শাশ্বত সনাতনস্বভূমি ও সমকাল

পণ্ডিতকুলতিলক মহাত্মা তারানাথ তর্কবাচস্পতি

শ্রী শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন

 

তারানাথ তর্কবাচস্পতি বিগত যুগের বাঙ্গালা দেশের একজন শ্রেষ্ঠ পন্ডিত ও মনীষী ছিলেন। একদিকে তাঁহার পান্ডিত্য যেমন অসাধারণ ছিল, অন্যদিকে তাঁহার বিষয়-বুদ্ধি এবং কৃতকারিতা-ও ছিল অনন্য-সুলভ। পান্ডিত্য ও কর্মশক্তির এইরূপ সমাবেশ প্রায় একত্রে দেখা যায় না। ইঁহাকে পান্ডিত্য ও কর্মশক্তিতে অতিমানব বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।

তারানাথ তর্কবাচস্পতি ব্রাহ্মণ-পন্ডিতের সন্তান। তাঁহার পূর্ব-পুরুষেরা শাস্ত্র-চর্চ্চা করিয়া বিলক্ষণ প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়া গিয়াছেন। তাঁহার পিতামহ বর্ধমান-রাজ্যের আগ্রহাতিশয়ে কালনা গ্রামে বাস করেন। এই কারণেই ইংরেজী ১৮১২ খ্রীষ্টাব্দে তারানাথের জন্ম হয়। বাল্যকাল হইতেই বিদ্যাশিক্ষায় তাঁহার অত্যন্ত উৎসাহ ছিল। তিনি সাত বৎসর বয়সে সংস্কৃত পড়িতে আরম্ভ করেন, এবং দিনরাত পরিশ্রম করিয়া অল্পদিনের মধ্যেই বাঙ্গালা দেশে তৎকাল-পরিচালিত ব্যাকরণ প্রভৃতি গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। তদনন্তর তিনি সংস্কৃত কালেজে (১) প্রবৃষ্ট হন। কালেজে কি শিক্ষক, কি ছাত্র, সকলে তাঁহার উৎসাহ, অধ্যবসায় ও অবিশ্রান্ত পরিশ্রমের ক্ষমতা দেখিয়া আশ্চর্যান্বিত হন। তিনি সংস্কৃত কালেজে ছয় বৎসর কাল অধ্যয়ন করিয়া, তত্রত্য সর্বোচ্চ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া “তর্ক-বাচস্পতি” এই উপাধি প্রাপ্ত হইলেন; অনন্তর তিনি আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

সেই সময়ে তিনি বর্ধমানের সদর-আমিনী (২) পদের নিয়োগ-পত্র পাইয়াছিলেন; কিন্তু চাকরী না করিয়া বেদান্তাদি শাস্ত্র পাঠের জন্য কাশী যাত্রা করিলেন। কাশীতেও তাঁহার বিলক্ষণ প্রতিপত্তি হইয়াছিল। তথায় তিনি পাঠ সমাপন করিয়া, স্বদেশ-প্রত্যাগমন-পূর্ব্বক কালনা গ্রামে একটি চতুষ্পাঠী স্থাপন করেন।

অন্যান্য ব্রাহ্মণ-পন্ডিতের ন্যায় তর্কবাচস্পতি বিদায় (৩) গ্রহণ করিতেন না। নিজের ব্যাবসায় করিয়া যে উপস্বত্ব পাইতেন, তাহা হইতেই আপনার সংসারের খরচ এবং ছাত্রদেরসমস্ত ব্যয় নির্বাহ করিতেন। এই-সকল ব্যবসায়ে তাঁহাকে অত্যন্ত পরিশ্রম করিতে হইত। তিনি নেপাল হইতে শাল-কাষ্ঠ আনাইয়া ব্যবসায়ে করিতেন। ধান্য ক্রয় করিয়া এবং তাহা হইতে চাউল প্রস্তুত করাইয়া ব্যবসায় করিতেন। এতদ্ভিন্ন তাঁহার কাপড়ের ও সুতার ব্যবসায় ছিল এবং বিস্তৃত চাষের কার্য-ও ছিল। এই সকল ব্যবসায় ক্রমে বিলক্ষণ বিস্তৃত হইয়া উঠে। তিনি সকল ব্যবসায়ের কার্যই ভাল-রূপে বুঝিতেন, এবং নিজেই সমস্ত কার্য পরিদর্শন করিতেন। তৎকালের ভদ্রলোকেরা যে সকল কার্য শিক্ষা করা আবশ্যক মনে করিতেন, সে সমস্তই বাচস্পতি ভাল-রূপে জানিতেন। তিনি জমিদারী সেরেস্তার কার্য পুঙ্খনাপুঙ্খরূপে বুঝিতেন। তিনি প্রসিদ্ধ প্রসিদ্ধ ব্যক্তিগণের বাটীতে শ্রাদ্ধাদি কার্যে অধ্যক্ষতা করিতেন, এবং তাঁহার অধ্যক্ষতায় সকল কার্য-ই সুচারুরূপে সম্পন্ন হইত।

তারানাথ কালনায় কিছুকাল অধ্যাপনা করেন; পরে সংস্কৃত কালেজের ব্যাকরণ-শাস্ত্রের প্রধান অধ্যাপকের পদ শূন্য হইলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আগ্রহে ঐ কার্য করিতে স্বীকার করেন। তাঁহার ঐ কার্য গ্রহণের প্রধান উদ্দেশ্য এই যে, কলিকাতায় তাঁহার অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার বিশেষ সুবিধা হইবে। কার্য-গ্রহণের পরে তাঁহাকে কালনা ত্যাগ করিয়া কলিকাতায় অবস্থিতি করিতে হইল। অতএব তিনি পুরাতন ব্যবসায়গুলি পরিত্যাগ করিয়া, অপরাপর বিস্তৃত ব্যবসায় আরম্ভ করেন, এবং শাল, স্বর্ণালঙ্কার প্রভৃতির ব্যবসায়ে প্রথমতঃ বিলক্ষণ লাভবান হইয়াছিলেন।

তাঁহাকে কালেজে পড়াইতে হইত, এজন্য সকল সময় তিনি আপন ব্যবসায়ের পর্যবেক্ষণ করিতে পারিতেন না। সুতরাং উত্তম-রূপে তত্ত্বা-বধানের অভাবে প্রায় এক লক্ষ টাকা মূল্যের শাল কীট-দষ্ট হইয়া নষ্ট হইয়া যায়। ইহাই তাঁহার ব্যবসায়ের অবনতির সূত্রপাত। এই কারণে কয়েক বৎসর মধ্যে তাঁহাকে লক্ষাধিক টাকা ঋণ-গ্রস্ত হইতে হইয়াছিল। আর ঐ টাকার জন্য তাঁহাকে অনেক লাঞ্ছনা ভোগ করিতে হয়। ঋণগ্রস্ত হওয়াতেই তারানাথ সর্বপ্রথম প্রতিগ্রহ (৫) করিতে আরম্ভ করেন। ভট্টাচার্য-বিদায় এবং অন্যান্য দান গ্রহণ করায়, তাঁহার আয় কিছু বৃদ্ধি হয় বটে, কিন্তু তাহাতে তাঁহার ঋণ শোধ হয় নাই। তাঁহার ঋণ-পরিশোধের কোনও উপায় ছিল না।

তর্কবাচস্পতির এই বিপদের সংবাদ পাইয়া সংস্কৃত কালেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত কাউয়েল (৬) সাহেব মহোদয়, তাঁহাকে প্রাচীন সংস্কৃত পুস্তক সকল মুদ্রিত করিয়া প্রচার করিবার পরামর্শ দেন। ইতিপূর্বে তিনি যে-সকল পুস্তক মুদ্রিত করিয়াছিলেন তাহা দেখিয়া উক্ত সাহেব মহোদয়ের দৃঢ় ধারণা হইয়াছিল যে, তর্কবাচস্পতির ন্যায় সর্ব-শাস্ত্র-বিশারদ অসাধারণ মেধাবী এবং ব্যবসায়-পটু পন্ডিত যদি এই কার্যের ভার গ্রহণ করেন, তাহা হইলে তিনি যথেষ্ট লাভবান হইতে পারিবেন, এতদ্ভিন্ন জগতের-ও বিশেষ উপকার হইবে।

তর্কবাচস্পতি তাঁহার পরামর্শানুসারে কার্য করিয়া অল্পকাল মধ্যেই আপনার সমস্ত ঋণ পরিশোধ করিয়া উঠেন। তাঁহার মুদ্রাঙ্কিত পুস্তক জগতের সর্বত্রই আদৃত হইয়াছে, এবং কি এশিয়া, কি ইউরোপ, কি আমেরিকা, সর্বত্রই তাঁহার পুস্তক সমাদরে গৃহীত হইয়া থাকে।

তর্কবাচস্পতির প্রধান কীর্তি, তৎপ্রণীত “বাচস্পত্য” অভিধান। এই সুবিস্তৃত সংস্কৃত অভিধান প্রণয়নে তাঁহাকে আঠার বৎসর গুরুতর পরিশ্রম করিতে হয়। ইহার মুদ্রাঙ্কনে ৮০, ০০০ টাকা ব্যয় হয়, এবং ১২ বৎসর কাল অতীত হয়। গ্রন্থখানি ৫৬০০ পত্রে সম্পূর্ণ। ইহাতে সকল শাস্ত্রের কথাই আছে। ইহ দ্বারা সংস্কৃত বিদ্যার্থীগণের যে কি পর্যন্ত উপকার হইয়াছে, তাহা লিখিয়া শেষ করা যায় না। এই বৃহৎ গ্রন্থ প্রণয়নে তর্কবাচস্পতি কাহারও সাহায্য গ্রহণ করেন নাই। ইতিপূর্বে যে সকল সংস্কৃত অভিধান মুদ্রিত হইয়াছে, তাহাতে শব্দের ব্যুৎপত্তি-সাধন ছিল না; বাচস্পতি এই সংস্কৃত অভিধানে শব্দের ব্যুৎপত্তি লিখিয়া দিয়াছেন। এই অভিধান-প্রণয়ন জন্য বৃদ্ধ বয়সে তাঁহাকে এত পরিশ্রম করতে হইয়াছিল যে গ্রন্থ-সমাপিটির পরেই তাঁহার শরীর একান্ত অপটু হইয়া পড়ে, এবং উহার দুই বৎসর পরেই তাঁহার মৃত্যু হয়।

তর্কবাচস্পতির অসাধারণ বিদ্যানুরাগ ও অধ্যবসায়, এদেশীয় লোকের অনুকরণীয়। সংস্কৃত বিদ্যার অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় তাঁহার সমস্ত জীবন অতিবাহিত হয়। তিনি যত অর্থ উপার্জন করিয়াছিলেন, তাহার অধিকাংশই পণ্ডিতগণের উৎসাহ-বর্ধনার্থ ব্যয় করিয়াছেন। তিনি বহুসংখ্যক বিদ্যার্থীকে তাঁহার নিজ বাটীতে রাখিয়া অকাতরে অন্ন ও বিদ্যা দান করিতেন। বঙ্গদেশীয় ছাত্র ব্যতীত সিংহল, কাশ্মীর, দ্রাবিড় (৭) ও কর্ণাট প্রভৃতি দূরদেশ হইতে ছাত্রগণ আসিয়া তাঁহার নিকট অধ্যয়ন করিত। যখন সংস্কৃত কালেজের কর্ম হইতে পেনশন লইয়া অবসর গ্রহণ করেন, তখন তিনি আপন বাটীতে ‘ফ্রী সংস্কৃত কালেজ’ নামক এক বিদ্যালয় স্থাপন করিয়া, তাহার সমস্ত কার্যের ভার স্বয়ং গ্রহণ করেন।

একদা বিলাত হইতে পার্লিয়ামেন্টের একজন মেম্বর কলিকাতা পরিদর্শনার্থে আগমন করিয়াছিলেন। তাঁহার অভ্যর্থনার্থ বাবু কেশবচন্দ্র সেন মহোদয়ের কলুটোলাস্থ পৈতৃকভবনে এক সভা হয়। ঐ সভায় কলিকাতার গণ্যমান্য কৃতবিদ্য বহুসংখ্যক সম্ভ্রন্ত লোক সমবেত হন। উপস্থিত লোকের মধ্যে রেভেরেণ্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় ও তারানাথ তর্কবাচস্পতি মহাশয়ও উপস্থিত ছিলেন। ঐ সভাতে রেভেরেণ্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় তর্কবাচস্পতি মহাশয়কে প্রণাম করেন। তদ্দর্শনে পার্লিয়ামেন্টের মেম্বার সাহেব মহোদয় কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়কে ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করলে, তিনি উত্তর দেন যে, আমি বাচস্পতি মহাশয়ের নিকট সংস্কৃত অধ্যয়ন করিয়াছি। আমি যাহা কিছু সংস্কৃত শিখিয়াছি, তাহা উঁহারি অনুগ্রহে। এই নিমিত্ত বিদ্যাদাতাকে এই প্রকার সম্মান দেখান, আমাদের আজন্ম অভ্যাস। ইনি কেবল আমারই বিদ্যাদাতা নন, সমস্ত ভারতবাসীর সংস্কৃতধ্যায়ীদিগের মধ্যে প্রধান প্রধান লোকের গুরু বলিলে অত্যুক্তি হয় না। আজকাল সংস্কৃতভাষায় যা কিছু উন্নতি দেখিতেছেন, তাহা ইঁহারই প্রসাদে হইতেছে। ইনি যদি জন্মগ্রহণ না করিতেন, তাহা হইলে সংস্কৃত ভাষার এরূপ উন্নতি হইত কিনা সন্দেহ।

বক্তৃতা সম্বন্ধে বাচস্পতি মহাশয়ের অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। তাঁহার মনে যে ভাব ছিল, সেই ভাব দশ সহস্র লোকের সম্মুখে দন্ডায়মান হইয়া প্রকাশ করিয়া স্বীয় মতানুযায়ী করিবার ক্ষমতাও ছিল। শাস্ত্র এবং অখণ্ড যুক্তি দ্বারা সভাস্থ সহস্র সহস্র লোকের অন্তঃকরণকে আকর্ষণ করিয়া স্বকৃত মতের অনুবর্ত্তী করিবার জন্য তাঁহার যে প্রকার ক্ষমতা ছিল, সে প্রকার ক্ষমতা অপর কাহারও দেখা যায় নাই। কি বাংলা কি হিন্দী কি সংস্কৃত ভাষায় তিনি মনের ভাব অতি সুচারু রূপে প্রকাশ করিতে পারিতেন। এ প্রকার সরল ভাষায় সংস্কৃত ভাষায় তিনি বক্তৃতা করিতে সমর্থ হইতেন যে, যাঁহারা সংষ্কৃত ভাষা না জানেন, তাঁহারাও তাঁহার বক্তৃতা সম্যকরূপে বুঝিতে পারিতেন। এক সময়ে মথুরার সেটবংশীয়দের উদ্যমে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশস্ত গৃহে এক সভা আহূত হয়, ঐ সভায় বঙ্গদেশের প্রধান প্রধান সমস্ত পন্ডিত নিমন্ত্রিত হইয়াছিলেন এবং কলিকাতা ও তৎসন্নিহিত স্থানের বহুসংখ্যক সম্ভ্রান্ত ও কৃতবিদ্য লোকের সমাগম হইয়াছিল। আর্য্য সমাজের স্থাপনকর্ত্তা দয়ানন্দ স্বামী দেবতার মূর্ত্তিপূজা বেদনিষিদ্ধ বলিয়া যে মত প্রকাশ করিয়াছিলেন, সেই মত খণ্ডন করিবার উদ্দেশেই এই সভা আহূত হয়। সংস্কৃত ভাষায় ঐ সভায় বক্তৃতা করিতে হইয়াছিল। বাঙ্গালা দেশের মধ্যে অন্য কোন পন্ডিতই ঐ সভায় সংস্কৃত ভাষায় বক্তৃতা করিতে সক্ষম হন নাই। ঐ সভাতে তর্কবাচস্পতি মহাশয় দেবতার মূর্ত্তিপূজা সম্বন্ধে বক্তৃতা করিয়াছিলেন এবং অখণ্ডনীয় যুক্তি দ্বারা দয়ানন্দের মত খণ্ডন করেন।

উত্তর পশ্চিম প্রদেশের এবং পঞ্চনদ দেশের অনেক সম্ভ্রান্ত লোকেরা দয়ানন্দের ঐ মত গ্রহণ করিয়া স্বস্ব কুলদেবতার মূর্ত্তি স্বকীয় মন্দির হইতে নিষ্কাশিত করিয়া রাজমার্গে ফেলিয়া দিয়াছিলেন। দয়ানন্দের মত, ঐরূপ বাঙ্গালাদেশেও প্রচার হইবার বিলক্ষণ সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু বাচস্পতি মহাশয় উক্ত স্বামীর মূর্ত্তিপূজা সম্বন্ধীয় মত খণ্ডন করাতে এদেশে দয়ানন্দের মত প্রচলিত হইল না। এবং দয়ানন্দের বেদ শাস্ত্রে যে কিঞ্চিৎমাত্র অধিকার নাই, ইহা বাচস্পতি মহাশয় ঐ সভায় বক্তৃতাকালে সপ্রমাণ করিয়াছিলেন। তিনি ঐ সকল বৈদিক নিগূঢ় তত্ত্ব এমন সরল ভাষায় বক্তৃতা করিয়াছিলেন যে, সকলেই বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, দয়ানন্দের মত ভ্রমসংকুল।

তর্কবাচস্পতি এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করিতেন না। বৃদ্ধ বয়সেও পথ চলিবার সময় প্রুফ দেখিতে দেখিতে যাইতেন। তিনি একজন দিগ্বিজয়ী পন্ডিত ছিলেন। কলিকাতায়, কাশীতে অথবা পূর্ব-বঙ্গ দেশে কোনও পন্ডিত-ই প্রায় তাঁহার ন্যায় বিচার-শক্তি-প্রদর্শন করিতে পারেন নাই। এমন সময়ে জয়পুরের মহারাজ কলিকাতার সংস্কৃত কালেজ পরিদর্শন সময়ে বাচস্পতির পান্ডিত্যে বিমুগ্ধ হন এবং প্রত্যাবর্তনকালে তাঁহাকে স্বীয় রাজধানীতে যাইবার অনুরোধ করেন। তদনুসারে বাচস্পতি মহাশয় জয়পুরে গমন-পূর্বক তত্রত্য পণ্ডিতদিগকে বিচারে পরাজিত করিয়া শৈব-মত (৮) স্থাপন করিয়া প্রভূত অর্থ ও রাজসম্মান লাভ করেন।

(১) সদর-আমিনী – রাজস্ব-সংক্রান্ত বিচারক (আরবী ‘আমীন’ – বিশ্বস্ত কর্মচারী, তত্ত্বাবধানকারী , ও ‘সদর’ – প্রধান) ।
(২) বিদায় – ব্রাহ্মণ-পন্ডিত অথবা অন্য ব্যক্তির বিদায়-কালে তাঁহার বিদ্যাবত্তার সম্মানের জন্য (অথবা পাথেয় প্রভৃতির জন্য) তাঁহাকে যে টাকা-পয়সা, তৈজস বা বস্ত্রাদি দেওয়া হইয়া থাকে।
(৩) ব্যবসায় – শব্দটি সাধারণতঃ ‘ব্যবসা’-রূপে বাঙ্গালায় শোনা যায় – অনেকে এই সংক্ষিপ্ত রূপেই ইহা লিখিয়া থাকেন। শম্ভুচন্দ্রও তৎপুস্তকে অনেক স্থানে ‘ব্যবসা’ লিখিয়াছেন।
(৪) কালেজ – ইংরেজী College শব্দ, আমরা এখন অ-কার দিয়া ‘কলেজ’ লিখি, আগে আ-কার দিয়া ‘কালেজ’ লিখিত। তদ্রূপ – Lord = ‘লর্ড’, কিন্তু পুরাতন বাঙ্গালায় ‘লার্ড, লাড, লাট’; Doctor = ‘ডক্টর’, পুরাতন বাঙ্গালায় ‘ডাক্তার’; Shaw = ‘শ’, পুরাতন বাঙ্গালা রূপ ‘শা’। উহার কারণ, এখনকার ইংরেজীর দীর্ঘ
অ-ধ্বনি শতবর্ষ পূর্বে ‘আ’ ছিল – বাঙ্গালীর কানে ‘আ’ শুনাইত; সেইজন্য এই আ-কার দিয়া বানান।
(৫) প্রতিগ্রহ – কাহারও দান গ্রহণ করা। যে-সকল ব্রাহ্মণ কাহারও দান লইতেন না বা লন না, তাঁহাদিগকে ‘অপ্রতিগ্রাহী’ বলে।
(৬) কাউএল – অধ্যাপক E. B. Cowell; একজন বিখ্যাত সংস্কৃতবিৎ পন্ডিত ছিলেন এবং বাঙ্গালা সাহিত্যের প্রতিও তাঁহার অনুরাগ ছিল।
(৭) দ্রাবিড় – তামিল দেশ; কর্ণাট – কানাড়ী দেশ, মহীশূর ও তন্নিকটবর্তী স্থান, যেখানে কানাড়ী-ভাষী জাতি বাস করে।
(৮) শৈব-মত – সাধারণতঃ ইহাকে ‘অদ্বৈত-বেদান্ত’ বলে। জীবাত্মা পরমাত্মার অংশ; জীবাত্মার মুক্তির অর্থ, শিব বা পরব্রহ্মে বিলীন হইয়া যাওয়া, জ্ঞানের দ্বারা অজ্ঞানের নাশ করিয়া ব্রহ্ম-জ্ঞান লাভ করা, মুক্তির প্রকৃষ্ট উপায় – এই প্রকার মত।

(লেখক পরিচিতি – শ্রী শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, মহাবরেণ্য শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহোদর ও সংস্কৃতে প্রগাঢ় পন্ডিত)

Comment here