সংস্কৃতি

‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী’ – শান্তিদেব ঘোষ

১৯৪১ সালের ১ লা বৈশাখ।রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ নববর্ষ।কবির বিশেষ স্নেহভাজন শান্তিদেব ঘোষ কবিকে একখানি গান রচনা করতে বললেন।কিন্তু কবি প্রথমে আপত্তি করলেন।শান্তিদেব অনড়। তখন রবীন্দ্রনাথ বললেন যে সৌম্য অর্থাৎ সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে বলেছেন মানবের জয়গান নিয়ে একখানি কবিতা লিখতে।এবার কবি একখানি কবিতা লিখলেন।সেই কবিতাটিই হবে নববর্ষের গান।সেসময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন মৈত্রেয়ী দেবী তিনি কবিতাটি অনুলিপি করে শান্তিদেবকে দিলেন।কবিতাটি বেশ বড়ো।এত বড়ো কবিতায় সুর দেওয়া মানে কবিকে কষ্ট দেওয়া।একটু তাও চেষ্টা করলেন রবীন্দ্রনাথ।পারলেন না।একদিন সময় চাইলেন।শেষ পর্যন্ত ‘ ঐ মহামানব আসে দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে’ গানটির যেটুকু গাওয়া হয় সেইটুকুই সুর দিলেন।তৈরী হলো একটি গান একটি বড়ো কবিতা থেকে,

‘ ঐ মহামানব আসে দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে 

মর্ত্যধূলির ঘাসে ঘাসে’

রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন ও রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষাদান এই দুটি বিষয়ের সঙ্গে যাঁরা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন তাঁদের মধ্যে শান্তিদেব ঘোষ অন্যতম।শান্তিনিকেতন ছিলো তাঁর রক্তে।এখানকার লালমাটিতে তিনি ছিলেন স্বচ্ছন্দ।মাত্র ৬ মাস বয়সে শান্তিনিকেতনে বাবা মার সঙ্গে এসেছিলেন।তখন থেকে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের ভাবধারা মিশে গিয়েছিলো তাঁর শিরায়,ধমনীতে।

শান্তিদেব ঘোষের প্রকৃত নাম ছিলো শান্তিময়।বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার চাঁদপুরে ১৯১০ সালে তাঁর জন্ম হয়।তাঁর পিতার নাম ছিলো কালীমোহন ঘোষ।তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের নিত্যসঙ্গী এবং শান্তিনিকেতনের পল্লী সংগঠক।তাঁর চারপুত্র শান্তিময়,সলিলময়,সাগরময় এবং শুভময় এবং কন্যা সুজাতা।রবীন্দ্রনাথ শান্তিময়ের নাম বদলে শান্তিদেব করেন।মাত্র কুড়ি বছর বয়সে তিনি শান্তিনিকেতনের সঙ্গীতভবনে যোগদান করেন।তখন থেকেই তিনি কলকাতা বেতারের সঙ্গে যুক্ত হন।১৯৫১ সালে সঙ্গীত ভবনের প্রধান হন শান্তিদেব।

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অনন্তপথযাত্রী।সেই অনন্তপথিক রবীন্দ্রনাথকে নিজের জীবনদেবতা করে নেন।বলা যায় তিনি রবীন্দ্রধারায় স্নাত হন।রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্নেহধন্য শান্তিদেবকে প্রতিবেশী দেশগুলিতে নৃত্যকলা ও সঙ্গীতশিক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলেন।রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি শ্রীলঙ্কা,বালি,জাভা ভ্রমণ করেছিলেন।পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য ও নাটকে নাচ,গান ও অভিনয় করতে শুরু করেন।রবীন্দ্রনাথের কৃষ্ণকলি কবিতার গীতিরূপ তিনিই সর্বপ্রথম জনপ্রিয় করেছিলেন।

শুধু রবীন্দ্রনৃত্যই বা কেন ১৯৩১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিউড়িতে ব্রতচারী আন্দোলনের জনক গুরুসদয় দত্তের উদ্যোগে লোকনৃত্যর আয়োজন হয়।সেখানে শান্তিদেব ঘোষ দর্শক হিসেবে ছিলেন এবং এই নাচের প্রভাবে প্রভাবিত হন।পরে শান্তিনিকেতনে শান্তিদেব রায়বেঁশে,বাউল,জারি নাচ নেচেছিলেন। কখনও তাঁর হাতে রুমাল,কখনও বা লাঠি,প্রায় ঘন্টা দেড়েক নাচ উপভোগ করেছিলেন সকলে।

যৌবনে সর্বপ্রথম হিন্দুস্তান মিউজিক্যাল পার্টির হয়ে দুটি গানে সমবেতভাবে অংশ নিয়েছিলেন শান্তিদেব। গানদুটি হলো  ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’ এবং ‘ যদি তোর ডাক শুনে’।এর পরে সেনোলা কোম্পানি থেকে রেবা মজুমদারের সঙ্গে দ্বৈত সঙ্গীত রেকর্ড করলেন। গানদুটি ছিলো ‘ আমার প্রাণের মানুষ’ এবং ‘ বাকি আমি রাখব না’।রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পর ১৯৪২ সালে গ্রামাফোন কোম্পানী থেকে প্রকাশ পেলো তাঁর দুটি একক গানের রেকর্ড।গানদুটি হলো ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’ এবং’ বসন্তে কি শুধু ফোটা ফুলের মেলা’।এরপর গ্রামাফোন কোম্পানী ও হিন্দুস্তান রেকর্ডস থেকে তাঁর গানের রেকর্ড প্রকাশ পেতে শুরু করলো।কীর্তনাঙ্গ বা বাউলাঙ্গের গানগুলি তাঁর কন্ঠে আলাদা মাত্রা পেতো।’ ভেঙে মোর ঘরের চাবি’,’ ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায়’,’ ‘ কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ’,’ যাত্রী আমি’,’ সে কোন বনের হরিণ’,’ ঐ বুঝি কালবৈশাখী ‘,’ও ভাই কানাই কারে জানাই’,’ গ্রামছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ’,ইত্যাদি গানগুলির সঙ্গে তিনি ছিলেন সমার্থক।

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বেশ কিছু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন শান্তিদেব ঘোষ।তাদের মধ্যে ‘ গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক ভারতীয় নৃত্য’,’ নৃত্যকলা ও রবীন্দ্রনাথ’,’ রবীন্দ্রনাথের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাদর্শে সঙ্গীত ও নৃত্য’,’ রবীন্দ্রসঙ্গীত বিচিত্রা’,ইত্যাদি। দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক হিসাবে প্রকাশিত ‘ জীবনের ধ্রুবতারা’ গ্রন্থে লেখক শান্তিদেব ঘোষকে আরও ভালো করে বোঝা যায়। 

তাঁর সুযোগ্য ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অশোক তরু বন্দ্যোপাধ্যায়,সুচিত্রা মিত্র,কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়,নীলিমা সেন,প্রমিতা মল্লিক অন্যতম।সারাজীবনে শান্তিদেব অজস্র পুরস্কার ও সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন।১৯৬১ তে রাশিয়ায় বিশেষ পদকে ভূষিত হন।১৯৭৬ এ সঙ্গীত নাটক একাডেমির ফেলো নির্বাচিত হন।১৯৮০ তে রবীন্দ্রভারতী সোসাইটি তাঁকে রথীন্দ্র পুরস্কারে সম্মানিত করেন। পেয়েছেন পদ্মভূষণ।বিশ্বভারতী তাঁকে সাম্মানিক দেশিকোত্তমে সম্মানিত করে।বর্ধমান ও রবীন্দ্রভার‍তী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন সাম্মানিক ডিলিট।

১৯১০ এর ৭ মে থেকে ১৯৯৯ এর ১ ডিসেম্বর। প্রায় ৯০ বছরের জীবন শান্তিদেব ঘোষের। শান্তিনিকেতনের মাটিতেই তাঁর দেহ মিশে রয়েছে।রবীন্দ্রধারার অনুসারী এই শিক্ষক ও শিল্পীকে জানাই নমস্কার।

Comment here