কালীপুজোর প্যান্ডেল…চারিদিকে জনজোয়ার। গিলে করা পাঞ্জাবী পরা চার ফুট এগারো ইঞ্চির পকেট হারকিউলিস ঢাক বাজাচ্ছেন ফিনিফিনে পাঞ্জাবি ভেদ করে ঘামে ভেজা পেশী গুলো ছন্দে ছন্দে ঢেউ খেলে যাচ্ছে।
অথবা স্টেজে নিজের বাজানো ঢাকের ক্যাসেট চালিয়ে দেখাচ্ছেন পেশী নৃত্য।বুকে উঠে যাচ্ছে ম্যাটাডোর, কিংবা একটানে ছিঁড়ে ফেলছেন ABTA test paper.. গত শতকের অসংখ্য মানুষ এ জিনিস চাক্ষুষ করবেনই। আবার শুকতারার পাতায় দুলালের তালমিছরী হাতে সেই বিজ্ঞাপন..
৮০ বছর বয়স অবধি স্টেজ শো করার রেকর্ড এখনো ভাঙতে পেরেছে কেউ কিনা জানা যায়নি। শতায়ু পেরোনো এই বিশ্বশ্রীর চিরযৌবনের রহস্য জানতে চাইলেই বলতেন- “ব্যায়াম”..সারাজীবন ডাম্বেল বারবেল নিয়ে শরীরের সাধনা করে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন মানুষ সাধারন খেয়ে পরেও কিভাবে পেশীবহুল,সুস্থ, নীরোগ থাকতে পারে।তাঁর জীবনী, উপদেশ,নানা অজানা দিক নিয়েই “কাঞ্জিক” – র এই বিশেষ নিবেদন।
১৯১৩ সালের ১৭ই মার্চ অবিভক্ত বঙ্গের কুমিল্লা জেলার ধামতি নামক এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মেছিলেন তিনি। যেখানে অধিকাংশ মানুষ কৃষিকার্য করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। বাবা মহেশচন্দ্র আইচ ঢাকার মুন্সিগঞ্জ সাবডিভিশনের অন্তর্গত বিক্রমপুরের এক জমিদারী সেরেস্তায় কাজ করতেন। নিজেকে বলতেন চাটগাঁইয়া বাঙাল।( সম্ভবত চট্টগ্রামের মানুষ বোঝাতে) ছোট থেকেই নানা ধরনের খেলা ধুলা, যদিও বেশীর ভাগই সেটা শক্তি সম্পর্কিত খেলাধুলায় আগ্রহ ছিল প্রচুর।ঢাকার জুবিলি স্কুলে তিনি বিদ্যা শিক্ষা করতেন। স্কুলে পড়তে পড়তেতেই শারীরিক কসরতের জন্য রূপলাল ব্যায়াম সমিতিতে ভর্তি হন।সেখানে তিনি ডন আর বৈঠক এই দুধরনের ব্যায়াম করতেন।আখড়ায় কুস্তিও লড়তেন। হারকিউলিস’ মনোহর আইচ।
১৯৪৬ সালে বাঙ্গালোর বিমান বাহিনী শিবিরে অফিসারদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহ করে তাদের একজন নেতা হিসাবে তাঁর জেল হয়। অভিযোগ কি? ব্রিটিশ অফিসারকে বাঙ্গালী সম্পর্কে আপত্তিকর কথা বলার জন্য এক চড় মেরে ছিলেন। দেশের প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবসে (২৬ জানুয়ারী, ১৯৫০) তিনি মুক্তি পান। ইতিমধ্যে অনেক লেখালিখি করে সরকারের পয়সায় ডাম্বেল বার্বেল কিনে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে একটি জিমন্যাসিয়াম তিনি গড়ে তুলেছিলেন।জেলে থাকাকালীন তিনি রোজ ১০০০ ডন বৈঠক করতেন।..পিসি সরকারের বহু শো তে ম্যাজিক দেখিয়েছেন। সেই শো এর নাম ছিল – Physique and Magic এবং সারা জীবনে অন্য কোন পেশাকে তিনি বেছে নেননি।
ব্যায়ামই ছিল তাঁর পেশা, নেশা সব। ১৯৪৬-এ জাতীয় ভারোত্তোলনে মহীশূরের হয়ে ব্যান্টমওয়েটে তিনি নির্বাচিত হন। কিন্তু অজানা কারণে ফেডারেশন অনুমতি দেয় না বলে যোগ দেওয়া হয়ে ওঠে না তাঁর পক্ষে। এয়ারফোর্সে যাওয়াতে মনোহর আইচের সুবিধা হয়েছিল,কারন এখানে দেহসৌষ্ঠবের বিশ্ব প্রতিযোগিতার কথা তাঁর কানে এসেছিল। জেল থেকে বেরোনোর পর ১৯৫০ সালে ভারতের প্রথম দেহসৌষ্ঠব প্রতিযোগিতা ‘মিঃ হারকিউলিস’ হল। তিনিই প্রথম মিঃ হারকিউলিস ।
ষড়যন্ত্রের বলি হয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যা-লয়ের ফিজিক্যাল ইন্সস্টাক্টরের চাকুরি এক বছর করার পর হারিয়েও দমেননি এই বিশ্ববিজয়ী। টিউশনি আর শিয়ালদায় ডাব বিক্রি করে ব্যায়াম চর্চা চালিয়েছেন তিনি এবং শুধু যাওয়ার ভাড়া নিয়ে ৫১-র ‘বিশ্বশ্রী’ প্রতিযোগিতায়। … তিনি প্রায়শই বলতেন-, ‘জীবন দিয়ে আমি ব্যায়াম বা শরীর চর্চা অনুভব করেছি। নিজের শরীর গড়ে প্রমাণ করেছি, অনেক গ্রন্থ লেখকের চেয়ে আমি অনেক বেশি সঠিক।”শরীর চর্চা ছিল তাঁর কাছে প্রাণ ও মনের সাধনা।
নইলে কি ৯০ বছর বয়স অবধিও ডাম্বেল বারবেল ভেঁযে ওই শরীর ধরে রাখা সম্ভব??,যে বয়সে মানুষ কে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে হয়,হাত পা অথর্ব হয়ে যায় সে বয়সে তিনি বেঞ্চ প্রেস করতেন!
ট্রেনার হিসেবেও ছিলেন খুব কড়া। তাঁর কড়া নিদান ছিল ৫০০ ডন ৫০০বৈঠক, সাথে ডাল ভাত খাও। পান্তার জল খাও। পুঁইশাক খাও।শরীরে শক্তি বাড়বে।।মাছের মাথায় গ্রোথ হরমোন থাকে বলে তিনি মাছের মূড়ো খেতেন।খেতেন ছোট মাছ,ফল ও দুধ।যেজন্যই তিনি ছিলেন শতায়ু।।তাঁর জীবনযাত্রাও ছিল সাদামাটা। ব্যাক্তি হিসেবেও তিনি খুব স্পষ্টবক্তা, নির্লোভ ও সাদামাটা ছিলেন।পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে Lifetime Achievement পুরস্কার ও বঙ্গভূষণ পান। নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে এবং বাংলার ছেলে-মেয়েদের নীরোগ রাখতে উত্তর কলকাতার মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্র কলেজের পিছনে তিনি একটি ব্যায়ামাগার স্থাপন করেন। নাম দেন স্টুডিও ডি ফিজিক। মনোহর বলতেন, ‘শ্মশান তৈরির থেকে বড়ি বিল্ডিংয়ের আখড়া বানানো ভালো।’ ২০০২ সালে তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু মনোহরের জীবনে বিশাল ধাক্কা নিয়ে আসে। অবশ্য ব্যায়ামচর্চায় ভাঁটা পড়েনি তার জন্য। শরীরকে মন্দির বানিয়ে চলতে থাকে নিরলস শরীরচর্চা। তাঁর বহু ছাত্র ভারতশ্রী হয়েছেন।হাওড়ার নানা ক্লাবে তিনি ব্যায়ামের ক্লাস নিতে আসতেন, কখনো বা শো করতে,বা বিচারক হয়ে।
বয়সকালেও ওনার শরীরে কোনো রোগ বাসা বাঁধেনি। ১০১ বছর বয়সেও দূর দুরান্তে সম্বর্ধনা নিতে গেছেন।আমার অগ্রজ দাদাও( কুশল খাড়া,যাকে দেখে এই অধমেরও প্রথম অল্পবিস্তর ব্যায়ামের অনুপ্রেরনা জাগে) ২০১২ সালে তার হাত থেকে বঙ্গশ্রী পুরস্কার নিয়েছে।,,
৮ বছর আগে, ৫ জুন, ২০১৬ – তে আমাদের ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন অনন্তলোকে । তিনি দুশ্চিন্তাহীন জীবন স্থাপন করে ও ব্যায়াম করে কিভাবে সুস্থ জীবনগঠম সম্ভব তা দেখিয়ে দিয়ে গেছেন।.. তাঁর আদর্শ, উপদেশ আমাদের অনুসরণীয় হোক।
হাওড়ার নরসিংহ দত্ত কলেজে ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতক পাঠরত।
অবসরে বইপড়া,হাওয়াইন গীটার ও তবলা বাজানো, ও অবশ্যই আখড়ায় ব্যায়াম।
Comment here