প্রযুক্তিবিদ্যা ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি পেশাতে যুক্ত হয়ে বাংলা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে গিয়েছিলেন তাদের বংশধরদের খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। একজনের পরিবারের খবর জানা ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন নলিনী মোহন লাহিড়ী। কাবুলে ও নেপালের গঠনে তার অবদান ছিল। তার পুত্রের কথা পরে আসবে। 2010-এ কোড়কদী ফরিদপুর শহরের প্রথম নাটকের সমাবেশে উপস্থিত ছিলেনর জনৈক্য সান্যাল আইনজীবী। আমাদের গ্রামের থিয়েটার হল টাও ছিল সান্যাল পাড়াতে যার প্রতিষ্ঠাতা এই আইনজী সান্যাল অবদান ছিল।
প্রখ্যাত নাটক ও যাত্রাভিনেতা ছিলেন করুক ওদের ছেলে তার ভ্রাতুষ্পুত্র ইন্দ্র লাহিড়ী একসময় নায়ক হিসেবে যাত্রা জগত কাঁপিয়েছেন| তিনি জীবিত কিন্তু ঠিকানা পাচ্ছিলাম না সম্প্রতি জেনেছি তিনি আর নেই। আমার মায়ের নাম মৃদুলা ভট্টাচার্য এই লাহিড়ী পরিবারেরই কন্যা ছিলেন। দীপান্বিতা রায় ভট্টাচার্য এর মূল শিকড়ড় কোড়করী তার স্বামী তরুণ রায় বিখ্যাত অভিনেতা নির্দেশক লেখক ধনঞ্জয় বৈরাগী ছদ্মনামে। এঁদের পুত্র অভিনেতা দেবরাজ রায়। দীপান্বিতার অভিনয় দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তিনি সম্পর্কে আমার জানছিলেন প্রীতি ব্যানার্জি লাহিড়ী আই.বিডি এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন জন্ম কড়কোদীতে, বিখ্যাত অভিনেতা কালি ব্যানার্জীর স্ত্রী প্রয়াত। কোড়কোদী সমাবেশে তাদের কন্যা হাজির হয়েছিলেন।
আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে হয়তো রক্ষণশীল সামন্ত সভ্যতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালো কোড়কোদীর কিছু দামাল ছেলেরা। কি করে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল ছোট কলকাতা, সেটা না শুনিয়ে কি করে শেষ করি
কোড়কদীর স্বর্ণযুগ বিংশ শতাব্দীর প্রায় মধ্যভাগ পর্যন্ত। অর্থনৈতিক ঘুণ প্রকার আক্রমণ কিন্তু শুরু হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে শরিক সংখ্যা। শুধু কৃষির উপর নির্ভর করে বেশি দিন চলবে না -শিক্ষিত ছেলেরা সেটি হৃদয়ঙ্গম করে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল বিভিন্ন স্থানে চাকুরীজীবী হয়ে। কোড়কোদীর ছেলেদের বেকার থাকতে হয়নি সে আমলে। বেশিরভাগই কলকাতা ও তার আশেপাশে; বাংলার বাইরেও। কিন্তু এর প্রভাব বাইরে থেকে বোঝা যায়নি কারণ এই নব্য চাকুরীরা সপ্তাহান্তে অধিকাংশই বাড়ি আসতেন শিয়ালদা থেকে গেদে, দর্শনা হয় কালুখালী জংশন। সেখানে অপেক্ষারত ভাটিয়াপাড়া লোকালে মধুখালি।
যা সময় লাগতো তখন তেমনি সময় লাগতো বহরমপুর পৌঁছতে; তারপর একই গ্রামের যুবক যাত্রীদল সোমবার ভোরে রওনা হ’য়ে সোজা কর্মস্থলে। দূরত্ব অনুযায়ী কেউ কেউ মাসান্তে আসতেন। তবে যেখানেই থাকুন দুর্গা পুজোতে সবাই বাড়িতে। এদের স্ত্রী সন্তানেরা গ্রামেই থাকতেন। শিকড়ছাড়া হননি। ত্রিশের দশকে চাকরিস্থল যাদের অন্যান্য প্রদেশে হতে লাগলো তারা ধীরে ধীরে সপরিবারে সেখানে থাকতে শুরু করল। নির্ভরশীল সদস্যরা বাড়িতেই থাকতেন। তার মাঝেও দু একটি বাড়ি আমিও দেখেছি। অর্ধ বিধ্বস্ত অবস্থাতে খালি পড়ে থাকতে। সেখানে কাউকে থাকতে দেখেছি বলে মনে হয় না। তারা বহু কাল আগে বাড়িঘর ছেড়ে কোথায় কেন চলে গিয়েছিলেন সেটা অজানাই থেকে গেছে এবং তারা আমাদেরই পূর্বপুরুষদের কেউ।
প্রথিতযশা অনেকের জন্ম এখানে। প্রথম যার নাম তার তিনি হলেন রামধন ভট্টাচার্য। তাঁর ও অন্য পন্ডিতদের শিক্ষানুরাগ অনুশাসন শৃঙ্খলা ও সামাজিক পরিবেশের উপর যে কর্তৃত্ব ছিল সেটাই ছিল গ্রামটির শিক্ষা সংস্কৃতির জন্মবীজ।তার দাদা রাম জগন্নাথ ছিলেন স্বল্পবাক। লোকে বলত কলির শিব ঠাকুর। গ্রামের ও আশেপাশের গ্রামে কারো বাড়িতে প্রথম শিশুর জন্ম হলে তাকে দেখিয়ে নিয়ে যেত; কোন গাছের প্রথম বছরের ফল বা সবজি তাকে দিয়ে তবে নিজেরা খেত।
আমি নিজেও ছোটবেলায় এটি দেখেছি, প্রথম ফল আমার মায়ের কাছে লুকিয়ে দিয়ে যেতে বাবা থাকলে বকুনি দিয়ে ফিরিয়ে দেবেন – সেই ভয়ে। বিশ্বাস না অন্ধবিশ্বাস জানিনা। কিন্তু আমরাই তার অধস্তনপুরুষদের মধ্যে তখনও সেখানে বাস করতাম।
এই অভ্যাসটি স্থানীয় মুসলমান পরিবারেও অনেককে বজায় রাখতে দেখেছি।
গ্রামে অতিথি- অসময়ে না জানিয়ে অতিথি আসা দৈনন্দিন ব্যাপার ছিল। অতগুলি পরিবারের অত আত্মীয়-স্বজনের আশা স্বাভাবিক ছিল। অতিথি আগমনের পর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তার মধ্যাহ্ন ভোজের ব্যবস্থা হতো যা অতিথিদের বিস্মিত করত। সামান্য সময়ে গৃহবধূরা এত পদের রান্না করলেন কি করে নাকি এ বাড়ির মানুষের দৈনন্দিন খাওয়া এমনই রাজসিক, নাকি সবটাই ভোজবাজী- এটা ছিল আলোচ্য। আসলে নিয়ম ছিল কারো বাড়িতে অতিথি এলে সে খবরটি আশেপাশের বাড়িতে সংখ্যা সহ জানিয়ে দিতে হবে সেই অনুযায়ী বিভিন্ন বাড়ি থেকে সেদিনের রান্নার ভালো
ভালো পদগুলির অংশ পিছনের দরজা দিয়ে আপ্যায়ন কারীর হেসে ঢুকে যেত কারণ অতিথি গ্রামের,সূতরাং সম্মানও গ্রামের।
(ক্রমশঃ)
Comment here