অতীত যা লেখেনি

বাংলা চলচ্চিত্রের গন্ধর্বকন্যা – ললিতা

(গত পর্বের লিঙ্ক)

এল নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানের দিন। এর মধ্যে আমি একটা কাজ করেছিলাম।তখন সবে রিলিজ করেছে গৌতম ঘোষের ‘শূন্য অঙ্ক’। ললিতা দি’র একটা মেজর রোল আছে ছবিটাতে।বোধ হয় এক জঙ্গীর মা -এরকম একটা চরিত্র সৌমিত্র চ্যাটার্জির বিপরীতে। আমি সেই ছবিটা দেখে নিয়েছিলাম,যাতে বহুদিন পর অভিনয়ে ফেরা নায়িকাকে ‘লাইভ’ অনুষ্ঠানে প্রশ্ন করতে সুবিধা হয়।ছবিটা নিয়ে যত কম শব্দখরচ করা যায়, আমার এবং পাঠকের এবং চলচ্চিত্র মাধ্যমের ততটাই মঙ্গল; কারণ, এত্ত খারাপ ছবি খুব কমই নির্মিত হয়েছে; কিন্তু প্রাপ্তি ছিল একটাই,ললিতা দি’র অসামান্য একটা শেক্সপীয়ার রেসিটেশন। ম্যাকবেথ থেকে বোধ হয়। ওঁকে ব’লেছিলাম ঐ ডায়লগ দিয়েই অনুষ্ঠানটা শুরু করতে।

প্রোগ্রামের দিন এলেন উনি একটা গাঢ় ম্যাজেন্টা আর ঘিয়ে রঙের থ্রি কোয়ার্টার হাতা স্যাটিনের পাটিয়ালা সালোয়ার প’রে। হাল্কা বাদামী ছোঁয়া চুল চূড়ো ক’রে বাঁধা।সুগন্ধে ভ’রে উঠল আকাশবাণী স্টুডিও চত্বর। সবই ঠিক আছে,কিন্তু তবু কোথাও যেন একটা এলোমেলো ভাব, যা বাকি সবার চোখ এড়িয়ে যায় তাঁর উজ্জ্বল সোনার মত রং,উচ্চতা আর পড়ন্ত বেলার গ্ল্যামারেও।আলো ক’রে তিনি এলেন,সইসাবুদ সারতে সারতেই মোটামুটি ভিড় জমে গেছে দেখলাম। ডিউটি রুমে সেদিন আমাদের (বর্তমানে গত) এক সিনিয়র দিদি। বয়সকালে তিনিও সৌন্দর্য আর শিক্ষার মিশেলে অদ্ভুত আকর্ষণীয়া ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ললিতা দি’র একটা পরিচিতের হাসি বিনিময় হল ম’নে হল। সেই ডিউটি অফিসার দিদি ইশারায় আমায় বললেন, ‘গেস্টকে স্টুডিওতে বসিয়ে দিয়ে যেন একবার দেখা ক’রে যাই।

স্টুডিওতে পৌঁছে দিয়ে ডিউটি রুমে ফিরতেই দেখলাম তাঁকে ঘিরে উৎসুক সবাই। আমি যেতেই বললেন, ‘বাব্বা, তুমি গেস্ট আজ এঁকে এনেছ!!’ তারপর অন্যদের দিকে ফিরে বললেন,’উফফ,আমাদের ত জানলা খুলতেই দেওয়া হত না’ – আমি বুঝতে পারলাম,গল্প অনেকটা এগিয়ে গেছে। বললাম, ‘ঘটনাটা কি?’
তিনি আমার দিকে ফিরে বললেন,
‘আমাদের বাড়ীর ঠিক পিছনেই ছিল এদের বাড়ী। এদের সবকটা বোনই,
যেমন দেখতে,তেমনই…’ উহ্য থাকলেও, ঠিক অব্যবহিত পরেই পাহাড়ি ভটচায্যির উল্লেখে বুঝলাম কি মিন করতে চাইছেন।
‘তাই আমাদের ওদের বাড়ীর দিকের জানলা খোলা বারণ ছিল। তবে , ওদের বাবা কিন্তু ছিলেন খুব অন্যরকম মানুষ’।
আমি ফিরে গেলাম স্টুডিওতে। শেক্সপিয়ার দিয়েই শুরু করলেন। তারপর একে একে তাঁর ছেলেবেলার কথা পেরিয়েই এল ১৭ বছর বয়সে উত্তমকে ‘শ্যামলী ‘ ছবির সেটে দেখার কথা। ছোটবেলাকার বন্ধু,পরবর্তীকালে ভ্রাতৃবধূ কাবেরী বসুর সঙ্গে শ্যুটিং দেখতে যাওয়া, আর সেখানেই উত্তম এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুমি অভিনয় করতে চাও?’… ধীরে কথা বলছিলেন ললিতা দি; তাঁকে এত কাছে পেয়ে আমার আজন্মপ্রিয় কাবেরী বসুর কথা শোনার লোভ সামলাতে পারছিলাম না। বললেন, ‘দেবী মালিনী’ করার সময়ে আমাদের বাড়ির সঙ্গে ওর প্রথম যোগাযোগ। আমার বাবা ওর নাচে মুগ্ধ হ’য়ে ব’লেছিলেন, ‘এর মধ্যে স্বয়ং মা সরস্বতীর অধিষ্ঠান।’…
লাইভ অনুষ্ঠান চলছে। যে গতিতে চলা উচিত,অবশ্যই সে গতি থমকাচ্ছিল বারবার।ললিতা দি ধীরে কথা বলছিলেন।হঠাৎই একটু উচ্চকিত হয়ে ব’লে উঠলেন,
– ‘বিভাসে, জানো তো,আমি একটুও অভিনয় করিই নি’।
– ‘মানে’?
– মানে পদ্মের যা অনুভব বিভাসের প্রতি তা তো উত্তমের প্রতি আমার অনুভবের চেয়ে কোথাও একবিন্দুও আলাদা ছিল না।সূতরাং,অভিনয় করতে হবে কেন বল?’…
আবার কেমন যেন উজ্জ্বলতায় ভ’রে উঠলেন তিনি।

এল ‘হার মানা হার’ ছবির প্রসঙ্গ। সেই দৃশ্য,যেখানে দাদাদের সংসারে অবহেলিতা, জীর্ণবেশী সুচিত্রা সেনকে দাদার বাগদত্তা, মহার্ঘ্য সাজে সজ্জিতা অভিনেত্রী ললিতা প্রায় এমন বলছেন, ‘তোমাকেও ত দেখতে মন্দ নয়। একটু চেহারার যত্ন নিলেই তুমিও পার ছবিতে অভিনয় করতে’…
আমি সাউন্ড ট্র‍্যাকে এই সংলাপ রেখেছিলাম।সংলাপ শেষ হওয়ামাত্রই ললিতা দি রিনরিনে হেসে উঠে বললেন, ‘ভাবতে পারছ আমার সাহস!!!?? মধ্যগগনের সুচিত্রাকে আমি বলছি কি না, ‘তুমি চেষ্টা কর,তোমারও অভিনয় হবে’!!!

প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ফিলজফি তে ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হয়েছিলেন তিনি, জেনেছিলাম আগেই।

সেদিন অনুষ্ঠানের শেষ প্রশ্ন রেখেছিলাম,
‘জীবনটা যদি আর একবার পান, কি করবেন’?…

চোখের ঘন কাজলদাগ রুধতে পারে নি উদগত অশ্রু। গলাও ভেঙে এসেছিল…

নতমুখে বলেছিলেন..

‘কেবল পড়াশোনা’।

★ ★ ★

এই অনুষ্ঠানেই লাইভ ফোনে এসেছিলেন অনিন্দিতা দি।’বিভাস’ ছবির পরিচালক বিনু বর্ধনের মেয়ে। এক অভাবনীয় যোগাযোগ বলা যায়। ললিতা দি’র সঙ্গে অনিন্দিতা রায়চৌধুরীর কথোপকথনেই উঠে এসেছিল ‘বিভাস’ ছবি নিয়ে এক রোমাঞ্চকর তথ্য।

সে গল্প পরের পর্বে।……..

Comments (1)

  1. […] (গত পর্বের লিঙ্ক) […]

Comment here