বিজ্ঞানবিপন্নতার মানব মুখ

জৈবিক মারণাস্ত্র –

বর্তমান পৃথিবীতে করোনা ভাইরাসের কারণে সারা মানবসমাজ ত্রস্ত। লক্ষ্য করার বিষয় এই যে এই ভাইরাসের প্রসার খুবই সন্দেহজনক। এই ভাইরাস যে দেশে প্রসারলাভ করেছে তার পুরো ভূগোলকেই সে তার বিস্তারভূমি তৈরী করেছে। কিন্তু সন্দেহের বিষয় এই যে ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনের হুবেই প্রদেশে এর প্রসার অতি অল্প ও যেখানে প্রায় গোটা ইউরোপ, আমেরিকা, ও ভারতের প্রধান প্রধান শহর ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলি আক্রান্ত সেখানে চীনের প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলিতে আক্রান্তের সংখ্যা খুবই কম। তাহলে কি চীন ইচ্ছা করেই এই মারণরোগ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়েছে ? এরপরের আলোচনা এই প্রসঙ্গেই হবে।

জৈবিক মারণাস্ত্র- কী ও কেন ?

বর্তমানে আমরা একটি কথার ব্যবহার খুবই দেখতে পাই। সেটি হলো “Weapons of Mass Destruction”। বাংলায় যাকে বলে গণবিধ্বংসী অস্ত্র। এই অস্ত্রগুলি খুব অল্প সময়ের মধ্যে এক বিরাট জনসংখ্যাকে খতম করে দিতে পারে। এর তিনটি প্রকার – আণবিক, রাসায়নিক ও জৈবিক। আণবিক মারণাস্ত্রের ব্যবহার ও জাপানে তার বীভৎস রূপ নিয়ে আর বলার দরকার নেই। রাসায়নিক মারণাস্ত্রের ব্যবহারও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুমুলভাবে হয়েছিল । এর আরো ব্যবহার আমেরিকা দ্বারা ভিয়েতনামে এবং গত শতাব্দীর শেষে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন দ্বারা কুর্দদের ওপর আমরা দেখেছি। কিন্তু জৈবিক মারণাস্ত্র- তার ব্যবহার কি আমরা দেখেছি ? উত্তর এটাই যে রাসায়নিক ও আণবিক মারণাস্ত্রের থেকে জৈবিক মারণাস্ত্রের ব্যবহার পৃথিবীতে আরো অনেক বেশিবার হয়েছে বিভিন্ন দেশ ও সাম্রাজ্যের দ্বারা।

বলে রাখা দরকার- কোনো মহামারীর প্রসার ইচ্ছে করে ঘটানো একটি জীবাণুর দ্বারা, তাও একটি বিশেষ জনজাতিকে লক্ষ্য করে: এই জীবাণুর নাম জৈবিক মারণাস্ত্র। মহামারীর মূলে হল জীবাণু যেমন Bacteria, Virus, Fungi, ইত্যাদি। অর্থাৎ bacteria বা virus জৈবিক মারণাস্ত্র তখনই যখন কোনো একটি দেশ তার প্রসার ঘটাবে শুধুমাত্র অন্য একটি দেশকে লক্ষ্য করে। এতে অস্ত্র প্রয়োগকারী দেশটি খুবই কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু যে দেশের ওপর এটি প্রয়োগ করা হল তার উপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। এরপর জৈবিক মারণাস্ত্র প্রয়োগকারী দেশটি একটি সৈন্য আক্রমণ করবে অন্য দেশটির ওপর যাতে মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশটির হার নিশ্চিত, বা তার সমস্ত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলি একে একে কিনে নেবে ও তার খনিজপদার্থ ও কৃষির ওপর আধিপত্য কায়েম করবে। মনে করা যাক আমি ‘ক’ বলে একটি দেশের লোক। ‘খ’ দেশের সাথে আমার খুব শত্রুতা। ক দেশ থেকে আমায় পাঠানো হল একটি মারণ ভাইরাসের asymptomatic carrier হিসেবে। এক্ষেত্রে এই মরণ ভাইরাসটি ছড়ায় হাঁচি ও কাশির মাধ্যমে। ভাইরাসটি শরীরের দখল নিলে অনেক সময়ই মৃত্যুই হয় পরিণাম। আমি ভ্রমণের অজুহাতে খ দেশে এসে সেখানকার নানা শহরে ঘুরে বেড়ালাম – হাঁচলাম, কাশলাম- কেউ দেখতে এলো না। ফল কি হল ? একা আমি পুরো শহরটাকে শেষ করে ফেললাম। এখানে ক দেশের কোনো দায়িত্ব রইলো না এবং খ দেশের গোয়েন্দা বিভাগ ব্যাপারটা সম্পর্কে ভালোভাবে জানার আগে সে দেশের ২৫ শতাংশ জনসংখ্যা লোপ পেয়ে গেল। এই হল জৈবিক মারণাস্ত্র প্রয়োগের ফল।

জৈবিক মারণাস্ত্র প্রয়োগের ইতিহাস: –

১) রোমান ও গ্রিকদের লড়াইয়ে আমরা প্রচুর এমন উদাহরণ দেখতে পাই যেখানে এক পক্ষ তীরের ফলায় মারাত্মক বিষ মাখিয়ে ছুঁড়ছে বা এক পক্ষ অন্যজনের কুয়ো বা পুকুর বিষাক্ত করছে।
২) ১১৫২ সালে ফ্রেডেরিক বারবারোসা হলেন সমস্ত জার্মানির কর্ণধার। তার প্রবল ইচ্ছা পোপ তাঁকে ‘পবিত্র রোমান সম্রাট’ হিসেবে ভূষিত করেন। তাই তিনি ইতালি দখল করতে চললেন একগাদা সৈন্যসামন্ত নিয়ে। এক্ষেত্রে বলা হয় যে ইতালির টরটোনা (Tortona) শহর দখল করার জন্য তিনি আশেপাশের সমস্ত কুয়োতে, যেখান থেকে শহরের অধিবাসীরা জল আনত, সেগুলিতে লাশ ফেলে বিষাক্ত করে তুলেছিলেন। এর ফল কি হয়েছিল আমরা জানিনা।
৩) এবার আসা যাক ইউরোপের ‘Black Death’ এর কথায়। এই ভয়াবহ মহামারীতে ইউরোপের এক-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা মারা যায়। এর স্মৃতি বংশপরম্পরায় প্রত্যেক ইউরোপীয়ের মধ্যে আজও বর্তমান।এই ‘Black Death’ নিয়ে প্রচুর বই ও সিনেমা পরবর্তীকালে আমরা পাই।
‘Black Death’ – এর কারণ ছিল বিউবোনিক প্লেগ (bubonic plague) । যার মুলে আছে bacteria ‘Yersenia Pestis’ । এই জীবাণুর মূল নিবাস হোলো ইঁদুরে। Rodent Flea নামক একপ্রকার মাছি যখন ইঁদুরের চামড়া থেকে রক্ত শোষে তখন Yersenia pestis সেই রক্তের মাধ্যমে মাছির শরীরে প্রবেশ করে। Rodent Flea সেই Yersenia pestisকে আবার মানুষের শরীরে প্রবেশ করায় যখন সে মানুষকে কামড়ায়। ফলে জ্বর, তীব্র মাথাব্যথা ও অবশেষে মৃত্যু সাতদিনের মধ্যে। মৃত্যুর হার ৮০ শতাংশ। খুব নোংরা জায়গায় যেখানে ইঁদুরের সংখ্যা বেশি সেখানেই এই রোগ ছড়ায়।

আশ্চর্য লাগবে এই তথ্য শুনতে যে এই ‘Black Death’ ছিল একপ্রকার জৈবিক মারণাস্ত্র প্রয়োগের ফল। চতুর্দশ শতাব্দীতে এই ‘Black Death’- এর আবির্ভাব হয়। মূলত ১৩৪৬-১৩৫১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। ১৩৪৬ সালে মোঙ্গলদের হাতে পুরো চীন, প্রায় পুরো রাশিয়া, তুর্কী, আরব দেশগুলি, ও ইরান এসে গিয়েছিল। তারা ঠিক করল ইউরোপ আক্রমণ করবে। আর ঠিক তখনই মোঙ্গলদের সেনাদের মধ্যেও এই প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। তবে মোঙ্গলদের মাথায় বুদ্ধি ছিল ! তারা তখন ক্রাইমিয়ার কাফা (Caffa) বন্দর দখল করার তালে। তারা তখন catapault-এর পাথরে প্লেগে মৃত সৈনিকদের লাশ বেঁধে শহরে ছুড়তে লাগল। কাফাতে প্লেগ আরম্ভ হল এবং কাতারে কাতারে মানুষ মরতে লাগল। শহরের অধিবাসীরা, যাদের মধ্যে অনেকেই প্লেগে ভুগছিল তারা পালাতে আরম্ভ করল জাহাজে চেপে ইতালির বন্দরগুলিতে। মধ্যযুগের জাহাজগুলি ছিল ইঁদুরের আখড়া। আর শহরগুলিও খোলা নর্দমায় ভরা আর বীভৎস রকমের জঞ্জালে ভর্তি। ইউরোপ হয়ে উঠল মৃত্যুপুরী। প্রথম ব্যাপকভাবে জৈবিক মারণাস্ত্রের প্রয়োগ এতেই দেখা যায়।

৪) এরপর ইউরোপিয়ানরা হয়ে উঠল মোঙ্গলদের যোগ্য শিষ্য। কিন্তু একটা পার্থক্য ছিল। মঙ্গোলরা প্রায় সব জায়গায় খোলাখুলি যুদ্ধ জিতলেও ইউরোপিয়ানরা কোনো জায়গাতেই খোলাখুলি যুদ্ধ জেতেনি। জিতেছিল এক পক্ষকে অন্য পক্ষের সাথে লড়িয়ে, ছলচাতুরী দিয়ে। নৃশংসতায় তারা ‘দ্বিতীয় মোঙ্গল‘ উপাধি খুব সহজেই পেতে পারত। ১৫২০-র দশকে কর্টেজ নামে এক স্পেনীয় শয়তান মধ্য আমেরিকাতে ‘খ্রীষ্টীয় সাম্রাজ্য’ গড়ার লক্ষ্যে এজটেক সাম্রাজ্য আক্রমণ করে। সম্রাট মন্টেজুমাকে হত্যা করা হয়। কিন্তু এতে শেষরক্ষা হল না। এজটেকদের রাজধানী টেনোকটিটলান (Tenochtitlan) স্পেনীয়রা দখল করল। যদিও স্পেনীয়দের বন্দুক ও কামান ছিল কিন্তু এজটেকরা সেখান থেকে তাদের মেরে তাড়ালো। কর্টেজ পালাল। এরপরেই অতি অদ্ভূতভাবে এজটেকদের মধ্যে small pox -এর আবির্ভাব ঘটে। বিপুল সংখ্যক এজটেক এতে মারা গেল। স্প্যানিশরা, যারা এজটেকদের তারা খেয়ে পালিয়েছিল তারা আবার ফিরে এল। এসে বাকি এজটেকদের মেরে কেটে শেষ করল। স্পেনীয়রা কিন্তু small pox -এ ক্ষতিগ্রস্ত হল না। কারণ তখনকার ইউরোপ ছিল রোগের আঁতুড়ঘর। প্রতিটি স্পেনীয় যোদ্ধারই ছোটবেলায় small pox হওয়াতে তাদের মধ্যে acquired immunity এসে যায়। আর small pox-এর চিকিৎসাও তাদের জানা ছিল। একথা পরিষ্কার যে স্পেনীয়দের থেকে এজটেকদের শরীরে small pox virus-এর প্রবেশ ঘটে। কিন্তু তা কি ইচ্ছাকৃত ? হতেই পারে। পরবর্তীকালে ইনকা সাম্রাজ্যের পতনও একই কারণে ঘটে। ইনকারা যখন স্পেনীয়দের সাথে যুদ্ধরত তখন ইনকাদের শরীরেও small pox দেখা যায়। ইনকা সম্রাট ও তার বংশধরেরা এতে লুপ্ত হয়। ফলে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা স্পেনের উপনিবেশে পরিণত হয়।

৫) একইভাবে ১৭৬৩ সালে ইংরেজরা উত্তর আমেরিকাতে small pox virus -এ ভরা কম্বল রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যে বিলি করে। ফলে উত্তর আমেরিকার মূল নিবাসী রেড ইন্ডিয়ানরা অধিকাংশই তাতে মারা পড়ে। বলা বাহুল্য ইংরেজরা এখানেও খোলাখুলি যুদ্ধে জিততে পারছিল না। এর প্রমাণ পাওয়া যায় লর্ড জেফ্রি আমহার্স্টের লেখা এক চিঠিতে। যেখানে তিনি খোলাখুলিভাবে small pox virus এ ভরা কম্বল রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যে বিলি করার আদেশ দিচ্ছেন।

৬) নেপোলিয়ানের সৈন্যরা নেপোলিয়ানের আদেশে ইতালি দখল করার সময় ইচ্ছাকৃতভাবে ম্যালেরিয়ার আবির্ভাব ঘটানোর জন্য মান্টুয়া (Mantua) সংলগ্ন অঞ্চলকে বন্যায় ভাসিয়ে দেন।

৭) আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় Confederate সৈন্যদল Uninonist সৈন্যদলের মধ্যে small pox ও yellow fever virus এ ভরা কম্বল বিলি করে।
আমার এই অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধের মধ্যে দিয়ে আশা করি যে পাঠকরা বুঝতে পারবেন যে জৈবিক মারণাস্ত্র ব্যাপারটি একেবারেই আধুনিক নয়। তা অনেক অস্ত্রের মতোই অতি প্রাচীন। ও এই ব্যাপারে সচেতন হয়ে ভবিষ্যতে এর প্রয়োগ যাতে না হয় তার জন্য যা যা কর্তব্য তা পালন করা উচিত।

 

লেখক- প্রতাপচন্দ্র , সদ্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জৈব-রসায়নে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রাপ্ত।

Comment here